সম্প্রতি আজকাল পত্রিকার একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ‘২০২০ অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস আগের থেকে আরও কমার ইঙ্গিত দিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। ব্যাঙ্কের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়াবে মাত্র ৫%। অথচ আগে এসবিআই জানিয়েছিল, বৃদ্ধির হার হবে ৬.১ শতাংশ। এমনকি চলতি অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ৪.২%–এ নামতে পারে বলেও আশঙ্কা। এ বিষয়ে আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, বিশ্বব্যাঙ্ক, ওইসিডি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও আইএমএফ। এসবিআই জানিয়েছে, অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কমার কারণ একাধিক। গাড়ি বিক্রি কমছে। কমছে বিমানযাত্রীর সংখ্যা। বিমান সংস্থাগুলির ব্যবসা বাড়ছে না। শিল্পের কোর সেক্টরে উৎপাদন বাড়ছে না। নির্মাণ ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিল্পোৎপাদনের সূচক সেপ্টেম্বরে নেমে এসেছে ৪.৩ শতাংশ হারে, যা খুবই উদ্বেগজনক। শিল্পে মন্দার পাশাপাশি নন ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি ঋণদান কমিয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কৃষি সঙ্কট। এসব কিছু মিলিয়েই রাশ টানছে অর্থনীতির অগ্রগতিতে, এমনই উল্লেখ করা হয়েছে এসবিআই রিপোর্টে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৯ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে যে ৩৩টি গুরুত্বপূর্ণ সূচকের বৃদ্ধির হার ছিল ৬৫ শতাংশ, চলতি অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সেগুলির বৃদ্ধি নেমে এসেছে ২৮ শতাংশ-এ। এর ওপর এ বছর অতিরিক্ত বর্ষার কারণে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কর্ণাটক ও পাঞ্জাবের মতো কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলিতে খরিফ শস্যের ফলনে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রদেশে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ সয়াবিন চাষ, ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বাদাম চাষ, গুজরাটে ৩০ শতাংশ তুলো চাষ ক্ষতির মুখে। এর প্রভাব পড়বে কৃষির বৃদ্ধিতেও। বেহাল দশা ঋণ বাজারেরও। আর্থিক পরিষেবা সংস্থা ক্রেডিট সুইজ জানিয়েছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বের মধ্যে ভারতে ঋণদানের হার নেমে এসেছিল মাত্র ৬ শতাংশ–এ, যা নোটবন্দির সময়ের সমান। এর কারণ নন ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তহবিলে ঋণ দেওয়ার মতো পুঁজি নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কও ঝুঁকি নিয়ে ঋণ দিতে সাহস করছে না। সরকার বিপুল পরিমাণ পুঁজি জোগানো সত্ত্বেও চলতি অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে ব্যাঙ্ক ঋণের পরিমাণ কমেছে ৩ শতাংশ। এমনকি বেসরকারি ব্যাঙ্কের ঋণ গত এক বছরে ২২ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশ–এ নেমে এসেছে। মিউচুয়াল ফান্ড থেকেও পুঁজি জোগান কমেছে ৩০ শতাংশ। আইএলঅ্যান্ডএফএস–এর বিপুল অনিয়মের খবর সামনে আসার পর অন্য নন ব্যাঙ্কিং আর্থিক সংস্থাগুলিকে কেউই পুঁজি জোগাতে রাজি নয়। সমস্যা মেটাতে বাজার থেকে ঋণ করার চেষ্টাও সফল হচ্ছে না। আবার ধার করার খরচও বেড়েছে বিপুল হারে। ফলে চরম সঙ্কটে ঋণের বাজারও।’ ১৯৪৭ সাল থেকে আজ অবধি সবচেয়ে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে চলছে ভারত এ কথা স্বীকার করে নিয়েছে বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামীও।
চরম সংকটে ইস্পাত, টায়ার, যন্ত্রাংশ, রং-সহ আরও বেশকিছু শিল্প। এই সংস্থাগুলিতেও কাজ হারানোর চরম সংকট তৈরি হয়েছে। সমস্যায় ভোগ্যপণ্য শিল্পও। ফলে সরকারের কাছে ত্রাণের দাবি উঠেছে দেশের বিভিন্ন শিল্পসংস্থা থেকে। অর্থাৎ একদিকে শিল্পের বেহাল দশা, অন্যদিকে দেশের ব্যাপক জনসাধারণও সংকটে জর্জ্জরিত। তাঁরা প্রতিদিন কর্মচ্যুত হচ্ছেন, বে-রোজগার হচ্ছেন, তাঁদের ব্যয় করার ক্ষমতা কমছে; অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম ক্রমবর্ধমান। এটা আজ এমনকি অনেক বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদও মনে করছে যে জনসাধারণের আর্থিক দুর্দশা, তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের ব্যাপক সংকোচনই দেশের আর্থিক সংকটের প্রধান কারণ। এ অবস্থায় সামনে দুটো পথ আছে। একটা পথ হচ্ছে — জনসাধারণের হাতে কাজ দাও, জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করো, মূল্যবৃদ্ধি কমাতে তৎপর হও। অন্য পথটি হচ্ছে জনসাধারণের উপর আরও শোষনের বোঝা বাড়িয়ে, আরো মুনাফা করে এবং জনগণের উপর করের বোঝা বাড়িয়ে কর্পোরেট পুঁজিকে আরো কর ছাড় দিয়ে সংকটের হাত থেকে আপাত ত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা, যা দেশকে অনিবার্যভাবে ফ্যাসিবাদের দিকে নিয়ে যেতে বাধ্য। জনসাধারণের কর্মসংস্থান বাড়লে, তাদের আয় বাড়লে একদিকে যেমন বাজারের অগ্রগতি হবে, শিল্পে গতি আসবে; তেমনই জনগণের দরকষাকষির জায়গাটাও বাড়বে (ব্যাপক বেকারির সময় যেটা কমে যায়) অন্যদিকে যদি জনসাধারণের দরকষাকষির জায়গাটা ভেঙে দিয়ে তাকে আরও সস্তা শ্রমিকে পরিণত করে আরো অতিমুনাফা করার মধ্যে দিয়ে শিল্প কিছুদিন আরো শ্বাস ফেলতে পারে, কিন্তু তা সাময়িক। কিন্তু এদেশের মুনাফালোভী, জনবিরোধী লুম্পেন কর্পোরেট পুঁজির একটা বড় অংশের এই দ্বিতীয় পথই বেশি পছন্দ, তাই তাদের পছন্দ মোদি, অমিত শাহ জুটি। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসেই তাই মোদি তড়িঘড়ি কিছু বিল পাশ করিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মিনিমাম ওয়েজেস বিল। যার মধ্যে দিয়ে তারা শ্রমিককে প্রায় ক্রীতদাসের স্তরে নামাতে চাইছে। অন্যদিকে এনআরসি চালু করে কোটি কোটি জনগণকে তারা ডি-ভোটার তথা অ-নাগরিক বানিয়ে, তাদের ডিটেনশান ক্যাম্পে রেখে, যাবতীয় নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে, আরেক ধরনের ক্রীতদাস বানাতে চাইছে। এই ফ্যাসিস্ত নীতির ধারাবাহিকতাতেই মোদি-শাহর কাশ্মীর নীতিকে দেখতে হবে। উল্লেখ যে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা এবং ৩৫-এ ধারা তুলে দেওয়ার সাথে সাথেই এদেশের বৃহৎ পুঁজির উল্লাস প্রমাণ করে যে মোদিজী কাদের স্বার্থে কাশ্মীর নিয়ে এই ফ্যাসিস্ত নীতি গ্রহণ করলেন।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য
মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কাশ্মীরের শ্রমসম্পদ এবং মানবসম্পদ লুঠ করা। তাই ৩৭০ ধারা বাতিলের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই মুকেশ আম্বানি কাশ্মীরে লগ্নি নিয়োগ করতে আগ্রহী বলে জানাতে দেরি করেননি। তিনি এটাও বলেছেন যে তাদের রিলায়েন্স গ্রুপ অফ ইন্ড্রাস্ট্রিজ কাশ্মীরে এবং লাদাখে উন্নয়নের জন্য স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গড়তে আগ্রহী। ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় পীযুষ পান্ডের ৫ আগষ্ট ২০১৯-এর রিপোর্টে ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির প্রভুদের উল্লাসের কিছু নমুনার দিকে একটু চোখ রাখা যাক। পত্রিকায় সজ্জন জিন্দাল ৩৭০ ধারা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমি সব সময় বিশ্বাস করতাম যে ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত হওয়া উচিত। কাশ্মীর উপত্যকা নিয়ে দুঃখজনক রাজনীতিকরণের কারণে এটার অস্তিত্ব ছিল। আমি বিজেপিকে এই নির্ধারক উদ্যোগের জন্য সমর্থন করি। এবং তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারকে মান্যতা দিতে দেখে খুশি হয়েছি।’ জিন্দাল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এটা জম্মু এবং কাশ্মীরকে ভারতের মূলস্রোতের সঙ্গে মিশতে এবং যৌথ ভারতের উন্নয়নে সামিলকে সুনিশ্চিত করবে।’
আর পি জি এন্টারপ্রাইজের হর্ষ গোয়েঙ্কা বলেছেন, ‘আমার কোনো সংশয় নেই যে এই ল্যান্ডমার্ক সিদ্ধান্ত বিনিয়োগ গতিকে ত্বরান্বিত করবে কিন্তু তা এই বিক্ষোভ কমে আসার পরেই হবে। শুধুমাত্র কর্মসংস্থানই হবে না, পাশাপাশি ট্যুরিজমের ব্যবসাও আবার সুদিনের মুখ দেখবে’।
মতিলাল অসোয়াল গ্রুপের সিএমডি মতিলাল অসোয়াল বলেছেন, ‘জিএসটি-উত্তর আমরা এক জাতি এক করের আওতায় এসেছি। জম্মু এবং কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা উঠে যাওয়ার পর আমরা প্রকৃত অর্থেই এক জাতি হয়ে উঠলাম। ধন্যবাদ মোদিজী, অমিত ভাইকে এবং গোটা বিজেপিকে। নাগরিক হিসাবে গর্ববোধ করছি’। মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও আশিস চৌহানের বক্তব্য, ‘ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এটা একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন। অনেকদিনের একটা দীর্ঘকালীন ইস্যুর সমাধান হলো। এটা হচ্ছে কাশ্মীরের সাথে ভারতের প্রকৃত অর্থেই নতুন করে একাত্ম হওয়ার সময়।’ লোধা গ্রুপের এমডি এবং সিইও অভিষেক লোধার মতে ‘এটা হচ্ছে একটা মহান উদ্যোগ। যদি জাতি একাত্ম এবং শক্তিশালী হয় তাহলে তার ভবিষ্যতও উজ্জ্বল হয়। ... প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে তাদের দূরদর্শী পদক্ষেপের জন্য ধন্যবাদ’।
উপরের চিত্রটি থেকে ভারতের মুনাফালোভী বৃহৎ পুঁজির উল্লাস স্পষ্ট। এবার তারা কাশ্মীরে লগ্নি করে সেখানকার উন্নয়ন করতে আগ্রহী। যদিও বিশ্বায়নোত্তর যুগের এই উন্নয়নকে ইউনাইটেড নেশনসের উন্নয়ন প্রকল্প রিপোর্টে ‘জবলেস গ্রোথ’ তথা ‘কর্মসংস্থানহীন উন্নয়ন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল বহুদিন আগেই। অভিজ্ঞতা বলছে এ দেশের বৃহৎ পুঁজি জনসাধারণকে কর্মসংস্থান দেওয়ার থেকেও কর্মসংস্থান চ্যুত করতেই বেশি সিদ্ধহস্ত; তা সত্ত্বেও তারা ‘কাশ্মীরি জনসাধারণের কর্মসংস্থান হবে’ এই আষাঢ়ে গল্প শোনাতে লেগে পড়েছে। যারা নিজেরাই ধুঁকছে তারা নাকি করবে কাশ্মীরের উন্নয়ন! ঘটনা হচ্ছে যে নিজেদের সংকট এতটাই তীব্র যে তার হাত থেকে বাঁচতে কাশ্মীরের সম্পদের দিকে এখন তাদের শকুনের দৃষ্টি পড়েছে।
(ক্রমশ:)
- অভিজ্ঞান সরকার