প্রতিবেদন
গোটা দেশ প্রতিবাদ প্রতিরোধে একযোগে জানিয়ে দিচ্ছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন মানছি না, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি মানছি না

দিল্লি থেকে ব্যাঙ্গালোর বা কোলকাতা থেকে মুম্বাই, পুণা থেকে পাটনা বা লক্ষনৌ থেকে হায়দ্রাবাদ – গোটা দেশ একযোগে অভূতপূর্ব প্রতিবাদ প্রতিরোধ কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির নামে দেশের মানুষকে নাগরিকত্বের অগ্নিপরীক্ষায় ঠেলে দেওয়া, হয়রানি করা চলবে না। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মধ্যে দিয়ে নাগরিকত্বের সঙ্গে ধর্মকে সংযুক্ত করা ও মুসলিমদের আলাদা চোখে দেখা কিছুতেই মানা হবে না।

Delhi

দিল্লিতে প্রতিবাদ

রাজধানী দিল্লিতে চলছে ধারাবাহিক প্রতিবাদ। প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই আন্দোলনকারীরা দেশের অন্যান্য প্রান্তের মতোই দিল্লির রাস্তায় নেমে লাগাতার প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাতিলের দাবিতে। ১৯ তারিখ দেশের নানা প্রান্তের মতো বামেদের বিক্ষোভ চলছিল দিল্লিতেও। সেখানে গ্রেপ্তার করা হয় সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য সুচেতা সহ অন্যান্য প্রতিবাদীদের। দেশের নানা প্রান্ত থেকে শান্তিপূর্ণ পথে প্রতিবাদ করা নাগরিকদের গ্রেপ্তারির খবর আসতে থাকে, যার মধ্যে ছিলেন অনেক বিশিষ্ট মানুষ। এই সব গ্রেপ্তারির প্রতিবাদে আবার নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায় দিল্লি ও অন্যত্র। দিল্লিতে একদল মানুষকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবার পরেই আরো বিক্ষোভকারীরা জমায়েত হতে থাকেন যন্তর-মন্তর এলাকায়।

২০ নভেম্বর ভীম আর্মি প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদের নেতৃত্বাধীন এক বিশাল মিছিল জামা মসজিদ থেকে যন্তর মন্তরের দিকে এগোতে থাকলে দিল্লি গেটের কাছে পুলিশ পথ আটকায় তাদের। হাতে তাঁদের ছিল জাতীয় পতাকা এবং মুখে ‘সংবিধান বাঁচাও’ স্লোগান। তাঁদের হাতে ছিল বি আর আম্বেদকার, কাঁসিরাম এবং ভগৎ সিংয়ের ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড। পুলিশ তাঁদের ব্যারিকেড করে আটকালেও তাঁরা সেই নিষেধ শুনতে চাননি। উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এই সময় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে পুলিশ। বিক্ষোভ হিংসাত্মক আকার নেয়। দরিয়াগঞ্জ থানার সামনে একটি গাড়িতে আগুন ধরানোকে ঘিরে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রশাসনিক ক্ষমতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার অজুহাত দেখিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জ করা শুরু করে। এরপর জলকামানও ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে। এই সংঘর্ষেই আহত হন বহু বিক্ষোভকারী। ৩৭ জনকে চিকিৎসার জন্য এলএনজেপি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানালেও বারবার দেখা যাচ্ছে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠছে। এমনিতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ- আন্দোলন চলছিল। বিক্ষোভ আন্দোলন আটকাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিল্লি পুলিশ। উত্তর-পূর্ব দিল্লির ১২টি থানা এলাকায় ওই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে কয়েকটি অঞ্চলে ড্রোন ব্যবহার করেছে পুলিশ। রাজধানীর বিভিন্ন অংশে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা যার মধ্যে আইটিও আছে। ওই অঞ্চলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের দপ্তর আছে এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকায় সংবাদ মাধ্যমের প্রভূত অসুবিধা হচ্ছে। বিক্ষোভের জন্য ১৭টি মেট্রো স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছে মেট্রো কর্তৃপক্ষ।

Jamiaa

জামিয়া মিলিয়া ও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি বর্বরতা ও জাতীয়, আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিবাদ

১৫ নভেম্বর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরতদের পাশাপাশি নিরীহ পড়ুয়াদের উপর বর্বর আক্রমণ চালায় পুলিশ। লাঠিচার্জের পাশাপাশি কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। গুলি চালানোরও অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। দুই গুলিবিদ্ধ বিক্ষোভকারী হাসপাতালে ভর্তির খবর পাওয়া গেলেও অস্বীকার করে পুলিশ। আহতদের অনেকেরই দুই হাত, কারোর পা ভেঙেছে। এবং কারোর বা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পুলিশ লাইব্রেরি এবং হস্টেলে ঢুকেও হামলা চালায়, রক্তপাত ঘটে। বস্তুত জামিয়ার ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর হামলার পর থেকে বিক্ষোভের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পড়ুয়ারা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে। এরপর পুলিশ একই কায়দায় আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে হামলা চালায় আন্দোলনকারীদের ওপর। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে পড়ুয়াদের ওপর হামলার প্রতিবাদে দিল্লির পাশাপাশি সোচ্চার হয় গোটা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন এবং নাগরিক সমাজও। জামিয়ার বিক্ষোভে পুলিশি বাড়াবাড়ি নাড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বের শিক্ষাবিদদেরা। জামিয়া নিয়ে বিবৃতিতে সই করেছেন নোয়াম চমস্কি, জুডিথ বাটলার, নিবেদিতা মেনন, রোমিলা থাপাররা। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘নতুন দিল্লির জামিয়া মিলিয়া এবং উত্তর প্রদেশে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে পুলিশি বাড়াবাড়ি হয়েছে, আমরা তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’ বিবৃতিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে বলা হয়েছে, ‘ভারতীয় সংবিধানে সাম্যের অধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার যে কথা বলা হয়েছে, এই আইন তার বিরোধী।’ শিক্ষাবিদরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ‘আমরা জামিয়া ও আলিগড়ের ছাত্র, শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মীদের পাশে আছি। পুলিশ যে আচরণ করেছে তা ভয়াবহ৷ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার অধিকার সব নাগরিকের আছে। বিশ্ববিদ্যালয় হল মুক্ত চিন্তার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের প্রবেশ ও তাণ্ডব গণতান্ত্রিক সমাজের মূল কাঠামোয় আঘাত করেছে।’ নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো বিশ্ববিখ্যাত সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি বর্বরতার ছবি ও রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

delhi students

 

students

 

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জেএনইউ, কলকাতায় যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মুম্বইয়ে টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোস্যাল সায়েন্সেস ও আইআইটি, উত্তর প্রদেশে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দরাবাদে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ উর্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং লখনউয়ের নাদোয়া কলেজে ছাত্রছাত্রীরা আগে থেকেই এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। জামিয়া ও আলিগড়ে সহপাঠীদের ওপর অত্যাচারের খবর ও ছবি তাদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদকে আরো বাড়িয়ে দেয়। গোটা দেশে এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছেন ছাত্রছাত্রীরা।

মুম্বাই ও চেন্নাইয়ে চিত্র তারকাদের প্রতিবাদ

নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ করায় ৬০০ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয় চেন্নাইয়ে। এই ৬০০ জনের মধ্যে রয়েছেন তামিল অভিনেতা সিদ্ধার্থ, গায়ক টি এম কৃষ্ণ সহ অনেকে। সেদিনই আন্দোলন হয় চেন্নাইয়েও। সেই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন তামিল অভিনেতা সিদ্ধার্থ ও টিএম কৃষ্ণ। তারপরই তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের হয় এফআইআর। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রথমদিন থেকেই সরব সিদ্ধার্থ। এমনকী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহকে টুইটারে ‘ শকুনি ও দুর্যোধন ‘ বলেও কটাক্ষ করেছিলেন তিনি। যদিও এফআইআর নিয়ে কোনও কথা বলেননি সিদ্ধার্থ। এদিনই মুম্বাইতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হন মুম্বাই সিনেমা জগতের বেশ কিছু জনপ্রিয় মুখ। যোগ দিয়েছিলেন ফারহান আখতার, সুশান্ত সিং, জোয়া আখতার, হুমা কুরেশি, স্বরা ভাস্বর সহ একগুচ্ছ বলিউড অভিনেতা অভিনেত্রী ও পরিচালক। সঙ্গে ছিলেন হাজার হাজার মানুষ। আজাদ ময়দানে যাওয়ার রাস্তায় দেখা গিয়েছে সেই জনস্রোত।

বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহর প্রতিবাদ ও গ্রেপ্তারি

১৯ তারিখ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ চলাকালীন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে সাড়া পড়ে যায় ব্যাঙ্গালোর থেকে আসা বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহর গ্রেপ্তারির খবরে। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে গ্রেপ্তারির আগে তাঁর দেওয়া প্রতিবাদী বার্তাটি। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ জানান তিনি শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর বক্তব্য ও প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। সেই সময় কেন্দ্রের নির্দেশে তাঁকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। তিনি বলেন যে দিল্লির শাসকেরা যে প্রতিবাদকে ভয় পাচ্ছে, তার প্রকাশ রয়েছে এই গ্রেপ্তারির মধ্যে। গোটা দেশের বিদ্বৎসমাজ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই গ্রেপ্তারির তীব্র নিন্দা করে।

kolkata portest

কলকাতায় প্রতিবাদ

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার ১৯ নভেম্বর বিকেলে কলকাতায় বামেদের ডাকা কেন্দ্রীয় মিছিলে অংশ নেন অগণিত মানুষ। মিছিল শুরু হয় মৌলালির রামলীলা ময়দান থেকে, শেষ হয় পাক সার্কাস সেভেন পয়েন্ট ক্রসিং-এ। সেখানে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) নেতা বিমান বসু, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ সহ অন্যান্য বামপন্থী দলের নেতারা। ২১ নভেম্বর কোলকাতায় বিভিন্ন সংগ্রামী বামপন্থী দলের তরফে একটি এবং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রযুবদের উদ্যোগে আরেকটি মিছিল আয়োজিত হয়। এছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা রাজনৈতিক দল, গণসংগঠন, নাগরিক সমাজ লাগাতার এই ইস্যুতে প্রতিবাদ প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী সামিল হয়েছেন প্রতিবাদে। নাগরিক মিছিলে সামিল হন অপর্ণা সেন ও কৌশিক সেন। বাংলার বিশিষ্ট লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ভারত বহু বর্ণ, বহু ভাষা, বহু ধর্মের দেশ। বরাবর এ দেশ সমস্ত মানুষকে সমান অধিকার দিয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার দেশের এই ঐতিহ্যটাকেই ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করছে। এর বিরুদ্ধে সকলের সরব হওয়া উচিত। বিল পাশ হলেও তা নিয়ে বিতর্ক বন্ধ করা যাবে না। শীর্ষেন্দুবাবুর কথাকেই সমর্থন করেছেন বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ অমল মুখোপাধ্যায়। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষের বক্তব্য, সরকার সংখ্যার জোরে আইনসভায় এই বিল পাশ করিয়ে নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এই বিলে এক দিকে অগণতান্ত্রিক এবং অন্য দিকে অসাংবিধানিক। অমলবাবুর বক্তব্য, দেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। সেখানে কোনও ভাবেই কয়েকটি নির্দিষ্ট ধর্মের উল্লেখ করে আইন তৈরি করা যায় না। এটি সংবিধানে অধিকারের যে ব্যাখ্যা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ফলে আদালতে এই বিষয়টি উল্লেখ করে মামলা হতেই পারে। একই সঙ্গে অমলবাবুর মন্তব্য, বিলটি অগণতান্ত্রিক কারণ, বিলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মাত্র তিনটি রাষ্ট্রের উল্লেখ করা হয়েছে। যদি প্রতিবেশী সার্ক রাষ্ট্রগুলির কথা বলা হত, তাহলেও বোঝা যেত একটি কোনও মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনটি দেশের নাম উল্লেখ করে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে তারা গণতান্ত্রিক ধারণাগুলিকেও ভেঙে দিতে চাইছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। নাট্য ব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীর অভিযোগ, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের সঙ্গে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসির সরাসরি সংযোগ আছে। তাঁর বক্তব্য, অসমে কীভাবে এনআরসি হয়েছে, সেটাই তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। এখন সরকার বলছে নাগরিকত্ব বিল পাশ হয়ে গেলে গোটা দেশে এনআরসি করা হবে। এটা তিনি কোনও ভাবেই মেনে নেবেন না। কারণ, দেশ ভাগের সময় কীভাবে মানুষ এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে এসে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন, সে ইতিহাস ভোলার নয়।

Bihar

বিহারে বামেদের ধর্মঘট

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বামপন্থীদের ডাকা ধর্মঘটে বৃহস্পতিবার অচল হয়ে পড়ে বিহার। গ্রাম থেকে শহর— সর্বত্রই ব্যাপক সাড়া পাওয়া গিয়েছে এদিনের বন্‌ধে। সমস্ত স্তরের মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা বামপন্থীদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। একজোট হয়েছেন সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। সিএএ, এনআরসি’র বিরুদ্ধে তাঁরা হেঁটেছেন মিছিলে। রাস্তায়-রাস্তায় পুড়েছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের কুশপুতুল। পথে নেমেছেন শতাধিক মহিলা। মুসলিম সংগঠনের কর্মীরা সোচ্চার হয়েছেন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। রাজ্যজুড়েই এদিন বন্ধ ছিল স্কুল-কলেজ, দোকান-বাজার। সরকারি অফিসেও হাজিরা ছিল অত্যন্ত কম। ট্রেন-বাসও বিশেষ চলেনি। বিভিন্ন সড়কপথে এবং রেল স্টেশনে চাক্কা জ্যাম, রেল রোকো করেন বামপন্থী কর্মী-সমর্থকরা। পাটনার গান্ধী ময়দান থেকে ডাকবাংলো ক্রসিং পর্যন্ত সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, সিপিআই(এম), সিপিআই, সহ বামপন্থীদের সুবিশাল মিছিলে অংশ নিয়েছেন সাধারণ মানুষ। সংবিধান রক্ষার দাবিতে ওঠা স্লোগানে গলা মিলিয়েছেন। স্লোগানে-স্লোগানে শপথ নিয়েছেন এনআরসি, সিএএ রুখে দেওয়ার। কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বর চড়া হতেই রাজ্যের জেডি(ইউ)-বিজেপি জোট সরকারের পুলিশ বিক্ষোভ-আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করে। যদিও সাধারণ মানুষের রোষের মুখে সেই কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। গয়া, লক্ষ্মীসরাই, ছাপরাসহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজারেরও বেশি বামপন্থী কর্মী-সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত উত্তর বিহারের মুজফ্ফরপুর বিভিন্ন সময়েই সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেই বিভাজনের রাজনীতিকে উড়িয়ে দিয়েই এদিন পথে নামেন বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের কর্মীরা। নরেন্দ্র মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার স্লোগান তোলেন তাঁরা। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিজেপি’র অন্যতম উগ্র হিন্দুত্ববাদী মুখ গিরিরাজ সিংয়ের বেগুসরাইয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানান শতাধিক মহিলা। ‘সংবিধান বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’ স্লোগান শোনা যায় তাঁদের মুখে। এনআরসি, সিএএ’র বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা। ধিক্কার জানান বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। কয়েক মাস আগেই সিপিআই নেতা কানহাইয়া কুমারকে হারিয়ে লোকসভা ভোটে জয়ী হন গিরিরাজ। কিন্তু বিভেদের রাজনীতিই তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বাধ্য করল সাধারণ মানুষকে। ভাগলপুরে মোদী-শাহের কুশপুতুল পুড়িয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। মুজফ্ফরপুর, বেগুসরাই, জেহানাবাদে সড়কপথে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বামপন্থীরা। দ্বারভাঙায় ট্রেন অবরোধ করেন বাম কর্মীরা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সমর্থন জানিয়েছেন এই ধর্মঘটে। ব্লকস্তর থেকে শুরু করে সমস্ত স্তরেই সাফল্য পেয়েছে এদিনের বন্‌ধ।’’ এদিন ডাকবাংলো ক্রসিংয়ে মিছিল শেষে জমায়েতে উপস্থিত ছিলেন কানহাইয়া কুমার। উদ্দীপ্ত বার্তা ছড়িয়ে দেন কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। বামপন্থীদলগুলির ডাকে এই বন্‌ধে সমর্থন জানিয়েছে বিহারের প্রধান বিরোধী দল আরজেডি। পাশাপাশি কংগ্রেস, আরএলএসপি, এইচএএম, প্রাক্তন সাংসদ পাপ্পু যাদবের জনঅধিকার পার্টি (জেএপি), বিকাশশীল ইনসান পার্টি (ভিআইপি) সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও শামিল হয়েছে এই প্রতিবাদ-আন্দোলনে।

bandh

 

উত্তরপ্রদেশে প্রতিবাদ ও নৃশংস গুলিচালনা, বিজেপি নেতাদের হিংসাত্মক উষ্কানি

সব থেকে ভয়াবহ পরিস্থিতি উত্তরপ্রদেশের। গত কয়েক দিন ধরেই সিএএ এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) বিরোধী বিক্ষোভ ঘিরে উত্তাল উত্তরপ্রদেশ। থমথমে ছিল রাজধানী দিল্লিও। যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে বৃহস্পতিবার থেকে টানা দু’দিনের বিক্ষোভ অশান্তিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮। তাঁদের মধ্যে আট বছরের এক নাবালকও রয়েছে। বিক্ষোভের সময় পদপিষ্ট হয়ে ওই নাবালকের মৃত্যু হয়। পরিস্থিতি সামলাতে শুধুমাত্র প্রয়াগরাজেই ১৫০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। গাজিয়াবাদে আটক ৬৫ জন। অশান্ত যোগীর রাজ্যে গভীররাত থেকেই কোপ পড়েছে বিভিন্ন জেলার ইন্টারনেট পরিষেবায়। উত্তরপ্রদেশের জেলায় জেলায় সংঘর্ষের পর রাত থেকেই লখনউ, বিজনৌর, মেরঠ, ফিরোজাবাদ, কানপুর, সম্বল, মোরাদাবাদ, আলিগড়, বরেলী, প্রয়াগরাজ (ইলাহাবাদ)-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

lucknow

 

পুলিশের নৃশংস দমননীতি ও নির্বিচার গুলিচালনার পেছনে রয়েছে বিজেপি নেতাদের হিংসাত্মক বক্তব্য ও খোলাখুলি নির্দেশ। বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের উস্কানিমূলক কথা বেড়েই চলেছে। নতুন নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে গুলি চালানোর কথা বললেন দিল্লির বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র। নতুন আইনের সমর্থনে নয়াদিল্লিতে একটি  মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। মিছিলের ভিডিয়ো পোস্ট করে কপিল দাবি করেন এটি ‘শান্তি মিছিল।’ সেই  ‘শান্তি’ মিছিলেই নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘গোলি মারো শালো কো। সংসদে জিততে পারলে রাস্তায় জিততে পারব না?’’ আগেও সাম্প্রদায়িক কথা বলে বিতর্কে জড়িয়েছেন আপ ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া কপিল। মেঙ্গালুরুতে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনাকে সমর্থন করে বিজেপির জাতীয় সম্পাদক এইচ রাজাও বলেছেন, ‘‘গুলির জবাব গুলিতেই দেওয়া হবে। গুলির বদলে গুলি তো চলবেই।’’ আরএসএস প্রচারক হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করা, তামিলনাড়ুর বিজেপি নেতা রাজা বরাবরই বিরোধী রাজনৈতিক নেতা এমনকি অপছন্দের প্রশ্ন করা সাংবাদিকদেরও ‘দেশদ্রোহী’ বলেই অভিহিত করেন। এর আগে স্বয়ং রেল প্রতিমন্ত্রী সুরেশ অঙ্গাড়ি বলেছিলেন, এই আন্দোলনের জেরে রেলের সম্পত্তি নষ্ট হতে দেখলেই এবার গুলি চালানো হবে। এমনকি, সংখ্যাগুরুরা ধৈর্য হারালে গোধরা-পরবর্তী পরিস্থিতি তৈরি করার হুমকি দিয়েছিলেন কর্নাটকের বিজেপি সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী সি টি রবি। এই সমস্ত হুমকি একদিকে বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদীদের যেমন জনগণের কাছে বে আব্রু করে দিচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে আন্দোলনের গতি ও রোখ।

খণ্ড-26
সংখ্যা-42