১৯ ডিসেম্বর ছিল একতা দিবস। ১৯২৭ সালের এই দিনে রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকুল্লা খান ও রোশন সিং - তিন স্বাধীনতা বিপ্লবীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ সরকার দ্বারা একই অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন এই তিনজন। তাঁদের শহীদ দিবস ভারতে সব ধর্মের মানুষের ঐক্য ও সমান অংশিদারিত্বের প্রতীক হয়ে আছে। বর্তমান সময়ে বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্ব রাষ্ট্রবাদ দেশকে ভেতর থেকে টুকরো টুকরো করতে চাইছে, সেই বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করে দেশব্যাপী একতা ও অংশিদারিত্বের প্রতীক হিসেবে জীবন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল ১৯ ডিসেম্বরের ভারত। সারা দেশের সাথে সাথে কলকাতাও সেদিন গণমিছিলে প্লাবিত হয়। মৌলালি রামলীলা ময়দান থেকে দুপুরে এবং সন্ধ্যায় দুটি সুবিশাল মিছিল যথাক্রমে ধর্মতলা ও পার্কসার্কাসে জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
দুপুরের মিছিলের আহ্বান ঘোষণা হয়েছিল এক মাস আগে, দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা “নো এনআরসি মুভমেন্ট” নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে। মাসাধিক কালব্যাপী এই গ্রুপের মাধ্যমে জেলায় জেলায় গড়ে ওঠে অনেকগুলি প্রচারগোষ্ঠি। প্রচার চলে। ১৫ ডিসেম্বর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রীদের প্রতিরোধ যখন সমস্ত সীমানা পেরিয়ে দেশের প্রায় সব ক্যাম্পাসকে জাগিয়ে তোলে, তখন ১৯-এর এই মহামিছিলের আহ্বান বাংলার, বিশেষত বৃহত্তর কলকাতার, ব্যাপক তরুণ প্রজন্ম ও সাধারণ নাগরিকদের সামনে এক যথোপযুক্ত সমাবেশকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এমন মিছিল মিছিলনগরী কলকাতাও বোধহয় আগে কখনও দেখেনি, যেখানে অর্ধেকের বেশি মানুষ জীবনে প্রথমবার মিছিলে এসেছেন, প্রথমবারেই বাচ্চা কাঁধে কোনও মধ্যবিত্ত স্বামী-স্ত্রী মিছিলে হাজির বয়স্ক বাবা-মাকে নিয়ে। মিছিলে সর্বমোট কত মানুষ সামিল হয়েছিলেন, দশ না পঞ্চাশ হাজার তা নিয়ে তুমুল তর্ক চলে। কারণ পথচারীরা দুপাশ থেকে স্বতস্ফুর্তভাবে মিশে যাচ্ছিলেন মিছিলে।
বজবজ থেকে আসা সুদেষ্ণা দত্ত লিখছেন, “গত উনিশে ডিসেম্বরের মিছিলে আমরা দুই মূর্তি — আমি আর গুলশন হাজার পায়ের সঙ্গে যখন তাল মিলিয়ে হাঁটছিলাম, মিছিলের প্রাণশক্তি দেখে এবং অনুভব করে মনে হচ্ছিল গাজনের মিছিলের কথা। রামলীলা ময়দানের শুরুতেই অচেনা মুখের ফাঁকে পুরোনো কিছু চেনা মুখ চোখ মটকে, ফিচেল হাসির কোড-ওয়ার্ডে সম্ভাষণ করে বলল – এসো, এসো বেরাদর! তারপর বাড়তে থাকল আরো মুখের ভিড় আর তার সঙ্গে বাড়তে থাকল প্রতিরোধের মঞ্চে নতুন সংযোগ স্থাপনের আনন্দ, নিজের ক্ষমতা বুঝতে পারার আনন্দ, লালনের বাংলার ওপর বিশ্বাস ফিরে পাবার আনন্দ। ‘আজাদি’র স্লোগানের সঙ্গে গোল হয়ে হাত ধরে ধরে যে নাচা যায়, তা ওই মিছিলে সামিল না হলে দেখার সৌভাগ্য হত বলে মনে হয় না। আর সে কী স্পিরিট! এই যাদবপুরের এক প্রাক্তনী কাঁধে তুলে নিল ফেজ-টুপি মাথায় দেওয়া সালোয়ার-কুর্তায় সাজা প্ল্যাকার্ড হাতের ছ-সাত বছরের এক শিশুকে। “আজাদ দেশ মে আজাদি”। ঠিক তার পাশেই হেনা করা কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা আরো লম্বা এক ভদ্রলোক জিন্স-জ্যাকেট পরা আর এক শিশুকে কাঁধে তুলে নিয়ে আওয়াজ মেলালেন — ইস পিতৃতন্ত্র সে — ভিড় গর্জন করে উঠল আজাদি। তার কয়েক কদম আগে একদল উলোঝুলো তরুণ-তরুণী বাজনার সুরে তাদের পরিসরে প্রতিবাদের মুর্ছনা তুলছে। কালো জামা, সাদা জামা, টুপি, ক্যাপ, হিজাব, বোরখা, শাড়ি, চুড়িদার, জিন্স, স্কার্ট, পাজামা-পাঞ্জাবি, ধুতি, লুঙ্গি -মানে বিশ্বাস করুন সব রকমের পোশাক পরা ছা-পোষা দেখতে মানুষগুলো হাঁটছেন, স্লোগান দিচ্ছেন, গান গাইছেন। দেশ স্বাধীনের দিনটিতে নিশ্চয় কলকাতার রাস্তা এমনভাবে স্বতস্ফূর্ত, গর্বিত ভারতীয়দের দেশের পতাকা হাতে হাঁটতে দেখেছিল।
এ মিছিল-এর বৈশিষ্ট্য ছিল বিভিন্নতার রং মেশানো বর্ণময়তা। এই যেমন ধরুন আপনি দু-কদম আগে গলা মেলাচ্ছিলেন “ইস সঙ্ঘিয়োঁ পে হল্লা বোল্”, এই বার তালে গোলে অম্বলে আপনি আপনার সাথীদের থেকে তেরছা মেরে ডান দিকে যদি বেঁকে যান, গুপী-বাঘার শিষ্যরা আপনাকে দিয়ে “ও রে হাল্লা রাজার সেনা” গাইয়ে নেবে। এবার আপনি দেখলেন দুটি ছোকরা ‘‘স্ট্যাণ্ড উইথ জামিয়া’’ প্ল্যাকার্ড পিঠে ঝুলিয়ে জল বিলি করছে। ও দিকে যেতেই আপনি “জয়ভীম, জয়ভীম” বলে মুষ্টিবদ্ধ হাত শীতের রোদ ঝলমল কলকাতার ধোঁয়াটে আকাশের দিকে তুলে ধরলেন। মিছিল যেখানে একটু দাঁড়াল সেখানে দেখলেন, সাতরঙ্গা পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে একটা বিস্কুটের প্যাকেট থেকে ভাগাভাগি করে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। ওই ভাগাভাগির বিস্কুটের দিকে হাত বাড়াতেই কেউ আপনার দিকে ‘ঘুসপইঠি’ বলে ভুরু কঁচকে তাকাল না। বরং একগাল হেসে গোটা প্যাকেটটাই আপনার হাতে তুলে দিল। এবার আর আপনি বুঝতে পারছেন না, কে কোথাকার? যাদবপুর, আলিয়া, প্রেসিডেন্সি, নাকি কলকাতা, শহরতলি? সে এক মেলা, প্রতিবাদী মানুষদের মিলনের মেলা। কার সঙ্গে আপনি পোজ দিয়ে ছবি তুললেন জানেন না। জানতে চানও না। কারণ আপনারা যে মিছিলের মানুষ। সে মিছিলে রাষ্ট্রবাদী ক্ষমতাশীল মুখ কার্টুন ক্যারেক্টার হয়ে গেছে। ডিক্টেটরকে নিয়ে ভিড়ের মস্করা আছড়ে পড়ে রাস্তা থেকে ফুটপাথে। আর আপনারা এক-দুজন তরুণীর হাতে ধরা পোস্টারের লেখা পড়ে বেদম হেসে বন্ধু হয়ে যান।
সেদিন এসপ্ল্যানেড আসার আগেই জনজোয়ারের চলা থেমে গেল। প্রশাসন মিছিলের মতো স্বাভাবিক যুক্তির সচেতনতায় পরিপক্ক নয়। পুলিশ তাই আর এগোতে দেয়নি মিছিলকে। তাতেই বা কী? রাস্তাতেই মিছিল বসে পড়ল। হাততালি, গান, বক্তৃতা — সব কিছু একসাথে হচ্ছে। কে বলবে যে এই আমরা, এই বিপুল জনতা কোনো নেতা-নেত্রীর আহ্বানে মিছিলে আসিনি। প্রত্যেকে ভারতীয় নাগরিকের দায় ও দায়িত্ব নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে নিজেই এসেছি। তাই অ্যাম্বুলেন্স এলে আপাত বিশৃঙ্খল ভিড় নিমেষে সরে গিয়ে পথ করে দিয়েছে।
আমরা সে দিন ন্যায়-বিচারের দাবিতে মানুষের পথে নামার ইতিহাসকে মনে করেই ভবিষ্যতের জন্য ইতিহাস গড়তে জড়ো হয়েছিলাম। আবার এ ভিড়ের মানুষগুলো দৈনন্দিন-এর সাধারণত্বে নিজেকে লুকিয়ে ফেলবে। কিন্তু জানবেন, প্রয়োজন হলেই, জানবেন প্রয়োজন হলেই কাতারে কাতারে নেমে পড়বে রাস্তায়। নেচে-কুঁদে, হেসে-গেয়ে দৃঢ় ভাষায় জানিয়ে দেবে যে, রাষ্ট্রনেতারাও জনগণের নজরদারিতে ছিলেন, আছেন, থাকবেন।”
সাংবাদিক দেবাশীষ আইচ লিখছেন, “না, এমন রাজনৈতিক মিছিল কলকাতা কখনও দেখেনি, এমন বৈচিত্র্যে ভরা মানুষের ঢল না, আমি কিংবা আমাদের বহু বন্ধু অনেকেই জীবনে কখনও জাতীয় পতাকা শোভিত মিছিলে হাঁটিনি, হাঁটেননি। নো এনআরসি মুভমেন্ট–এর এডমিনদেরও অনেকের সম্পর্কেই একথা বলা যায় (ব্রহ্মা জানে)। বোরখা পরা সম্ভ্রান্ত গৃহবধূ, হিজাব জড়ানো তরুণীর সঙ্গে কখনও মিছিলে হাঁটিনি। এলজিবিটি–দের সঙ্গে হেঁটেছি। ‘হোককলরব’ হেঁটেছি। এ যুগের কথা বলছি, কিন্তু এমন মিছিলে কী হেঁটেছি যা এই শহরের মতো খণ্ড খণ্ড নানা মহল্লার এক মোজেইক, এক উপলচিত্রণ।”
একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকার কলকাতা করেসপন্ডেন্ট শেখ আজিজুর রহমান জানালেন যে, এই মিছিলে হিন্দু ও মুসলমান দুই জনগোষ্ঠিকে পরস্পরের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে যেতে দেখলেন তিনি, পরস্পরের সাথে ‘ফিউশন’ বা সংমিশ্রিত হয়ে যেতে দেখলেন। বললেন কীভাবে যাদবপুরের ছাত্রীরা পার্কসার্কাসের মহিলাদের শ্লোগান শেখাচ্ছে মিছিল চলতে চলতেই, কীভাবে একজন হিন্দিভাষী মুসলিম ভ্যান চালক অবাক হয়ে যাদবপুর-প্রেসিডেন্সীর ছাত্রীদের সাহস ও আন্তরিকতার তারিফ করতে করতে আক্ষেপ করে বলছিলেন যে এই মেয়েদের সম্পর্কে কিছু না জেনেই খারাপ ধারণা পোষণ করতেন।
সন্ধ্যার মিছিল ছিল ১৭টি বাম দলের ডাকে। রামলীলা ময়দান থেকে পার্ক সার্কাস সেভেন পয়েন্টে গিয়ে মোদির পুতুল পোড়ানো হয়। দুপুরের মিছিল শেষে সেখানকার অনেকেই যেমন এই মিছিলে এসে যোগ দিয়েছিলেন তেমনি বৃহত্তর কলকাতার বেশ কয়েক হাজার বাম কর্মী সমর্থকের এক স্বতস্ফুর্ত সাড়া ছিল এই মিছিলে। দুপুরের মিছিলের তেজ ও উচ্ছ্বলতা যেন এই মিছিলে এসে এক দৃঢ়বদ্ধ সংগঠিত প্রতিজ্ঞায় স্থিতু হয়। ১৯ ডিসেম্বর সারা দেশ জুড়েই একতা দিবস পালনের আহ্বান রেখেছিল কেন্দ্রীয়ভাবে পাঁচটি বামপন্থী দল। বাংলায় তা প্রসারিত হয়ে ১৭টি বাম ও গণতান্ত্রিক দলের কর্মসূচীর রূপ নেয়। এছাড়া একই আহ্বান রেখেছিল ৬০টি গণ সংগঠনের এক কেন্দ্রীয় জোট।
সন্ধ্যায় এই লাল মিছিল বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তোলে। এনআরসি ও সিএএ বাতিল করার জনপ্রিয় দাবির সাথে সাথে এনপিআর বয়কটের ডাক ওঠে। বস্তুত বিজেপি সরকার এখন এনপিআর-এর আড়ালে এনআরসি-কে লুকিয়ে ফেলতে চাইছে। বিগত কয়েক মাস ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এনআরসির মাধ্যমে ‘ঘুসপেটিয়া’ তাড়ানোর বহুৎ হুমকি হামকা দেওয়ার পর ক্রমবর্ধমান একতার ভয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলতে শুরু করে যে এনআরসি করার কোনও চর্চাই নাকি সরকার করেনি। অমিত শাহও তার দুদিন বাদে ভালোমানুষি মুখ করে বলে যে এনআরসি নিয়ে কোনও কথাই হয়নি। এখন তারা বলছেন যে এনপিআর হবে। আর তারা প্রাণপণে বোঝাতে শুরু করেছে যে এনপিআরের সাথে এনআরসির কোনোই সম্পর্ক নাই। কিন্তু মানুষ এই মিথ্যাচারকে সহজেই ধরতে পারছে। আসলে এনপিআর হল এনআরসি-র প্রথম ধাপ। একথা একাধিক এনপিআর নোটিফিকেশনে, এনআরসির ২০০৩-এর রুলসে এবং সংসদে দেওয়া সরকারের বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বারবার বলা আছে। এনআরসির মূল কথাই হল আমাদের প্রত্যেককেই প্রমাণ দিয়ে নাগরিক হতে হবে। কিন্তু আমরা যদি এখন নাগরিক হিসেবেই গণ্য হই তাহলে তো আর নতুন করে প্রমাণ চাওয়া বা দেওয়ার প্রশ্ন আসেনা। এনপিআর যা করবে তা হল, নাগরিকের বদলে “বসবাসকারী” হিসেবে নথিভূক্ত করবে। “বসবাসকারী” মানেই তো আর নাগরিক নয়, “ঘুসপেটিয়া”ও হতে পারে। অর্থাৎ এনপিআর-এর মাধ্যমে আমরা নিজেদের প্রথমে বসবাসকারী হিসেবে নথিভূক্ত করব। তারপর আসবে সমন। কাগজপত্র নিয়ে তখন আমাদের ছুটতে হবে প্রমাণ করতে যে এননিআরে এক গুচ্ছ প্রশ্নের যে যে উত্তর আমরা দিয়েছি সেগুলি মিথ্যা নয়। অনেক প্রশ্নের মধ্যে দুটি প্রশ্ন হল আমার/আপনার জন্মস্থান কোথায়, আমার/আপনার বাবা ও মায়ের জন্মস্থান কোথায়। আমাদের বাবা বা মা বেঁচে থাকলে তাকেও তাঁদের বাবা মায়ের জন্মস্থান বলতে হবে এবং তারপর প্রমাণ করতে হবে যে সেগুলো মিথ্যা নয়। একবার ওরা এনপিআর করে নিতে পারলে তারপর আমাদের কেবল অপেক্ষা করতে হবে। বাড়িতে কবে নোটিশ আসবে তার অপেক্ষা। ফলত এনআরসি আটকানোর প্রথম ধাপ হল “বয়কট এনপিআর”।
পার্ক সার্কাসের সমাবেশ মঞ্চ থেকে একইসাথে ডাক দেওয়া হয় ৮ জানুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট সর্বাত্মকভাবে সফল করে তুলুন।