দুপুর ১:৩০ শিলিগুড়ির ভেনাস মোড় কার্যত থেমে গেছে। রাস্তার দখল নিয়েছে মেহনতি কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবরা। কৃষি ঋণ মুকুব করতে হবে, চা বাগানের ন্যূনতম মজুরি, জমির পাট্টা চাই। বিএসএনএল থেকে রেল বিলগ্নীকরণ-বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মুষ্টিবদ্ধ হাত তখন অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার দাবিতে পথকে শাসন করছে, গন্তব্য বাঘাযতীন পার্ক। কৃষক নেতা পবিত্র সিংহ, খেমু সিংহ চা বাগানের তরুণী লড়াকু শ্রমিক সুমন্তি এক্কা, সিআইটিইউ-র সুমন পাঠকদের নেতৃত্বে এনজেপি তিনবাত্তি মোড়ের পদযাত্রীদের একটি দল যখন প্রায় মাঠে পৌঁছে গেছে, এআইসিসিটিইউ-র বাসুদেব বোস অভিজিৎ মজুমদার, সিআইটিইউ-র গৌতম ঘোষ, স্বপন গুহ নিয়োগীদের নেতৃত্বে মাটিগাড়ার পরিবহন নগরী থেকে আর একটি পদযাত্রা তখন শহরের আরেক দিক থেকে মাঠমুখী! স্কুল শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমল কেন মোদী সরকার জবাব দাও, নারীদের সার্বিক স্বাধীনতা ও ছাত্র যুবদের আওয়াজ তখন এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাইত বলি দিকে দিকে কমরেড গড়ে তোলো ব্যারিকেড, অবশেষে একের পর এক মিছিল এসে ঢুকেছে বাঘাযতীন পার্কে, কমরেড মীরা চতুর্বদী উদ্বোধনী গণ সঙ্গীত শঙ্খচিলে ছড়িয়ে দিয়েছেন নতুন আশার কথা, নতুন লড়াইয়ের বার্তার কথা। সভাপতি মন্ডলীতে ছিলেন অভিজিৎ মজুমদার, বিকাশ সেন রায়, সমন পাঠক প্রমুখ। এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বোস বক্তব্য রাখতে গিয়ে এনআরসি, এনপিআর, ক্যাব নিয়ে যেমন সরব ছিলেন পাশাপাশি রাজ্য এবং কেন্দ্রের শ্রমিক বিরোধী নীতি বিএসএনএল, রেল, এয়ার ইন্ডিয়ার মতো সংস্থাগুলির বেসরকারীকরণ বিলগ্নিকরণের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হন। যে কোনো মূল্যেই ৮ জানুয়ারী ধর্মঘটকে সফল করার কথা তিনি বলেন। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ-র অনাদি শাহু, আইএনটিইউসি-র মণীকুমার দারনাল প্রমুখ। মাঠে উপস্থিত সংগ্রামী শ্রমিক কৃষকরাও ছাত্র যুবরা ততক্ষণে চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেলেছে।
চা বাগান সহ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি একুশ হাজার টাকা এবং দশ হাজার টাকা পেনশন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারীকরণ এবং বিলগ্নিকরণের বিরোধিতা সহ ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব বিরুদ্ধে ও কর্মসংস্থানের দাবী সহ এনআরসি, এনপিআর, ক্যাব বাতিল করার দাবি সহ ১২ দফা দাবিতে সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশন গুলির ডাকে আগামী বছরের ৮ জানুয়ারি দেশ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে, অন্যান্য জায়গার সাথে দার্জিলিং জেলাতেও তার সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছিল ২১ নভেম্বরের কনভেনশনের মধ্যে দিয়ে। কনভেনশনের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১ ডিসেম্বর থেকে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি সহ নকশালবাড়ি খড়িবাড়ি বাগডোগরা থেকে চা বাগানের প্রত্যন্ত জনপদ কার্যত চলে গেছে মেহনতি মানুষের দখলে লাল পতাকায় প্রত্যয় শ্লোগানে শ্লোগানে ছাত্র-যুব শপথ নিচ্ছে আগামীর অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ের। শিলিগুড়ি কর্পোরেশনের যুক্ত এলাকা ৩১ নং ওয়ার্ডথেকে শহরের প্রায় শেষ প্রান্তের উত্তরায়ণ থেকে রাজীব নগর, ফাঁসিদেওয়ার জয়ন্তীকা চা বাগান থেকে বিধাননগর ঘোষপুকুর থেকে লক্ষ্মণ সিং জোত সব জায়গাতেই এআইসিসিটিইউ-র ব্যানারে জেলা কার্যনির্বাহী সভাপতি অভিজিৎ মজুমদার সম্পাদক, মোজাম্মেল হক, পুলক গাঙ্গুলী, অপু চতুর্বদী সহ কর্মীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।
৭ ডিসেম্বর এআইসিসিটিইউ, সিআইটিইউ সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশন এবং গণসংগঠনের নেতৃত্বে শিলিগুড়ি শহরের হাতি মোড় থেকে শুরু হয়ে একটি মিছিল শেষ হয় স্থানীয় ফুলেশ্বরী বাজারে। সেখানে সংক্ষিপ্ত পথ সভায় বক্তব্য রাখেন এআইটিইউ-র রাজ্য নেতৃত্ব বাসুদেব বোস, ডিওয়াইএফ-এর উদয়ন দাশগুপ্ত, বারো জুলাই কমিটির রামেশ্বর বক্সী সহ অন্যান্য নেতৃত্ব। প্রত্যেকেই কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন এবং ৮ জানুয়ারী সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করার লক্ষ্যে ১০ ডিসেম্বর শিলিগুড়ি বাঘাযতীন পার্কে উত্তরবঙ্গের কেন্দ্রীয় সমাবেশকে সর্বাত্বক সফল করে তোলার আহ্বান জানান। বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতা সহ পথচলতি অনেকেই আগ্রহ নিয়ে সভার বক্তব্য শুনতে দেখা যায়। দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি সন্নিহিত অঞ্চলে লং মার্চের যে রুট পূর্বনির্ধারিত ছিল এআইকেএমএর জেলা সম্পাদক কমরেড পবিত্র সিংহের অনুরোধ এবং অঞ্চলের রাজনৈতিক গুরুত্বকে মাথায় রেখে এআইসিসিটিইউ এবং সিআইটিইউ জেলা নেতৃত্ব লিউসিপুকরি থেকে ফাঁসিদেওয়া ৭ কিমি পথ পাড়ি দিতে সম্মত হয়, সেই অনুযায়ী ৮ ডিসেম্বর এআইসিসিটিইউ, এআইকেএস, এআইএআরএলএ, এআইএসএ, আরওয়াইএ সহ বিভিন্ন গণ সংগঠন এবং সিআইটিইউ, এআইকেএমএস, এফআইএ-র যৌথ উদ্যোগে অভিজিৎ মজুমদার, বাসুদেব বোস পবিত্র সিংহ, জীবেশ সরকার, তাপস সরকারের নেতৃত্বে ব্যানার ফ্ল্যাগ সম্মিলিত বর্ণাঢ্য মিছিল শেষে ফাঁসিদেওয়ার সিপিআই(এম) অফিসের সামনে সভায় বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে বাসুদেব বোস, সিআইটিইউ-র জীবেশ সরকার, এআইকেএমএস-এর তাপস সরকার প্রমুখ।
৯ ডিসেম্বরের মিছিল খড়িবাড়ি থেকে নকশালবাড়ি। চা বাগানের শ্রমিকরা জমির পাট্টা ন্যুনতম মজুরির দাবিতে পা মিলিয়েছে আজকের মিছিল, কৃষক শ্রমিক এর দৃপ্ত কণ্ঠে সোচ্চারে ঘোষনা করছে ৮ জানুয়ারী কোনোও কাজ নয়। ১০ ডিসেম্বর-এর সমাবেশে সফল করতে (বাঘাযতীন পার্ক) শিলিগুড়ি চলো। এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে মিছিলের নেতৃত্ব ছিলেন অভিজিৎ মজুমদার। নেপাল সীমান্তের পাণিট্যাঙ্কিতে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিট ইউ-র দার্জিলিং জেলা সভাপতি অভিজিৎ মজুমদার। বাসুদেব বোস, সিআইটিইউ-র গৌতম ঘোষ, সমন পাঠক, ইউটিইউসি-র তাপস গোস্বামী প্রমুখ। পদযাত্রা শেষ হয়ে নকশালবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে। পায়ে পায়ে লং মার্চ পথনাটিকা সংঘটিত হয় সেখানে উৎসাহী সাধারণ মানুষ রাস্তার দুপাশে ভীড় করে যাত্রীদের স্বাগত জানান। নাটক শেষে সভাতে এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে বক্তব্য রাখেন বাসুদেব বোস। কোচবিহার থেকে পদযাত্রীদের আর একটি দল শিলিগুড়ি এসে পৌঁছায়। ১০ ডিসেম্বর সকাল থেকেই চলতে থাকে সমাবেশেকে সফল করার প্রস্তুতি। শিলিগুড়ি শহরের এনজিপি তিনবাত্তি থেকে পবিত্র সিংহ, সমন পাঠক, দীবক চৌবে, খেমু সিংহ, সুমন্তি এক্কা-দের নেতৃত্বে পদযাত্রীদের একটি দল অভিজিৎ মজুমদার, বাসুদেব বোস, অলোক চক্রবর্তীদের নেতৃত্বে মাটিগাড়া পরিবহন নগরী থেকে আরও একটি হজযাত্রীদের দল সঙ্গে কয়েক হাজার ছাত্র, যুব, মহিলা, শ্রমিক, কৃষকের শ্লোগান সম্মিলিত দৃপ্ত পদচারণা শিলিগুড়ি রাস্তাকে কয়েক ঘন্টার জন্য থামিয়ে দিয়ে মীরা চতুর্বেদীর শঙ্খচিলের আহ্বানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় সমাবেশ। অভিজিত মজুমদার, সমন পাঠক, বিকাশ সেন রায়-দের নিয়ে তৈরি সম্পাদক মণ্ডলীর সামনে একে একে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বোস, সিআইটিইউ-র অনাদি শাহু, আইএনটিইউসি-র মণীকুমার দাবানল, বারো জুলাই কমিটির রামেশ্বর বক্সী প্রমুখ। সকলেই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির তীব্র সমালোচনা করেন এবং ৮ জানুয়ারী দেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘটকে সর্বাত্বক সফল করে তোলার আহ্বান জানান। হ্যাঁ সফল আমরা করবই। মেহনতি মানুষের সার্বিক ঐক্যে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হবেই। অপেক্ষা ৮ জানুয়ারী ২০২০।