ডিসেম্বর ৯, ২০১৯ তারিখ ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক দিন হয়ে থাকবে। একদিকে সংসদে এই দিন যেমন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশ এবং পাশ করানো হয়, ঠিক ওই দিনেই ‘ পাহাড় থেকে সাগর’ এই পদযাত্রার সমাপ্তি হয় কলকাতার রানী রাসমণি রোডের হাজার হাজার মানুষের সমাবেশের মধ্যে দিয়ে। যে পদযাত্রা শুরু হয়েছিল দার্জিলিং জেলা থেকে সেই লড়াই যখন একটা পর্যায় অতিক্রম করে সাগর পাড়ে কলকাতায় সমাবেশের মধ্যে দিয়ে শেষ হচ্ছে, সেই সময়েই কিন্তু লোকসভায় ২৯৩ জন সাংসদ এই বিলের সপক্ষে ভোট দিয়েছেন। লড়াইটা তবু শুরু হয়ে গেছে। নাগরিকের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে নাগরিকদের।
এটা মনে করিয়ে দেওয়া জরুরী যে গণতন্ত্রে নাগরিকদের হাতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা থাকে। সরকার যদি মনে করে যে তাঁরা সর্বময় ক্ষমতার মালিক তাহলে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে যে যত বড় ক্ষমতার অধিকারী হোক না সরকার, মানুষই শেষ কথা বলে। তাই মানুষের সমাবেশে যারা উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁরাও এই কথাটা মাথায় নিয়েই আজ বাড়ি ফিরেছেন যে সরকারের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা করাটা আজ একান্তই সময়ের দাবি। সমাবেশে বক্তা হিসেবে যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুখ ছিলেন, এআইপিএফের পক্ষে কবিতা কৃষ্ণান, পদত্যাগী আইএএস অফিসার কান্নান গোপিনাথন, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিধায়ক আলি ইমরান রামজ, ইমতিয়াজ আহমেদ মোল্লা, নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্মী রঞ্জিত শূর, আদিবাসী বিকাশ মঞ্চের মিলন মান্ডি, জয় ভীম ইন্ডিয়া নেটওয়ার্কের পক্ষে শরদিন্দু, উদ্দীপন এবং যুব আন্দোলনের কর্মী ও মুখ কানহাইয়া কুমার।
প্রত্যেক বক্তাই এই বয়কট আন্দোলনকে একেবারে নিচু স্তরে নিয়ে যাওয়ার দিকে জোর দিতে বলেন। প্রত্যেকেই মনে করিয়ে দেন, সমস্ত লড়াই আসলে জেতার জন্য লড়া হয় না, কিছু লড়াই করতে হয় এটা জানান দেওয়ার জন্য যে কেউ তো ছিল যে সরকারকে জানান দিয়েছিল যে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। কান্নান গোপিনাথন বলেন যে প্রত্যেক ৪০ বছর পর দেখা গেছে যে কিছু মানুষকে রাস্তায় নামতে হয় গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্য, এখন সেই সময়টা এসেছে। এমারজেন্সির সময়েও কিছু যুবক আত্মবলিদান দিয়েছেন এখন আবার সেই সময়টা উপস্থিত হয়েছে, এই নাগরিকত্ব নিয়ে লড়াইয়ে নামাটা এখন সময়ের দাবি, কারণ পরবর্তী প্রজন্ম যদি প্রশ্ন করে, যখন এই ভাবে সংবিধানের উলঙ্ঘন করা হয়েছিল তখন আপনার নাগরিক হিসেবে কী ভুমিকা ছিল? তখন উত্তর দেওয়ার মতো উত্তর থাকবে তো?
কবিতা কৃষ্ণান বলেন যে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, যা কিনা দেশের আসল চাকরি না পাওয়ার সমস্যা, দ্রব্যমূল্য বাড়ার সমস্যার থেকে চোখ ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য পেশ করা হল, তার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে হবে। তিনি আরও বলেন যে যদি সরকার নাগরিকত্বের প্রমাণ চাইতে আসে তাহলে আপনার অঞ্চল থেকে ছোট ছোট স্তরে তার বিরোধ করাটা জরুরী। সরকার আসলে কম পয়সায় কিছু শ্রমিক তৈরি করবে এই নাগরিকপঞ্জী এবং সংশোধনী বিলের মধ্যে দিয়ে। প্রত্যেক নাগরিকের উচিত এই বিষয়ে সচেতন হওয়া, এবং সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন তিনি। “পেঁয়াজসহ আনাজের চড়া দাম, অর্থনীতির বেহাল দশা, কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়ে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ধর্ম, জাতি, ভাষার নামে বিভাজন করতে চাইছে”।
স্বাধীনতা সংগ্রামী রামপ্রসাদ বিসমিল ও আসফাকের ‘আত্মবলিদানে’র দিন ১৯ ডিসেম্বর তাঁদের বন্ধুত্বকে মনে রেখে দেশ জুড়ে এনআরসি- প্রতিবাদের ডাক দিলেন শেষ বক্তা কানহাইয়া কুমার। তিনি বলেন ‘সরকারের যদি সন্দেহ হয় আমরা অনেকেই এ দেশের নাগকির নই, আমরা অনুপ্রবেশকারী, তা হলে নাগরিক কি না, তা প্রমাণ করার ভার সরকারই নিক। আমরা কেন নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে যাব?’’ এনআরসি-র প্রথম ধাপ হিসেবে এনপিআর-এর জন্য সমীক্ষার কাজে সরকারি আধিকারিকেরা এলে জল খাইয়ে তাঁদের বিদায় দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। কানহাইয়ার কথায়, ‘‘দরজায় লিখে রাখবেন, পরের বার ১৫ লক্ষ টাকা নিয়ে আসতে! ওই টাকা অ্যাকাউন্টে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসেছিলেন।’’
সব বক্তার বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা গেছে যে এই নাগরিকত্ব নিয়ে লড়াই আসলে দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াই। প্রতিটি নাগরিককে তাঁর নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে বলার মধ্যে দিয়ে আসলে জল, জঙ্গল, জমি থেকে সেখানকার ভুমিপুত্রদের উৎখাত করতে চাইছে সরকার। সরকারের এই চক্রান্তকে বুঝতে হবে এবং অঙ্কুরেই বিনাশ করতে হবে। ১৯৪৭ সালের মধ্যরাতে ভারত স্বাধীন হয়েছিল আর ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে সেই স্বাধীনতা খর্ব করা হল। কিন্তু এ লড়াই দীর্ঘস্থায়ী লড়াই, এ লড়াই জেতার লড়াই। যদি সংসদের ৫৪৩ জন সাংসদও এর বিরোধিতা না করেন, তাও মানুষকে রাস্তায় নেমেই এর বিরোধিতা করতে হবে।