খবরা-খবর
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের শতবর্ষ প্রসঙ্গে আলোচনা

গত ২২ নভেম্বর সুবর্ণ বণিক সমাজ হলে কমিনটার্ন প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উপলক্ষে রাডিক্যাল পত্রিকার পক্ষ থেকে একটি আলোচনা সভা আয়োজিত হয়েছিল। এই আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল)- এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ, বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক শোভনলাল দত্তগুপ্ত, আরএসপি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পার্থসারথি দাশগুপ্ত এবং সিপিআই(এম)-এর শ্রীদীপ ভট্টাচার্য্য। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছিলেন অধ্যাপক কুনাল চট্টোপাধ্যায়।

অনুষ্ঠানের প্রথম বক্তা পার্থ ঘোষ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের আগে যে দুটি আন্তর্জাতিক কাজ করেছিল, সেই প্রসঙ্গর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। প্রথম আন্তর্জাতিকের মধ্যে মার্কস এবং এঙ্গেলস দুজনেই কাজ করেছিলেন এবং কমিউনিস্ট লীগ এর সূত্রে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো লেখার সময়েই তাঁরা দেখিয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আন্দোলনের একটি আন্তর্জাতিক চরিত্র আছে। পুঁজির চলাচল একটি আন্তর্জাতিক চেহারা অর্জন করেছে, সে পৃথিবীর এখানে সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছে অবিরাম আর সেই সূত্রেই শ্রমিকের মুক্তির প্রসঙ্গটির একটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। প্রথম আন্তর্জাতিক অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তুলনায় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সময়সীমা ছিল অনেকটা বেশি। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল আন্তর্জাতিকের সামনে একটি বড় পরীক্ষা এবং সেই পরীক্ষায় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যেকার বিভিন্ন শক্তি সঠিক মতাদর্শগত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হলো সেই সময় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে এমন কিছু প্রবণতা দেখা দিলো যে প্রবণতাগুলি বিভিন্ন দেশের শ্রমিক আন্দোলনের পারস্পরিক সংহতির একটি বিপরীত চেহারা নিল। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে থাকা বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব নিজ নিজ দেশের যুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকার ও বুর্জোয়াদের পক্ষে দাঁড়ালেন। এর ফলে বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের কার্যত রণাঙ্গনে পরস্পরের মুখোমুখি ঠেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। লেনিন আগাগোড়া দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের এই সুবিধা আত্মসমর্পণকারী প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছেন এবং রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি লেনিনের নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সাধারণ প্রবণতার বিপরীতে দাঁড়িয়েই রুশ বিপ্লব সম্পন্ন করেছিল।

বিশ্বযুদ্ধের সময় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে যায়। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা বজায় ছিল। লেনিন এবং তার সহযোগীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৯-এ তৃতীয় আন্তর্জাতিক শুরু হয় এবং ১৯৪৩ অবধি তা সক্রিয় ছিল। এই সময় বিভিন্ন দেশের বুর্জোয়াদের থেকে অভিযোগ উঠেছিল এই আন্তর্জাতিক হল একটি ইনফেকশন। লেনিন এর প্রত্যুত্তরে বলেন, এটি হল এমন এক মতাদর্শগত ইনফেকশান যা বিভিন্ন দেশে বুর্জোয়া শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের দৃষ্টিকোণ ও লড়াইকে শাণিত করার কাজ করছে।

পার্থ ঘোষ মনে করিয়ে দেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে গিয়েছিল, আর ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৃতীয় আন্তর্জাতিককে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের থেকেই ভেঙে দেওয়া হয়। এই সময়ে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের নির্দেশিকার মধ্যে ইউরোপ এবং সোভিয়েত কেন্দ্রিক নীতিমালার দিকটিকে সর্বজনীন করার প্রবণতার দিকটির সমস্যা নিয়ে আওয়াজ তোলেন কমরেড মাও সেতুং এবং চীনা বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় একটি নিজস্ব পথের ওপর জোর দেন।

পার্থ ঘোষ তাঁর বক্তব্যে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে তৃতীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক কি হবে তা নিয়ে একেবারে প্রথম থেকেই কমিন্টার্নের মধ্যে বেশ কিছু বিতর্কছিল। কমিন্টার্নের দ্বিতীয় অধিবেশনেই এই নিয়ে তার নিজস্ব দলিল দেন মানবেন্দ্রনাথ রায় এবং সেটি প্রস্তাবের মধ্যে গৃহীতও হয়। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ভারতের কমিউনিস্টরা ফ্যাসিবিরোধী জনযুদ্ধ এবং ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সংগ্রামের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে যে অনেকাংশে সমস্যায় পড়েছিলেন তার জন্য কমিন্টার্নের নির্দেশিকা বা তাকে বোঝার মধ্যে সমস্যা কতটা কি ছিল, তা এক জরুরি প্রশ্ন।

আলোচনা সভার শেষ বক্তা শোভনলাল দত্তগুপ্ত কমিন্টার্নের সঙ্গে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর বেশি জোর দেন। পার্থ ঘোষের তোলা প্রশ্নগুলিকে তিনি নানা দলিলের উল্লেখ করে সমর্থন করেন। এই বিশিষ্ট কমিন্টার্নের ইতিহাসবিদ কমিন্টার্নের আরেকটু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। ভারতের কমিউনিস্টদের অনেকেই সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ছিলেন। ভারতের মধ্যেও যোগ্য কমিউনিস্টরা কাজ করছিলেন। কিন্তু ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিকে খুব স্পষ্টভাবে বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশনা মেনে চলার কথা বলা হয়। এর ফলে বেশ কিছু সমস্যা যে তৈরি হয়েছিল তা নথিপত্র ভালো করে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় বলে শোভনলালবাবু মত প্রকাশ করেন।

international

 

খণ্ড-26
সংখ্যা-38