১ আগস্ট ২০২১ রাজ্য কর্মীসভায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটির প্রস্তাব সোৎসাহে গ্রহণ করে অভিজিৎ মজুমদারকে নতুন রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত করে এবং ধনঞ্জয় গাঙ্গুলি, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, ফারহান হোসেইন খান, স্বর্ণেন্দু মিত্র ও দেবব্রত ভক্ত — এই পাঁচজনকে রাজ্য কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে। রাজ্য পরিস্থিতির বর্তমান সন্ধিক্ষণে পার্টির কর্মকৌশল ও আগামি কর্মসূচি বিষয়ে কর্মীসভায় বিস্তারিত চর্চা হয়।
রাজ্য পার্টি সংগঠনের চারশত কর্মী এই সভায় অংশ নেন, এককভাবে জুম মিটিং রুমে এবং পার্টি অফিসগুলিতে সমবেতভাবে। কার্তিক পাল, অভিজিৎ মজুমদার ও জয়তু দেশমুখ সভা পরিচালনা করেন, আনুষঙ্গিক সহযোগিতায় ছিলেন মলয় তেওয়ারি, সৌভিক ঘোষাল ও মধুরিমা বক্সী। সভার শুরুতে অভিজিৎ মজুমদার শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন। এই পর্বে আমরা আমাদের যেসব সাথীবন্ধুদের হারিয়েছি, যেসব মানুষ অধিকারের লড়াইয়ে শহীদ হয়েছেন, আর যারা এই অতিমারীতে সরকারি অবহেলায় প্রাণ দিলেন তাঁদের সকলকে স্মরণ করে নিরবতা পালন করা হয়। সঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায় এবং তারপর ক্যাডার কনভেনশনের মূল প্রস্তাবনা পাঠ করেন জয়তু দেশমুখ।
পার্থ ঘোষ প্রস্তাবনার ওপরে আলোচনা করেন এবং রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে সাংগঠনিক প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি বলেন, ষাটের দশকে যেরকম বিপ্লবের প্রশ্নে মহাবিতর্ক হয়েছিল, আজও তেমন এক মহাবিতর্ক চলছে ফ্যাসিবাদের মোকাবিলার পথ নিয়ে। এই বিতর্কে আমাদের পার্টি সামনের সারিতে আছে। এই বিতর্ককে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কৃষকদের ওপর, শ্রমিকদের ওপর যে হামলা তার মোকাবিলা করতে হবে। এসব বলে তিনি রাজ্য কমিটিতে নতুন পাঁচজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা ও অভিজিৎ মজুমদারকে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব পেশ করেন।
সভায় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা নেতৃস্থানীয় কমরেডদের কোভিড অসুস্থতার জন্য বিশেষ সমস্যায় পড়ি। এই সমস্যার মোকাবিলা করে আমরা বিহার নির্বাচনের পর থেকে বিজেপি-বিরোধী বক্তব্যকে তুঙ্গে নিয়ে যাই। বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে কিছুতেই ক্ষমতায় আসতে দেওয়া যাবেনা, এই প্রচার ক্রমশ সাড়া ফেলে।
সিপিআই(এম) ছিল প্রাথমিকভাবে তৃণমূল বিরোধী এবং তার বিজেপি বিরোধিতা ছিল অনেকটাই আনুষ্ঠানিক। বিজেপি এবং তৃণমূলকে মিলিয়ে তারা ‘বিজেমূল’ নামক একটা কাল্পনিক পার্টির জন্ম দিয়েছিল। ওদের এই ভুল ওরা এখন স্বীকার করছেন। সেইসঙ্গে রাজ্যে সরকারকে, তার প্রকল্পগুলিকে যেভাবে ওরা নস্যাৎ করেছিলেন, সেটাও যে ভুল হয়েছিল, তাও ওরা মানতে বাধ্য হয়েছেন। সিপিআই(এম) অনেকটা ভোল বদল করছে জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা থেকে, জাতীয় রাজনীতিতে টিএমসির সাথে চলতে।
তবে সিপিআই(এম) ভুল স্বীকার করলেও আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা করার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেনি। আমরা প্রচারে সামনে এসেছি। কিন্তু আমাদের সাংগঠনিক শক্তির সীমাবদ্ধতা থেকে গেছে। সিপিআই(এম) আমাদের তৃণমূল সমর্থক বলে দাগিয়ে দিতে চায় এবং এভাবে আমাদের কথাকে বিকৃত করতে চায়। কেউ কেউ এতে প্রভাবিত হয়েছেন। আমাদের এই সংক্রান্ত চাপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আমরা থাকব। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মমতা কিছু উদ্যোগ নেবেন, সেগুলিকে আমরা কমবেশি সমর্থন করব, পাশে থাকব। পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু তৃণমূল সরকারকে প্রয়োজনে কাঠগড়াতে দাঁড় করানোতে আমরা দ্বিধা করবনা। আমরা এটা সিপিআই(এম) বা বিজেপির কায়দায় বলবনা, নিজেদের মতো করে যথাযথ সমালোচনা করব।
একুশের ডাক একটা অভিযান, এটা এখনো কোনও মঞ্চ নয়। এখানে বেশ কিছু তৃতীয় শিবিরের মানুষ, গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক, বামপন্থী মানুষদের আমরা পাচ্ছি। বড় বড় সেলিব্রিটিদের বদলে সাধারণ বুদ্ধিজীবীদের বেশি মাত্রায় একুশের ডাকে আনার চেষ্টা করতে হবে। গ্রাম মফস্বলের এই ধরনের মানুষদের কাছে আনার ওপর জোর দিতে হবে।
আমাদের গণসংগঠনগুলির উদ্যোগ বাড়ানোর দরকার আছে। আমাদের আদিবাসীদের নিয়ে, চা বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে, ছাত্রদের নিয়ে উদ্যোগের কিছু সুফল আমরা পাচ্ছি। আমাদের বেশ কিছু অনুসন্ধানের জায়গায় যেতে হবে। এইরকম অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে ঋণমুক্তি আন্দোলনে কিছু সাফল্য এসেছে। এরকম আরো অনুসন্ধান ও অনুসন্ধানভিত্তিক উদ্যোগ দরকার।
কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে আন্দোলন বাড়াতে হবে। একদিকে মৃতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ, অন্যদিকে স্বাস্থ্যের অধিকারের জন্য তলা থেকে আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।
সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে একটা বিরোধী ঐক্য গড়ার পর্ব চলছে। সিপিআই(এম)-এর থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে চায়। একে অতিক্রম করার চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব। আমরা সমস্ত অ-বিজেপি পার্টির ঐক্য বোঝাপড়ায় থাকতে চাইবো। এর মানে অ-বিজেপি সব পার্টিকে সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া নয়।
আমরা বাম শিবিরকে সিপিআই(এম)-কে বাদ দিয়ে দেখি না। যারা সিপিআই(এম)-কে বাম বলেই মনে করেনা, আমরা তাদের সঙ্গে একমত নই। সিপিআই(এম)-কে এখনই বামেদের মধ্যেকার ড্রাইভিং সিট থেকে সরিয়ে দেওয়ার জায়গায় আমরা নেই। তবে আমরা অন্যান্য নানা ছোট, মাঝারি বাম শক্তির সঙ্গে সমন্বয়ে যাচ্ছি। নতুন নতুন কাজের জায়গায় যেতে হবে। যেমন মহিলাদের মধ্যে এই নির্বাচন পর্বে যে জাগরণ ঘটেছে, সেই স্রোতকে ভেতরে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।”
সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের পর বিভিন্ন প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। ধনেখালি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী তথা যুব নেতা সজল দে ও ফাঁসিদেওয়া কেন্দ্রের প্রার্থী তথা চা-শ্রমিক নেত্রী সুমন্তি এক্কা নির্বাচনী সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ক্ষেতমজদুর ফ্রন্ট থেকে সজল অধিকারী, কৃষক ফ্রন্ট থেকে জয়তু দেশমুখ, ছাত্রফ্রন্ট থেকে স্বর্ণেন্দু, নীলাশিস, অন্বেষা, ফারহান, যুবফ্রন্ট থেকে অপূর্ব ঘোষ, মহিলা ফ্রন্ট থেকে ইন্দ্রাণী দত্ত, একুশের ডাক অভিযান থেকে মলয় তেওয়ারি, সামাজিক মাধ্যম বিভাগ থেকে মধুরিমা বক্সী, সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট থেকে নীতীশ রায় বক্তব্য রাখেন। কাজের অভিজ্ঞতা, পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ, সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনার কথা তাঁদের বক্তব্যে উঠে আসে।
সবশেষে নতুন রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে পার্টির রাজনীতি ও অনুশীলন পদ্ধতি প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখেন। নতুন পরিস্থিতিতে নতুন উদ্যমে জনগণের স্বার্থে লড়াই ও পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে কর্মীসভা সমাপ্ত হয়।