এবছরের ১৫ আগস্ট ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতের মুক্ত হওয়ার ৭৪ তম বছর। স্বাধীনতার পর শতাব্দীর তিন সিকি কাল পেরিয়ে এসেও কি ভারতবাসী সেই স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন তারা দেখেছিল? নিপীড়ন ও নৃশংস দমনের আইন আর লুটতরাজে খচিত ঔপনিবেশিক শাসনের ধারা থেকে স্বাধীনতা পেয়েছি কি আমরা?
এবছরের ৫ আগস্ট কমরেড সরোজ দত্তর হেফাজত হত্যার ৫০তম বছর। সরোজ দত্ত ছিলেন কবি ও সাংবাদিক এবং সিপিআই(এমএল) প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম, পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক ছিলেন তিনি। এবছরের ১২-১৩ আগস্ট কাশিপুর-বরানগর গণহত্যারও ৫০ বছর। কমরেড সরোজ দত্তকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আর তারপর ৫ আগস্ট ১৯৭১ ভোর রাতে কলকাতা ময়দানে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর এক সপ্তাহ পরেই কলকাতা সংলগ্ন কাশিপুর-বরানগরে ১২-১৩ আগষ্টের রাতে শাসক দলের কর্মী ও পুলিশের যৌথ বাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় ২০০ যুবককে নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করেছিল। এই নির্বিচার গণহত্যা সংগঠিত করা হয়েছিল সমগ্র তরুণ প্রজন্মকে সবক শেখানোর উদ্দেশ্যে, যে তরুণ প্রজন্ম নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যুত্থানে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। বাড়িগুলিকে ঘিরে ফেলা হয়েছিল, তারপর ঘরে ঘরে হানা দিয়ে পরিবারের বাকিদের চোখের সামনে তরুণদের টেনে বের করে কারও চোখ উপড়ে নেয়, কারও শিরশ্ছেদ করে ওরা।
পরের বছর, জুলাই ১৯৭২, সিপিআই(এমএল)-র সাধারণ সম্পাদক চারু মজুমদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ হেফাজতে অত্যাচারের পর ২৮ জুলাই ১৯৭২ কলকাতার লালবাজার লকাপে মৃত্যু হয় তাঁর।
তখনকার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, যার নাম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সমার্থক হয়ে গেছে, এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ঘোষণা করেন, “বাংলার জনতা জানতে চায় না কারা দোষী”। জনতা ভালো করেই জানত এই ঘাতকেরা কারা। একটা প্রজন্মকে অঙ্কুরে বিনাশ করার এই অপরাধের সুবিচার চেয়েছিল মানুষ। কিন্তু পরবর্তী কোনও সরকারেরই সৎসাহস হয়নি সত্যটা বলার।
রাষ্ট্র পরিচালিত এই নৃশংসতার প্রতিক্রিয়াতেই নবারুণ ভট্টাচার্যর একটি কবিতা ঘোষণা দিয়েছিল “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না/এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না/এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না/আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব”।
১৯৭০-এর কৃষক ও তরুণ প্রজন্ম প্রকৃতপক্ষে দেশকে মুক্ত করার লড়াই লড়ছিল, যেখানে দেশ মানে দেশের জনগণ, নিছক দেশের শাসকেরা নয়। সেইজন্য সেই আন্দোলনের সঙ্গীত হয়ে উঠেছিল “মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি” যেখানে ঘোষণা করা হয় “মহান ভারতের জনতা মহান – ভারত হবে জনতার”।
নিজের দেশকে ফিরে কেড়ে নেওয়ার লড়াই, প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করার সংগ্রাম বর্তমান সন্ধিক্ষণের মতো জরুরি বোধহয় আর কখনও হয়ে ওঠেনি। সংসদ ভবনকে ঔপনিবেশিক চিহ্ন হিসেবে ঘোষণা করে তাকে নতুন ইমারত দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার উদ্যোগ নিয়ে মোদি সরকার দেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৭৫ বছরকে উদযাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তা করতে গিয়ে দিল্লির চেহারা ধ্বংস করে বদলে দিচ্ছে। কিন্তু একইসাথে এই জমানা ঔপনিবেশিক যুগের রাজদ্রোহ সহ ঔপনিবেশিক ধারার সমস্ত গণতন্ত্র-বিরোধী অপ-আইনগুলিকে ঢালাও ভাবে প্রয়োগ করছে। এমনভাবে শ্রম আইন ও কৃষি আইন বদলে দেওয়া হচ্ছে যাতে শ্রমিকের ইউনিয়ন করার অধিকার ঔপনিবেশিক যুগের মতো করে কেড়ে নেওয়া যায় আর বৃহৎ কর্পোরেটদের কাছে কৃষকের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়া যায়।
মানুষের প্রতিবাদ, সাংবাদিকদের খোঁজখবর, মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিকের প্রশ্ন তোলা - সবই “রাজদ্রোহ” ও “এন্টি ন্যাশনাল” হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, গ্রেপ্তার করে ঔপনিবেশিক ধারার আইনে বছরের পর বছর বিনা বিচারে জেলবন্দি রাখা হচ্ছে। ইজরায়েলি সফটওয়্যার ব্যবহার করে বেআইনিভাবে গোপনে আড়িপাতা চলছে, এমনকি বিরোধী দলনেতা, সাংবাদিক, এক্টিভিস্ট, সুপ্রিম কোর্টের জাজ ও আর্মি অফিসার সহ সাধারণ মানুষকে ফাঁসাতে তাঁদের ডিভাইসে মিথ্যা তথ্য স্থাপন করা হচ্ছে। দেশ ও দেশের নাগরিকের স্বাধীনতা বোধহয় আগে কখনই এরকম বিপজ্জনক মাত্রায় খর্বিত হয়নি।
হিন্দু প্রভুত্ববাদীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দিবস ৫ আগস্টকে দিয়ে ১৫ আগষ্টের ঐতিহ্যকে ঢেকে দিতে চাইছে মোদি সরকার। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট মোদি সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০/ধারা বিলোপ করে জম্মু ও কাশ্মীরের সাথে ভারতের সাংবিধানিক যোগসূত্র ছিন্ন করেছিল এবং জম্মু ও কাশ্মীরের জনতাকে সার্বিকভাবে অধীনস্থ করেছিল। ২০২০-র ৫ আগস্ট মোদি সরকার রাম মন্দির বানানোর কাজ শুরু করে অযোধ্যায়, যেখানে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল হিন্দু প্রভুত্ববাদী দল।
১৯৪৭-এর ১৫ আগষ্টের প্রতিশ্রুতিকে ধ্বংস করার, সাংবিধানিক গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে ব্রিটিশরাজের কায়দায় হিন্দু প্রভুত্ববাদী শাসন কায়েম করার যে চক্রান্ত মোদি সরকার চালাচ্ছে তাকে রুখে দিয়ে দেশকে পুনরুদ্ধার করার অঙ্গীকার এই আগষ্টে ভারতের জনগণ আরেকবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ৩ আগস্ট ২০২১)