তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। চিদাম্বরম ১৯০৮’র ক্রিমিন্যাল অ্যাক্টের এক্সটেনসন করে ইউএপিএ দিয়ে মাওবাদীদের ব্যান করা নিশ্চিত করে ফেলেছেন। শোনা গেল, জয়সওয়াল, তৎকালীন কয়লামন্ত্রী বলছেন যে মুখ্যমন্ত্রী নাকি এই ব্যানের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ‘হ্যাঁ’ এ ‘হাঁ’ দিয়ে এসেছেন। কিন্তু কার্যত তিনি পলিটিক্যাল সলিউসনের কথা দলগতভাবে ভেবেছিলেন। মাও অ্যাক্টিভিস্টদের জন্য ব্যানের চেয়েও কার্যকরী রাস্তার কথা তখন বাংলা ভেবেছিল। এই সাবাশ অর্জনের ঠিক পরেই গৌর চক্রবর্তীকে ধরা হয় এবং ইউএপিএ দিয়ে বিশেষ সংস্থা দমনের ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করে অন্য রাস্তা দেখানোর অভিভাবকরা হঠাৎ গুলিয়ে দেন সব এক নিমেষে। সকলকে অবাক করে মুখ্যমন্ত্রীর আগের ঘোষণাকে ভুল প্রমাণ করে কমিশনার-অফ-পুলিশ গৌতম মোহন চক্রবর্তী জানিয়ে দেন যে, ভারতের আইন ভারতের সর্বত্র প্রযোজ্য বলে দুই মাও আক্টিভিস্টকে ধরা হয়। তাই ‘সরাসরি ব্যান ঘোষিত নয়’ বাংলার পথ সেই ভারতের আইনি সিদ্ধান্তের পথেই মেশে। জল গড়ায়। জেলবন্দীদের নিয়ে প্রতিশ্রুতি ও প্রতিশোধে কী বদল আশা করার ছিল? না, রাষ্ট্র এক ফর্মুলাতেই চলে। যদিও সাম্প্রতিক ৬৩ জনের মুক্তির ঘোষণানামায় কে কিসের ভিত্তিতে মুক্ত হচ্ছে তা কুয়াশা মোড়া। জেলবন্দীদের মুক্তিকে মেইনষ্ট্রিমের ভাবনায় জায়গা দিতে গেলে ও সেই অরবিটে গতি আনতে গেলে যা করার কথা তা নাগরিক সমাজকে মাথায় নিয়ে ঘুরতে হবে। কিন্তু তাদের তো নানা কাজ। নানা প্রায়োরিটিজ। নানা জটিল অঙ্ক। যাক, শেষমেশ শোভা মুন্ডাদের বন্ধ হয়ে যায় সংশোধনাগারে ফ্রেন্ডস মিটিং-এর অপশনটাও। কার্যত পরিবার ছাড়া কারও দেখা করার অনুমতি নেই ওদের। ভিনরাজ্যের বন্দীদের আবার শেকড় বিহীন অবস্থা। পরিবারের হাতটুকুও ছুটেছে। শুধু কেমন আছে শোভা সেটুকু জানাই দুরূহ। শোভার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা এরকম। উপরতলার অনুমতি ছাড়া কিছু জানা যাবে না। আর উপরতলার অনুমতি আদায় করা একরকম ‘না’ বরাবর। তবুও হোপ এগেইনষ্ট হোপ তো বেঁচে ও বাঁচিয়ে রাখার অমোঘ পাথেয়।
স্ট্যান স্বামীর জন্য আপনি ফেসবুক পোষ্ট লেখেন। প্রবন্ধ লেখেন। রাষ্ট্রীয় হত্যার বিরুদ্ধে গলা চিরে স্লোগানও দেন। কিন্তু আপনি শোভা মুন্ডাকে চেনেন না। নাম শুনেই পালিয়ে বাঁচেন। মাওবাদী কানেকশন? হ্যাঁ, এসবে আপনাকে থাকতে নেই। কারণ আপনি ফ্যামিলিম্যান ও আপনি একটি সরকারি চাকরি করেন। পাছে শোভা মুন্ডার নাম জেনে ফেললেও যদি আপনার কাঁচের বাড়িটায় ঢিল পড়ে যায়! আপনার কাল্পনিক ভয়ের কলেবর বাড়াতে আপনি কী সুন্দর কতগুলি উদাহরণের ইঁট সাজিয়ে ফেলে বলেন, সরকারি লোকদের বন্দীর মুক্তি চাইলে সরকার রুষ্ট হয়ে যাবে। আপনার এই যুক্তি আপনার পরের প্রজন্মকে পঙ্গু করছে। আপনার এই এসকেপিস্ট মানসিকতা ওদের মনের পরিসর ঘিঞ্জি করছে। ওরা দেখছে আপনি শোভা মুন্ডার নাম শুনেই সরকার টেনে এনে খাড়া করছেন। সরকারি চাকরি করা মানে নিজের মস্তিষ্ক ও নীতি বন্ধক রাখা নয়। নিজের কাজের সময়টুকুতে সৎ পরিশ্রম করা ও বিনিময়ে পারিশ্রমিক পাওয়া। স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর প্রতিবাদ আপনি করেছেন। ওতো দূরের ব্যাপার। দেখতে যাওয়ার দায় বর্তাবে না। তাই না? একজন অপর্না সেন ও কৌশিক সেনকে নিয়ত খুঁজে বেড়াই আমরা। ওদের হাতের মোমবাতিতেই আগুন দিতে চাই। কেননা ওই আলোটি আমরা নিজের মুখে চাই। একেবারেই স্ট্যান স্বামী আপনার কন্সার্ন নয়। আপনার কন্সার্ন একদম আপনি। যদি স্ট্যান স্বামীকে আপনি বোঝেন তো শোভা মুন্ডাকেও বোঝেন! বাড়ির পাশের প্রতিদিনের আপনার যাওয়া-আসার রাস্তায় পড়ে বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের লাল দেওয়াল। আপনি চেনেন। ওই লাল দেওয়ালে নজরুল আটক ছিলেন। বলেন এবং গর্ব করেন।
আর ওই দেওয়ালের পেছনে এক মহিলা দশ বছর আটকে আছে। আপনি জানেন না। কেননা শোভা মুন্ডার বন্দীত্ব আপনাকে বিচলিত করে না। কেননা আপনি নারী-পুরুষ বলে নয়, সকলের জন্য লড়েন। এই তো আপনার মত! তবে আপনি একজন ঘোরতর মিথ্যাবাদী। মহিলা জেলবন্দী নিয়ে আপনার সমস্যা হয়না। কেননা আপনি খুব ইনসেন্সিটিভ। এক মহিলা তার হাতখরচ ও অন্তর্বাসের জন্য আবেদন করে, সেটা পৌঁছালে নেওয়া হয় না। কারণ সে একটি বিশেষ ইজিমে বিশ্বাস করে। আপনিও করেন। হয়ত অন্য। তাই বলে মহিলাটিকেই আপনার বিবেক থেকে অদৃশ্য করে দিতে চান! স্ট্যান স্বামীকে শুধু কেন তবে রাষ্ট্রীয় হত্যা বলছেন? কেন সিভিল সোসাইটির নীরবতার অপরাধ বলছেন না? আমরা ক’দিন কাজে ছুটি নিয়ে ধর্নায় বসেছি? যখন স্ট্যান স্বামী ডায়ালিসিসের আবেদন করেও অনুমতি পাচ্ছিল না? কটা ওয়েবিনার করেছি এই মৃত্যু আটকাতে? কটা পোস্টার তৈরি করেছি ওনার মুক্তির আবেদনের জন্য? আমরা শোভা মুন্ডাকেও এভাবেই হারিয়ে ফেলবো হয়ত। এইরকম অনেক বন্দীকেই এক এক করে। একদিন আমাদের ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। তারাও স্ট্যান স্বামী আর শোভা মুন্ডার মতো জেলে পড়ে থাকবে বছরের পর বছর। সেদিন এভাবেই পথ দিয়ে সকলে হেঁটে যাবে। কেউ দল, কেউ সরকারি চাকরির দোহাই দিয়ে এদের নাম শুনে রাস্তা বদলে চলে যাবে। আপনার বিপদ শুধু আপনার একার হবে। কেননা এই স্বার্থপরতা আর বিভাজনের বীজ আপনি নিজেই বপন করে চলেছেন দিনের পর দিন। সেই পথ ধরে আপনার পরবর্তী প্রজন্ম এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে যে সে বিশ্বাস করবে দাসত্বই জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। বিশ্বাস করতে শিখবে যে রাষ্ট্রের ভয়ের জুজু খাড়া করে নিজেদের কাপুরুষত্বের পিঠ চাপড়ানোর নামই বুঝি জাতীয়তাবাদ। এদের কোনও ইজম থাকবে না। ছাতা থাকবে একটা। যা নিজেদের বাঁচানোর অস্ত্র বা আশ্রয় হবে। এরাই ঐক্যবদ্ধ সুন্দর সমাজের ক্ষতিকারক মেটেরিয়াল হয়ে উঠবে। শোভারা যা বিশ্বাস করে করেছে। রাষ্ট্রের হিসেবে সেটা ঠিক হোক, ভুল হোক, শোভা নিজের মতো করে লড়াই চালিয়ে গেছে। এরা সমাজের ভাঙা-গড়ার উদ্দীপক। এদের অবহেলা নয়, সুবিচার প্রাপ্য। শোভাদের এড়িয়ে যাওয়া চরিত্র ও নামগুলি মনে রাখুন। রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা থেকে এড়িয়ে যাওয়া মুখগুলি স্মরণে থাকুক। শোভা আমাদের সহনাগরিক। আসুন তারাই শোভার জন্য লড়ি যাদের জেলের ভয় আর চাকরি হারানোর ভয় নেই! হ্যাঁ, বিবেক আর মনুষ্যত্ব হারানোর ভয় আছে! আর আমরা মানুষকে মানুষ ভাবব এটাই সভ্যতার প্রথম ও প্রধান সত্য। তার রাজনৈতিক পরিচয়, তার লড়াইয়ের পথ। সেটা আজ নিষিদ্ধ, কাল হয়ত নিষেধাজ্ঞার বেড়া পেরিয়ে যেতেও পারে। তাই শোভা মুন্ডা কেমন আছেন জানব। হাজার বার জানতে চাইবো! ভাববো সব মহিলা ও অনান্য জেলবন্দীর কথা। কেননা কোনও মানুষের মুক্ত থাকা, স্বাধীন থাকা রাষ্ট্রের শর্তাধীন নয়। সংশোধনাগারও মানুষের মুক্তির পথ দেখানোর জন্য। উকিল, আইন, কোর্ট, বিচার মানুষের জীবন রক্ষার কবচ। এগুলিকে সুনিশ্চত করা নাগরিক দায়। শোভার অধিকারের লড়াইতে আপনি শামিল? স্পষ্টভাবে সঙ্গে আছেন? তো আসুন। সঙ্গে নেই? জোরে বলুন! আপনার অভিমত সম্মানের ও গুরুত্বের, যতক্ষণ আপনি নিজের ও অন্যের কাছে আপনার মত নিয়ে স্পষ্ট।
শোভার উকিল, যিনি শোভার যাবজ্জীবন হওয়ার কেসটি রাঁচি হাইকোর্টে লড়ছেন তাকে নয় বছরে কেউ একটি ফোনও করেনি। শোভা কেমন আছেন জানার কেউ নেই। সেটাই স্বাভাবিক। যে দেশে জিন্স পরার অপরাধে মেয়েদের প্রাণে মরে যেতে হয় সেখানে আবার বিপ্লবী শোভা! এবং মাথায় পুরুলিয়া, বাংলা, ঝাড়খন্ডে এতগুলি কেস। তাই স্বাভাবিকভাবেই সে ব্রাত্য। লকডাউনের আগে ডিসেম্বর মাসে ছিল শোভার শুনানির ডেট। বেলপাহাড়ির ভুলাভেদার আদিবাসি মেয়ে ক্ষেপির মধ্যে যে বিপ্লবের আগুন ছিল তা তাকে শোভা বানায় আর শোভাকে মানুষ হিসেবে দেখার চিরন্তন চোখ আমাদের শোভার কাছে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। হ্যাঁ, ছুটছি আমরা। শামিল হোন সকলে। ‘আমিও শোভা’ এই মিছিলের লাইনটা লম্বা হোক আরও। মহিলাদের মুক্তি, সংশোধনাগারের উদ্দেশ্য ও ভাবনাকে সফল করুক। সুবিচার মনুষত্বের মুক্তি ঘটাক। রাষ্ট্র জেলবাসীদের নিবিড় পরিচর্যায় আর একটু মানবিক হোক। অপরাধীকে নয় অপরাধকে ঘৃণা করার অভ্যস গড়ে তুলুক এই সমাজ।
- জিনাত রেহেনা ইসলাম