২০২১ পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে সিপিআই(এম)-এর পর্যালোচনা প্রসঙ্গে
CPIM review of elections

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক

পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের ফল ঘোষিত হওয়ার দু’মাস পর, সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পদক ও পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র ৭ জুলাই ফেসবুকে এক লাইভ সম্প্রচারে বক্তব্য পেশ করেন। পার্টি সংগঠন ও পার্টি পরিচালিত গণসংগঠনগুলির বিভিন্ন স্তরে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের ফলাফল ঘিরে দু’মাস ধরে যে পর্যালোচনা চলে, তার প্রেক্ষিতেই প্রায় দীর্ঘ দু’ঘণ্টা ধরে তাঁর এই ভাষণ। সুতরাং তাঁর এই ভাষণকে আসলে সিপিআই(এম)-এর নির্বাচনী পর্যালোচনাকে জনসমক্ষে তুলে ধরার এক প্রয়াস হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন পরবর্তী বিকাশমান পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে নির্বাচনী পর্যালোচনাকে উপস্থাপন করতে হয়েছে আর তাঁর এই অস্বাভাবিক দীর্ঘ বক্তৃতার এটি অংশত একটি কারণ। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পর্কে সিপিআই(এম)-এর নিজস্ব মূল্যায়ন ও পশ্চিমবঙ্গে এযাবৎ তাঁদের এই দুর্বলতম ফলাফলের কারণকে তাঁরা কীভাবে ব্যাখ্যা করেন তা জানার জন্যই শ্রোতারা অবশ্য বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাঁর এই ভাষণকে, নির্বাচন উত্তরকালে এক প্রকারের ডিগবাজি খাওয়া বলে সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক চর্চা হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি সমস্ত বক্তৃতাটি সত্যিই শুনে থাকেন, তাহলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে, স্বীকার না করা ও বহু প্রশ্নের উত্তরবিহীন তাঁর নীরবতা, কিছু কিছু প্রশ্নে তাঁর দেওয়া ব্যাখ্যা ও কিছু ভুল স্বীকার করাকে ছাপিয়ে অনেক বেশি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে এবং তাঁর দেওয়া উত্তরগুলি আরও নতুন কিছু প্রশ্নেরই জন্ম দিয়েছে মাত্র।

প্রথমে একবার তিনি বলেছেন, বিশেষত যেসব স্বীকারোক্তিগুলি সরকারিভাবে প্রথমবার করা হল, সেদিকে দ্রুত নজর ফেরানো যাক। ভাষণে পরিষ্কারভাবে কবুল করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে ২০০৮’র পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই তাদের ভোটের অংশ ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে চলেছে (পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের নিশ্চয় মনে থাকবে যে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের পর এটা ছিল প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন)। ঐ ক্ষয় (decline) সাংঘাতিক পর্যায়ে পৌঁছায় ২০১৯-এ যখন সিপিআই(এম) ও তার বামফ্রন্টের মিত্রেরা একটি মাত্র আসন জিততেই শুধু যে ব্যর্থ হয় শুধু তাই নয়, মিশ্র যেমনটি বলেছেন, কোনও একটি বিধানসভা ক্ষেত্রেও ভোটে এগিয়ে থাকতে সক্ষম হয়নি। আর, এদিক থেকে, ২০২১এ ২০১৯’র ধাঁচটিরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে যেখানে ২০১৯’র তুলনায় ১৩০টি আসনের মধ্যে ৯৪টিতে এবার সিপিআই(এম)-এর ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোটের ক্ষয় রোধ করতে, সিপিআই(এম) ২০১৬-তে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধে আর ২০২১-এ তদরিক্ত আইএসএফ বা আরএসএমপির সঙ্গেও জোট গড়ে তোলে। ২০১৯-এ কংগ্রেস সিপিআই(এম) থেকে এগিয়ে ছিল আর ২০২১-এ ‘বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ’এর সম্মিলিত জোটের মধ্যে একমাত্র আসনটি পেয়েছে আরএসএমপি। অন্যভাবে বলতে গেলে, এই জোটের কৌশল সিপিআই(এম)-এর ভাগ্য ফেরাতে আরও একবার ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে জোটসঙ্গী বাছাই করার প্রশ্নে মিশ্র কোন আলোচনা করেননি। তিনি কেবল ইঙ্গিত করেছেন যে নির্বাচনের সময় যে জোট গড়ে তোলা হয়েছিল পার্টি তা বজায় রাখতে ইচ্ছুক। যেটা আরও স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে তা হল সিপিআই(এম)-এর শোচনীয় কৌশলগত বিপর্যয়ের বিষয়ে এবং তাঁরা যে বিকল্প সরকার গঠনের প্রচার চালিয়ে একটাও আসন জিততে ব্যর্থ হয়েছেন সে সম্পর্কে তাঁর নীরবতা।

প্রাসঙ্গিক শব্দবন্ধ (keyword) হিসেবে ভাষণে উঠে এসেছে মেরুকরণের কথা যা অবশ্যই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়নি, বোঝাতে চাওয়া হয়েছে বিজেপি ও টিএমসি’র মধ্যে রাজনৈতিক বা নির্বাচনী মেরুকরণকে। নিশ্চিতভাবেই এই মেরুকরণকে প্রবল করে তোলার জন্য যথার্থভাবেই প্রধানধারার সংবাদমাধ্যমগুলির উপর দোষারোপ করা হয়েছে আর সেজন্য কোনও তৃতীয় শক্তির প্রধান সংবাদ মাধ্যমে স্থান করে নেওয়াও যে কঠিন ছিল তা বলা হয়েছে। বস্তুত, মেরুকরণটা কোনও নতুন বিষয় নয়, নতুন যা তা হল, জাতীয় স্তরে ও অধিকাংশ রাজ্যে প্রধানধারার সংবাদমাধ্যমগুলির আনুকূল্যে বিজেপির সম্পূর্ণ বা একমুখী আধিপত্য ভোগ করা। পশ্চিমবঙ্গ বরং কিছুটা ব্যতিক্রম যেখানে, অন্তত মূদ্রণ মাধ্যমের একটা বড় অংশের মধ্যে বিজেপি এখনও পর্যন্ত এজাতীয় কোনও সুবিধা করে উঠতে পারেনি।

পশ্চিমবঙ্গে যে স্তরের মেরুকরণ ২০১৯এ প্রকট হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনার থেকেও বেশি জরুরী হল এই মেরুকরণ রুখতে সিপিআই(এম) কী করেছে তা খতিয়ে দেখা। জনমনে গড়ে ওঠা দুই মেরুর ধারনাকে উড়িয়ে সিপিআই(এম) তাকে একটিই মেরু হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছে। আর ‘বিজেমূল’ (বিজেপি + তৃণমূল) বলে একটা গালভরা নামও তারা হাজির করেছে এবং বারংবার দুটি মেরুকে সমতুল বলে গেছে এবং নিজেকেই একমাত্র বিকল্প হিসেবে তুলে ধরেছে। ২৮ ফেব্রুয়ারীর সমাবেশের প্রেক্ষাপট এটাই ছিল যেখানে খোলাখুলি এবং উচ্চস্বরে বলা হয়েছিল, “আমরাই বিকল্প, আমরাই ধর্মনিরপেক্ষ, আমরাই ভবিষ্যৎ”।

বাস্তবে ভোটের ফলে জোরদার মেরুকরণের চিত্রই ধরা পড়েছে যেখানে টিএমসির ভোটের পরিমাণ ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে আর মাত্র ২ শতাংশ ভোট কমলেও, বিজেপির প্রাপ্ত ভোটও কমবেশি একই থেকেছে। আর এ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, মেরুকরণ মোকাবিলায় সিপিআই(এম)-এর রণনীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। একটি ফ্যাসিবাদী দল বিজেপি যদি দুটি মেরুর অন্যতম হয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিরোধিতাই সিপিআই(এম)-এর প্রাথমিক অবস্থানে থাকার কথা। মিশ্র শ্রোতাদের বলেছেন যে ২২ বছর আগেই সিপিআই(এম) ঘোষণা করেছিল যে বিজেপিকে অন্য কোন দলের সঙ্গে সমান দেখানো বা এক বন্ধনীতে রাখা যায় না। তাহলে সিপিআই(এম)-এর অন্যতম মজবুত ঘাঁটি — ৩৪ বছর যেখানে দল ক্ষমতায় থেকেছে সেই পশ্চিমবঙ্গে এত বছর ধরে টিএমসি’কেই কার্যত প্রধান শত্রু মনে করা হল কীসের ভিত্তিতে? তিনি আমাদের শুনিয়েছেন কীভাবে বিজেপি বা আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে টিএমসি গঠনে উৎসাহ দিয়েছে এবং ২০১৯ পর্যন্ত তারা আসলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মিত্র হিসেবে কাজ করে এসেছে।

তাহলে ২০১৯-এ ঠিক কী বদলে গেল? মোদী সরকার উপর্যপুরি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এল এবং তার ফ্যাসিবাদী প্রকল্পগুলিকে এত দ্রুত ও আগ্রাসী রূপে চাপিয়ে দিতে চাইল যে সমগ্র দেশ ও দুনিয়ার সজাগ দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ হল। অপারেশন কাশ্মীর ও রামমন্দির থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব আইনের বিভেদমূলক সংশোধন এবং নয়া কৃষি আইন ও কর্পোরেট স্বার্থে শ্রমকোডগুলি চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মোদী সরকার ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতকে এক ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার আরএসএস’র স্বপ্নকে তীব্র গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ২০১৯’র পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনের লক্ষ্য হয়েছে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে হটানো কিম্বা তাকে পরাস্ত করা। এই বুনিয়াদী সত্যকে দেখতে না পাওয়া ও বিজেপি বিরোধী এক দৃঢ় অবস্থান গ্রহণে সিপিআই(এম)-এর ব্যর্থতাই আসলে টিএমসিকে বিজেপি বিরোধিতার পরিসরটাকে প্রায় এককভাবে দখল করে নিতে সাহায্য করেছে ও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার রেশকে প্রতিহত করতে ও ভোটের পরিমাণকে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে নিতে সমর্থ করে তুলেছে।

এই বিজেপি-বিরোধী মেরুকরণ পরিষ্কারভাবে বোধগম্য, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে যেখানে কোনও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে রাজ্য বিজয়ের লক্ষ্যে বিজেপির ঝাঁপিয়ে পড়ার পর। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে জিতলে তার পরিণাম কী ভয়ানক হতে পারে সারা দেশ তা বুঝেছিল। দিল্লী কৃষক আন্দোলনের নেতারা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচকদের কাছে বিজেপিকে পরাস্ত করার উদ্দীপ্ত বার্তা দিতে ছুটে এসেছিলেন এরাজ্যে। বাংলার বাম ও উদারপন্থী শিবিরের বড় অংশও বিজেপিকে প্রতিহত করার প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করেছিল। এই সমবেত উৎকণ্ঠারই প্রতিফলন ঘটেছে নির্বাচনী ফলাফলে এবং (পশ্চিমবঙ্গে) ক্ষমতায় আসার বিজেপির আগ্রাসী প্রচেষ্টা নির্ধারকভাবে ধাক্কা খাওয়ায় সারা দেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। অন্তত সাময়িকভাবে হলেও সমগ্র পূর্ব ভারত ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে আধিপত্য কায়েমের লক্ষ্য হাসিল করার বিজেপির পরিকল্পনাকে রুখে দেওয়া গেছে।

বাংলার ফলাফল নিয়ে হর্ষ প্রকাশ করার সময় অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক সিপিআই(এম)-এর খারাপ ফলকে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাজিত করার বৃহত্তর লক্ষ্য পূরণে গুণে দেওয়া মাশুল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনা যেন পূর্ব হতেই স্থিরীকৃত। নিশ্চিতভাবেই সিপিআই(এম) কোনও মাশুল গুণে দিতে চায়নি এবং এত চড়ামূল্য রোধ করাও সম্ভব ছিল। এমন এক রাজ্য যেখানে পার্টি মাত্র দশ বছর আগেও বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ছিল সেখানে সিপিআই(এম) আবার নেতৃত্বকারী না হোক, গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী পক্ষ হিসেবে উঠে আসবে — এমন ভাবাটাও দুষ্কর। মেরুকৃত ভোটের আবহেও সিপিআই(এম) রাজস্থানে কয়েকটি আসন জিতে এসেছে, সিপিআই(এমএল) ২০১৫-তে বিহারে তিনটি আসন জেতে এবং আরো সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডে অত্যন্ত মেরুকৃত নির্বাচনেও আসন জিতেছে। একটি কমিউনিস্ট পার্টির নিচুতলায় যদি শক্তিশালী কাজের এলাকা থাকে এবং প্রধান প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এক লড়াকু শক্তি বলে পরিগণিত হয়, তাহলে রাজ্যব্যাপী মেরুকরণকে সে স্থানীয়স্তরে অগ্রাহ্য করতে পারে ও কয়েকটি আসনে জেতার মতো তার ভালোই সুযোগ থাকে। এটা শুধু কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রেই নয় পরন্তু ছোট পার্টিগুলির পক্ষেও সাধারণভাবে প্রযোজ্য। এই প্রশ্নে মিশ্র ও পট্টনায়েক — কেউই আলোকপাত করেননি।

মিশ্র আমাদের বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন, ২০১৯ পর্যন্ত টিএমসি যে বিজেপির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলছিল সে প্রশ্নে সিপিআই(এম)-এর মূল্যায়ন সঠিক ছিল কিন্তু পরবর্তীতে বদলে যায়। টিএমসি ঠিক কী করেছিল যা সিপিআই(এম) অনুমান ও মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়? প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেড়ে ওঠা ক্ষোভকে মোকাবিলা করতে টিএমসি মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য নবতর পদক্ষেপ নিতে থাকে এবং বিজেপি বিরোধী ভাবমূর্তি তৈরি করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। সিপিআই(এম) টিএমসি সরকারের জনমোহিনী প্রকল্পগুলিকে চুরি ও ভিক্ষা প্রদান বলে তাচ্ছিল্য করে চলে এবং টিএমসি ও বিজেপিকে সমার্থক বলে দেখিয়ে চলে, এমনকি যদি ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হয় সেখানে টিএমসি-বিজেপির সরকার গড়ে উঠতে পারে বলে প্রচার চালায়।

পরিস্থিতির এমন নিকৃষ্ট ভুল ব্যাখ্যার পিছনে আরও গভীরতর কারণ রয়েছে। ক্ষমতা হারানোর পর পরিস্থিতির মুখোমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে সিপিআই(এম)-এর মৌলিক উদাসীনতা ও অক্ষমতা প্রকট হয়ে ওঠে। প্রথমত বোঝা দরকার সিপিআই(এম)-এর দীর্ঘ, নিরবচ্ছিন্ন রাজত্বের অবসান ঘটাটা কোনও ষড়যন্ত্রের ফল নয়। পার্টি গুরুতর কয়েকটি ভুল করে এবং জনগণের প্রভূতভাবে মোহভঙ্গ হয় এবং তাদের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্খা জেগে ওঠে। বস্তুত, মিশ্রও তাঁদের ক্ষয় ২০১১-তে নয়, ২০০৮ থেকেই শুরু হয়েছিল বলে এখন চিহ্নিত করছেন যদিও পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম) ২০০৮কে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের প্রেক্ষিতে দেখতে রাজী নয় এবং ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির কারণ দেখিয়ে ইউপিএ সরকার থেকে বামফ্রন্টের সমর্থন প্রত্যাহার ও পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-টিএমসি জোট গড়ে ওঠাকেই এর কারণ হিসেবে দেখে থাকে।

এই সত্যকে বোঝা দরকার, টিএমসি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের উপর ভর করে ক্ষমতায় আসে এবং যে গ্রামের গরিব, গ্রামীণ ও শহুরে বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন বামদের দীর্ঘদিনের সমর্থক তাদের বড় অংশকে পক্ষে নিয়ে আসে —যেখানে প্রত্যয় জেগে ওঠে যে একটি আঞ্চলিক দলের পরিচিত কক্ষপথেই সরকার পরিচালিত হবে না — অন্তত বিজু জনতা দলের নবীন পট্টনায়েকের পথে তো নয়ই। ইতিহাসের পরিহাস, টিএমসি যেক্ষেত্রে বিজেপি-বিরোধী অবস্থান ধ্বনিত করতে বাধ্য হয় সিপিআই(এম) সেখানে তার বিজেপি-বিরোধী তীক্ষ্ণতাকে লঘু করে ফেলে আর এভাবেই বিজেপি-বিরোধী ভোটকে টিএমসির প্লেটে সাজিয়ে দেয়। এরসাথে সাথে সিপিআই(এম)-এর অন্ধ টিএমসি বিরোধী শক্তিগুলি লাগাতার বিজেপির দিকে চলে যাওয়ায় সিপিআই(এম)-এর ৪০ শতাংশ ভোট প্রাপ্তির সুউচ্চ অবস্থান মাত্র ৪ শতাংশে নেমে আসে।

সে যাই হোক, এটা দেখেও ভাল লাগে, সিপিআই(এম) এই বাস্তবকে স্বীকার করছে যে কোথাও তাদের কোনভাবে ভুল হয়ে গেছে। আর সবটুকুকেই সাংগঠনিক ঘাটতি না বলে রাজনৈতিক-কৌশলগত ফাঁক থাকার কথাও মেনে নেওয়া হয়েছে। শুধুই কি বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার বিকাশমান রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে জাতীয় রাজনীতিতে সিপিআই(এম)-কে টিএমসির সঙ্গে একসাথে চলতে হবে? নাকি পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তিত বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে বাম পুনরুত্থান ঘটানোর স্বার্থে সত্যিকারের কোন প্রচেষ্টা চালানো হবে? শেষোক্ত বিষয়টি ঘটাতে হলে গভীরতর আত্মানুসন্ধান ও ভুল পথের সংশোধন প্রয়োজন। আর সেজন্য আরও বিনম্রতা বাঞ্ছনীয়। যে ঔদ্ধত্য নিয়ে সিপিআই(এম)-এর মুখ্য সামাজিক মাধ্যম বাহিনী বৃহত্তর বাম ও গণতান্ত্রিক মহল থেকে ওঠা পৃথক মতকে আক্রমণ ও কদর্য ভাষায় ব্যঙ্গ করেছে তা তো সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে পার্টির সেই দম্ভেরই পুনরাবৃত্তি যার পরিণামস্বরূপ বামফ্রন্ট সরকারেরই পতন ঘটে। সামনের দিনে সিপিআই(এম) কি আরও সতর্ক হবে?

খণ্ড-28
সংখ্যা-29