চাকরি পাওয়া এখন ভাগ্যের ব্যাপার। নয়া উদারবাদী নীতি অনুসরণের কারণে কাজের বাজারে আকাল। তার ওপর লেগেছে অতিমারীর আগুন। সহসা কোনও আশার দরজা খুলছে না। কোথাও কখনও নিয়োগের ক্ষেত্র তৈরির খবর মিলছে তো সেখানে লেগে যাচ্ছে তীব্র প্রতিযোগিতা। কল্পনাতীত অসম প্রতিযোগিতা। এরই এক হালফিল চিত্র পাওয়া গেল কলকাতার এক নামী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সবচেয়ে নিচের স্তরের হাতে গোণা কয়েকটা পদে কর্মী নিয়োগকে কেন্দ্র করে। যেক্ষেত্রে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়োজন হয় না, সেখানে ভীড় করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শুরু করে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা প্রার্থীরা। এরাই ছিলেন সংখ্যায় বেশি। এদের কর্মপ্রার্থী হওয়ার মধ্যে অবশ্যই এক সাবেক গোঁড়া মানসিক গড়ন ভাঙার প্রকাশ ঘটেছে, তা হল কোন কাজ ছোট মনে না করা। ভাবনায় রূপান্তর ঘটছে তীব্র বেকারির জ্বালা-যন্ত্রণার জেরে। শিক্ষাগত কাঠখড় পোড়ানো আর অগ্নিমূল্যের বাজারের তুলনায় বেতন কাঠামো অপ্রতুল হলেও চাকরি জুটছে, সরকারি চাকরি। উপরোক্ত ঘটনার চেরাই করলে ইতিবাচক ওইটুকুই। আর যা কিছু উন্মোচিত হল সবই নেতিবাচক। প্রথমত, যে চাকরি যে অংশের পাওয়ার কথা তারা তা পেলেন না, ছিটকে গেলেন তীব্র অসম যোগ্যতা-পরীক্ষায়, আর যে অংশ পেলেন তাদের কি প্রাপ্য এটুকুই মাত্র! শিক্ষাগত নিরিখে তাদের প্রত্যাশার পারদ আরও কি বেশি চড়া স্বাভাবিক নয়? চাকরির বাজারে এই নিদারুণ সংকট ও চূড়ান্ত অসঙ্গত অবস্থা চলছে। এই দুরবস্থার জন্য দায়ি কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার উভয়েই।
প্রবণতা হিসেবে নয়া উদারনীতির ভারত বিশ্বায়িত ভারত কর্মসংস্থানের নিবিড়তার প্রয়োজনকে বিভৎসভাবে কচুকাটা করেছে। কাজের বাজারে ফোয়ারা তোলা বলতে কেবল আইটি সেক্টর। মোদী সরকারের মতিগতিতে প্রাধান্য কেবলই ডিজিটাল ভারত। সরকারি-বেসরকারি, সংগঠিত-অসংগঠিত, সমস্তক্ষেত্রেই কাজ উধাও হয়ে যাচ্ছে অনবরত। মোদী জমানা বেকারি সৃষ্টিতে সাড়ে চার দশকের রেকর্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্তক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলগ্নী ও বেসরকারি করণে নজীরবিহীন মাত্রায় ক্রুরতার দ্রুততার পরিচয় দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ কোনও বিচ্ছিন্ন রাজ্য নয়। বিভিন্ন রাজ্যের মতো এরাজ্যেও কেন্দ্র পরিচালিত প্রতিষ্ঠান সমূহের ক্রমাগত দায় প্রত্যাহার, সংকোচন, অপসারণ বা হস্তান্তর হয়ে চলেছে; শুনিয়ে আসা হচ্ছে শুধু শুকনো প্রতিশ্রুতি। সদ্য সদ্য বিজেপির হয়ে বিধানসভা নির্বাচনী প্রচারে এসেও একই প্রতারণা করে গেছেন কেন্দ্রের মহামন্ত্রীরা।
রাজ্যের মমতা সরকারও ভিন্ন রাস্তা দেখাতে পারছেনা। প্রথম প্রথম শোনানো হোত ‘এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক’ গঠনের কথা, যাতে যোগ্যতার প্রমাণ সহ নাম লেখালে চাকরির সংস্থানের হদিশ মিলবে। জানার উপায় নেই গত একদশকে এরকম কত সংস্থান হয়েছে, কেননা এসংক্রান্ত তথ্য পরিসংখ্যান সরকার প্রকাশ করেনি। বেকারির হার বেড়ে চলেছে এখানেও। এই দুর্দশার চেহারা এখানকার পুরানো ও নতুন সব ক্ষেত্রেই। অতিমারীর স্থিতিতে লম্বা কঠোর নির্মম লকডাউন নীতি আরও বহুগুণ কেড়েছে কাজের সুযোগ। সরকার যতই ধামাচাপা দিয়ে চলুক ভয়াবহ সত্য প্রকাশ হয়েই যাচ্ছে। সিএমআইই রিপোর্ট বলছে, রাজ্যে বেকারির হার ২০২১’র মে মাসে ছিল ১৯.৩ শতাংশ, জুন মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২.১ শতাংশ। গত একদশকে সর্বোচ্চ। মহিলা বেকারির হার একুশের এপ্রিলে ছিল ৪৯.৮ শতাংশ। এই সময়ে সামগ্রিক শ্রমে অংশগ্রহণের হার ছিল ৪৬.৬ শতাংশ। পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশ নিচে। বেকারির হারে রাজ্যগুলোর মধ্যে বাংলা রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। ক্রমাবনতির এই অবস্থায় দীর্ঘ টালবাহানার পরে যদিও বা স্কুল শিক্ষা ক্ষেত্রে কয়েক হাজার শিক্ষক নিয়োগের পদক্ষেপ করা হল, তা আবার আদালতের গেরোয় আটকে গেল। ইন্টারভিউর জন্য মেধার ভিত্তিতে তৈরী তালিকা বারবার অভিযুক্ত হচ্ছে এমনতর সব অস্বচ্ছতার দায়ে যে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। দাঁড়াতে হচ্ছে কাঠগড়ায়। প্রায়শই হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্টের হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে পড়ছে, মুখ পুড়ছে সরকারের। তবু স্কুলের চাকরির দাবিতে শিক্ষিত যুবরা ধর্ণায় বসলে পুলিশ দিয়ে মেরে তুলে দেওয়া হয়। বহুকিছু যেমন এখনও পর্দার আড়ালে থাকছে, তেমনি পর্দা ফাঁসও হচ্ছে বহু; শাসকদলের দুর্নীতির, পক্ষপাত দুষ্টতার। গত নির্বাচনের পরিস্থিতিতে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে দলবদলের খেয়োখেয়িতে বেরিয়ে এসেছিল চাপা থাকা স্বজন পোষণের সত্যকথা। এক দলনেতা কোণঠাসা অবস্থায় দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হন। স্কুলের চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন যেমন ঘরের লোকদের, তেমনি দলের লোকজনদেরও। দল নেতাদের নির্দেশে, সুপারিশে। এ হল চাকরির আকালের দিনকালে সরকার আর শাসকদলের যোগসাজশের দৃশ্যমান শিলাখন্ড মাত্র।