আধুনিক বাংলা কবিতার একজন প্রথিতযশা বিশ্লেষককে ময়দানে নিয়ে গিয়ে পুলিশ হত্যা করেছিল, আজ থেকে ৫০ বছর আগে। ময়দানে সাজানো এনকাউন্টারে পুলিশ তাঁকে নির্মভাবে খুন করে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, আজও তিনি পুলিশের খাতায় নিখোঁজ। ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট মাঝ রাতে পুলিশ তাঁকে পার্টি সমর্থক অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
কমরেড সরোজ দত্তের মৃত্যুর ৫০ বছর অতিক্রান্ত হল। ছাত্রাবস্থা থেকে বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল ও কলেজ জীবন থেকেই তাঁর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ। ১৯৬৪ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে সরোজ দত্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-তে যোগ দেন। মুখপত্র দেশহিতৈষীতে তিনি নিয়মিত লিখতে থাকেন। নয়া সংশোধনবাদের তীব্র সমালোচনা ও নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে লেখার ফলে পার্টি অফিসে গুন্ডা কর্তৃক প্রহৃত হন। পার্টি আবার ভাগ হলে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-তে যোগ দেন।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ চারু মজুমদারের সঙ্গে নবগঠিত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন এবং মুখপত্র ‘দেশব্রতী’তে পার্টি লাইনের সমর্থনে ‘শশাঙ্ক’ ছদ্মনামে নিয়মিত লিখেছেন তিনি। সুশীতল রায়চৌধুরীর পরে সরোজ দত্ত হন পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ও দেশব্রতীর সম্পাদক।
তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরে কলকাতার ধর্মতলায়, কার্জন পার্কে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উদ্যোগে ৫ অগাস্ট স্মরণ ও প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। বাবুনি মজুমদারের গাওয়া উদ্বোধনী সঙ্গীত “শত শহীদের রক্তে রাঙা পতাকা আজ আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি” দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। সঞ্চালনায় ছিলেন জয়তু দেশমুখ। সরোজ দত্তের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করেন পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য কার্তিক পাল, হুগলি জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার, নদীয়া জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, কলকাতা জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী, উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, এআইসিসিটিউ সম্পাদক বাসুদেব বসু, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক নীতীশ রায় ও সভাপতি দেবাশিস চক্রবর্তী, মহিলা সমিতির নেত্রী চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, আইসা'র সংগঠক ও নেতৃবৃন্দ অন্বেষা, নীলাশিস বসু, স্বর্ণেন্দু মিত্র, রেলের বর্ষিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এন এন ব্যানার্জি প্রমুখ। এছাড়া আইপিসিএ-র অমিতাভ চক্রবর্তী পুষ্পার্ঘ অর্পণ করেন। চলমান কৃষক আন্দোলনে শহিদ ও কোভিডে মৃত শহীদদের উদ্দেশে নীরবতা পালন করা হয়।
এর পর ধর্মতলার লেনিন মূর্তির পাদদেশে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে বক্তব্য রাখেন বাসুদেব বসু। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৫ অগাস্ট ময়দানে কবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক ও সিপিআই(এমএল)-এর রাজ্য সম্পাদক কমরেড সরোজ দত্তকে পুলিশ হত্যা করে এবং সেই হত্যার বিচার তো দূর অস্ত, ৫০ বছর ধরে তাঁকে পুলিশের খাতায় ‘নিখোঁজ’ দেখানো হয়। ১৯৭২ সালে কমরেড চারু মজুমদারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ও নিজেদের হেফাজতে তিল তিল করে হত্যা করে। সেই হত্যার বিচার আজও হয়নি। স্ট্যান স্বামীকে সম্প্রতি রাষ্ট্রের হেফাজতে হত্যা করে সেই ধারাকে অব্যাহত রাখা হচ্ছে। তিনি ইউএপিএ আইন প্রত্যাহার এবং রাজবন্দি মুক্তির বিষয়েও সোচ্চার হন। কার্তিক পাল ভারত থেকে কোম্পানি রাজের খতমের ডাক দেন। নাট্যব্যক্তিত্ব দেবাশিস চক্রবর্তী সংস্কৃতির উপর রাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানুষকে একজোট হতে বলেন, একত্রিত না হলে কোনও মানুষ বাঁচতে পারবেন না। চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি কেন্দ্রের এনআরসি, এনপিআর ও নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করেন। মানুষকে অবৈধভাবে আটক রাখার আইন বাতিলের দাবিও জানান তিনি। এছাড়া আধার ও রেশন কার্ডের সংযুক্তির ফল নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, এর ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্যের নিরাপত্তা হারাবেন। শামিম আহমেদ কেন্দ্রের শ্রম আইনের বিরোধিতা করেন। নীলাশিস বসু বলেন, এখন এমন একটা অবস্থা যে, কোনও মানুষ দেশের স্বার্থে কথা বললেই তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, জেলে পোরা হচ্ছে। উত্তর প্রদেশের যোগী সরকার বামপন্থীদের সভা করতে দিচ্ছে না। দাঙ্গাকারীদের বাদ দিয়ে দাঙ্গা থামাচ্ছেন যাঁরা, পুলিশ তাঁদের তুলে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরছে, জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করছে, তাঁদের দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে জেলে রাখা হচ্ছে বছরের পর বছর। দেশদ্রোহ আইন আসলে ঔপনিবেশিক আইন, সেই আইন বাতিলের দাবি জানান নিলাশিস। সুজিত ঘোষও এই সব কালা আইনের বিরোধিতা করেন। অমিত দাশগুপ্ত বলেন, যাঁরা জমির অধিকার, জঙ্গলের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন, তাঁদের ঠাঁই হচ্ছে কারাগারে। গরিবের পক্ষে, শান্তির পক্ষে কথা বললেই রাষ্ট্র আটক করছে। সঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায়। সমাপ্তি সঙ্গীত গান শান্তনু ভট্টাচার্য।
দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি, নদীয়া, বাঁকুড়া জেলায় শহীদ সরোজ দত্ত স্মরণ কর্মসূচি পালন করা হয়। শিলিগুড়ির কর্মসূচিতে ছিলেন পার্টির নব নির্বাচিত রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, বাঁকুড়ার কর্মসূচিতে ছিলেন জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জী।