সম্প্রতি ইন্ডিয়া পলিসি ফোরামের একটি আলোচনাসভায় কেন্দ্রীয় অর্থসচিব জানিয়েছেন যে প্রায় সমস্ত সরকারি ব্যাঙ্ককে বেসরকারিকরণ করা হবে। ব্যাপারটা নিয়ে শোরগোল হওয়ার আশঙ্কায় সঙ্গে সঙ্গে খাবি খেয়ে তিনি যুক্ত করে দিয়েছেন যে এটা তাঁর ব্যক্তিগত মত, সরকারের নয়। ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। ব্যাঙ্ক শিল্পে বড়সড় পরিবর্তন ২০১৯ থেকেই শুরু হয়ে গেছে। ঐবছর আইডিবিআই ব্যাঙ্ক’কে সংকট থেকে উদ্ধার করার জন্য সরকার এলআইসি’র দ্বারস্থ হয়। ক্রমবর্ধমান এনপিএ’র কারণে বিপর্যস্ত এই ব্যাঙ্কটিকে উদ্ধার করার জন্য এলআইসি’কে ৫১ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করতে বাধ্য করা হয়। ২০২০’র এপ্রিল মাসে দশটি সরকারি ব্যাঙ্ক’কে একত্রিত করে (মার্জার) আরও বৃহৎ ও তথাকথিত শক্তিশালী চারটি ব্যাঙ্ক তৈরি করা হয়। ঐ বছরই নভেম্বর মাসে ৯৪ বছর পুরানো লক্ষ্মী নারায়ণ ব্যাঙ্ককে সংকট থেকে উদ্ধার করার জন্য সেটিকে বিদেশী সংস্থা ডিবিএস (ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক অফ সিঙ্গাপুর)-এর সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। এটি একটি অভুতপূর্ব ঘটনা কারণ এর মাধ্যমে ব্যাঙ্কিং শিল্পে বিদেশী পুঁজির প্রবেশ সুগম করে দেওয়া হয়। এরমধ্যে ইয়েস ব্যাঙ্ককে উদ্ধার করার জন্য এসবিআই’এর সাহায্য নিতে হয়। ইতিপূর্বে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রমোটারদের অবিমৃশ্যকারিতার জন্য পিএমসি (পাঞ্জাব এন্ড মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ) ব্যাংকের গ্রাহকদের কী হয়রানি হয়েছে (অনেকে আত্মহত্যা করেছেন) তা আমরা দেখেছি।
নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েও ব্যাংকের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কেন? তাহলে জানতে হয় ব্যাংকের মূল সমস্যা কী? সরকার বলবে সরকারি ব্যাংকের পরিষেবা ভালো না, কর্মচারীরা কামচোর, অফিসাররা দুর্নীতিগ্রস্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলিই সাধারণ মানুষের কাছে সর্বাধিক প্রচারিত এবং সেটাই কর্মচারী ও গ্রাহকদের মধ্যে সংগ্রামী সংহতি গড়ে তোলার অন্যতম বাধা। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে লাগামছাড়া অনুৎপাদক সম্পদ যেটার বৃদ্ধির জন্যও সরকার অফিসার, কর্মচারীদেরই দোষারোপ করে। ঘটনা হচ্ছে যে কোনও বৃহৎ ঋণ, ১০০ কোটির ওপরে, অত্যন্ত উচ্চপদস্ত আধিকারিক এবং সরকারি কর্তাব্যক্তি, মন্ত্রীদের যোগসাজশ ছাড়া হয় না। যে সব কোম্পানি বা কর্পোরেট সংস্থা এই ঋণগুলি নেয় তাদের সাথে প্রভাবশালী মহলের সম্পর্ক সুবিদিত। মাসের পর মাস এদের ঋণ অনাদায়ী হয়ে পড়ে থেকে, তা উদ্ধারের জন্য সরকারের মনোভাব নিতান্তই দায়সারা। আইডিবিআই ব্যাঙ্ক’কে এলআইসি’র হাতে তুলে দেওয়ার আগের বছর ঐ ব্যাংকের ৩০,০০০ কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ের কারণে ব্যাল্যান্স শিট থেকে মুছে ফেলা হয়েছে, যেটাকে বলে রাইট অফ; সেই ঋণ উদ্ধারের চেষ্টা কেন হল না; সেইসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন নেওয়া হল না? ২০২০ সালে বিবেক ভেলাঙ্কার নামে এক আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট অনুৎপাদক সম্পদ নিয়ে যাবতীয় তথ্য যোগাড় করে জানতে পারেন যে গত আট বছরে বারোটি সরকারি ব্যাঙ্ক ৬.৩২ লক্ষ কোটি ঋণ রাইট অফ করেছে, এরমধ্যে ২.৭৮ লক্ষ কোটি ঋণ বৃহৎ ঋণগ্রহিতা, যাদের ঋণের পরিমাণ ১০০ কোটির ওপরে। ভাবা যায়! অনেক ছোটাছুটি, অনুনয় বিনয় করে ব্যাঙ্কগুলি এদের থেকে মাত্র ৭ শতাংশ অর্থাৎ ১৯,২০৭ কোটি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। এর আগে অন্য লেখায় আমরা দেখেছি যে ২,৪২৬ সংস্থা থেকে ব্যাংকের পাওনা আছে ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা। বারবার আবেদন নিবেদন বিক্ষোভ আন্দোলন সত্ত্বেও এই টাকা উদ্ধারে সরকারের কোনও প্রচেষ্টাই নেই।
সরকারের একটাই দাওয়াই — বেসরকারিকরণ। দুটো ব্যাংকের ওপর কোপ প্রায় নিশ্চিত, মনে করা হচ্ছে একটি সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, আরেকটি ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক। দুটোর ওপরেই কিন্তু আরবিআই’এর নিষেধাজ্ঞা আছে, যেটাকে বলে পিসিএ (প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন)। কেন পিসিএ? না এক বছর আগেও দুটি ব্যাঙ্কই লাগাতার লোকসানে চলছিল এবং অনুৎপাদক সম্পদ বৃদ্ধি হচ্ছিল। লোকসানের ব্যাঙ্ক কে নেবে? আমাদের দেশের কর্পোরেট পুঁজি ঝুঁকি নিতে অপারগ, তৈরি রেডিমেড জিনিষ দাও হামলে পড়বে। সুতরাং ব্যাঙ্ক দুটির ব্যাল্যান্স শিট সাফসুতরো করতে হবে। এরজন্য নানা কল আছে। প্রথম হচ্ছে সরকার বাহাদুর বদান্যতা দেখাবে, সরকারি ব্যাংকের জন্য কুম্ভীরাশ্রু ফেলবে এবং নতুন করে তাতে টাকা ঢালবে! সেন্ট্রাল ব্যাংকে ৪,৮০০ কোটি, এবং আইওবি’তে ৪,১০০ কোটি। কিন্তু এতো বাস্কেট কেস, যা ঢালবে তা চুঁইয়ে নীচ দিয়ে পড়ে যাবে। বছর দুয়েক ঐ কোরামিনের জোরে লাভ করবে, তারপর আবার যে কি সেই!
আরেকটা কল আবার নিয়ে আসা হচ্ছে, অতীতেও ছিল, ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে — ব্যাড ব্যাঙ্ক। নাম থেকেই এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার, যত ব্যাংকের যত এনপিএ আছে তা এখানে সরিয়ে দেওয়া হবে। এ সেই শিবরাম চক্কোত্তির গল্পের মতো, রামের কাছ থেকে ধার নিয়ে একশো টাকা ফেরত দিতে পারছি না তো শ্যামের থেকে নিয়ে রামকে দিলাম; আবার শ্যাম যখন তাগাদা শুরু করলো তখন যদুর কাছে হাত পাতলাম, এইভাবে চলতেই থাকবে। তাহলে ব্যাঙ্ক এখন ঋণ মুক্ত, লাভও হচ্ছে। এবার দুটি ব্যাঙ্কই কোনও ধনকুবেরের মৃগয়াক্ষেত্র হবে, সাধারণ মানুষের হাজারো কোটি আমানত নিয়ে সে যেখানে খুশি বিনিয়োগ করবে, তার নিজের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠবে, ব্যাঙ্ক রুগ্নই থাকবে; অথবা বিদেশী সংস্থা ঢুকবে, সেই রাস্তা তো খুলেই দেওয়া হয়েছে। আর ব্যাড ব্যাঙ্ক এতো অনাদায়ী ঋণ কী করে উদ্ধার করবে? গুড ব্যাঙ্কই যখন পাওনা উদ্ধার করতে পারলো না তখন ব্যাড ব্যাঙ্ক কী করে পারবে? এরজন্য আর একটি কল আগে থেকেই ছিল, ‘ইনসলভেন্সি এন্ড ব্যাঙ্করাপ্টসি কোড’, ব্যাড ব্যাঙ্ক এই ধারাটির সাহায্য নিতে পারে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ভিডিওকন টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদির এক সময়ের বিখ্যাত ব্র্যান্ড। দেউলিয়া ঘোষণা করেছে, বাস্তবে হয়েছে কীনা সেটা সরকার তদন্ত করে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। বিভিন্ন ব্যাংকে কোম্পানির ৪৬,০০০ কোটি টাকা অনাদায়ী লোন, কিন্তু তারা হাত তুলে দিয়েছে, পয়সা নেই! মাত্র ৩,০০০ কোটি টাকায় সেটা বেদান্তকে বেচে দেওয়া হল। ভাবতে পারেন বাকি ৪৩,০০০ কোটি জলে, সাধারণ মানুষের টাকা! লুট চলছে, লুট! ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেবে, খারাপ হয়ে গিয়ে সেটা ব্যাড ব্যাংকে চলে যাবে, নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করবে, জলের দরে সেটা অন্য কেউ কিনে নেবে। এবার ভিডিওকন আর বেদান্তর মধ্যে কী লেনাদেনা হবে সেটা সম্পর্কে কারো কোনও ধারণা নেই।
উপরোক্ত দুটি ব্যাঙ্ক’কে বেসরকারিকরণের জন্য হয়তো এই বাদল অধিবেশনেই ব্যাঙ্কিং আইনের সংশোধনি আনা হবে। ইনসিউরেন্স বিজনেস আইনেও সংশোধনি হবে কারণ ফেব্রুয়ারিতে বাজেটে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে দুটি ব্যাঙ্ক ছাড়াও একটি বিমা সংস্থা বেসরকারিকরণ হবে। এক্ষেত্রে ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ইনসিউরেন্স-এর নাম বাজারে ভাসছে, অথচ এটি একটি অত্যন্ত লাভজনক সংস্থা। বীমা শিল্পের প্রধান ইউনিয়ন AIIEA এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে, “এর পরিবর্তে তিনটি প্রধান সরকারি বিমা সংস্থার সংযুক্তিকরণ করা হোক”। এই সংস্থা তামিলনাড়ু মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্যবীমা স্কিম এবং মহারাষ্ট্রের জ্যোতিবা ফুলে জনআরোগ্য যোজনা স্কিমের সঙ্গেও যুক্ত। বেসরকারি হয়ে গেলে এই স্কিমগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে তা পরিষ্কার নয়।
এলআইসি’র মতো সংস্থা যেটা প্রতি অর্থবর্ষে প্রায় ৩৫,০০০ কোটি টাকা মতো লাভ করে সেখান থেকেও টাকা উপার্জন করার জন্য উদগ্রীব সরকার। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও আস্থার প্রতীক এলআইসি, এর পরিষেবা নিয়েও সেরকম কোনও অভিযোগ নেই। জীবনবীমায় বিনিয়োগ করলে রিটার্ন কম, কিন্তু নিরাপদ। শুধুমাত্র এই নিরাপত্তার কারণেই ছাপোষা মানুষ কয়েক শতক ধরে জীবনবীমা করার জন্য এই সংস্থারই দ্বারস্থ হয়েছে। নতুন শতাব্দীর শুরু থেকে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলি আগমনের পরেও এখনো ব্যবসার প্রায় ৭৬ শতাংশ এই সংস্থার অধীনে। এখন সরকার ধাপে ধাপে এর ২৫ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যারমধ্যে অন্তত ৫ শতাংশ এই অর্থবর্ষে করার সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো একদিন এই নতুন সংস্থাগুলোও ভালো পরিষেবা দেবে, মানুষের আস্থা অর্জন করবে। কিন্তু একটি লাভজনক সংস্থা যেটি সম্পর্কে গুরুতর কোনও অভিযোগ নেই সেটির থেকে ব্যবসা ছিনিয়ে নিয়ে সরকারের প্রিয় সাঙাতদের বন্টন করা হচ্ছে কেন? এই ভাবেই ছক করে এয়ার ইন্ডিয়া, বিএসএনএল’কেও রুগ্ন করে দেওয়া হয়েছে।
সরকার বলছে তার টাকার দরকার। ব্যাঙ্ক, বীমা বেচে, বিপিসিএলের মতো কোম্পানি বেচে, এলআইসির শেয়ার বেচে সরকার অন্তত ১,৭৫,০০০ কোটি টাকা তুলতে চায় যা দিয়ে তারা নাকি গরীবের জন্য বাড়ি, স্কুল, রাস্তাঘাট ইত্যাদি তৈরি করবে। এদিকে অতিমারির সময়ে মানুষদের খাতায় নিয়মিত কিছু পয়সা দিতে বলুন, টাকা নেই; ফসলের লাভজনক মূল্য দিতে বলুন, টাকা নেই; লাগামছাড়া পেট্রোল, ডিজেল, সরষের তেলের দাম কমাতে বলুন, সরকার নিশ্চুপ। বারবার এটা ওটা বিক্রি করে যে টাকা তোলা হচ্ছে তা যে জনস্বার্থে কোথায় ব্যয় হচ্ছে তা কারোর জানা নেই, যদি না কেউ বলে সেন্ট্রাল ভিস্তা বা বুলেট ট্রেন এগুলোও জনগণের হিতার্থেই করা।
মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে সংযুক্তিকরণ, বেসরকারিকরণ ইত্যাদি হচ্ছে, এতে কী ব্যাঙ্ক পরিষেবা, ঋণ প্রদান বা কর্মচারীদের অবস্থার উল্লেখজনক কোনও উন্নতি হয়েছে? আমরা অনেকেই ব্যাংকের গ্রাহক, তিন বছর আগেকার পরিস্থিতি এবং আজকের মধ্যে লক্ষ্যনীয় কোনও পরিবর্তন কী বুঝতে পারছেন? টাকা তুলতে বা জমা দিতে এখনো কি আগের মতোই সময় লাগছে, ঋণ পেতে এখনো কি জুতোর শুকতলি খয়ে যাচ্ছে? বাজারে কান পাতুন দেখবেন মানুষ এখনো পরিষেবায় বিরক্ত; এখনো শহরের একটু বাইরে গেলেই দেখা যায় কোনো শাখায় দিনের পর দিন নেট থাকেনা, এটিএম বহু জায়গায় বিকল, চালু থাকলেও পয়সা থাকেনা। অতিমারীর ফলে সমস্যা আরও গভীর হয়েছে; স্টাফ সীমিতকরণ করা হয়েছে, যারফলে পরিষেবা ব্যহত হচ্ছে, ব্যাংকের বাইরে লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। কর্মাচারীদের ফ্রন্ট লাইন ওয়ার্কার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বারবার সরকারের কাছে দরবার করতে হচ্ছে, অথচ তাঁদের প্রতিনিয়ত গ্রাহককে পরিষেবা দিতে হচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে তাঁদের টীকাকরণেরও ব্যবস্থা করা হয়নি। সেন্ট্রাল ব্যাংকে ৩৩,০০০ কর্মচারী, আইওবিতে ২৬,০০০ কর্মচারী, এঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এতো কর্মী রাখতে নাকি সম্ভাব্য কোনও ক্রেতাই রাজি নয়। সুতরাং VRS এর প্রস্তাব আসছে। এর আগে বিভিন্ন ব্যাংকে চাপ দিয়ে VRS নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এবারও তাই হবে। গ্রাহক, কর্মচারী সরকারের তুঘলকি নীতিতে বলি হবে। ব্যাঙ্ক, বীমা উভয় ক্ষেত্রেই এই দুই প্রধান অংশীদার যদি সংঘবদ্ধ হয় একমাত্র তা হলেই এই ব্যবস্থাকে রুখে দেওয়া সম্ভব।
- সোমনাথ গুহ