আজকের দেশব্রতী : ৫ আগস্ট ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)

deshabrati 05-08-21

The Call of August 2021

এবছরের ১৫ আগস্ট ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতের মুক্ত হওয়ার ৭৪ তম বছর। স্বাধীনতার পর শতাব্দীর তিন সিকি কাল পেরিয়ে এসেও কি ভারতবাসী সেই স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন তারা দেখেছিল? নিপীড়ন ও নৃশংস দমনের আইন আর লুটতরাজে খচিত ঔপনিবেশিক শাসনের ধারা থেকে স্বাধীনতা পেয়েছি কি আমরা?

এবছরের ৫ আগস্ট কমরেড সরোজ দত্তর হেফাজত হত্যার ৫০তম বছর। সরোজ দত্ত ছিলেন কবি ও সাংবাদিক এবং সিপিআই(এমএল) প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম, পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক ছিলেন তিনি। এবছরের ১২-১৩ আগস্ট কাশিপুর-বরানগর গণহত্যারও ৫০ বছর। কমরেড সরোজ দত্তকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আর তারপর ৫ আগস্ট ১৯৭১ ভোর রাতে কলকাতা ময়দানে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর এক সপ্তাহ পরেই কলকাতা সংলগ্ন কাশিপুর-বরানগরে ১২-১৩ আগষ্টের রাতে শাসক দলের কর্মী ও পুলিশের যৌথ বাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় ২০০ যুবককে নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করেছিল। এই নির্বিচার গণহত্যা সংগঠিত করা হয়েছিল সমগ্র তরুণ প্রজন্মকে সবক শেখানোর উদ্দেশ্যে, যে তরুণ প্রজন্ম নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যুত্থানে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। বাড়িগুলিকে ঘিরে ফেলা হয়েছিল, তারপর ঘরে ঘরে হানা দিয়ে পরিবারের বাকিদের চোখের সামনে তরুণদের টেনে বের করে কারও চোখ উপড়ে নেয়, কারও শিরশ্ছেদ করে ওরা।

পরের বছর, জুলাই ১৯৭২, সিপিআই(এমএল)-র সাধারণ সম্পাদক চারু মজুমদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ হেফাজতে অত্যাচারের পর ২৮ জুলাই ১৯৭২ কলকাতার লালবাজার লকাপে মৃত্যু হয় তাঁর।

তখনকার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, যার নাম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সমার্থক হয়ে গেছে, এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ঘোষণা করেন, “বাংলার জনতা জানতে চায় না কারা দোষী”। জনতা ভালো করেই জানত এই ঘাতকেরা কারা। একটা প্রজন্মকে অঙ্কুরে বিনাশ করার এই অপরাধের সুবিচার চেয়েছিল মানুষ। কিন্তু পরবর্তী কোনও সরকারেরই সৎসাহস হয়নি সত্যটা বলার।

রাষ্ট্র পরিচালিত এই নৃশংসতার প্রতিক্রিয়াতেই নবারুণ ভট্টাচার্যর একটি কবিতা ঘোষণা দিয়েছিল “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না/এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না/এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না/আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব”।

১৯৭০-এর কৃষক ও তরুণ প্রজন্ম প্রকৃতপক্ষে দেশকে মুক্ত করার লড়াই লড়ছিল, যেখানে দেশ মানে দেশের জনগণ, নিছক দেশের শাসকেরা নয়। সেইজন্য সেই আন্দোলনের সঙ্গীত হয়ে উঠেছিল “মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি” যেখানে ঘোষণা করা হয় “মহান ভারতের জনতা মহান – ভারত হবে জনতার”।

নিজের দেশকে ফিরে কেড়ে নেওয়ার লড়াই, প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করার সংগ্রাম বর্তমান সন্ধিক্ষণের মতো জরুরি বোধহয় আর কখনও হয়ে ওঠেনি। সংসদ ভবনকে ঔপনিবেশিক চিহ্ন হিসেবে ঘোষণা করে তাকে নতুন ইমারত দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার উদ্যোগ নিয়ে মোদি সরকার দেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৭৫ বছরকে উদযাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তা করতে গিয়ে দিল্লির চেহারা ধ্বংস করে বদলে দিচ্ছে। কিন্তু একইসাথে এই জমানা ঔপনিবেশিক যুগের রাজদ্রোহ সহ ঔপনিবেশিক ধারার সমস্ত গণতন্ত্র-বিরোধী অপ-আইনগুলিকে ঢালাও ভাবে প্রয়োগ করছে। এমনভাবে শ্রম আইন ও কৃষি আইন বদলে দেওয়া হচ্ছে যাতে শ্রমিকের ইউনিয়ন করার অধিকার ঔপনিবেশিক যুগের মতো করে কেড়ে নেওয়া যায় আর বৃহৎ কর্পোরেটদের কাছে কৃষকের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়া যায়।

মানুষের প্রতিবাদ, সাংবাদিকদের খোঁজখবর, মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিকের প্রশ্ন তোলা - সবই “রাজদ্রোহ” ও “এন্টি ন্যাশনাল” হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, গ্রেপ্তার করে ঔপনিবেশিক ধারার আইনে বছরের পর বছর বিনা বিচারে জেলবন্দি রাখা হচ্ছে। ইজরায়েলি সফটওয়্যার ব্যবহার করে বেআইনিভাবে গোপনে আড়িপাতা চলছে, এমনকি বিরোধী দলনেতা, সাংবাদিক, এক্টিভিস্ট, সুপ্রিম কোর্টের জাজ ও আর্মি অফিসার সহ সাধারণ মানুষকে ফাঁসাতে তাঁদের ডিভাইসে মিথ্যা তথ্য স্থাপন করা হচ্ছে। দেশ ও দেশের নাগরিকের স্বাধীনতা বোধহয় আগে কখনই এরকম বিপজ্জনক মাত্রায় খর্বিত হয়নি।

হিন্দু প্রভুত্ববাদীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দিবস ৫ আগস্টকে দিয়ে ১৫ আগষ্টের ঐতিহ্যকে ঢেকে দিতে চাইছে মোদি সরকার। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট মোদি সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০/ধারা বিলোপ করে জম্মু ও কাশ্মীরের সাথে ভারতের সাংবিধানিক যোগসূত্র ছিন্ন করেছিল এবং জম্মু ও কাশ্মীরের জনতাকে সার্বিকভাবে অধীনস্থ করেছিল। ২০২০-র ৫ আগস্ট মোদি সরকার রাম মন্দির বানানোর কাজ শুরু করে অযোধ্যায়, যেখানে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল হিন্দু প্রভুত্ববাদী দল।

১৯৪৭-এর ১৫ আগষ্টের প্রতিশ্রুতিকে ধ্বংস করার, সাংবিধানিক গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে ব্রিটিশরাজের কায়দায় হিন্দু প্রভুত্ববাদী শাসন কায়েম করার যে চক্রান্ত মোদি সরকার চালাচ্ছে তাকে রুখে দিয়ে দেশকে পুনরুদ্ধার করার অঙ্গীকার এই আগষ্টে ভারতের জনগণ আরেকবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ৩ আগস্ট ২০২১)

saroj dutta

আধুনিক বাংলা কবিতার একজন প্রথিতযশা বিশ্লেষককে ময়দানে নিয়ে গিয়ে পুলিশ হত্যা করেছিল, আজ থেকে ৫০ বছর আগে। ময়দানে সাজানো এনকাউন্টারে পুলিশ তাঁকে নির্মভাবে খুন করে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, আজও তিনি পুলিশের খাতায় নিখোঁজ। ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট মাঝ রাতে পুলিশ তাঁকে পার্টি সমর্থক অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।

কমরেড সরোজ দত্তের মৃত্যুর ৫০ বছর অতিক্রান্ত হল। ছাত্রাবস্থা থেকে বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল ও কলেজ জীবন থেকেই তাঁর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ। ১৯৬৪ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে সরোজ দত্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-তে যোগ দেন। মুখপত্র দেশহিতৈষীতে তিনি নিয়মিত লিখতে থাকেন। নয়া সংশোধনবাদের তীব্র সমালোচনা ও নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে লেখার ফলে পার্টি অফিসে গুন্ডা কর্তৃক প্রহৃত হন। পার্টি আবার ভাগ হলে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-তে যোগ দেন।

নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ চারু মজুমদারের সঙ্গে নবগঠিত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন এবং মুখপত্র ‘দেশব্রতী’তে পার্টি লাইনের সমর্থনে ‘শশাঙ্ক’ ছদ্মনামে নিয়মিত লিখেছেন তিনি। সুশীতল রায়চৌধুরীর পরে সরোজ দত্ত হন পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ও দেশব্রতীর সম্পাদক।

তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরে কলকাতার ধর্মতলায়, কার্জন পার্কে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উদ্যোগে ৫ অগাস্ট স্মরণ ও প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। বাবুনি মজুমদারের গাওয়া উদ্বোধনী সঙ্গীত “শত শহীদের রক্তে রাঙা পতাকা আজ আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি” দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। সঞ্চালনায় ছিলেন জয়তু দেশমুখ। সরোজ দত্তের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করেন পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য কার্তিক পাল, হুগলি জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার, নদীয়া জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, কলকাতা জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী, উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, এআইসিসিটিউ সম্পাদক বাসুদেব বসু, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক নীতীশ রায় ও সভাপতি দেবাশিস চক্রবর্তী, মহিলা সমিতির নেত্রী চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, আইসা'র সংগঠক ও নেতৃবৃন্দ অন্বেষা, নীলাশিস বসু, স্বর্ণেন্দু মিত্র, রেলের বর্ষিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এন এন ব্যানার্জি প্রমুখ। এছাড়া আইপিসিএ-র অমিতাভ চক্রবর্তী পুষ্পার্ঘ অর্পণ করেন। চলমান কৃষক আন্দোলনে শহিদ ও কোভিডে মৃত শহীদদের উদ্দেশে নীরবতা পালন করা হয়।

এর পর ধর্মতলার লেনিন মূর্তির পাদদেশে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে বক্তব্য রাখেন বাসুদেব বসু। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৫ অগাস্ট ময়দানে কবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক ও সিপিআই(এমএল)-এর রাজ্য সম্পাদক কমরেড সরোজ দত্তকে পুলিশ হত্যা করে এবং সেই হত্যার বিচার তো দূর অস্ত, ৫০ বছর ধরে তাঁকে পুলিশের খাতায় ‘নিখোঁজ’ দেখানো হয়। ১৯৭২ সালে কমরেড চারু মজুমদারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ও নিজেদের হেফাজতে তিল তিল করে হত্যা করে। সেই হত্যার বিচার আজও হয়নি। স্ট্যান স্বামীকে সম্প্রতি রাষ্ট্রের হেফাজতে হত্যা করে সেই ধারাকে অব্যাহত রাখা হচ্ছে। তিনি ইউএপিএ আইন প্রত্যাহার এবং রাজবন্দি মুক্তির বিষয়েও সোচ্চার হন। কার্তিক পাল ভারত থেকে কোম্পানি রাজের খতমের ডাক দেন। নাট্যব্যক্তিত্ব দেবাশিস চক্রবর্তী সংস্কৃতির উপর রাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানুষকে একজোট হতে বলেন, একত্রিত না হলে কোনও মানুষ বাঁচতে পারবেন না। চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি কেন্দ্রের এনআরসি, এনপিআর ও নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করেন। মানুষকে অবৈধভাবে আটক রাখার আইন বাতিলের দাবিও জানান তিনি। এছাড়া আধার ও রেশন কার্ডের সংযুক্তির ফল নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, এর ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্যের নিরাপত্তা হারাবেন। শামিম আহমেদ কেন্দ্রের শ্রম আইনের বিরোধিতা করেন। নীলাশিস বসু বলেন, এখন এমন একটা অবস্থা যে, কোনও মানুষ দেশের স্বার্থে কথা বললেই তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, জেলে পোরা হচ্ছে। উত্তর প্রদেশের যোগী সরকার বামপন্থীদের সভা করতে দিচ্ছে না। দাঙ্গাকারীদের বাদ দিয়ে দাঙ্গা থামাচ্ছেন যাঁরা, পুলিশ তাঁদের তুলে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরছে, জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করছে, তাঁদের দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে জেলে রাখা হচ্ছে বছরের পর বছর। দেশদ্রোহ আইন আসলে ঔপনিবেশিক আইন, সেই আইন বাতিলের দাবি জানান নিলাশিস। সুজিত ঘোষও এই সব কালা আইনের বিরোধিতা করেন। অমিত দাশগুপ্ত বলেন, যাঁরা জমির অধিকার, জঙ্গলের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন, তাঁদের ঠাঁই হচ্ছে কারাগারে। গরিবের পক্ষে, শান্তির পক্ষে কথা বললেই রাষ্ট্র আটক করছে। সঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায়। সমাপ্তি সঙ্গীত গান শান্তনু ভট্টাচার্য।

দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি, নদীয়া, বাঁকুড়া জেলায় শহীদ সরোজ দত্ত স্মরণ কর্মসূচি পালন করা হয়। শিলিগুড়ির কর্মসূচিতে ছিলেন পার্টির নব নির্বাচিত রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, বাঁকুড়ার কর্মসূচিতে ছিলেন জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জী।

recruitment policy

চাকরি পাওয়া এখন ভাগ্যের ব্যাপার। নয়া উদারবাদী নীতি অনুসরণের কারণে কাজের বাজারে আকাল। তার ওপর লেগেছে অতিমারীর আগুন। সহসা কোনও আশার দরজা খুলছে না। কোথাও কখনও নিয়োগের ক্ষেত্র তৈরির খবর মিলছে তো সেখানে লেগে যাচ্ছে তীব্র প্রতিযোগিতা। কল্পনাতীত অসম প্রতিযোগিতা। এরই এক হালফিল চিত্র পাওয়া গেল কলকাতার এক নামী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সবচেয়ে নিচের স্তরের হাতে গোণা কয়েকটা পদে কর্মী নিয়োগকে কেন্দ্র করে। যেক্ষেত্রে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়োজন হয় না, সেখানে ভীড় করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শুরু করে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা প্রার্থীরা। এরাই ছিলেন সংখ্যায় বেশি। এদের কর্মপ্রার্থী হওয়ার মধ্যে অবশ্যই এক সাবেক গোঁড়া মানসিক গড়ন ভাঙার প্রকাশ ঘটেছে, তা হল কোন কাজ ছোট মনে না করা। ভাবনায় রূপান্তর ঘটছে তীব্র বেকারির জ্বালা-যন্ত্রণার জেরে। শিক্ষাগত কাঠখড় পোড়ানো আর অগ্নিমূল্যের বাজারের তুলনায় বেতন কাঠামো অপ্রতুল হলেও চাকরি জুটছে, সরকারি চাকরি। উপরোক্ত ঘটনার চেরাই করলে ইতিবাচক ওইটুকুই। আর যা কিছু উন্মোচিত হল সবই নেতিবাচক। প্রথমত, যে চাকরি যে অংশের পাওয়ার কথা তারা তা পেলেন না, ছিটকে গেলেন তীব্র অসম যোগ্যতা-পরীক্ষায়, আর যে অংশ পেলেন তাদের কি প্রাপ্য এটুকুই মাত্র! শিক্ষাগত নিরিখে তাদের প্রত্যাশার পারদ আরও কি বেশি চড়া স্বাভাবিক নয়? চাকরির বাজারে এই নিদারুণ সংকট ও চূড়ান্ত অসঙ্গত অবস্থা চলছে। এই দুরবস্থার জন্য দায়ি কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার উভয়েই।

প্রবণতা হিসেবে নয়া উদারনীতির ভারত বিশ্বায়িত ভারত কর্মসংস্থানের নিবিড়তার প্রয়োজনকে বিভৎসভাবে কচুকাটা করেছে। কাজের বাজারে ফোয়ারা তোলা বলতে কেবল আইটি সেক্টর। মোদী সরকারের মতিগতিতে প্রাধান্য কেবলই ডিজিটাল ভারত। সরকারি-বেসরকারি, সংগঠিত-অসংগঠিত, সমস্তক্ষেত্রেই কাজ উধাও হয়ে যাচ্ছে অনবরত। মোদী জমানা বেকারি সৃষ্টিতে সাড়ে চার দশকের রেকর্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্তক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলগ্নী ও বেসরকারি করণে নজীরবিহীন মাত্রায় ক্রুরতার দ্রুততার পরিচয় দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ কোনও বিচ্ছিন্ন রাজ্য নয়। বিভিন্ন রাজ্যের মতো এরাজ্যেও কেন্দ্র পরিচালিত প্রতিষ্ঠান সমূহের ক্রমাগত দায় প্রত্যাহার, সংকোচন, অপসারণ বা হস্তান্তর হয়ে চলেছে; শুনিয়ে আসা হচ্ছে শুধু শুকনো প্রতিশ্রুতি। সদ্য সদ্য বিজেপির হয়ে বিধানসভা নির্বাচনী প্রচারে এসেও একই প্রতারণা করে গেছেন কেন্দ্রের মহামন্ত্রীরা।

রাজ্যের মমতা সরকারও ভিন্ন রাস্তা দেখাতে পারছেনা। প্রথম প্রথম শোনানো হোত ‘এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক’ গঠনের কথা, যাতে যোগ্যতার প্রমাণ সহ নাম লেখালে চাকরির সংস্থানের হদিশ মিলবে। জানার উপায় নেই গত একদশকে এরকম কত সংস্থান হয়েছে, কেননা এসংক্রান্ত তথ্য পরিসংখ্যান সরকার প্রকাশ করেনি। বেকারির হার বেড়ে চলেছে এখানেও। এই দুর্দশার চেহারা এখানকার পুরানো ও নতুন সব ক্ষেত্রেই। অতিমারীর স্থিতিতে লম্বা কঠোর নির্মম লকডাউন নীতি আরও বহুগুণ কেড়েছে কাজের সুযোগ। সরকার যতই ধামাচাপা দিয়ে চলুক ভয়াবহ সত্য প্রকাশ হয়েই যাচ্ছে। সিএমআইই রিপোর্ট বলছে, রাজ্যে বেকারির হার ২০২১’র মে মাসে ছিল ১৯.৩ শতাংশ, জুন মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২.১ শতাংশ। গত একদশকে সর্বোচ্চ। মহিলা বেকারির হার একুশের এপ্রিলে ছিল ৪৯.৮ শতাংশ। এই সময়ে সামগ্রিক শ্রমে অংশগ্রহণের হার ছিল ৪৬.৬ শতাংশ। পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশ নিচে। বেকারির হারে রাজ্যগুলোর মধ্যে বাংলা রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। ক্রমাবনতির এই অবস্থায় দীর্ঘ টালবাহানার পরে যদিও বা স্কুল শিক্ষা ক্ষেত্রে কয়েক হাজার শিক্ষক নিয়োগের পদক্ষেপ করা হল, তা আবার আদালতের গেরোয় আটকে গেল। ইন্টারভিউর জন্য মেধার ভিত্তিতে তৈরী তালিকা বারবার অভিযুক্ত হচ্ছে এমনতর সব অস্বচ্ছতার দায়ে যে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। দাঁড়াতে হচ্ছে কাঠগড়ায়। প্রায়শই হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্টের হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে পড়ছে, মুখ পুড়ছে সরকারের। তবু স্কুলের চাকরির দাবিতে শিক্ষিত যুবরা ধর্ণায় বসলে পুলিশ দিয়ে মেরে তুলে দেওয়া হয়। বহুকিছু যেমন এখনও পর্দার আড়ালে থাকছে, তেমনি পর্দা ফাঁসও হচ্ছে বহু; শাসকদলের দুর্নীতির, পক্ষপাত দুষ্টতার। গত নির্বাচনের পরিস্থিতিতে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে দলবদলের খেয়োখেয়িতে বেরিয়ে এসেছিল চাপা থাকা স্বজন পোষণের সত্যকথা। এক দলনেতা কোণঠাসা অবস্থায় দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হন। স্কুলের চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন যেমন ঘরের লোকদের, তেমনি দলের লোকজনদেরও। দল নেতাদের নির্দেশে, সুপারিশে। এ হল চাকরির আকালের দিনকালে সরকার আর শাসকদলের যোগসাজশের দৃশ্যমান শিলাখন্ড মাত্র।

cadre meeting

১ আগস্ট ২০২১ রাজ্য কর্মীসভায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটির প্রস্তাব সোৎসাহে গ্রহণ করে অভিজিৎ মজুমদারকে নতুন রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত করে এবং ধনঞ্জয় গাঙ্গুলি, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, ফারহান হোসেইন খান, স্বর্ণেন্দু মিত্র ও দেবব্রত ভক্ত — এই পাঁচজনকে রাজ্য কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে। রাজ্য পরিস্থিতির বর্তমান সন্ধিক্ষণে পার্টির কর্মকৌশল ও আগামি কর্মসূচি বিষয়ে কর্মীসভায় বিস্তারিত চর্চা হয়।

রাজ্য পার্টি সংগঠনের চারশত কর্মী এই সভায় অংশ নেন, এককভাবে জুম মিটিং রুমে এবং পার্টি অফিসগুলিতে সমবেতভাবে। কার্তিক পাল, অভিজিৎ মজুমদার ও জয়তু দেশমুখ সভা পরিচালনা করেন, আনুষঙ্গিক সহযোগিতায় ছিলেন মলয় তেওয়ারি, সৌভিক ঘোষাল ও মধুরিমা বক্সী। সভার শুরুতে অভিজিৎ মজুমদার শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন। এই পর্বে আমরা আমাদের যেসব সাথীবন্ধুদের হারিয়েছি, যেসব মানুষ অধিকারের লড়াইয়ে শহীদ হয়েছেন, আর যারা এই অতিমারীতে সরকারি অবহেলায় প্রাণ দিলেন তাঁদের সকলকে স্মরণ করে নিরবতা পালন করা হয়। সঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায় এবং তারপর ক্যাডার কনভেনশনের মূল প্রস্তাবনা পাঠ করেন জয়তু দেশমুখ।

পার্থ ঘোষ প্রস্তাবনার ওপরে আলোচনা করেন এবং রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে সাংগঠনিক প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি বলেন, ষাটের দশকে যেরকম বিপ্লবের প্রশ্নে মহাবিতর্ক হয়েছিল, আজও তেমন এক মহাবিতর্ক চলছে ফ্যাসিবাদের মোকাবিলার পথ নিয়ে। এই বিতর্কে আমাদের পার্টি সামনের সারিতে আছে। এই বিতর্ককে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কৃষকদের ওপর, শ্রমিকদের ওপর যে হামলা তার মোকাবিলা করতে হবে। এসব বলে তিনি রাজ্য কমিটিতে নতুন পাঁচজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা ও অভিজিৎ মজুমদারকে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব পেশ করেন।
সভায় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা নেতৃস্থানীয় কমরেডদের কোভিড অসুস্থতার জন্য বিশেষ সমস্যায় পড়ি। এই সমস্যার মোকাবিলা করে আমরা বিহার নির্বাচনের পর থেকে বিজেপি-বিরোধী বক্তব্যকে তুঙ্গে নিয়ে যাই। বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে কিছুতেই ক্ষমতায় আসতে দেওয়া যাবেনা, এই প্রচার ক্রমশ সাড়া ফেলে।

সিপিআই(এম) ছিল প্রাথমিকভাবে তৃণমূল বিরোধী এবং তার বিজেপি বিরোধিতা ছিল অনেকটাই আনুষ্ঠানিক। বিজেপি এবং তৃণমূলকে মিলিয়ে তারা ‘বিজেমূল’ নামক একটা কাল্পনিক পার্টির জন্ম দিয়েছিল। ওদের এই ভুল ওরা এখন স্বীকার করছেন। সেইসঙ্গে রাজ্যে সরকারকে, তার প্রকল্পগুলিকে যেভাবে ওরা নস্যাৎ করেছিলেন, সেটাও যে ভুল হয়েছিল, তাও ওরা মানতে বাধ্য হয়েছেন। সিপিআই(এম) অনেকটা ভোল বদল করছে জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা থেকে, জাতীয় রাজনীতিতে টিএমসির সাথে চলতে।

তবে সিপিআই(এম) ভুল স্বীকার করলেও আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা করার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেনি। আমরা প্রচারে সামনে এসেছি। কিন্তু আমাদের সাংগঠনিক শক্তির সীমাবদ্ধতা থেকে গেছে। সিপিআই(এম) আমাদের তৃণমূল সমর্থক বলে দাগিয়ে দিতে চায় এবং এভাবে আমাদের কথাকে বিকৃত করতে চায়। কেউ কেউ এতে প্রভাবিত হয়েছেন। আমাদের এই সংক্রান্ত চাপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আমরা থাকব। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মমতা কিছু উদ্যোগ নেবেন, সেগুলিকে আমরা কমবেশি সমর্থন করব, পাশে থাকব। পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু তৃণমূল সরকারকে প্রয়োজনে কাঠগড়াতে দাঁড় করানোতে আমরা দ্বিধা করবনা। আমরা এটা সিপিআই(এম) বা বিজেপির কায়দায় বলবনা, নিজেদের মতো করে যথাযথ সমালোচনা করব।

একুশের ডাক একটা অভিযান, এটা এখনো কোনও মঞ্চ নয়। এখানে বেশ কিছু তৃতীয় শিবিরের মানুষ, গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক, বামপন্থী মানুষদের আমরা পাচ্ছি। বড় বড় সেলিব্রিটিদের বদলে সাধারণ বুদ্ধিজীবীদের বেশি মাত্রায় একুশের ডাকে আনার চেষ্টা করতে হবে। গ্রাম মফস্বলের এই ধরনের মানুষদের কাছে আনার ওপর জোর দিতে হবে।

আমাদের গণসংগঠনগুলির উদ্যোগ বাড়ানোর দরকার আছে। আমাদের আদিবাসীদের নিয়ে, চা বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে, ছাত্রদের নিয়ে উদ্যোগের কিছু সুফল আমরা পাচ্ছি। আমাদের বেশ কিছু অনুসন্ধানের জায়গায় যেতে হবে। এইরকম অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে ঋণমুক্তি আন্দোলনে কিছু সাফল্য এসেছে। এরকম আরো অনুসন্ধান ও অনুসন্ধানভিত্তিক উদ্যোগ দরকার।

কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে আন্দোলন বাড়াতে হবে। একদিকে মৃতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ, অন্যদিকে স্বাস্থ্যের অধিকারের জন্য তলা থেকে আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।

সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে একটা বিরোধী ঐক্য গড়ার পর্ব চলছে। সিপিআই(এম)-এর থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে চায়। একে অতিক্রম করার চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব। আমরা সমস্ত অ-বিজেপি পার্টির ঐক্য বোঝাপড়ায় থাকতে চাইবো। এর মানে অ-বিজেপি সব পার্টিকে সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া নয়।

আমরা বাম শিবিরকে সিপিআই(এম)-কে বাদ দিয়ে দেখি না। যারা সিপিআই(এম)-কে বাম বলেই মনে করেনা, আমরা তাদের সঙ্গে একমত নই। সিপিআই(এম)-কে এখনই বামেদের মধ্যেকার ড্রাইভিং সিট থেকে সরিয়ে দেওয়ার জায়গায় আমরা নেই। তবে আমরা অন্যান্য নানা ছোট, মাঝারি বাম শক্তির সঙ্গে সমন্বয়ে যাচ্ছি। নতুন নতুন কাজের জায়গায় যেতে হবে। যেমন মহিলাদের মধ্যে এই নির্বাচন পর্বে যে জাগরণ ঘটেছে, সেই স্রোতকে ভেতরে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।”

সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের পর বিভিন্ন প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। ধনেখালি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী তথা যুব নেতা সজল দে ও ফাঁসিদেওয়া কেন্দ্রের প্রার্থী তথা চা-শ্রমিক নেত্রী সুমন্তি এক্কা নির্বাচনী সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ক্ষেতমজদুর ফ্রন্ট থেকে সজল অধিকারী, কৃষক ফ্রন্ট থেকে জয়তু দেশমুখ, ছাত্রফ্রন্ট থেকে স্বর্ণেন্দু, নীলাশিস, অন্বেষা, ফারহান, যুবফ্রন্ট থেকে অপূর্ব ঘোষ, মহিলা ফ্রন্ট থেকে ইন্দ্রাণী দত্ত, একুশের ডাক অভিযান থেকে মলয় তেওয়ারি, সামাজিক মাধ্যম বিভাগ থেকে মধুরিমা বক্সী, সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট থেকে নীতীশ রায় বক্তব্য রাখেন। কাজের অভিজ্ঞতা, পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ, সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনার কথা তাঁদের বক্তব্যে উঠে আসে।

সবশেষে নতুন রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে পার্টির রাজনীতি ও অনুশীলন পদ্ধতি প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখেন। নতুন পরিস্থিতিতে নতুন উদ্যমে জনগণের স্বার্থে লড়াই ও পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে কর্মীসভা সমাপ্ত হয়।

CPIM review of elections

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক

পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের ফল ঘোষিত হওয়ার দু’মাস পর, সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পদক ও পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র ৭ জুলাই ফেসবুকে এক লাইভ সম্প্রচারে বক্তব্য পেশ করেন। পার্টি সংগঠন ও পার্টি পরিচালিত গণসংগঠনগুলির বিভিন্ন স্তরে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের ফলাফল ঘিরে দু’মাস ধরে যে পর্যালোচনা চলে, তার প্রেক্ষিতেই প্রায় দীর্ঘ দু’ঘণ্টা ধরে তাঁর এই ভাষণ। সুতরাং তাঁর এই ভাষণকে আসলে সিপিআই(এম)-এর নির্বাচনী পর্যালোচনাকে জনসমক্ষে তুলে ধরার এক প্রয়াস হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন পরবর্তী বিকাশমান পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে নির্বাচনী পর্যালোচনাকে উপস্থাপন করতে হয়েছে আর তাঁর এই অস্বাভাবিক দীর্ঘ বক্তৃতার এটি অংশত একটি কারণ। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পর্কে সিপিআই(এম)-এর নিজস্ব মূল্যায়ন ও পশ্চিমবঙ্গে এযাবৎ তাঁদের এই দুর্বলতম ফলাফলের কারণকে তাঁরা কীভাবে ব্যাখ্যা করেন তা জানার জন্যই শ্রোতারা অবশ্য বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাঁর এই ভাষণকে, নির্বাচন উত্তরকালে এক প্রকারের ডিগবাজি খাওয়া বলে সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক চর্চা হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি সমস্ত বক্তৃতাটি সত্যিই শুনে থাকেন, তাহলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে, স্বীকার না করা ও বহু প্রশ্নের উত্তরবিহীন তাঁর নীরবতা, কিছু কিছু প্রশ্নে তাঁর দেওয়া ব্যাখ্যা ও কিছু ভুল স্বীকার করাকে ছাপিয়ে অনেক বেশি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে এবং তাঁর দেওয়া উত্তরগুলি আরও নতুন কিছু প্রশ্নেরই জন্ম দিয়েছে মাত্র।

প্রথমে একবার তিনি বলেছেন, বিশেষত যেসব স্বীকারোক্তিগুলি সরকারিভাবে প্রথমবার করা হল, সেদিকে দ্রুত নজর ফেরানো যাক। ভাষণে পরিষ্কারভাবে কবুল করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে ২০০৮’র পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই তাদের ভোটের অংশ ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে চলেছে (পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের নিশ্চয় মনে থাকবে যে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের পর এটা ছিল প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন)। ঐ ক্ষয় (decline) সাংঘাতিক পর্যায়ে পৌঁছায় ২০১৯-এ যখন সিপিআই(এম) ও তার বামফ্রন্টের মিত্রেরা একটি মাত্র আসন জিততেই শুধু যে ব্যর্থ হয় শুধু তাই নয়, মিশ্র যেমনটি বলেছেন, কোনও একটি বিধানসভা ক্ষেত্রেও ভোটে এগিয়ে থাকতে সক্ষম হয়নি। আর, এদিক থেকে, ২০২১এ ২০১৯’র ধাঁচটিরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে যেখানে ২০১৯’র তুলনায় ১৩০টি আসনের মধ্যে ৯৪টিতে এবার সিপিআই(এম)-এর ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোটের ক্ষয় রোধ করতে, সিপিআই(এম) ২০১৬-তে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধে আর ২০২১-এ তদরিক্ত আইএসএফ বা আরএসএমপির সঙ্গেও জোট গড়ে তোলে। ২০১৯-এ কংগ্রেস সিপিআই(এম) থেকে এগিয়ে ছিল আর ২০২১-এ ‘বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ’এর সম্মিলিত জোটের মধ্যে একমাত্র আসনটি পেয়েছে আরএসএমপি। অন্যভাবে বলতে গেলে, এই জোটের কৌশল সিপিআই(এম)-এর ভাগ্য ফেরাতে আরও একবার ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে জোটসঙ্গী বাছাই করার প্রশ্নে মিশ্র কোন আলোচনা করেননি। তিনি কেবল ইঙ্গিত করেছেন যে নির্বাচনের সময় যে জোট গড়ে তোলা হয়েছিল পার্টি তা বজায় রাখতে ইচ্ছুক। যেটা আরও স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে তা হল সিপিআই(এম)-এর শোচনীয় কৌশলগত বিপর্যয়ের বিষয়ে এবং তাঁরা যে বিকল্প সরকার গঠনের প্রচার চালিয়ে একটাও আসন জিততে ব্যর্থ হয়েছেন সে সম্পর্কে তাঁর নীরবতা।

প্রাসঙ্গিক শব্দবন্ধ (keyword) হিসেবে ভাষণে উঠে এসেছে মেরুকরণের কথা যা অবশ্যই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়নি, বোঝাতে চাওয়া হয়েছে বিজেপি ও টিএমসি’র মধ্যে রাজনৈতিক বা নির্বাচনী মেরুকরণকে। নিশ্চিতভাবেই এই মেরুকরণকে প্রবল করে তোলার জন্য যথার্থভাবেই প্রধানধারার সংবাদমাধ্যমগুলির উপর দোষারোপ করা হয়েছে আর সেজন্য কোনও তৃতীয় শক্তির প্রধান সংবাদ মাধ্যমে স্থান করে নেওয়াও যে কঠিন ছিল তা বলা হয়েছে। বস্তুত, মেরুকরণটা কোনও নতুন বিষয় নয়, নতুন যা তা হল, জাতীয় স্তরে ও অধিকাংশ রাজ্যে প্রধানধারার সংবাদমাধ্যমগুলির আনুকূল্যে বিজেপির সম্পূর্ণ বা একমুখী আধিপত্য ভোগ করা। পশ্চিমবঙ্গ বরং কিছুটা ব্যতিক্রম যেখানে, অন্তত মূদ্রণ মাধ্যমের একটা বড় অংশের মধ্যে বিজেপি এখনও পর্যন্ত এজাতীয় কোনও সুবিধা করে উঠতে পারেনি।

পশ্চিমবঙ্গে যে স্তরের মেরুকরণ ২০১৯এ প্রকট হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনার থেকেও বেশি জরুরী হল এই মেরুকরণ রুখতে সিপিআই(এম) কী করেছে তা খতিয়ে দেখা। জনমনে গড়ে ওঠা দুই মেরুর ধারনাকে উড়িয়ে সিপিআই(এম) তাকে একটিই মেরু হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছে। আর ‘বিজেমূল’ (বিজেপি + তৃণমূল) বলে একটা গালভরা নামও তারা হাজির করেছে এবং বারংবার দুটি মেরুকে সমতুল বলে গেছে এবং নিজেকেই একমাত্র বিকল্প হিসেবে তুলে ধরেছে। ২৮ ফেব্রুয়ারীর সমাবেশের প্রেক্ষাপট এটাই ছিল যেখানে খোলাখুলি এবং উচ্চস্বরে বলা হয়েছিল, “আমরাই বিকল্প, আমরাই ধর্মনিরপেক্ষ, আমরাই ভবিষ্যৎ”।

বাস্তবে ভোটের ফলে জোরদার মেরুকরণের চিত্রই ধরা পড়েছে যেখানে টিএমসির ভোটের পরিমাণ ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে আর মাত্র ২ শতাংশ ভোট কমলেও, বিজেপির প্রাপ্ত ভোটও কমবেশি একই থেকেছে। আর এ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, মেরুকরণ মোকাবিলায় সিপিআই(এম)-এর রণনীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। একটি ফ্যাসিবাদী দল বিজেপি যদি দুটি মেরুর অন্যতম হয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিরোধিতাই সিপিআই(এম)-এর প্রাথমিক অবস্থানে থাকার কথা। মিশ্র শ্রোতাদের বলেছেন যে ২২ বছর আগেই সিপিআই(এম) ঘোষণা করেছিল যে বিজেপিকে অন্য কোন দলের সঙ্গে সমান দেখানো বা এক বন্ধনীতে রাখা যায় না। তাহলে সিপিআই(এম)-এর অন্যতম মজবুত ঘাঁটি — ৩৪ বছর যেখানে দল ক্ষমতায় থেকেছে সেই পশ্চিমবঙ্গে এত বছর ধরে টিএমসি’কেই কার্যত প্রধান শত্রু মনে করা হল কীসের ভিত্তিতে? তিনি আমাদের শুনিয়েছেন কীভাবে বিজেপি বা আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে টিএমসি গঠনে উৎসাহ দিয়েছে এবং ২০১৯ পর্যন্ত তারা আসলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মিত্র হিসেবে কাজ করে এসেছে।

তাহলে ২০১৯-এ ঠিক কী বদলে গেল? মোদী সরকার উপর্যপুরি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এল এবং তার ফ্যাসিবাদী প্রকল্পগুলিকে এত দ্রুত ও আগ্রাসী রূপে চাপিয়ে দিতে চাইল যে সমগ্র দেশ ও দুনিয়ার সজাগ দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ হল। অপারেশন কাশ্মীর ও রামমন্দির থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব আইনের বিভেদমূলক সংশোধন এবং নয়া কৃষি আইন ও কর্পোরেট স্বার্থে শ্রমকোডগুলি চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মোদী সরকার ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতকে এক ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার আরএসএস’র স্বপ্নকে তীব্র গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ২০১৯’র পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনের লক্ষ্য হয়েছে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে হটানো কিম্বা তাকে পরাস্ত করা। এই বুনিয়াদী সত্যকে দেখতে না পাওয়া ও বিজেপি বিরোধী এক দৃঢ় অবস্থান গ্রহণে সিপিআই(এম)-এর ব্যর্থতাই আসলে টিএমসিকে বিজেপি বিরোধিতার পরিসরটাকে প্রায় এককভাবে দখল করে নিতে সাহায্য করেছে ও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার রেশকে প্রতিহত করতে ও ভোটের পরিমাণকে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে নিতে সমর্থ করে তুলেছে।

এই বিজেপি-বিরোধী মেরুকরণ পরিষ্কারভাবে বোধগম্য, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে যেখানে কোনও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে রাজ্য বিজয়ের লক্ষ্যে বিজেপির ঝাঁপিয়ে পড়ার পর। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে জিতলে তার পরিণাম কী ভয়ানক হতে পারে সারা দেশ তা বুঝেছিল। দিল্লী কৃষক আন্দোলনের নেতারা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচকদের কাছে বিজেপিকে পরাস্ত করার উদ্দীপ্ত বার্তা দিতে ছুটে এসেছিলেন এরাজ্যে। বাংলার বাম ও উদারপন্থী শিবিরের বড় অংশও বিজেপিকে প্রতিহত করার প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করেছিল। এই সমবেত উৎকণ্ঠারই প্রতিফলন ঘটেছে নির্বাচনী ফলাফলে এবং (পশ্চিমবঙ্গে) ক্ষমতায় আসার বিজেপির আগ্রাসী প্রচেষ্টা নির্ধারকভাবে ধাক্কা খাওয়ায় সারা দেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। অন্তত সাময়িকভাবে হলেও সমগ্র পূর্ব ভারত ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে আধিপত্য কায়েমের লক্ষ্য হাসিল করার বিজেপির পরিকল্পনাকে রুখে দেওয়া গেছে।

বাংলার ফলাফল নিয়ে হর্ষ প্রকাশ করার সময় অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক সিপিআই(এম)-এর খারাপ ফলকে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাজিত করার বৃহত্তর লক্ষ্য পূরণে গুণে দেওয়া মাশুল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনা যেন পূর্ব হতেই স্থিরীকৃত। নিশ্চিতভাবেই সিপিআই(এম) কোনও মাশুল গুণে দিতে চায়নি এবং এত চড়ামূল্য রোধ করাও সম্ভব ছিল। এমন এক রাজ্য যেখানে পার্টি মাত্র দশ বছর আগেও বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ছিল সেখানে সিপিআই(এম) আবার নেতৃত্বকারী না হোক, গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী পক্ষ হিসেবে উঠে আসবে — এমন ভাবাটাও দুষ্কর। মেরুকৃত ভোটের আবহেও সিপিআই(এম) রাজস্থানে কয়েকটি আসন জিতে এসেছে, সিপিআই(এমএল) ২০১৫-তে বিহারে তিনটি আসন জেতে এবং আরো সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডে অত্যন্ত মেরুকৃত নির্বাচনেও আসন জিতেছে। একটি কমিউনিস্ট পার্টির নিচুতলায় যদি শক্তিশালী কাজের এলাকা থাকে এবং প্রধান প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এক লড়াকু শক্তি বলে পরিগণিত হয়, তাহলে রাজ্যব্যাপী মেরুকরণকে সে স্থানীয়স্তরে অগ্রাহ্য করতে পারে ও কয়েকটি আসনে জেতার মতো তার ভালোই সুযোগ থাকে। এটা শুধু কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রেই নয় পরন্তু ছোট পার্টিগুলির পক্ষেও সাধারণভাবে প্রযোজ্য। এই প্রশ্নে মিশ্র ও পট্টনায়েক — কেউই আলোকপাত করেননি।

মিশ্র আমাদের বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন, ২০১৯ পর্যন্ত টিএমসি যে বিজেপির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলছিল সে প্রশ্নে সিপিআই(এম)-এর মূল্যায়ন সঠিক ছিল কিন্তু পরবর্তীতে বদলে যায়। টিএমসি ঠিক কী করেছিল যা সিপিআই(এম) অনুমান ও মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়? প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেড়ে ওঠা ক্ষোভকে মোকাবিলা করতে টিএমসি মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য নবতর পদক্ষেপ নিতে থাকে এবং বিজেপি বিরোধী ভাবমূর্তি তৈরি করতে উঠে পড়ে লেগে যায়। সিপিআই(এম) টিএমসি সরকারের জনমোহিনী প্রকল্পগুলিকে চুরি ও ভিক্ষা প্রদান বলে তাচ্ছিল্য করে চলে এবং টিএমসি ও বিজেপিকে সমার্থক বলে দেখিয়ে চলে, এমনকি যদি ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হয় সেখানে টিএমসি-বিজেপির সরকার গড়ে উঠতে পারে বলে প্রচার চালায়।

পরিস্থিতির এমন নিকৃষ্ট ভুল ব্যাখ্যার পিছনে আরও গভীরতর কারণ রয়েছে। ক্ষমতা হারানোর পর পরিস্থিতির মুখোমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে সিপিআই(এম)-এর মৌলিক উদাসীনতা ও অক্ষমতা প্রকট হয়ে ওঠে। প্রথমত বোঝা দরকার সিপিআই(এম)-এর দীর্ঘ, নিরবচ্ছিন্ন রাজত্বের অবসান ঘটাটা কোনও ষড়যন্ত্রের ফল নয়। পার্টি গুরুতর কয়েকটি ভুল করে এবং জনগণের প্রভূতভাবে মোহভঙ্গ হয় এবং তাদের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্খা জেগে ওঠে। বস্তুত, মিশ্রও তাঁদের ক্ষয় ২০১১-তে নয়, ২০০৮ থেকেই শুরু হয়েছিল বলে এখন চিহ্নিত করছেন যদিও পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম) ২০০৮কে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের প্রেক্ষিতে দেখতে রাজী নয় এবং ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির কারণ দেখিয়ে ইউপিএ সরকার থেকে বামফ্রন্টের সমর্থন প্রত্যাহার ও পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-টিএমসি জোট গড়ে ওঠাকেই এর কারণ হিসেবে দেখে থাকে।

এই সত্যকে বোঝা দরকার, টিএমসি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের উপর ভর করে ক্ষমতায় আসে এবং যে গ্রামের গরিব, গ্রামীণ ও শহুরে বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন বামদের দীর্ঘদিনের সমর্থক তাদের বড় অংশকে পক্ষে নিয়ে আসে —যেখানে প্রত্যয় জেগে ওঠে যে একটি আঞ্চলিক দলের পরিচিত কক্ষপথেই সরকার পরিচালিত হবে না — অন্তত বিজু জনতা দলের নবীন পট্টনায়েকের পথে তো নয়ই। ইতিহাসের পরিহাস, টিএমসি যেক্ষেত্রে বিজেপি-বিরোধী অবস্থান ধ্বনিত করতে বাধ্য হয় সিপিআই(এম) সেখানে তার বিজেপি-বিরোধী তীক্ষ্ণতাকে লঘু করে ফেলে আর এভাবেই বিজেপি-বিরোধী ভোটকে টিএমসির প্লেটে সাজিয়ে দেয়। এরসাথে সাথে সিপিআই(এম)-এর অন্ধ টিএমসি বিরোধী শক্তিগুলি লাগাতার বিজেপির দিকে চলে যাওয়ায় সিপিআই(এম)-এর ৪০ শতাংশ ভোট প্রাপ্তির সুউচ্চ অবস্থান মাত্র ৪ শতাংশে নেমে আসে।

সে যাই হোক, এটা দেখেও ভাল লাগে, সিপিআই(এম) এই বাস্তবকে স্বীকার করছে যে কোথাও তাদের কোনভাবে ভুল হয়ে গেছে। আর সবটুকুকেই সাংগঠনিক ঘাটতি না বলে রাজনৈতিক-কৌশলগত ফাঁক থাকার কথাও মেনে নেওয়া হয়েছে। শুধুই কি বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার বিকাশমান রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে জাতীয় রাজনীতিতে সিপিআই(এম)-কে টিএমসির সঙ্গে একসাথে চলতে হবে? নাকি পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তিত বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে বাম পুনরুত্থান ঘটানোর স্বার্থে সত্যিকারের কোন প্রচেষ্টা চালানো হবে? শেষোক্ত বিষয়টি ঘটাতে হলে গভীরতর আত্মানুসন্ধান ও ভুল পথের সংশোধন প্রয়োজন। আর সেজন্য আরও বিনম্রতা বাঞ্ছনীয়। যে ঔদ্ধত্য নিয়ে সিপিআই(এম)-এর মুখ্য সামাজিক মাধ্যম বাহিনী বৃহত্তর বাম ও গণতান্ত্রিক মহল থেকে ওঠা পৃথক মতকে আক্রমণ ও কদর্য ভাষায় ব্যঙ্গ করেছে তা তো সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে পার্টির সেই দম্ভেরই পুনরাবৃত্তি যার পরিণামস্বরূপ বামফ্রন্ট সরকারেরই পতন ঘটে। সামনের দিনে সিপিআই(এম) কি আরও সতর্ক হবে?

 press conference

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নব নির্বাচিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার প্রথম সাংবাদিক বৈঠকেই ‘বিজেপি-আরএসএস’এর ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পুনর্ঘোষণা করলেন। একইসঙ্গে এরাজ্যে গণতন্ত্রবিরোধী ইউএপিএ প্রয়োগের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। ডাক দিয়েছেন লড়াইয়ের।

২ আগস্ট কলকাতায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সদর দপ্তরে সাংবাদিক বৈঠকে নব নির্বাচিত রাজ্য সম্পাদকের নাম ঘোষণা করেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি জানান অভিজিৎ দীর্ঘদিন উত্তরবঙ্গের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। দীপঙ্কর দেশজুড়ে বিজেপির জনস্বার্থ-বিরোধী নানা অপকর্মের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। জেল হেফাজতে সদ্য প্রয়াত ফাদার স্ট্যান স্বামীর ওপর নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে দোষীদের শাস্তির দাবি জানান।

দীপঙ্করের বক্তব্যের রেশ ধরে দলের নতুন রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার বলেন, রাষ্ট্রশক্তির নির্যাতন এখনও লাগু রয়েছে। তিনি চারু মজুমদার এবং সরোজ দত্তের ওপর রাষ্ট্রশক্তি যেভাবে হামলা নামিয়ে এনেছিল সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। বলেন, লালবাজার লকআপে চারু মজুমদারের মৃত্যু নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল বামফ্রন্ট সরকার, কিন্তু কোনও সদুত্তর মেলেনি। বর্তমান টিএমসি আমলেও তার কোনও সুরাহা মেলেনি। সরোজ দত্তের হত্যা রহস্য নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে। তিনি ৫ আগস্ট কমরেড সরোজ দত্তের আত্মত্যাগ স্মরণে দলের সমস্ত কর্মীকে নিপীড়িত মানুষের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।

সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির অর্থ ও রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগের কঠোর সমালোচনা করেন অভিজিৎ। তিনি বলেন, মানুষের গণরায়ে বিজেপি পর্যুদস্ত হয়েছে। তবে, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা ধরে রাখা টিএমসি সরকারকে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখতে হবে। এই প্রশ্নে ‘ইয়াস’ পরবর্তী পুনর্বাসনের প্রশ্নে রাজ্য সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেন। পাশাপাশি করোনা অতিমারীতে প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর অভিযোগ অফিস-কাছারি খুলে রেখে লোকাল ট্রেন বন্ধ রাখা হয়েছে। অপ্রতুল সরকারি ও বেসরকারি পরিবহনও। এটা রাজ্য সরকারের দ্বিচারিতা। অভিজিৎ কোভিড টিকাকরণ নিয়েও রাজ্য সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেন। প্রশ্ন তোলেন, বেসরকারি কেন্দ্রগুলিতে টিকাকরণ চলছে, অথচ বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও বহু জায়গায় টিকা অমিল। কোভিড বিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবি জানিয়েছেন অভিজিৎ।

দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে তিনি অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের এই দাবি না মেনে দমন-পীড়নের পথ নিয়েছে যা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। অভিজিৎ ঘোষণা করেন, আগামী ৯ আগস্ট দেশজুড়ে শ্রমিক কৃষকদের আন্দোলনকে সংহতি জানিয়ে ‘ভারত বাঁচাও’ দিবসে এরাজ্যও সামিল হবে।

- অশোকতরু

government nurses

এসএসকেএম হাসপাতালের মধ্যে সরকারি নার্সরা আন্দোলন শুরু করেছেন গত ২৬ জুলাই থেকে। তাঁদের দাবি — বেতন বৈষম্য বন্ধ করতে হবে, নার্সিং অফিসারদের উপর প্রশাসনিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে, চুক্তি প্রথা বাতিল করে নার্সদের স্থায়ী পদে নিয়োগ করতে হবে। এছাড়াও তাঁরা দাবি করছেন, জিএনএম (জেনারেল নার্সিং ও মিডওয়াইফ) কোর্স বাতিল করা চলবে না। রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের নার্সিং কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে নার্সিং কেয়ার অ্যালাউন্স, হাউস রেন্ট অ্যালাউন্স, হ্যাজার্ডস অ্যালাউন্স, ওয়াসিং ও ড্রেস অ্যালাউন্স, ট্রান্সপোর্ট অ্যালাউন্স দিতে হবে। বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা এবং কলকাতার বিভিন্ন  হাসপাতালের নার্সরা এই অবস্থান আন্দোলন কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছেন। নার্সেস ইউনিটি নামক সংগঠনের ডাকেই এই আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। আগামী শুক্রবার ৬ অগাস্ট তাঁরা মহামিছিলের ডাক দিয়েছে। রাজ্য সরকার এখনও পর্যন্ত তাঁদের  আন্দোলনে কোন কর্ণপাত করছে না। রাজ্য সরকারের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার বিরুদ্ধে নিজেদের ডিউটি সম্পন্ন করেই আজ তাঁরা আন্দোলনের পথে। তাই সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি থেকে কয়েকজন তাঁদের পাশে সংহতি জানাতে গেছিলেন ৩১ জুলাই।

work of MNREGA

২৬ জুলাই আয়ারলা এবং মনরেগা মজদুরসভা সহ বিভিন্ন বাম গ্রামীণ মজদুর সংগঠনের সম্মিলিত প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হল জেলা এবং ব্লকস্তরে। তৎসহ প্রধানমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয় যে দাবিতে তা হল, সমস্ত মনরেগা মজদুর ও অন্যান্য গ্রামীণ শ্রমিক কোভিড অতিমারীর জন্য যে পীড়াদায়ক পরিস্থিতির মধ্যে দিন যাপন করছেন তারজন্য ৩ মাসের মনরেগা মজুরি তাদের দিতে হবে। দেশের সব রাজ্যেই অন্যান্য যে দাবি নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে তা হল,

    • মূল এমএনআরইজিএ আইন ২০০৫ চালু কর।
    • সমস্ত কর্মপ্রার্থীদের বছরে ২০০ দিনের কাজ নিশ্চিত কর।
    • এমএনআরইজিএ কাজের জন্য দিনপ্রতি ন্যূনতম ৬০০ টাকা দিতে হবে।
    • সমস্ত সংশোধনী এবং উপদেষ্টাদের বাতিল কর।

দিল্লীতে যন্তর-মন্তরে এইসব দাবি নিয়ে প্রতিবাদসভা হয়েছে। সংগঠনগুলির তরফ থেকে রাষ্ট্রপতিকে মনরেগা মজদুরদের কেন্দ্রীয় সরকারের উপদেষ্টা দ্বারা জাতপাতের ভিত্তিতে ভাগ করা ও সেইমতো মজুরি প্রদানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়েছে গত ২ মার্চ ২০২১ গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক থেকে উপদেষ্টা কর্তৃক রাজ্য সরকারগুলিকে বলা হয়েছে, তারা যেন এসসি/এসটি ও অন্যান্য মজদুরদের তাদের বর্গ অনুযায়ী মজুরি প্রদান করেন। সংগঠনগুলি বলেছেন যে ‘এই উপদেষ্টাদের দেখে আমরা অবাক হয়েছি’। মজদুরদের বিভিন্ন জাতপাত ও বর্গে ভাগ করা অনৈতিক এবং সমকাজে সমমজুরি প্রযোজ্য। উপদেষ্টাদের জন্য মজুরি প্রদানে, বিতরণে এবং কাজ বন্টণে ব্যাঘাত ঘটবে। তাঁরা রাষ্ট্রপতিকে স্মরণ করিয়ে দেন মনরেগা একটি সর্বজনীন প্রকল্প যেখানে গ্রামীণ ভারতের যে কোনও কায়িক শ্রম দিতে ইচ্ছুক সাবালক কর্মপ্রার্থী যথাবিহিত ন্যূনতম মজুরিতে কাজ পাওয়ার অধিকারী। এই প্রকল্পে চাহিদা অনুযায়ী কর্মের সংস্থান করা হয়। কিন্তু কাজের সংস্থান যদি জাতপাতের ভিত্তিতে করা হয় তাহলে এই আইনের মূল ভিত্তিকেই দূর্বল করা হবে এবং কর্মপ্রার্থীদের পৃথকীকরণ ঐ আইনকে পথভ্রষ্ট করবে। জানা গেছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জাতপাত নিরপেক্ষভাবে সবার জন্য সুযোগের নীতিকে প্রভাবিত করছেন। বিভিন্ন রাজ্যে এসসি/এসটি’দের মজুরি প্রদানে শুধু দেরী করাই হচ্ছে না, তাদের কম মজুরিও দেওয়া হচ্ছে বেআইনিভাবে। এর সামাজিক অভিঘাতে দেখা যাচ্ছে গ্রামীণ এলাকায় জাতপাতের ভিত্তিতে কিছু কিছু গোষ্ঠীর মজদুর কাজ পাচ্ছেন, আর সেই কারণে মনরেগার কাজের ক্ষেত্র সেই জাতের এলাকায় চলে যাচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে মনরেগার কাজে দলিতরা কম মজুরি পাচ্ছেন।

চিঠির শেষভাগে বলা হয়েছে মনরেগার কাজের জন্য প্রচুর চাহিদা রয়েছে। গ্রামে গ্রামে পরিযায়ী শ্রমিকরা বিগত বছর থেকে কোভিডের জন্য ফিরে আসায় কাজের চাহিদা আরও বেড়ে গেছে। পরিবহণ, গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গ্রামীণ দরিদ্ররা প্রায় অভুক্ত অবস্থায় রয়েছেন। তাই আমাদের দাবি এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে মনরেগার উপদেষ্টাদের প্রত্যাহার করুন এবং মনরেগায় বছরে ২০০ দিন কাজ ও দিনপ্রতি ৬০০ টাকা মজুরি দেওয়া হোক যাতে গ্রামের দরিদ্ররা বেঁচে থাকেন।

responsiblefor violence

আসাম-মিজোরামের সীমান্তে রক্তাক্ত সংঘর্ষের বলি হলেন ৫ জন আসাম পুলিশ কর্মী ও আহত হলেন দুই রাজ্যের বহু সাধারণ বসবাসীরা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র উত্তর-পূর্বাঞ্চল সফরের পরেপরেই এই ঘটনা ঘটে। আসামে রয়েছে বিজেপি সরকার এবং মিজোরাম শাসিত হচ্ছে বিজেপি জোটের এমএনএফ শাসনে।

অমিত শাহ শিলং-এ উভয় রাজ্যের নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাতে বলেন, দুই রাজ্যের পেকে ওঠা সীমান্ত বিবাদের মীমাংসা হবে উত্তর-পূর্বের গণতান্ত্রিক জোটের সৎ প্রচেষ্টায়। বিজেপি এই কংগ্রেস-বিরোধী জোট গড়ে তুলেছে ২০১৬ সালে। শাহর সফরের অব্যবহিত পরে আসাম মিজোরামের বিতর্কিত সীমানা অঞ্চলে আসাম পুলিশের একটি টীম কেন পরিদর্শনে গিয়েছিল? এই পরিদর্শনের অনুমোদন নিশ্চয়ই আসাম মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছিলেন? পরিস্থিতির এই অবনমন এবং হিংসা থামানোর জন্য কেন দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা পরস্পর সহযোগীতা করলেন না? বিজেপি নেতৃত্বের গর্ব কেন্দ্র ও রাজ্যে বিজেপি-এনডিএ জোটের ‘ডবল-ইঞ্জিন সরকার’ রয়েছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং উত্তর-পূর্বের এই দুই প্রতিবেশি রাজ্যের বিজেপি-এনডিএ সরকারের জোটবদ্ধতা সত্ত্বেও এই লজ্জাজনক হিংসার ঘটনা ঘটলো। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিজেপির আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্খার জন্যই সীমান্ত বিবাদের এই চরম রূপ ধারণ করেছে। আসাম, মিজোরামের দুই মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই সংঘর্ষের জন্য দায়ী। দুই রাজ্যের সীমান্ত বিবাদ, বন্ধুত্বপূর্ণ আপসের মনোভাব নিয়ে, কোনও প্ররোচনা বা বাহুবল না দেখিয়ে বা হিংসা ছাড়াই মীমাংসা করতে হবে।

mizoram tribesmen

উত্তর ত্রিপুরার দামছড়ায় ব্রু (রিয়াং) শরণার্থীদের পুনর্বাসন প্রকল্পে পরিকল্পনাবিহীন ও অবাস্তবোচিতভাবে জমি বন্টন নিয়ে বিরোধের ফলে রাজ্যের জনজাতি ভূমিপুত্ররা আজ উদ্বাস্তু হয়ে আসামে আশ্রয় নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার এরজন্য দায়বদ্ধ এবং ডাবল ইঞ্জিন সরকারকে এরজন্য জবাব দিতে হবে।

গত ২৬ জুলাই উত্তর ত্রিপুরা জেলার পানিসাগর মহকুমার দামছড়ায় ফাইকো (হালাম) পাড়াতে ব্রু শরণার্থীদের একটি অংশ এবং স্থানীয় হালাম ও চরাইদের মধ্যে জমি দখল নিয়ে সংঘর্ষ হয়। বাড়ি ঘরে ঢুকে অগ্নিসংযোগ করা ও অস্ত্র হাতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের সতেরো-আঠারো জন আহত হয়। প্রাণভয়ে কয়েকশো পরিবার সীমান্তবর্তী আসামে পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করেছে। পাথারকান্দির মানিকবন্দে ৪৪৩নং সার্কেলে ঙিরনেইসিয়েক এলপি স্কুলে ১৬০টি পরিবারের ৭৫০ জন শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। আরও কিছু পরিবার মানুষের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছে। সরকার তাদের কোনও সহায়তা করেনি। স্থানীয় কিছু সংগঠন তাদের সহায়তা করছেন। এলাকায় শান্তি ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য কোনও উদ্যোগ নেই। তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য কোনও উদ্যোগ নেই।

এই পরিস্থিতিতে সিপিআই(এমএল) রাজ্য কমিটি দাবি করছে যে, রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে আসামের পাথারকান্দিতে আশ্রিত উদ্বাস্তু পরিবারগুলির জন্য উপযুক্ত ভরণপোষণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। দামছড়া এলাকায় শান্তি ও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কার্যকরী গণউদ্যোগ ও প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উদ্বাস্তু হালাম ও চরাইদের নিজভূমিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি তৈরি করে দিতে হবে। সব সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতির মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে।

কিন্তু দীর্ঘদিনের ব্রু শরণার্থী সমস্যার সমাধানে মিজোরামের বিধানসভা নির্বাচন ও ত্রিপুরায় টিটিএডিসি ভোটের দিকে লক্ষ্য রেখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রদপ্তর ও রাজ্য সরকার কর্তৃক তড়িঘড়ি করে গৃহীত অবাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত আজ এই বিরোধের জন্য দায়ি। ১৯৯৭ সালে মিজোরামে এথেনিক (জাতি) সংঘর্ষের ফলে প্রায় ৩৮ হাজার রিয়াং (ব্রু) জনজাতি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে রাজ্যে এসে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। পরে ছয় হাজার মানুষ ফিরে যায়। গত ২৩ বছর ধরে ৩২ হাজার ব্রু শরণার্থীরা ত্রিপুরাতেই আছে। কেন্দ্রীয় সরকার ও মিজোরাম সরকার তাদের নিজভূমিতে ফিরিয়ে নিতে পারেনি। মিজোরাম, ত্রিপুরা ও আসামে রিয়াং জনজাতি গোষ্ঠী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে আসছে। ১৯২০ সালের জানুয়ারী মাসে তড়িঘড়ি ব্রু শরণার্থী সমস্যার সমাধানে চারপক্ষীয় অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার, মিজোরাম ও ত্রিপুরা সরকার ও শরণার্থী ব্রু নেতাদের মধ্যে এক চুক্তি হয়। তাতে ত্রিপুরার ভূমিতে ঐ ৩২ হাজার ব্রু শরণার্থীদের পুনর্বাসন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু তাদের পুনর্বাসন দেওয়ার মত এত বিশাল পরিমাণ ভূমি কোথায়। বনভূমি ছাড়া বিকল্প নেই। কিন্তু ত্রিপুরায় ১,২৯,০০০ জনজাতি পরিবারকে বনভূমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে। এক বিরাট পরিমাণ জনসংখ্যা বনভূমিতে বসবাস করে। এমতাবস্থায় ব্রু’দের সাথে স্থানীয় ভূমিপুত্রদের এই ধরণের সংঘর্ষ অনিবার্য। এই অবাস্তবোচিত ও পরিকল্পনাবিহীন সিদ্ধান্তের জন্য উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপি’র ভুল নীতি দায়ী। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার দায়বদ্ধ। তাদের জবাব দিতে হবে।

sell the kidneys

আয়ারলা’র অন্তর্ভুক্ত সদৌ অসম গ্রামীণ শ্রমিক সংস্থার রাজ্য সমিতির সাধারণ সম্পাদক অরূপ কুমার মহন্ত, রাজ্য সমিতির সদস্য আয়েফা বেগম এবং ধরমতুল শাখার কাবেরী দাস ও হেমলতা দাসকে নিয়ে গঠিত চার সদস্যের একটি দল সরেজমিন তদন্তের জন্য অসমের জাগীরোড বিধানসভা কেন্দ্রের দক্ষিণ ধরমতুল গ্রাম পঞ্চায়েতের দক্ষিণ ধরমতুলে হাজির হয়। কিছুদিন আগেই অসমিয়া দৈনিক ‘অসমিয়া প্রতিদিন’ কাগজের একটি প্রতিবেদন সারা অসম জুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। খবরটি এমন যে এই অঞ্চলের দারিদ্র ক্লিষ্ট গ্রামবাসীরা মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির ঋণের কবলে পড়ে সুদ সহ কিস্তি পরিশোধ করতে না পারার দরুণ কলকাতার মুকুন্দপুরে রবীন্দ্রনাথ টেগোর ইন্টান্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেস-এ কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য হন।

এই খবরটি সামনে আসার অব্যবহিত পরেই আর দেরী না করে চটজলদি সেখানে যাওয়া হয়। এবং যাঁরা কিডনি বিক্রি করেছেন তাঁদের সঙ্গে দেখা করা হয়। জানা যায় গ্রামটি বন্যা কবলিত। প্রায় সাতশো পরিবার কপিলি নদীর বাঁধের উপর মনুষ্যেতর জীবন কাটান। গ্রামবাসীরা দিন মজুরি, কুমোর বৃত্তি, খড়ি বিক্রি করেই দিন গুজরান করেন। আজ পর্যন্ত এঁদের না আছে কৃষিভূমি — না আছে পাট্টা। বাসভূমি সর্বাধিক তিন কাঠা থেকে সর্বনিম্ন দশ লোচা। বেশিরভাগ বাড়িগুলো বাসযোগ্যই নয়। সরকারি অনেক স্কিম এই অঞ্চলে ঢোকেইনি। বছরের পাঁচ মাস বাঁধের উপরেই বাস করাটা এখন অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে। এঁদের বেশিরভাগ পরিবারের রেশন কার্ড নেই। যাঁদের আছে তাঁরা সরকার নির্ধারিত পরিমাণ থেকে কম পরিমাণে চাল পান। জবকার্ড আছে কিন্তু কাজ নেই। বন্ধন, আরজিভিএন মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির ঋণের কবলে। এই ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে মহাজনী ঋণের কবলে পড়েছেন। মাসিক শতকরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সুদ গুনতে হয়। ঋণের নাগপাশ এঁদের এমনভাবে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে যে বেঁচে থাকার সমস্ত পথই আস্তে আস্তে রুদ্ধ হয়ে আসছে। আর এখানেই মানব অঙ্গের কারবারিরা চোরাবালিতে ফেঁসে যাওয়া মানুষের ত্রাতা সেজে দুরাবস্থার পুরো সুযোগ নিতে তৎপর হয়ে ভাগাড়ের শকুনের মতো নেমে পড়েছে। কিডনি বিক্রি করা মানুষটিকে যখন কলকাতায় প্রায় ৪-৭ মাস থাকতে হয় তখন প্রতিবেশিরা জানেন যে সেই ব্যক্তিটি রোজগারের তাগিদে বাইরে কাজ করতে গেছেন। মোদীর গরিব কল্যাণ যোজনার অন্তঃসারশূন্যতা এখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে। কিডনি বিক্রি করার পর দালালেরা প্রতিশ্রুতি মতো দেয় টাকা কিডনি বিক্রেতাদের না দিয়ে ঠকায়।

আমরা প্রথম দেখা করি দীনেশ দাসের সাথে। তাঁর বয়স ৪০। কিন্তু সব মিলিয়ে অকাল বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট, পেশায় দিন মজুর। কখনও মাটির জিনিস বিক্রি করেন। বাবার নাম মাধোরাম দাস। তিন সদস্যের পরিবার। তাঁর বাসযোগ্য জমি মাত্র দশ লোচা। চাষ জমি নেই। প্রায় দু’বছর আগে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানটির মাথায় জল জমা হয়। ফলে চিকিৎসার জন্য প্রায়ই গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজে যেতে হয়। সেখানেই তাঁরসঙ্গে গুয়াহাটির চাঁদমারির দিলীপ দাসের সঙ্গে পরিচয়। সেই দিলীপ দাস তাঁকে বললেন যে তাঁর কিডনির দরকার আর ছেলেটির চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব তিনি নেবেন। তখন তিনি গোলাঘাট জেলার উরিয়ামঘাটের বুল বরার সঙ্গে ফোনে আলাপ করিয়ে দেন। দীনেশ দাস ছেলের জীবন বাঁচাতে কিডনি বিক্রি করতে সম্মত হন এবং সাড়ে চার লাখ টাকায় কিডনি বিক্রির মৌখিক চুক্তি হয়। অ্যাডভান্স হিসেবে এক লাখ ষাট হাজার টাকা দীনেশ দাস হাতে পান; তাঁকে বলা হয় কোনকিছুর অভাব হলে জানাতে আর প্রয়োজন হলে আরো টাকা দেয়া হবে। কয়েকদিন বাদে দীনেশ দাসকে ফোন করে জানানো হয় যে কলকাতায় যেতে হবে। গুয়াহাটির দিলীপ দাস ও ভারতী বরা স্থানীয় রাজস্ব দফতর থেকে কাগজ বের করে বলেন যে দীনেশ দাসকে দেড় মাসের জন্য কলকাতায় যেতে হবে। তারপর দীনেশ দাস কলকাতায় যান। ছেলের চিকিৎসার জন্য আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়। তিনি মোট তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা পান। বাকি এক লাখ টাকা দালালরা মেরে দেয়। তাঁর রেশন কার্ড নেই। জবকার্ড আছে কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে কোনো কাজই হচ্ছেনা। ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘর আছে কিন্তু পায়খানা নেই। বন্ধন থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ১০৪ কিস্তিতে সেই ঋণ পরিশোধ করার শর্ত ছিল। ৭০টি কিস্তি পরিশোধ করেছেন মাসিক ১০ শতাংশ সুদে ১৫,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে। প্রথম প্রথম দীনেশবাবু মুখ খুলতে নারাজ ছিলেন কারণ তার আগের দিনই অর্থাৎ ১৪ জুলাই নগাওঁ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ প্রদ্যোত বরদোলইকে বিজেপি’র লোকজন অপদস্থ করে। কিন্তু যখন আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম আর সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে বললাম তখন আস্তে আস্তে সন্দেহের দৃষ্টি হটিয়ে শুধু মুখ খুললেন তাই নয় বরং প্রতারণার শিকার অন্যান্যদের মুখ খুলতেও উৎসাহিত করলেন।

এরপর দেখা করা হয় সুমন্ত দাসের সঙ্গে। তাঁর বাবার নাম বসন্ত দাস। বয়স ৪০ ছুঁই ছুঁই। পাঁচ সদস্যের পরিবার। পেশায় রাজমিস্ত্রি। কৃষি জমি নেই কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাঁই দশ লোচা। তাঁর মেজ ছেলে ধ্রুবজ্যোতির হার্টের ব্যামো। তিনি পূর্ব ধরমতুলের রমেন মেধির কাছে তাঁর ছেলের সমস্যার বিষয়ে জানানোর পর রমেন মেধি বিজেপি যুব মোর্চার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতা নীতু দাসের সঙ্গে পরিচয় করান। নীতু দাস সুমন্তকে নিয়ে কলকাতায় গেলে পাঁচ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রির বন্দোবস্ত হয়। কলকাতায় প্রায় সাত মাস তিনি থাকেন এবং নগদ দেড় লাখ টাকা পান। বাকি টাকা চাইলে গুয়াহাটির লিলিমাই বড়ো ফোন করে সুমন্ত দাসের স্ত্রীকে কিডনি দিতে বলে আর বিনিময়ে ছেলের চিকিৎসার খরচ বহন করা হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু আজ অবধি সুমন্তবাবু বাকি টাকা আর পাননি। সুমন্তবাবুর আইএওয়াই ঘর আছে কিন্তু রেশন কার্ড নেই। বন্ধন থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ৯০,০০০ টাকা। শোধ করেছেন ৪৫,০০০ টাকা।

তারপর দেখা করা হয় তৃষ্ণা দাসের সঙ্গে। বয়স ৩০ বছর। স্বামী ললিত দাস। পেশায় মৎস্যজীবীই। এই দাস দম্পতি নিঃসন্তান। বাসোপযোগী ঘরের অভাব। এরমধ্যেই বিপত্তি। গাছ থেকে পড়ে ললিত বাবুর হাত-পা ভেঙে যাওয়ার ফলে আয় বন্ধ হয়ে যায়। ইতোমধ্যেই বন্ধন থেকে ৭০,০০০ টাকা আর আরজিভিএন থেকে ২৫,০০০ টাকা ঋণ নিয়েছেন। দু’বছরের মধ্যে দুটো কোম্পানির ঋণ পরিশোধ করার শর্তে। একবছর দুটি কোম্পানির কিস্তি ঠিকমতো পরিশোধ করা হয়। এরপর স্বামীর চিকিৎসার জন্য কিডনি বিক্রি করা হয়। সাড়ে চার লাখ টাকায় কিডনি বিক্রির বন্দোবস্ত হয় যদিও সাড়ে তিন লাখ টাকা হাতে পান। কিডনি বিক্রির টাকা দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা আর কাঠের একটি ছোট্ট ঘর তৈরি করা হয়। বাকি টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করেন। কৃষি জমি নেই। জবকার্ড আছে, কাজ নেই। বিজেপি যুব মোর্চার নেতা নীতু দাসই তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যান। যতই ভেতরে যেতে থাকি ততই দেখি আম জনতার দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে কিভাবে রাজনৈতিক নেতা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রের মুনাফাখোর ব্যবসায়ী-পুলিশ-দালাল চক্রের অশুভ আঁতাত তার জাল প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিছিয়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে পথেই দেখা হল বছর তিরিশের তরতাজা যুবক বুল দাসের সঙ্গে। বুল পেশায় দিন মজুর। বাবা মনোরঞ্জন দাস। চার সদস্যের পরিবার। সাড়ে চার লাখ টাকায় তিনি কিডনি বিক্রি করেছেন এবং সম্পূর্ণ টাকাই পেয়েছেন। এখানেও বিজেপি যুব মোর্চার নেতা নীতু দাসই কিডনি বিক্রি চক্রের আসল পাণ্ডা। এবার এই গ্রামে শেষ যে মানুষটির সঙ্গে দেখা করা হয় তাঁর নাম ভীমরাজ দাস। বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। বাবা প্রয়াত কাদিত দাস। চার সদস্যের পরিবার। কৃষি জমি নেই। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলেই দিনমজুরি করে সংসার চালান। কোনো সরকারি ঘর নেই। জবকার্ড আছে, কিন্তু কাজ নেই। রেশন কার্ড আছে, কিন্তু সরকার নির্ধারিত পরিমাণ চাল পাননা। বন্ধন থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ সুদ সহ দাঁড়িয়েছে এক লাখ কুড়ি হাজার টাকা। এই দেনা থেকে মুক্তি পেতে আবার মহাজনী ঋণ মাসিক ১০ শতাংশ সুদে মাঝে মাঝেই ঋণ নিয়ে থাকেন। এর মাঝেই ভীমরাজের মা মারা যান এবং মেয়ে প্রথম রজঃস্বলা হয়। মেয়েদের প্রথম রজঃস্বলা হওয়া বিষয়টি অসমিয়া গ্রামীণ সমাজে আনন্দের বিষয়। এই সময় তাঁর টাকার প্রয়োজন হওয়ায় তিনি উত্তর ধরমতুলের রমেন দাসের সঙ্গে দেখা করে সমস্যার বিষয়ে জানান। এরপরই কিডনি বিক্রির প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রথমে ভীমরাজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয় গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজে। তাঁকে মাঝে মাঝে হাজার-পাঁচশ টাকা দেওয়া হয়েছিল। ভীমরাজের সঙ্গে গুয়াহাটির হাতীগাওঁ-র সুমি দাসের সঙ্গে পরিচয় করানো হয়, আর পাঁচ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি চূড়ান্ত হয়। ভীমরাজ বাড়িতে এসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করতে দেরি করার দরুণ গুয়াহাটি থেকে তিনজন লোক এসে জোর করে ভীমরাজকে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি ওই তিনজনকে তাড়িয়ে দেন। এরপর সেই তিনজন গিয়ে নেলী থানায় কেস দেন। এটি ২০১৯ সালের ঘটনা। নেলী থানায় পুলিশ ভীমরাজকে ডেকে পাঠায় এবং ধমক দিয়ে কিছু কাগজে সই করিয়ে বলে যে কলকাতায় গিয়ে কিডনি দিতে হবে আর সুমি দাসের সঙ্গে দেখা করতে বলে। এর পরদিনই ভীমরাজ কলকাতায় যান এবং সেখানে তিন মাস থাকেন। তিনি তিন লাখ টাকা পান কিন্তু বাকি দুই লাখ টাকা তাঁকে দেওয়া হয়নি। এনিয়ে সুমি দাসকে ফোন করলে সুমির মোবাইল ফোনের সুইচ অফ থাকে আর তাঁর অফিসেও তালা ঝোলানো থাকে।

অনুরূপ কিডনি বিক্রির ঘটনা নগাওঁ জেলার সদর শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে হুজ কৈবর্ত গ্রামেও সংঘটিত হয়েছে। এটিও অনুসূচিত জাতি অধ্যূষিত গ্রাম। বিষ্ণু গোয়ালা ওরফে বাপোতি শর্মা দাসের বাড়িতে গিয়ে আমরা তাঁরসঙ্গে দেখা করে জানতে পারলাম যে বন্ধন থেকে ঋণের পরিমাণ ৫০,০০০ টাকা আর আশা ইণ্ডিয়াতে ঋণের পরিমাণ ২৫,০০০ টাকা। এবার মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির দেনা শোধ করতে গিয়ে মহাজনী ঋণ মাসিক ১০ শতাংশ সুদে ৭০,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে একেবারে ঋণের ফাঁদে ফেঁসে গেছেন। তারপর সবকিছু থেকে মুক্তি পেতে এবার কিডনি বিক্রি। কলকাতায় তিনি তিন মাস ছিলেন। কিডনি বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা পান। এই গ্রামের কিডনি বিক্রেতাদের চোখে মুখে এক অজানা ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। ফলে আর বেশিদূর এগোতে পারেনি।

কিডনি বিক্রির বিষয়টি ডিব্রুগড় জেলার লাহোয়াল বিধানসভা কেন্দ্রেও সংঘটিত হয়েছে। এখানে কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন আদিবাসী চা শ্রমিকরা। আসলে বিজেপি সরকারের আমলে অসমের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কথা নিতি আয়োগের রিপোর্টেই সামনে এসেছে। অসম দেশের সর্বাধিক ঋণগ্রস্ত রাজ্য। কিছু চমকপ্রদ হিতাধিকারী সৃষ্টির রাজনীতি করতে গিয়ে অসমে উপার্জন ও সংস্থাপনের অর্থাৎ রুটি-রুজির জন্য স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলার বিষয়টি বিসর্জন দিয়েছে। ফলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্র ভেঙে পড়ছে। একটার পর একটা শিল্প মৃত্যুর দিন গুণছে।

অনুন্নত জাতির উন্নয়নের প্রশ্নে অসমে একটি উন্নয়ন বোর্ড আছে। অনুন্নত জাতির উন্নয়নের প্রশ্নে এই বোর্ড মারফত কোটি কোটি টাকা কোথায় যায়? তার খরচ জনসমক্ষে আনা খুবই দরকার। আমরা সদৌ অসম গ্রামীণ শ্রমিক সংস্থা থেকে দাবি করি,

  • (১) কিডনি বিক্রি করা ব্যক্তির পরিবারকে দশ লক্ষ টাকা এককালীন সাহায্য দেওয়া হোক।
  • (২) কিডনি বিক্রি করা ব্যক্তির পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য মাসিক ৭,০০০ টাকা পেনশন দেওয়া হোক।
  • (৩) মানব অঙ্গের কারবারিদের মূল চক্রকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে উচ্চ পর্যায়ের ন্যায়বিচারের তদন্ত কমিটি গঠন করে রাজনৈতিক নেতা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রের মুনাফাখোর ব্যবসায়ী-প্রশাসন-দালাল চক্রের অশুভ আঁতাতের রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক। কারণ বিজেপি যুব মোর্চার নেতা নীতু দাসের কিডনি বিক্রি কাণ্ডে গ্রেফতারির ঘটনা সামনে এসেছে।
  • (৪) রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইণ্ডিয়ার গাইডলাইন ভঙ্গকারী মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির লাইসেন্স তাৎক্ষণিক ভাবে বাতিল করা হোক।

- ভাষান্তর: শুভ্রজ্যোতি বর্ধণ
সভাপতি, সদৌ অসম গ্রামীণ শ্রমিক সংস্থা, অসম রাজ্য সমিতি

insurance liquidation

সম্প্রতি ইন্ডিয়া পলিসি ফোরামের একটি আলোচনাসভায় কেন্দ্রীয় অর্থসচিব জানিয়েছেন যে প্রায় সমস্ত সরকারি ব্যাঙ্ককে বেসরকারিকরণ করা হবে। ব্যাপারটা নিয়ে শোরগোল হওয়ার আশঙ্কায় সঙ্গে সঙ্গে খাবি খেয়ে তিনি যুক্ত করে দিয়েছেন যে এটা তাঁর ব্যক্তিগত মত, সরকারের নয়। ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। ব্যাঙ্ক শিল্পে বড়সড় পরিবর্তন ২০১৯ থেকেই শুরু হয়ে গেছে। ঐবছর আইডিবিআই ব্যাঙ্ক’কে সংকট থেকে উদ্ধার করার জন্য সরকার এলআইসি’র দ্বারস্থ হয়। ক্রমবর্ধমান এনপিএ’র কারণে বিপর্যস্ত এই ব্যাঙ্কটিকে উদ্ধার করার জন্য এলআইসি’কে ৫১ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করতে বাধ্য করা হয়। ২০২০’র এপ্রিল মাসে দশটি সরকারি ব্যাঙ্ক’কে একত্রিত করে (মার্জার) আরও বৃহৎ ও তথাকথিত শক্তিশালী চারটি ব্যাঙ্ক তৈরি করা হয়। ঐ বছরই নভেম্বর মাসে ৯৪ বছর পুরানো লক্ষ্মী নারায়ণ ব্যাঙ্ককে সংকট থেকে উদ্ধার করার জন্য সেটিকে বিদেশী সংস্থা ডিবিএস (ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক অফ সিঙ্গাপুর)-এর সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। এটি একটি অভুতপূর্ব ঘটনা কারণ এর মাধ্যমে ব্যাঙ্কিং শিল্পে বিদেশী পুঁজির প্রবেশ সুগম করে দেওয়া হয়। এরমধ্যে ইয়েস ব্যাঙ্ককে উদ্ধার করার জন্য এসবিআই’এর সাহায্য নিতে হয়। ইতিপূর্বে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রমোটারদের অবিমৃশ্যকারিতার জন্য পিএমসি (পাঞ্জাব এন্ড মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ) ব্যাংকের গ্রাহকদের কী হয়রানি হয়েছে (অনেকে আত্মহত্যা করেছেন) তা আমরা দেখেছি।

নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েও ব্যাংকের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কেন? তাহলে জানতে হয় ব্যাংকের মূল সমস্যা কী? সরকার বলবে সরকারি ব্যাংকের পরিষেবা ভালো না, কর্মচারীরা কামচোর, অফিসাররা দুর্নীতিগ্রস্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলিই সাধারণ মানুষের কাছে সর্বাধিক প্রচারিত এবং সেটাই  কর্মচারী ও গ্রাহকদের মধ্যে সংগ্রামী সংহতি গড়ে তোলার অন্যতম বাধা। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে লাগামছাড়া অনুৎপাদক সম্পদ যেটার বৃদ্ধির জন্যও সরকার অফিসার, কর্মচারীদেরই দোষারোপ করে। ঘটনা হচ্ছে যে কোনও বৃহৎ ঋণ, ১০০ কোটির ওপরে, অত্যন্ত উচ্চপদস্ত আধিকারিক এবং সরকারি কর্তাব্যক্তি, মন্ত্রীদের যোগসাজশ ছাড়া হয় না। যে সব কোম্পানি বা কর্পোরেট সংস্থা এই ঋণগুলি নেয় তাদের সাথে প্রভাবশালী মহলের সম্পর্ক সুবিদিত। মাসের পর মাস এদের ঋণ অনাদায়ী হয়ে পড়ে থেকে, তা উদ্ধারের জন্য সরকারের মনোভাব নিতান্তই দায়সারা। আইডিবিআই ব্যাঙ্ক’কে এলআইসি’র হাতে তুলে দেওয়ার আগের বছর ঐ ব্যাংকের ৩০,০০০ কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ের কারণে ব্যাল্যান্স শিট থেকে মুছে ফেলা হয়েছে, যেটাকে বলে রাইট অফ; সেই ঋণ উদ্ধারের চেষ্টা কেন হল না; সেইসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন নেওয়া হল না? ২০২০ সালে বিবেক ভেলাঙ্কার নামে এক আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট অনুৎপাদক সম্পদ নিয়ে যাবতীয় তথ্য যোগাড় করে জানতে পারেন যে গত আট বছরে বারোটি সরকারি ব্যাঙ্ক ৬.৩২ লক্ষ কোটি ঋণ রাইট অফ করেছে, এরমধ্যে ২.৭৮ লক্ষ কোটি ঋণ বৃহৎ ঋণগ্রহিতা, যাদের ঋণের পরিমাণ ১০০ কোটির ওপরে। ভাবা যায়! অনেক ছোটাছুটি, অনুনয় বিনয় করে ব্যাঙ্কগুলি এদের থেকে মাত্র ৭ শতাংশ অর্থাৎ ১৯,২০৭ কোটি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। এর আগে অন্য লেখায় আমরা দেখেছি যে ২,৪২৬ সংস্থা থেকে ব্যাংকের পাওনা আছে ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা। বারবার আবেদন নিবেদন বিক্ষোভ আন্দোলন সত্ত্বেও এই টাকা উদ্ধারে সরকারের কোনও প্রচেষ্টাই নেই।

সরকারের একটাই দাওয়াই — বেসরকারিকরণ। দুটো ব্যাংকের ওপর কোপ প্রায় নিশ্চিত, মনে করা হচ্ছে একটি সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, আরেকটি ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক। দুটোর ওপরেই কিন্তু আরবিআই’এর নিষেধাজ্ঞা আছে, যেটাকে বলে পিসিএ (প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন)। কেন পিসিএ? না এক বছর আগেও দুটি ব্যাঙ্কই লাগাতার লোকসানে চলছিল এবং অনুৎপাদক সম্পদ বৃদ্ধি হচ্ছিল। লোকসানের ব্যাঙ্ক কে নেবে? আমাদের দেশের কর্পোরেট পুঁজি ঝুঁকি নিতে অপারগ, তৈরি রেডিমেড জিনিষ দাও হামলে পড়বে। সুতরাং ব্যাঙ্ক দুটির ব্যাল্যান্স শিট সাফসুতরো করতে হবে। এরজন্য নানা কল আছে। প্রথম হচ্ছে সরকার বাহাদুর বদান্যতা দেখাবে, সরকারি ব্যাংকের জন্য কুম্ভীরাশ্রু ফেলবে এবং নতুন করে তাতে টাকা ঢালবে! সেন্ট্রাল ব্যাংকে ৪,৮০০ কোটি, এবং আইওবি’তে ৪,১০০ কোটি। কিন্তু এতো বাস্কেট কেস, যা ঢালবে তা চুঁইয়ে নীচ দিয়ে পড়ে যাবে। বছর দুয়েক ঐ কোরামিনের জোরে লাভ করবে, তারপর আবার যে কি সেই!

আরেকটা কল আবার নিয়ে আসা হচ্ছে, অতীতেও ছিল, ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে — ব্যাড ব্যাঙ্ক। নাম থেকেই এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার, যত ব্যাংকের যত এনপিএ আছে তা এখানে সরিয়ে দেওয়া হবে। এ সেই শিবরাম চক্কোত্তির গল্পের মতো, রামের কাছ থেকে ধার নিয়ে একশো টাকা ফেরত দিতে পারছি না তো শ্যামের থেকে নিয়ে রামকে দিলাম; আবার শ্যাম যখন তাগাদা শুরু করলো তখন যদুর কাছে হাত পাতলাম, এইভাবে চলতেই থাকবে। তাহলে ব্যাঙ্ক এখন ঋণ মুক্ত, লাভও হচ্ছে। এবার দুটি ব্যাঙ্কই কোনও ধনকুবেরের মৃগয়াক্ষেত্র হবে, সাধারণ মানুষের হাজারো কোটি আমানত নিয়ে সে যেখানে খুশি বিনিয়োগ করবে, তার নিজের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠবে, ব্যাঙ্ক রুগ্নই থাকবে; অথবা বিদেশী সংস্থা ঢুকবে, সেই রাস্তা তো খুলেই দেওয়া হয়েছে। আর ব্যাড ব্যাঙ্ক এতো অনাদায়ী ঋণ কী করে উদ্ধার করবে? গুড ব্যাঙ্কই যখন পাওনা উদ্ধার করতে পারলো না তখন ব্যাড ব্যাঙ্ক কী করে পারবে? এরজন্য আর একটি কল আগে থেকেই ছিল, ‘ইনসলভেন্সি এন্ড ব্যাঙ্করাপ্টসি কোড’, ব্যাড ব্যাঙ্ক এই ধারাটির সাহায্য নিতে পারে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ভিডিওকন টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদির এক সময়ের বিখ্যাত ব্র্যান্ড। দেউলিয়া ঘোষণা করেছে, বাস্তবে হয়েছে কীনা সেটা সরকার তদন্ত করে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। বিভিন্ন ব্যাংকে কোম্পানির ৪৬,০০০ কোটি টাকা অনাদায়ী লোন, কিন্তু তারা হাত তুলে দিয়েছে, পয়সা নেই! মাত্র ৩,০০০ কোটি টাকায় সেটা বেদান্তকে বেচে দেওয়া হল। ভাবতে পারেন বাকি ৪৩,০০০ কোটি জলে, সাধারণ মানুষের টাকা! লুট চলছে, লুট! ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেবে, খারাপ হয়ে গিয়ে সেটা ব্যাড ব্যাংকে চলে যাবে, নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করবে, জলের দরে সেটা অন্য কেউ কিনে নেবে। এবার ভিডিওকন আর বেদান্তর মধ্যে কী লেনাদেনা হবে সেটা সম্পর্কে কারো কোনও ধারণা নেই।  
উপরোক্ত দুটি ব্যাঙ্ক’কে বেসরকারিকরণের জন্য হয়তো এই বাদল অধিবেশনেই ব্যাঙ্কিং আইনের সংশোধনি আনা হবে। ইনসিউরেন্স বিজনেস আইনেও সংশোধনি হবে কারণ ফেব্রুয়ারিতে বাজেটে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে দুটি ব্যাঙ্ক ছাড়াও একটি বিমা সংস্থা বেসরকারিকরণ হবে। এক্ষেত্রে ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ইনসিউরেন্স-এর নাম বাজারে ভাসছে, অথচ এটি একটি অত্যন্ত লাভজনক সংস্থা। বীমা শিল্পের প্রধান ইউনিয়ন AIIEA এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে, “এর পরিবর্তে তিনটি প্রধান সরকারি বিমা সংস্থার সংযুক্তিকরণ করা হোক”। এই সংস্থা তামিলনাড়ু মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্যবীমা স্কিম এবং মহারাষ্ট্রের জ্যোতিবা ফুলে জনআরোগ্য যোজনা স্কিমের সঙ্গেও যুক্ত। বেসরকারি হয়ে গেলে এই স্কিমগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে তা পরিষ্কার নয়।

এলআইসি’র মতো সংস্থা যেটা প্রতি অর্থবর্ষে প্রায় ৩৫,০০০ কোটি টাকা মতো লাভ করে সেখান থেকেও টাকা উপার্জন করার জন্য উদগ্রীব সরকার। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও আস্থার প্রতীক এলআইসি, এর পরিষেবা নিয়েও সেরকম কোনও অভিযোগ নেই। জীবনবীমায় বিনিয়োগ করলে রিটার্ন কম, কিন্তু নিরাপদ। শুধুমাত্র এই নিরাপত্তার কারণেই ছাপোষা মানুষ কয়েক শতক ধরে জীবনবীমা করার জন্য এই সংস্থারই দ্বারস্থ হয়েছে। নতুন শতাব্দীর শুরু থেকে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলি আগমনের পরেও এখনো ব্যবসার প্রায় ৭৬ শতাংশ এই সংস্থার অধীনে। এখন সরকার ধাপে ধাপে এর ২৫ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যারমধ্যে অন্তত ৫ শতাংশ এই অর্থবর্ষে করার সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো একদিন এই নতুন সংস্থাগুলোও ভালো পরিষেবা দেবে, মানুষের আস্থা অর্জন করবে। কিন্তু একটি লাভজনক সংস্থা যেটি সম্পর্কে গুরুতর কোনও অভিযোগ নেই সেটির থেকে ব্যবসা ছিনিয়ে নিয়ে সরকারের প্রিয় সাঙাতদের বন্টন করা হচ্ছে কেন? এই ভাবেই ছক করে এয়ার ইন্ডিয়া, বিএসএনএল’কেও রুগ্ন করে দেওয়া হয়েছে।

সরকার বলছে তার টাকার দরকার। ব্যাঙ্ক, বীমা বেচে, বিপিসিএলের মতো কোম্পানি বেচে, এলআইসির শেয়ার বেচে সরকার অন্তত ১,৭৫,০০০ কোটি টাকা তুলতে চায় যা দিয়ে তারা নাকি গরীবের জন্য বাড়ি, স্কুল, রাস্তাঘাট ইত্যাদি তৈরি করবে। এদিকে অতিমারির সময়ে মানুষদের খাতায় নিয়মিত কিছু পয়সা দিতে বলুন, টাকা নেই; ফসলের লাভজনক মূল্য দিতে বলুন, টাকা নেই; লাগামছাড়া পেট্রোল, ডিজেল, সরষের তেলের দাম কমাতে বলুন, সরকার নিশ্চুপ। বারবার এটা ওটা বিক্রি করে যে টাকা তোলা হচ্ছে তা যে জনস্বার্থে কোথায় ব্যয় হচ্ছে তা কারোর জানা নেই, যদি না কেউ বলে সেন্ট্রাল ভিস্তা বা বুলেট ট্রেন এগুলোও জনগণের হিতার্থেই করা।

মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে সংযুক্তিকরণ, বেসরকারিকরণ ইত্যাদি হচ্ছে, এতে কী ব্যাঙ্ক পরিষেবা, ঋণ প্রদান বা কর্মচারীদের অবস্থার উল্লেখজনক কোনও উন্নতি হয়েছে? আমরা অনেকেই ব্যাংকের গ্রাহক, তিন বছর আগেকার পরিস্থিতি এবং আজকের মধ্যে লক্ষ্যনীয় কোনও পরিবর্তন কী বুঝতে পারছেন? টাকা তুলতে বা জমা দিতে এখনো কি আগের মতোই সময় লাগছে, ঋণ পেতে এখনো কি জুতোর শুকতলি খয়ে যাচ্ছে? বাজারে কান পাতুন দেখবেন মানুষ এখনো পরিষেবায় বিরক্ত; এখনো শহরের একটু বাইরে গেলেই দেখা যায় কোনো শাখায় দিনের পর দিন নেট থাকেনা, এটিএম বহু জায়গায় বিকল, চালু থাকলেও পয়সা থাকেনা। অতিমারীর ফলে সমস্যা আরও গভীর হয়েছে; স্টাফ সীমিতকরণ করা হয়েছে, যারফলে পরিষেবা ব্যহত হচ্ছে, ব্যাংকের বাইরে লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। কর্মাচারীদের ফ্রন্ট লাইন ওয়ার্কার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বারবার সরকারের কাছে দরবার করতে হচ্ছে, অথচ তাঁদের প্রতিনিয়ত গ্রাহককে পরিষেবা দিতে হচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে তাঁদের টীকাকরণেরও ব্যবস্থা করা হয়নি। সেন্ট্রাল ব্যাংকে ৩৩,০০০ কর্মচারী, আইওবিতে ২৬,০০০ কর্মচারী, এঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এতো কর্মী রাখতে নাকি সম্ভাব্য কোনও ক্রেতাই রাজি নয়। সুতরাং VRS এর প্রস্তাব আসছে। এর আগে বিভিন্ন ব্যাংকে চাপ দিয়ে VRS নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এবারও তাই হবে। গ্রাহক, কর্মচারী সরকারের তুঘলকি নীতিতে বলি হবে। ব্যাঙ্ক, বীমা উভয় ক্ষেত্রেই এই দুই প্রধান অংশীদার যদি সংঘবদ্ধ হয় একমাত্র তা হলেই এই ব্যবস্থাকে রুখে দেওয়া সম্ভব।

- সোমনাথ গুহ

shobha mumnda

তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। চিদাম্বরম ১৯০৮’র ক্রিমিন্যাল অ্যাক্টের এক্সটেনসন করে ইউএপিএ দিয়ে মাওবাদীদের ব্যান করা নিশ্চিত করে ফেলেছেন। শোনা গেল, জয়সওয়াল, তৎকালীন কয়লামন্ত্রী বলছেন যে মুখ্যমন্ত্রী নাকি এই ব্যানের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ‘হ্যাঁ’ এ ‘হাঁ’ দিয়ে এসেছেন। কিন্তু কার্যত তিনি পলিটিক্যাল সলিউসনের কথা দলগতভাবে ভেবেছিলেন। মাও অ্যাক্টিভিস্টদের জন্য ব্যানের চেয়েও কার্যকরী রাস্তার কথা তখন বাংলা ভেবেছিল। এই সাবাশ অর্জনের ঠিক পরেই গৌর চক্রবর্তীকে ধরা হয় এবং ইউএপিএ দিয়ে বিশেষ সংস্থা দমনের ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করে অন্য রাস্তা দেখানোর অভিভাবকরা হঠাৎ গুলিয়ে দেন সব এক নিমেষে। সকলকে অবাক করে মুখ্যমন্ত্রীর আগের ঘোষণাকে ভুল প্রমাণ করে কমিশনার-অফ-পুলিশ গৌতম মোহন চক্রবর্তী জানিয়ে দেন যে, ভারতের আইন ভারতের সর্বত্র প্রযোজ্য বলে দুই মাও আক্টিভিস্টকে ধরা হয়। তাই ‘সরাসরি ব্যান ঘোষিত নয়’ বাংলার পথ সেই ভারতের আইনি সিদ্ধান্তের পথেই মেশে। জল গড়ায়। জেলবন্দীদের নিয়ে প্রতিশ্রুতি ও প্রতিশোধে কী বদল আশা করার ছিল? না, রাষ্ট্র এক ফর্মুলাতেই চলে। যদিও সাম্প্রতিক ৬৩ জনের মুক্তির ঘোষণানামায় কে কিসের ভিত্তিতে মুক্ত হচ্ছে তা কুয়াশা মোড়া। জেলবন্দীদের মুক্তিকে মেইনষ্ট্রিমের ভাবনায় জায়গা দিতে গেলে ও সেই অরবিটে গতি আনতে গেলে যা করার কথা তা নাগরিক সমাজকে মাথায় নিয়ে ঘুরতে হবে। কিন্তু তাদের তো নানা কাজ। নানা প্রায়োরিটিজ। নানা জটিল অঙ্ক। যাক, শেষমেশ শোভা মুন্ডাদের বন্ধ হয়ে যায় সংশোধনাগারে ফ্রেন্ডস মিটিং-এর অপশনটাও। কার্যত পরিবার ছাড়া কারও দেখা করার অনুমতি নেই ওদের। ভিনরাজ্যের বন্দীদের আবার শেকড় বিহীন অবস্থা। পরিবারের হাতটুকুও ছুটেছে। শুধু কেমন আছে শোভা সেটুকু জানাই দুরূহ। শোভার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা এরকম। উপরতলার অনুমতি ছাড়া কিছু জানা যাবে না। আর উপরতলার অনুমতি আদায় করা একরকম ‘না’ বরাবর। তবুও হোপ এগেইনষ্ট হোপ তো বেঁচে ও বাঁচিয়ে রাখার অমোঘ পাথেয়।

স্ট্যান স্বামীর জন্য আপনি ফেসবুক পোষ্ট লেখেন। প্রবন্ধ লেখেন। রাষ্ট্রীয় হত্যার বিরুদ্ধে গলা চিরে স্লোগানও দেন। কিন্তু আপনি শোভা মুন্ডাকে চেনেন না। নাম শুনেই পালিয়ে বাঁচেন। মাওবাদী কানেকশন? হ্যাঁ, এসবে আপনাকে থাকতে নেই। কারণ আপনি ফ্যামিলিম্যান ও আপনি একটি সরকারি চাকরি করেন। পাছে শোভা মুন্ডার নাম জেনে ফেললেও যদি আপনার কাঁচের বাড়িটায় ঢিল পড়ে যায়! আপনার কাল্পনিক ভয়ের কলেবর বাড়াতে আপনি কী সুন্দর কতগুলি উদাহরণের ইঁট সাজিয়ে ফেলে বলেন, সরকারি লোকদের বন্দীর মুক্তি চাইলে সরকার রুষ্ট হয়ে যাবে। আপনার এই যুক্তি আপনার পরের প্রজন্মকে পঙ্গু করছে। আপনার এই এসকেপিস্ট মানসিকতা ওদের মনের পরিসর ঘিঞ্জি করছে। ওরা দেখছে আপনি শোভা মুন্ডার নাম শুনেই সরকার টেনে এনে খাড়া করছেন। সরকারি চাকরি করা মানে নিজের মস্তিষ্ক ও নীতি বন্ধক রাখা নয়। নিজের কাজের সময়টুকুতে সৎ পরিশ্রম করা ও বিনিময়ে পারিশ্রমিক পাওয়া। স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর প্রতিবাদ আপনি করেছেন। ওতো দূরের ব্যাপার। দেখতে যাওয়ার দায় বর্তাবে না। তাই না? একজন অপর্না সেন ও কৌশিক সেনকে নিয়ত খুঁজে বেড়াই আমরা। ওদের হাতের মোমবাতিতেই আগুন দিতে চাই। কেননা ওই আলোটি আমরা নিজের মুখে চাই। একেবারেই স্ট্যান স্বামী আপনার কন্সার্ন নয়। আপনার কন্সার্ন একদম আপনি। যদি স্ট্যান স্বামীকে আপনি বোঝেন তো শোভা মুন্ডাকেও বোঝেন! বাড়ির পাশের প্রতিদিনের আপনার যাওয়া-আসার রাস্তায় পড়ে বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের লাল দেওয়াল। আপনি চেনেন। ওই লাল দেওয়ালে নজরুল আটক ছিলেন। বলেন এবং গর্ব করেন।

আর ওই দেওয়ালের পেছনে এক মহিলা দশ বছর আটকে আছে। আপনি জানেন না। কেননা শোভা মুন্ডার বন্দীত্ব আপনাকে বিচলিত করে না। কেননা আপনি নারী-পুরুষ বলে নয়, সকলের জন্য লড়েন। এই তো আপনার মত! তবে আপনি একজন ঘোরতর মিথ্যাবাদী। মহিলা জেলবন্দী নিয়ে আপনার সমস্যা হয়না। কেননা আপনি খুব ইনসেন্সিটিভ। এক মহিলা তার হাতখরচ ও অন্তর্বাসের জন্য আবেদন করে, সেটা পৌঁছালে নেওয়া হয় না। কারণ সে একটি বিশেষ ইজিমে বিশ্বাস করে। আপনিও করেন। হয়ত অন্য। তাই বলে মহিলাটিকেই আপনার বিবেক থেকে অদৃশ্য করে দিতে চান! স্ট্যান স্বামীকে শুধু কেন তবে রাষ্ট্রীয় হত্যা বলছেন? কেন সিভিল সোসাইটির নীরবতার অপরাধ বলছেন না? আমরা ক’দিন কাজে ছুটি নিয়ে ধর্নায় বসেছি? যখন স্ট্যান স্বামী ডায়ালিসিসের আবেদন করেও অনুমতি পাচ্ছিল না? কটা ওয়েবিনার করেছি এই মৃত্যু আটকাতে? কটা পোস্টার তৈরি করেছি ওনার মুক্তির আবেদনের জন্য? আমরা শোভা মুন্ডাকেও এভাবেই হারিয়ে ফেলবো হয়ত। এইরকম অনেক বন্দীকেই এক এক করে। একদিন আমাদের ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। তারাও স্ট্যান স্বামী আর শোভা মুন্ডার মতো জেলে পড়ে থাকবে বছরের পর বছর। সেদিন এভাবেই পথ দিয়ে সকলে হেঁটে যাবে। কেউ দল, কেউ সরকারি চাকরির দোহাই দিয়ে এদের নাম শুনে রাস্তা বদলে চলে যাবে। আপনার বিপদ শুধু আপনার একার হবে। কেননা এই স্বার্থপরতা আর বিভাজনের বীজ আপনি নিজেই বপন করে চলেছেন দিনের পর দিন। সেই পথ ধরে আপনার পরবর্তী প্রজন্ম এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে যে সে বিশ্বাস করবে দাসত্বই জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। বিশ্বাস করতে শিখবে যে রাষ্ট্রের ভয়ের জুজু খাড়া করে নিজেদের কাপুরুষত্বের পিঠ চাপড়ানোর নামই বুঝি জাতীয়তাবাদ। এদের কোনও ইজম থাকবে না। ছাতা থাকবে একটা। যা নিজেদের বাঁচানোর অস্ত্র বা আশ্রয় হবে। এরাই ঐক্যবদ্ধ সুন্দর সমাজের ক্ষতিকারক মেটেরিয়াল হয়ে উঠবে। শোভারা যা বিশ্বাস করে করেছে। রাষ্ট্রের হিসেবে সেটা ঠিক হোক, ভুল হোক, শোভা নিজের মতো করে লড়াই চালিয়ে গেছে। এরা সমাজের ভাঙা-গড়ার উদ্দীপক। এদের অবহেলা নয়, সুবিচার প্রাপ্য। শোভাদের এড়িয়ে যাওয়া চরিত্র ও নামগুলি মনে রাখুন। রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা থেকে এড়িয়ে যাওয়া মুখগুলি স্মরণে থাকুক। শোভা আমাদের সহনাগরিক। আসুন তারাই শোভার জন্য লড়ি যাদের জেলের ভয় আর চাকরি হারানোর ভয় নেই! হ্যাঁ, বিবেক আর মনুষ্যত্ব হারানোর ভয় আছে! আর আমরা মানুষকে মানুষ ভাবব এটাই সভ্যতার প্রথম ও প্রধান সত্য। তার রাজনৈতিক পরিচয়, তার লড়াইয়ের পথ। সেটা আজ নিষিদ্ধ, কাল হয়ত নিষেধাজ্ঞার বেড়া পেরিয়ে যেতেও পারে। তাই শোভা মুন্ডা কেমন আছেন জানব। হাজার বার জানতে চাইবো! ভাববো সব মহিলা ও অনান্য জেলবন্দীর কথা। কেননা কোনও মানুষের মুক্ত থাকা, স্বাধীন থাকা রাষ্ট্রের শর্তাধীন নয়। সংশোধনাগারও মানুষের মুক্তির পথ দেখানোর জন্য। উকিল, আইন, কোর্ট, বিচার মানুষের জীবন রক্ষার কবচ। এগুলিকে সুনিশ্চত করা নাগরিক দায়। শোভার অধিকারের লড়াইতে আপনি শামিল? স্পষ্টভাবে সঙ্গে আছেন? তো আসুন। সঙ্গে নেই? জোরে বলুন! আপনার অভিমত সম্মানের ও গুরুত্বের, যতক্ষণ আপনি নিজের ও অন্যের কাছে আপনার মত নিয়ে স্পষ্ট।

শোভার উকিল, যিনি শোভার যাবজ্জীবন হওয়ার কেসটি রাঁচি হাইকোর্টে লড়ছেন তাকে নয় বছরে কেউ একটি ফোনও করেনি। শোভা কেমন আছেন জানার কেউ নেই। সেটাই স্বাভাবিক। যে দেশে জিন্স পরার অপরাধে মেয়েদের প্রাণে মরে যেতে হয় সেখানে আবার বিপ্লবী শোভা! এবং মাথায় পুরুলিয়া, বাংলা, ঝাড়খন্ডে এতগুলি কেস। তাই স্বাভাবিকভাবেই সে ব্রাত্য। লকডাউনের আগে ডিসেম্বর মাসে ছিল শোভার শুনানির ডেট। বেলপাহাড়ির ভুলাভেদার আদিবাসি মেয়ে ক্ষেপির মধ্যে যে বিপ্লবের আগুন ছিল তা তাকে শোভা বানায় আর শোভাকে মানুষ হিসেবে দেখার চিরন্তন চোখ আমাদের শোভার কাছে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। হ্যাঁ, ছুটছি আমরা। শামিল হোন সকলে। ‘আমিও শোভা’ এই মিছিলের লাইনটা লম্বা হোক আরও। মহিলাদের মুক্তি, সংশোধনাগারের উদ্দেশ্য ও ভাবনাকে সফল করুক। সুবিচার মনুষত্বের মুক্তি ঘটাক। রাষ্ট্র জেলবাসীদের নিবিড় পরিচর্যায় আর একটু মানবিক হোক। অপরাধীকে নয় অপরাধকে ঘৃণা করার অভ্যস গড়ে তুলুক এই সমাজ।

- জিনাত রেহেনা ইসলাম

a few words about UGC

ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত একটি নয়া পাঠ্যক্রম প্রকাশ করা হয়েছে। এই পাঠ্যক্রমের স্বঘোষিত উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থার নিরিখে ভারতীয় ইতিহাসের স্নাতকস্তরের শিক্ষায় মৌলিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য কী? সব ধরনের ‘অপ্রয়োজনীয়’ বর্গকে সঙ্কীর্ণ ঘেরাটোপ মনে করা ও তাকে পেরিয়ে জাতির গৌরবময় অতীত তথা ইতিহাসের নতুন নির্মাণ। এই তথাকথিত নতুন নির্মাণ অবশ্য এক অর্থে খুবই পরিচিত ও সেকেলে। হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসচেতনার পরিবর্তন বিমুখতা হিসেবে আমরা অনেকদিন ধরে এই ধারাটিকে চিনি। সেটিই আবার নতুন চেহারায় সামনে এনেছে ইউজিসি।

অধ্যাপক ইরফান হাবিব ‘সোসাল সায়েন্টিস্ট’ পত্রিকায় তাঁর সদ্য প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এই পাঠ্যক্রমটির নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি এর আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক চরিত্র, চূড়ান্ত অপেশাদারী মনোভাব, নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও একাধিক পাঠগত সমস্যা তুলে ধরেছেন। ইউজিসি নির্দেশিত ‘অপ্রয়োজনীয়’ তালিকায় রয়েছে লৌহ প্রযুক্তি ও দ্বিতীয় নগরায়ণের বিতর্ক, আদিপর্বের বর্ণ-জাতি ব্যবস্থা, আদি-মধ্যযুগীয় আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ও সামন্ততান্ত্রিক বিতর্ক, আলাউদ্দিন খলজীর অর্থনৈতিক সংস্কার, শেরশাহের প্রশাসনিক সংস্কার, আকবরের ধর্মচিন্তা, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের শাসন, অষ্টাদশ শতকের বিতর্ক। পাঠ্যক্রমের পরিসর থেকে অপসারিত হয়েছেন বীরসা, আম্বেদকর, ফুলে, রামমোহন, বিদ্যাসাগর। দলিত ও নারী আন্দোলনের ইতিহাসের ভাগ্যেও জুটেছে অপ্রাসঙ্গিকতার তকমা। প্রায় অবধারিতভাবেই এই পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি শিরীন রত্নাগর, রামশরণ শর্মা, দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা, উমা চক্রবর্তী, রাজন গুরুক্কল, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সরকার, হরবন্স মুখিয়া, ইরফান হাবিব, সৈয়দ রিজভী, মুজফ্‌ফর আলম, সঞ্জয় সুব্রাহ্মন্যম, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বময় পতি সহ একাধিক ইতিহাসবিদের গুরুত্বপূর্ণ প্রচলিত গবেষণাগ্রন্থ ও পাঠ্যপুস্তক। প্রস্তাবিত গ্রন্থপঞ্জীতে আর্য সমস্যা, অশোকের ধম্মনীতি থেকে সুফীবাদ, কৃষক ও আদিবাসী বিদ্রোহ, মুসলীম লীগ এবং গান্ধীর রাজনৈতিক আন্দোলন পর্যন্ত বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মৌলিক গ্রন্থগুলির লক্ষণীয় অনুপস্থিতিও হতাশাজনক। সর্বভারতীয় শিক্ষাক্রমে দেশীয় আঞ্চলিক ভাষার গ্রন্থতালিকায় কেবলমাত্র হিন্দীভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তকের উপস্থিতি হিন্দুত্ববাদের মজ্জাগত হিন্দী আধিপত্য এবং ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের আরেকটি উদ্ভাস মাত্র। আন্তর্জাতিক শিক্ষাস্তরের সাথে প্রতিযোগিতায় আদি ভারতের ইতিহাসের পর্যালোচনা থেকে বিলুপ্ত হয় মার্ক্সীয় ব্যাখ্যাসহ অন্যান্য সুপ্রতিষ্ঠিত সাম্প্রতিক গবেষণা, মধ্যকালীন দক্ষিণ ভারতের গবেষনাগ্রন্থের সাক্ষাৎ মেলে ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাসের পাঠ্যসূচীতে, আবার খ্যাতনামা ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র সহজেই রূপান্তরিত হন বিপিনচন্দ্র পালে। শিক্ষামানে উন্নতির আশায় ভারতীয় ইতিহাসচর্চার সাম্প্রতিক গবেষণার প্রসারকে অগ্রাহ্য করে কয়েক দশক পিছিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক স্বার্থপ্রণোদিত এই কপট স্ববিরোধীতা ও চরম অপেশাদারী আচরণ নিঃসন্দেহে দৃষ্টিকটু।

অন্যদিকে, সাধারণ কালানুক্রমিক রাজনৈতিক ইতিহাস সহ, এই নব্যধারার ইতিহাসশিক্ষার পরিসরে অত্যাবশ্যক পাঠ্যরূপে প্রতিভাত হয় ‘ভারতের’ শাশ্বত ধারণা ও তার গৌরবময় সাহিত্য, ভারতীয় বীরত্বের নৈতিক চরিত্র, গৌরবময় জাতীয় ঐতিহ্যের পাঠ, আর্যদের ভারতীয় পরিচিতি, রাজপুতদের মহিমান্বিত ইতিহাস, আফগান ও মুঘল শাসনে জাতিব্যবস্থা, দেশভাগের ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের ভূমিকা ইত্যাদি একাধিক উল্লেখযোগ্য বিষয়। উচ্চশিক্ষারস্তরে নতুন গবেষণার সিদ্ধান্ত এবং তার ব্যাখ্যা ও সমালোচনা সংযোজনের যে রীতি রয়েছে, তর্কবিরোধী এই পাঠ্যক্রমের লক্ষ্য তাকে সমূলে বিনাশ করা। প্রশিক্ষণগত স্তরে এই অনুশীলনের অভাবের পরিণাম ভারতীয় ইতিহাসের ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণিকক্ষের আলোচনা থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে ইতিহাসের অপ্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু, আর তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত থাকবে রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবীকতা।

ঊনিশ শতক থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ভারতীয় আধুনিক ইতিহাসচর্চায় নানারকম বয়ান ও তাদের দ্বন্দ্বমূলক সহাবস্থান রয়েছে। ঔপনিবেশিক, জাতীয়তাবাদী, মার্ক্সীয়, সংশোধনবাদী, নিম্নবর্গীয়, দলিত, নারীবাদী – প্রভৃতি নানা বয়ানের সাথে বিজড়িত বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও পাঠপদ্ধতি বারংবার প্রশ্ন তুলেছে প্রচলিত তথ্যসূত্রের আপাত সুষম পাঠ ও বিশ্লেষণের দিকে। ফলত, অতীত ও বর্তমানের নিরন্তর সংলাপে উঠে আসা প্রশ্নের নিরিখে, প্রতিষ্ঠিত প্রমাণের পাশাপাশি বিভিন্ন সম্ভাবনার খোঁজে ঐতিহাসিকেরা প্রতিনিয়ত ফিরে গেছেন তথ্যসূত্রের পুনর্পাঠে। আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, লিঙ্গ, যৌনতা, পরিবার, স্মৃতি, সংস্কৃতি, বিনোদন, খেলা, পরিবেশ, ইত্যাদি বিবিধ স্তরে ভারতীয় ইতিহাসচর্চার নানা দৃষ্টিভঙ্গীর প্রসারের সাথেই উঠে এসেছে বিজড়িত বহু গোষ্ঠী জনজাতি ও সম্প্রদায়ের অপ্রকাশিত বয়ান। আর এই নিরিখেই প্রসঙ্গত উঠে এসেছে ইতিহাসের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার নৈতিক দায়বদ্ধতা, জ্ঞানের জগতে অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিত্বের আঙ্গিকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কার্যত, উত্তরের সন্ধানের সাথেই বদলাতে থাকে আকরের রূপ, তথ্যের চরিত্র, ইতিহাসের উপাদানের সন্ধান ছাপিয়ে যায় মহাফেজখানা, যাদুঘরের গন্ডী। ফলত, অতীতের আকর মেলে বনে, ক্ষেতে, গলি-রাজপথে, স্মৃতির বয়ানে, নিঃশব্দতায়, মিছিলে, গানে, ছবিতে, নিত্যসামগ্রী ও জীবনের ছন্দেও।

বস্তুত, ইতিহাসের প্রেক্ষিতে হিন্দুত্বের ‘বাদ’ বলতে যা কিছু বোঝায় এসবই তার বাদের খাতায়। হিন্দুজাতীয়তাবাদী ইতিহাসের বয়ান মূলত ঔপনিবেশিক বর্গবিন্যাস ভিত্তিক, যা তার আপাত বিরোধিতার অন্তরালে সেই ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদী চেতনাকেই পুষ্ট করে চলে। কালানুক্রমিক রাজনৈতিক আখ্যান যে কোনো জাতির অভিনব সামগ্রিক ইতিহাস নয় বরং ইতিহাসচর্চার এক প্রাথমিক ধাপ মাত্র, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিজ্ঞানসম্মত তথ্যনিষ্ঠার অভিনবত্বের পোষাকে এই পাঠ্যক্রম সেই উনিশ শতকের অচল ইতিহাসচর্চার প্রণালীকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে ভারতীয় ইতিহাসের বহুমাত্রিকতার সম্ভাবনাকে নির্মূল করতে সচেষ্ট হয়েছে। এই নয়া ইতিহাসের সারবত্তায় থাকা বৃহৎ কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের আখ্যান ও তৎমধ্যবর্তী অরাজকতা, বৈদেশিক আক্রমণের মূল ধারাবিবরণীর আত্মীকরণের প্রক্রিয়ায় বিলীন হয়ে যাবে বিষম অভিজ্ঞতার বহুস্বরের সম্ভাবনা, ইতিহাসের আঙিনায় অব্যক্ত সার্বভৌমত্বের অভিব্যক্তি। সুতরাং প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক সত্যরূপে এমন একটি সঙ্কীর্ণ একরৈখিক রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক পরিসরের কল্পনা এই পাঠ্যক্রমে পরিবেশিত হয়, যার মালিকানা কেবল অভিজাত, শাসকগোষ্ঠীদের কুক্ষিগত। জনসাধারণের জীবন অভিজ্ঞতার, বহুত্বের, আর্থ-সামাজিক কাঠামোর ও দৈনন্দিন বর্ণ-জাতি, ধর্ম ও লিঙ্গ ভিত্তিক হিংসার মুখে প্রতিস্পর্ধা, বিতর্ক, বিরোধ, সংগ্রাম, বোঝাপড়ার পাঠ জাতিরাষ্ট্রের এই সন্দর্ভে ব্রাত্য ও বিস্মৃত। কেন্দ্রীয় সার্বভৌম শাসনের উত্থান পতনের এই বৃত্তান্তের মৌলিক অভিপ্রায় ইতিহাসের পরিবর্তনশীলতার জটিল প্রক্রিয়ার নিবিড় পাঠ নয়। বরং বিস্মৃতি উৎপাদনের যাঁতাকলে এই পরিবর্তনশীলতার পাঠপ্রক্রিয়ার গতিরোধ এবং সার্বিক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রনের রাজনীতিকে  সভ্যতার ঐতিহাসিক অনিবার্যতার বৈধতা দান করার বাসনা।

একথা অনস্বীকার্য যে, অতীতের তথ্যসূত্র বিশ্লেষণে আদর্শ নৈর্ব্যক্তিকতার সন্ধান নিছকই অবান্তর। বৌদ্ধিক ইতিহাসচর্চার নিরীক্ষায় বহু সুপ্রতিষ্ঠিত নৈর্ব্যক্তিক মহাগ্রন্থের পরতে-পরতে মেলে স্বনামধন্য ইতিহাসকারদের তৎকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের সূত্র। স্বভাবতই, প্রতিটি ইতিহাসের পাঠেই তত্ত্ব বা দৃষ্টিভঙ্গীর, ভাবকল্পের অথবা কোনো তথ্যসূত্রের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়, কেননা গবেষকদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির পাঠেই তাদের জিজ্ঞাসার বীজ সুপ্ত থাকে। ফলস্বরূপ, ইতিহাসের একটি বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে এমন সন্দর্ভ নির্মিত হয় যা ভিন্নধর্মী বিশ্লেষণের নিরিখে আলোচিত ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় বিজড়িত সম্পর্কগুলির নানা বৈশিষ্ট্য ও প্রেক্ষাপটকে করে তোলে বাঙ্ময়। বিবিধ সামাজিক অবস্থানের সমীকরণ থেকে উত্থাপিত প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যসূত্রগুলির পাঠ জন্ম দেয় ভিন্নতর দ্যোতনার। লিখিত বা বস্তুগত উপাদানগুলির স্বচ্ছ মাধ্যমরূপে অতীতের তথ্য সরবরাহ করার যে একমাত্রিক কল্পনা এই পাঠ্যক্রমে উপস্থিত তা অতীতের বহুদ্যোতনার অনুসন্ধানের পরিপন্থী। বিজ্ঞানলব্ধ নতুন তথ্যের নিছক উপস্থিতিতে নয়, ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু এবং বিদ্যমান গবেষণার নিরিখে সেই নতুন তথ্যের জ্ঞানগত বৈশিষ্ট্য, পটভূমি ও মতাদর্শের পারস্পরিক সম্পর্কের সুচিন্তিত গভীর পর্যালোচনার প্রশিক্ষণেই নিহিত থাকে কাঙ্খিত অভিনবত্বের সম্ভাবনা।

এই সকল আশঙ্কা যে নিতান্তই অমূলক নয় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে পাঠ্যক্রমের ভারতের জাতীয় ঐক্যের ধারণাকে প্রাচীনত্ব প্রদানের প্রকল্পে। সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক ‘ভারতের ধারণা’ পরিকল্পিত হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারণার গৌরবপ্রচারের ভিত্তিতে যেখানে জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যের সামান্য উল্লেখ ব্যতিরেকে ভারতীয় গৌরবময় সাহিত্যরূপে পাঠের সম্মান লাভ করেছে বেদ, স্মৃতি ও পুরাণ। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ অথবা দলিত-বহুজন ও লিঙ্গ রাজনৈতিক সমালোচনামূলক পাঠের স্থান গৌরবময় সাহিত্যের পঠনে প্রশ্নাতীত। জাতীয় চরিত্রের রূপকল্প নির্মাণের পরিপন্থী, স্বতন্ত্র জনপদ সন্নিবিষ্ট ভারতবর্ষের আদি ভৌগোলিক পরিচয়ের উন্মুক্ত সীমানার ধারণা ও ভারতীয় ঐক্যচেতনার আপাত আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যের ঐতিহাসিকতা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত। প্রসঙ্গত, আর্য সমস্যার পঠনে পূর্বশর্তরূপে আর্যদের দেশজ উৎসের ধারণাকে সত্যরূপে উপস্থাপনের নির্দেশও একই প্রবণতার সাক্ষ্যবাহী। বলাবাহুল্য, হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের প্রকল্পে ইতিহাসচর্চা কেবল অন্তরায় মাত্র। তবে ইতিহাসচর্চার এই বিকৃত সংস্করণই যে জনপরিসরে সর্বাধিক পরিচিত তা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি তার দায়বদ্ধতা বর্তায় পেশাদারী ঐতিহাসিক ও গবেষকদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে নিমগ্ন থাকার প্রবণতায়। একথা সহজেই অনুমেয় যে, ভারতীয় জনমতে ব্রাহ্মণ্যবাদী, পুরুষতান্ত্রিক এবং সাম্প্রদায়িক জল্পনা ও অতিকথনের যে উর্বরভূমিতে হিন্দুত্ববাদী ধারণার আধিপত্য ও আত্মীকরণের প্রসার, কার্যত তা জনজীবনে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণাপ্রসূত সাম্প্রতিক বয়ানের অনুরণনের অনুপস্থিতির ফল। অন্যদিকে, বহু দশকব্যাপী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমান্তরাল ব্যবস্থারূপে হিন্দুগৌরবের যে সর্বগ্রাসী আত্মীকরণের আখ্যান নানা রূপে সমাজের ভিন্নস্তরে প্রচারিত হয়েছে তার ফলস্বরূপ ক্রমশই জাতীয় ব্যক্তিত্বের প্রধান সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণীয় চরিত্র শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। প্রাথমিকস্তরে, এই প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রমের পরিকল্পনা সেই সমান্তরাল বিদ্বেষমূলক ‘অনৈতিহাসিক’ বিবৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদারী ইতিহাসচর্চার বৈধতা ও আনুকূল্য প্রদান করা, যা স্বভাবতই হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগরিষ্ঠতার রাজনীতিকে পুষ্ট করবে। তবে আপাতভাবে এই সুস্পষ্ট পরিকল্পনার গভীরে ক্রিয়াশীল রয়েছে বিস্মৃতির কারখানা যার কার্যকারিতা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষাস্তরে, প্রাতিষ্ঠানিক বৃত্তে ও বাইরে, একটি একমাত্রিক প্রয়োজনীয় বয়ানের অনুশীলনের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে  আগামী প্রজন্মের চিন্তার পরিসরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কেবলমাত্র গবেষকের সংশয়বাদী মনোভাব ইতিহাসের এই আগ্রাসী আত্মীকরণ ও বিকৃতির প্রতিরোধ হিসেবে যথেষ্ট নয়। আর্থসামাজিক কাঠামোগত বৈষম্য ও হিংসার বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি এবং পেশাদারী গবেষণার নিজস্ব গণ্ডীর বাইরে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কার্যকরী হয়ে ওঠা আবশ্যিক।

প্রসঙ্গত, জ্ঞানচর্চার গন্ডীতে এই সাধারণ সংযোগহীনতার দৃষ্টান্ত আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে জ্ঞানের নির্মাণপদ্ধতি এবং আনুষঙ্গিক আর্থসামাজিক বৈষম্য ও সাংস্কৃতিক মূলধন বিষয়ক তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নেরও অবতারণা করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আভিজাত্যের সীমা অতিক্রম করে গবেষকদের নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান ও সহজাত ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতনতার সাথে সাথেই ইতিহাসচর্চার ভাষা ও বর্গের ব্যবহারে আনতে হবে সামাজিক ন্যায়ের দাবিগুলির অভিব্যক্তি ও বিচার। প্রাতিষ্ঠানিক সীমানা পেরিয়ে সুচিন্তিত গবেষণাপদ্ধতির প্রশিক্ষণের পরিসর করে তুলতে হবে সহজলভ্য ও ব্যাপক। জ্ঞানগত বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ভিন্ন প্রান্তিক পরিচিতির অতীত চেতনার অভিব্যক্তিকে উপস্থাপিত করতে হবে সংলাপের সমস্তরে। সাধারণের অতীতের অধিকারের প্রকাশ জাতিরাষ্ট্রের বিজ্ঞানসিদ্ধ একক ঐতিহাসিক সত্যে আত্মীকরণের অনুগ্রাহীতাই নয়, বরং জ্ঞাননির্মাণের প্রক্রিয়ায় তাদের সচেতন অংশীদারিত্বে।

- সাগ্নিক সাহা

comrade minu

comrade minuজলপাইগুড়ি জেলার পার্টি সদস্য কমরেড মিনু দেবগুপ্ত ৫ আগস্ট রাতে শিলিগুড়িতে আনন্দলোক নার্সিং হোমে প্রয়াত হয়েছেন। তিনদিন আগে লাটাগুড়ি থেকে ময়নাগুড়ি মোটরবাইকে আসার পথে তিনি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। আশংকাজনক অবস্থায় প্রথমে জলপাইগুড়ি হাসপাতাল, তারপরে সেখান থেকে শিলিগুড়িতে নিয়ে আসা হয়। সমস্ত ধরনের চিকিৎসা সত্ত্বেও তাঁকে রক্ষা করা যায়নি। কমরেড মিনুদের বাড়ি দীর্ঘদিনের পার্টির আশ্রয়স্থল। তিনি ছিলেন জলপাইগুড়ি জেলা কমিটির সদস্য প্রদীপ দেবগুপ্তের জীবনসঙ্গী। এই আকস্মিক মৃত্যু জলপাইগুড়ি জেলার পার্টি সংগঠনের সবার কাছে বিরাট আঘাতজনক। শোক ও সমবেদনা জানানোর কোনো ভাষা নেই। জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলার কমরেডরা, পার্টির রাজ্য সম্পাদক সকলে অন্তিম শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন।

কমরেড মিনু দেবগুপ্ত লাল সেলাম।

comrade Lutfar Rahman

গত ৩১ জুলাই সিপিআই(এমএল) মালদহ জেলা কমিটির সদস্য লুৎফর রহমান কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে বয়স ছিল ৬৫ বছর। দীর্ঘ দিন শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। মালদহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।সেখান থেকে পরে কলকাতায় আসতে বাধ্য হন। শ্বাসকষ্টজনিত রোগেই মারা গেলেন।

আশির দশকের শেষ দিকে তাঁর পার্টিতে আসা। কালিয়াচকের গ্রামাঞ্চলে এবং জেলার অন্যত্র অনেক লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তিনি জেলার সামনের সারিতে আসেন। সাহসী দক্ষ সংগঠক ও সুবক্তা ছিলেন। একসময় কিছুদিন জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েও কাজ করেন। সম্প্রতি জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে কাজ করছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে সংগঠনের খুব ক্ষতি হল।

কমরেড লুৎফরের বাড়ি কালিয়াচকের নবীনগর গ্রামে। পরিবারে তিনি রেখে গেলেন তাঁর স্ত্রী, দুই পুত্র ও তিন বিবাহিতা কন্যাকে। তাঁর প্রয়াণে পার্টি সংগঠন গভীর শোকাহত। কমরেড লুৎফর রহমান রহমান লাল সেলাম।

Comrade Lalda

৪ আগস্ট সকালে প্রয়াত হয়েছেন লালদা (অশোক মুখার্জি)। তিনি দুরারোগ্য ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ৯০-এর দশকে বামফ্রন্ট বহির্ভূত বাম দলগুলির বাসভাড়া বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি আইপিএফ’এর সাথে যুক্ত হন, সেইসময় চুঁচুঁড়ায় ব্যাঙ্কের সামনে এক বন্ধ্ কর্মসূচি চলার সময় পুলিশ অন্যদের সাথে তাঁকেও গ্রেপ্তার করে। তিনি নিয়মিত সক্রিয় রাজনৈতিক কাজে যুক্ত না থাকলেও দেশব্রতীর নিয়মিত পাঠক ছিলেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে পার্টিকে অর্থ সাহায্য করতেন। অসুস্থ অবস্থায় তিনি গত ১১ জুলাই স্ট্যান স্বামীর হত্যার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগদান করেন। লালদা হাওড়ার একটি স্কুলে অঙ্কের শিক্ষকতা করতেন এবং সেখান থেকে সদ্যই অবসর নিয়েছিলেন। লালদাকে লাল সেলাম।

*****

১৩ আগস্ট কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার ৫০ বছর স্মরণ

খণ্ড-28
সংখ্যা-29