ইউজিসি’র নয়া ইতিহাসের পাঠ্যক্রম ও তার উদ্দেশ্য নিয়ে কয়েকটি কথা
a few words about UGC

ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত একটি নয়া পাঠ্যক্রম প্রকাশ করা হয়েছে। এই পাঠ্যক্রমের স্বঘোষিত উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থার নিরিখে ভারতীয় ইতিহাসের স্নাতকস্তরের শিক্ষায় মৌলিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য কী? সব ধরনের ‘অপ্রয়োজনীয়’ বর্গকে সঙ্কীর্ণ ঘেরাটোপ মনে করা ও তাকে পেরিয়ে জাতির গৌরবময় অতীত তথা ইতিহাসের নতুন নির্মাণ। এই তথাকথিত নতুন নির্মাণ অবশ্য এক অর্থে খুবই পরিচিত ও সেকেলে। হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসচেতনার পরিবর্তন বিমুখতা হিসেবে আমরা অনেকদিন ধরে এই ধারাটিকে চিনি। সেটিই আবার নতুন চেহারায় সামনে এনেছে ইউজিসি।

অধ্যাপক ইরফান হাবিব ‘সোসাল সায়েন্টিস্ট’ পত্রিকায় তাঁর সদ্য প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এই পাঠ্যক্রমটির নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি এর আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক চরিত্র, চূড়ান্ত অপেশাদারী মনোভাব, নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও একাধিক পাঠগত সমস্যা তুলে ধরেছেন। ইউজিসি নির্দেশিত ‘অপ্রয়োজনীয়’ তালিকায় রয়েছে লৌহ প্রযুক্তি ও দ্বিতীয় নগরায়ণের বিতর্ক, আদিপর্বের বর্ণ-জাতি ব্যবস্থা, আদি-মধ্যযুগীয় আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ও সামন্ততান্ত্রিক বিতর্ক, আলাউদ্দিন খলজীর অর্থনৈতিক সংস্কার, শেরশাহের প্রশাসনিক সংস্কার, আকবরের ধর্মচিন্তা, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের শাসন, অষ্টাদশ শতকের বিতর্ক। পাঠ্যক্রমের পরিসর থেকে অপসারিত হয়েছেন বীরসা, আম্বেদকর, ফুলে, রামমোহন, বিদ্যাসাগর। দলিত ও নারী আন্দোলনের ইতিহাসের ভাগ্যেও জুটেছে অপ্রাসঙ্গিকতার তকমা। প্রায় অবধারিতভাবেই এই পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি শিরীন রত্নাগর, রামশরণ শর্মা, দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা, উমা চক্রবর্তী, রাজন গুরুক্কল, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সরকার, হরবন্স মুখিয়া, ইরফান হাবিব, সৈয়দ রিজভী, মুজফ্‌ফর আলম, সঞ্জয় সুব্রাহ্মন্যম, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বময় পতি সহ একাধিক ইতিহাসবিদের গুরুত্বপূর্ণ প্রচলিত গবেষণাগ্রন্থ ও পাঠ্যপুস্তক। প্রস্তাবিত গ্রন্থপঞ্জীতে আর্য সমস্যা, অশোকের ধম্মনীতি থেকে সুফীবাদ, কৃষক ও আদিবাসী বিদ্রোহ, মুসলীম লীগ এবং গান্ধীর রাজনৈতিক আন্দোলন পর্যন্ত বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মৌলিক গ্রন্থগুলির লক্ষণীয় অনুপস্থিতিও হতাশাজনক। সর্বভারতীয় শিক্ষাক্রমে দেশীয় আঞ্চলিক ভাষার গ্রন্থতালিকায় কেবলমাত্র হিন্দীভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তকের উপস্থিতি হিন্দুত্ববাদের মজ্জাগত হিন্দী আধিপত্য এবং ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের আরেকটি উদ্ভাস মাত্র। আন্তর্জাতিক শিক্ষাস্তরের সাথে প্রতিযোগিতায় আদি ভারতের ইতিহাসের পর্যালোচনা থেকে বিলুপ্ত হয় মার্ক্সীয় ব্যাখ্যাসহ অন্যান্য সুপ্রতিষ্ঠিত সাম্প্রতিক গবেষণা, মধ্যকালীন দক্ষিণ ভারতের গবেষনাগ্রন্থের সাক্ষাৎ মেলে ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাসের পাঠ্যসূচীতে, আবার খ্যাতনামা ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র সহজেই রূপান্তরিত হন বিপিনচন্দ্র পালে। শিক্ষামানে উন্নতির আশায় ভারতীয় ইতিহাসচর্চার সাম্প্রতিক গবেষণার প্রসারকে অগ্রাহ্য করে কয়েক দশক পিছিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক স্বার্থপ্রণোদিত এই কপট স্ববিরোধীতা ও চরম অপেশাদারী আচরণ নিঃসন্দেহে দৃষ্টিকটু।

অন্যদিকে, সাধারণ কালানুক্রমিক রাজনৈতিক ইতিহাস সহ, এই নব্যধারার ইতিহাসশিক্ষার পরিসরে অত্যাবশ্যক পাঠ্যরূপে প্রতিভাত হয় ‘ভারতের’ শাশ্বত ধারণা ও তার গৌরবময় সাহিত্য, ভারতীয় বীরত্বের নৈতিক চরিত্র, গৌরবময় জাতীয় ঐতিহ্যের পাঠ, আর্যদের ভারতীয় পরিচিতি, রাজপুতদের মহিমান্বিত ইতিহাস, আফগান ও মুঘল শাসনে জাতিব্যবস্থা, দেশভাগের ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের ভূমিকা ইত্যাদি একাধিক উল্লেখযোগ্য বিষয়। উচ্চশিক্ষারস্তরে নতুন গবেষণার সিদ্ধান্ত এবং তার ব্যাখ্যা ও সমালোচনা সংযোজনের যে রীতি রয়েছে, তর্কবিরোধী এই পাঠ্যক্রমের লক্ষ্য তাকে সমূলে বিনাশ করা। প্রশিক্ষণগত স্তরে এই অনুশীলনের অভাবের পরিণাম ভারতীয় ইতিহাসের ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণিকক্ষের আলোচনা থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে ইতিহাসের অপ্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু, আর তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত থাকবে রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবীকতা।

ঊনিশ শতক থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ভারতীয় আধুনিক ইতিহাসচর্চায় নানারকম বয়ান ও তাদের দ্বন্দ্বমূলক সহাবস্থান রয়েছে। ঔপনিবেশিক, জাতীয়তাবাদী, মার্ক্সীয়, সংশোধনবাদী, নিম্নবর্গীয়, দলিত, নারীবাদী – প্রভৃতি নানা বয়ানের সাথে বিজড়িত বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও পাঠপদ্ধতি বারংবার প্রশ্ন তুলেছে প্রচলিত তথ্যসূত্রের আপাত সুষম পাঠ ও বিশ্লেষণের দিকে। ফলত, অতীত ও বর্তমানের নিরন্তর সংলাপে উঠে আসা প্রশ্নের নিরিখে, প্রতিষ্ঠিত প্রমাণের পাশাপাশি বিভিন্ন সম্ভাবনার খোঁজে ঐতিহাসিকেরা প্রতিনিয়ত ফিরে গেছেন তথ্যসূত্রের পুনর্পাঠে। আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, লিঙ্গ, যৌনতা, পরিবার, স্মৃতি, সংস্কৃতি, বিনোদন, খেলা, পরিবেশ, ইত্যাদি বিবিধ স্তরে ভারতীয় ইতিহাসচর্চার নানা দৃষ্টিভঙ্গীর প্রসারের সাথেই উঠে এসেছে বিজড়িত বহু গোষ্ঠী জনজাতি ও সম্প্রদায়ের অপ্রকাশিত বয়ান। আর এই নিরিখেই প্রসঙ্গত উঠে এসেছে ইতিহাসের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার নৈতিক দায়বদ্ধতা, জ্ঞানের জগতে অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিত্বের আঙ্গিকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কার্যত, উত্তরের সন্ধানের সাথেই বদলাতে থাকে আকরের রূপ, তথ্যের চরিত্র, ইতিহাসের উপাদানের সন্ধান ছাপিয়ে যায় মহাফেজখানা, যাদুঘরের গন্ডী। ফলত, অতীতের আকর মেলে বনে, ক্ষেতে, গলি-রাজপথে, স্মৃতির বয়ানে, নিঃশব্দতায়, মিছিলে, গানে, ছবিতে, নিত্যসামগ্রী ও জীবনের ছন্দেও।

বস্তুত, ইতিহাসের প্রেক্ষিতে হিন্দুত্বের ‘বাদ’ বলতে যা কিছু বোঝায় এসবই তার বাদের খাতায়। হিন্দুজাতীয়তাবাদী ইতিহাসের বয়ান মূলত ঔপনিবেশিক বর্গবিন্যাস ভিত্তিক, যা তার আপাত বিরোধিতার অন্তরালে সেই ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদী চেতনাকেই পুষ্ট করে চলে। কালানুক্রমিক রাজনৈতিক আখ্যান যে কোনো জাতির অভিনব সামগ্রিক ইতিহাস নয় বরং ইতিহাসচর্চার এক প্রাথমিক ধাপ মাত্র, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিজ্ঞানসম্মত তথ্যনিষ্ঠার অভিনবত্বের পোষাকে এই পাঠ্যক্রম সেই উনিশ শতকের অচল ইতিহাসচর্চার প্রণালীকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে ভারতীয় ইতিহাসের বহুমাত্রিকতার সম্ভাবনাকে নির্মূল করতে সচেষ্ট হয়েছে। এই নয়া ইতিহাসের সারবত্তায় থাকা বৃহৎ কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের আখ্যান ও তৎমধ্যবর্তী অরাজকতা, বৈদেশিক আক্রমণের মূল ধারাবিবরণীর আত্মীকরণের প্রক্রিয়ায় বিলীন হয়ে যাবে বিষম অভিজ্ঞতার বহুস্বরের সম্ভাবনা, ইতিহাসের আঙিনায় অব্যক্ত সার্বভৌমত্বের অভিব্যক্তি। সুতরাং প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক সত্যরূপে এমন একটি সঙ্কীর্ণ একরৈখিক রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক পরিসরের কল্পনা এই পাঠ্যক্রমে পরিবেশিত হয়, যার মালিকানা কেবল অভিজাত, শাসকগোষ্ঠীদের কুক্ষিগত। জনসাধারণের জীবন অভিজ্ঞতার, বহুত্বের, আর্থ-সামাজিক কাঠামোর ও দৈনন্দিন বর্ণ-জাতি, ধর্ম ও লিঙ্গ ভিত্তিক হিংসার মুখে প্রতিস্পর্ধা, বিতর্ক, বিরোধ, সংগ্রাম, বোঝাপড়ার পাঠ জাতিরাষ্ট্রের এই সন্দর্ভে ব্রাত্য ও বিস্মৃত। কেন্দ্রীয় সার্বভৌম শাসনের উত্থান পতনের এই বৃত্তান্তের মৌলিক অভিপ্রায় ইতিহাসের পরিবর্তনশীলতার জটিল প্রক্রিয়ার নিবিড় পাঠ নয়। বরং বিস্মৃতি উৎপাদনের যাঁতাকলে এই পরিবর্তনশীলতার পাঠপ্রক্রিয়ার গতিরোধ এবং সার্বিক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রনের রাজনীতিকে  সভ্যতার ঐতিহাসিক অনিবার্যতার বৈধতা দান করার বাসনা।

একথা অনস্বীকার্য যে, অতীতের তথ্যসূত্র বিশ্লেষণে আদর্শ নৈর্ব্যক্তিকতার সন্ধান নিছকই অবান্তর। বৌদ্ধিক ইতিহাসচর্চার নিরীক্ষায় বহু সুপ্রতিষ্ঠিত নৈর্ব্যক্তিক মহাগ্রন্থের পরতে-পরতে মেলে স্বনামধন্য ইতিহাসকারদের তৎকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের সূত্র। স্বভাবতই, প্রতিটি ইতিহাসের পাঠেই তত্ত্ব বা দৃষ্টিভঙ্গীর, ভাবকল্পের অথবা কোনো তথ্যসূত্রের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়, কেননা গবেষকদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির পাঠেই তাদের জিজ্ঞাসার বীজ সুপ্ত থাকে। ফলস্বরূপ, ইতিহাসের একটি বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে এমন সন্দর্ভ নির্মিত হয় যা ভিন্নধর্মী বিশ্লেষণের নিরিখে আলোচিত ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় বিজড়িত সম্পর্কগুলির নানা বৈশিষ্ট্য ও প্রেক্ষাপটকে করে তোলে বাঙ্ময়। বিবিধ সামাজিক অবস্থানের সমীকরণ থেকে উত্থাপিত প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যসূত্রগুলির পাঠ জন্ম দেয় ভিন্নতর দ্যোতনার। লিখিত বা বস্তুগত উপাদানগুলির স্বচ্ছ মাধ্যমরূপে অতীতের তথ্য সরবরাহ করার যে একমাত্রিক কল্পনা এই পাঠ্যক্রমে উপস্থিত তা অতীতের বহুদ্যোতনার অনুসন্ধানের পরিপন্থী। বিজ্ঞানলব্ধ নতুন তথ্যের নিছক উপস্থিতিতে নয়, ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু এবং বিদ্যমান গবেষণার নিরিখে সেই নতুন তথ্যের জ্ঞানগত বৈশিষ্ট্য, পটভূমি ও মতাদর্শের পারস্পরিক সম্পর্কের সুচিন্তিত গভীর পর্যালোচনার প্রশিক্ষণেই নিহিত থাকে কাঙ্খিত অভিনবত্বের সম্ভাবনা।

এই সকল আশঙ্কা যে নিতান্তই অমূলক নয় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে পাঠ্যক্রমের ভারতের জাতীয় ঐক্যের ধারণাকে প্রাচীনত্ব প্রদানের প্রকল্পে। সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক ‘ভারতের ধারণা’ পরিকল্পিত হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারণার গৌরবপ্রচারের ভিত্তিতে যেখানে জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যের সামান্য উল্লেখ ব্যতিরেকে ভারতীয় গৌরবময় সাহিত্যরূপে পাঠের সম্মান লাভ করেছে বেদ, স্মৃতি ও পুরাণ। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ অথবা দলিত-বহুজন ও লিঙ্গ রাজনৈতিক সমালোচনামূলক পাঠের স্থান গৌরবময় সাহিত্যের পঠনে প্রশ্নাতীত। জাতীয় চরিত্রের রূপকল্প নির্মাণের পরিপন্থী, স্বতন্ত্র জনপদ সন্নিবিষ্ট ভারতবর্ষের আদি ভৌগোলিক পরিচয়ের উন্মুক্ত সীমানার ধারণা ও ভারতীয় ঐক্যচেতনার আপাত আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যের ঐতিহাসিকতা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত। প্রসঙ্গত, আর্য সমস্যার পঠনে পূর্বশর্তরূপে আর্যদের দেশজ উৎসের ধারণাকে সত্যরূপে উপস্থাপনের নির্দেশও একই প্রবণতার সাক্ষ্যবাহী। বলাবাহুল্য, হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের প্রকল্পে ইতিহাসচর্চা কেবল অন্তরায় মাত্র। তবে ইতিহাসচর্চার এই বিকৃত সংস্করণই যে জনপরিসরে সর্বাধিক পরিচিত তা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি তার দায়বদ্ধতা বর্তায় পেশাদারী ঐতিহাসিক ও গবেষকদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে নিমগ্ন থাকার প্রবণতায়। একথা সহজেই অনুমেয় যে, ভারতীয় জনমতে ব্রাহ্মণ্যবাদী, পুরুষতান্ত্রিক এবং সাম্প্রদায়িক জল্পনা ও অতিকথনের যে উর্বরভূমিতে হিন্দুত্ববাদী ধারণার আধিপত্য ও আত্মীকরণের প্রসার, কার্যত তা জনজীবনে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণাপ্রসূত সাম্প্রতিক বয়ানের অনুরণনের অনুপস্থিতির ফল। অন্যদিকে, বহু দশকব্যাপী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমান্তরাল ব্যবস্থারূপে হিন্দুগৌরবের যে সর্বগ্রাসী আত্মীকরণের আখ্যান নানা রূপে সমাজের ভিন্নস্তরে প্রচারিত হয়েছে তার ফলস্বরূপ ক্রমশই জাতীয় ব্যক্তিত্বের প্রধান সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণীয় চরিত্র শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। প্রাথমিকস্তরে, এই প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রমের পরিকল্পনা সেই সমান্তরাল বিদ্বেষমূলক ‘অনৈতিহাসিক’ বিবৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদারী ইতিহাসচর্চার বৈধতা ও আনুকূল্য প্রদান করা, যা স্বভাবতই হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগরিষ্ঠতার রাজনীতিকে পুষ্ট করবে। তবে আপাতভাবে এই সুস্পষ্ট পরিকল্পনার গভীরে ক্রিয়াশীল রয়েছে বিস্মৃতির কারখানা যার কার্যকারিতা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষাস্তরে, প্রাতিষ্ঠানিক বৃত্তে ও বাইরে, একটি একমাত্রিক প্রয়োজনীয় বয়ানের অনুশীলনের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে  আগামী প্রজন্মের চিন্তার পরিসরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কেবলমাত্র গবেষকের সংশয়বাদী মনোভাব ইতিহাসের এই আগ্রাসী আত্মীকরণ ও বিকৃতির প্রতিরোধ হিসেবে যথেষ্ট নয়। আর্থসামাজিক কাঠামোগত বৈষম্য ও হিংসার বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি এবং পেশাদারী গবেষণার নিজস্ব গণ্ডীর বাইরে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কার্যকরী হয়ে ওঠা আবশ্যিক।

প্রসঙ্গত, জ্ঞানচর্চার গন্ডীতে এই সাধারণ সংযোগহীনতার দৃষ্টান্ত আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে জ্ঞানের নির্মাণপদ্ধতি এবং আনুষঙ্গিক আর্থসামাজিক বৈষম্য ও সাংস্কৃতিক মূলধন বিষয়ক তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নেরও অবতারণা করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আভিজাত্যের সীমা অতিক্রম করে গবেষকদের নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান ও সহজাত ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতনতার সাথে সাথেই ইতিহাসচর্চার ভাষা ও বর্গের ব্যবহারে আনতে হবে সামাজিক ন্যায়ের দাবিগুলির অভিব্যক্তি ও বিচার। প্রাতিষ্ঠানিক সীমানা পেরিয়ে সুচিন্তিত গবেষণাপদ্ধতির প্রশিক্ষণের পরিসর করে তুলতে হবে সহজলভ্য ও ব্যাপক। জ্ঞানগত বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ভিন্ন প্রান্তিক পরিচিতির অতীত চেতনার অভিব্যক্তিকে উপস্থাপিত করতে হবে সংলাপের সমস্তরে। সাধারণের অতীতের অধিকারের প্রকাশ জাতিরাষ্ট্রের বিজ্ঞানসিদ্ধ একক ঐতিহাসিক সত্যে আত্মীকরণের অনুগ্রাহীতাই নয়, বরং জ্ঞাননির্মাণের প্রক্রিয়ায় তাদের সচেতন অংশীদারিত্বে।

- সাগ্নিক সাহা

খণ্ড-28
সংখ্যা-29