বেশ কিছুদিন ধরেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মোদি সরকারের দ্বন্দ্ব চলছিল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিজার্ভ তহবিলে থাবা মারা নিয়ে বাদ বিতন্ডা। দুজন অর্থনীতিবিদ গভর্ণর ও একজন অর্থনীতিবিদ ডেপুটি গভর্ণর সেই কারণে অনাড়ম্বর বিদায় নিয়েছেন। অবশ্য এই সরকারে তেমনটাই দস্তুর। সমস্ত স্বশাসিত সংস্থাকেই সরকারের কতামত চলতে হবে। না হলেই অপসারণ। যেমনটা ঘটেছিল সিবিআই-এর ডিরেক্টরের। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাশাসিত হিসেবে সুনাম ছিল। সুব্বারাও গভর্নর থাকাকালীন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরমের শত আকাঙ্খা সত্বেও তিনি সুদের হার কমাননি। কিন্তু এখন অন্য বন্দোবস্ত। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অর্তনীতিবিদ প্রশাসকরা মোদি-জেটলি-গোয়েল-শাহদের কথা না শুনলে তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। যে কাজ রাজন প্যাটেল-আচার্যরা করতে নারাজ ছিলেন সেই কাজ বর্তমান গভর্নর ইতিহাসের ছাত্র শক্তিকান্ত দাসকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া গিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিজার্ভ তহবিলে থাকা প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা সরকার নিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছে। এছাড়াও ২০১৮-১৯ সালের উদ্বৃত্ত, অর্থাৎ ব্যাঙ্কের মোট আয় ও ব্যয়ের তফাৎ, হিসেবে কিঞ্চিদধিক ১২৩ হাজার কোটি টাকাও সরকারের ঘরে দেবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ফলে সরকারের ভাঁড়ারে সর্বমোট ১৭৬ হাজার কোটি টাকা যোগান দেবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক
যেহেতু দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ, এবং সরকারের বাজেটের হিসেব নিকেশ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এমনকি কম্পট্রোলার এন্ড একাউন্টটেন্ট জেনারেলও সরকারের রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ নিয়ে কারচুপির অভিযোগ করেছেন, তাই এই সময়ে সরকারের আর্থিক দুরবস্থা কাটাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিল ব্যবহার নিয়ে সাধারণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এই লেখায় সংক্ষেপে সেরকম কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করব।
১। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে সরকার কোনো অর্থ নেয় কি? — হ্যাঁ, নেয়। ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই) সম্পূর্ণভাবেই সরকারের মালিকানাধীন, কিন্তু কোনো রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক সংস্থা নয়। রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক সংস্থা তাদের মুনাফা থেকে সরকার বা অন্যান্য শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। আরবিআই উদ্বৃত্তের থেকে বিভিন্ন তহবিল, মূলত ঝুঁকির জন্য তহবিল সরিয়ে রেখে বাদবাকি সমস্ত উদ্বৃত্তই সরকারকে দিয়ে দেয়। সাধারণত আরবিআই-এর আয় আসে বিদেশী মুদ্রায় থাকা সম্পদ-এর থেকে পাওয়া আয় থেকে, যে সব সম্পদ বন্ডে বা অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ট্রেজারি বিল বা অন্য কিছু দামি ঋণপত্রে বা অন্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের আমানত হিসেবে থাকে। আরবিআই দেশীয় টাকায় নামাঙ্কিত সরকারি বন্ড বা ঋণপত্র বা অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে স্বল্পকালিন ঋণের উপর সুদও আয় করে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণের কাজকর্ম করার জন্য কমিশনও পায়। ব্যয় হিসেবে রয়েছে নোট ছাপার খরচা, কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধের জন্য ব্যয় প্রভৃতি। এই আয় ও ব্যয়ের তফাৎকে উদ্বৃত্ত বলা হয়। ২০১২-১৩ সাল পর্যন্ত ওই উদ্বৃত্তের একটা বড় অংশ বিভিন্ন তহবিলে সরানোর পরে যে টাকা থাকত তা সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। যেমন ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ তে অনুরূপ উদ্বৃত্তের যথাক্রমে ৩৭.২% ও ৫৩.৪% সরকারকে দেওযা হয়েছিল। ফলে যথাক্রমে ৬২.৮% ও ৪৬.৬% উদ্বৃত্ত তহবিলে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। মালেগাম কমিটির রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০১৫- ১৬ সাল পর্যন্ত ৩ বছর প্রায় কোনো অর্থই তহবিলে সরানো হয়নি। ফলে ওই উদ্বৃত্তের ৯৯.৯%-ই ওই ৩ বছর সরকারকে দেওয়া হয়েছে। ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ সালে ওই উদ্বৃত্তের থেকে যথাক্রমে ১৩,১৪০ কোটি ও ১৪,১৯০ কোটি টাকা তহবিলে সরানো হয়েছিল। (দেখুন সারণী-১)
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাজকর্ম থেকে প্রাপ্ত উদ্বৃত্তের থেকে সরকারকে প্রদত্ত অর্থ (কোটি টাকায়)
২। তাহলে এখন নেওয়াতে সমালোচনা কেন? — উপরের তালিকায় দেখা যাচ্ছে যে, মোট উদ্বৃত্তের থেকে বেশ কিছু পরিমাণ টাকা আরবিআই ঝুঁকি মেটানোর তহবিলে রেখে দিত। এই তহবিল ব্যাঙ্কের এবং তার দ্বারা ভারতীয় অর্থনীতির ঝুঁকি অনেকটাই কমাতো। বিশ্ব বাজারে তেমন কোনো ঘটনা ঘটলে আরবিআই ভারতীয় আর্থিক ব্যবস্থাকে অনেকটাই স্থিতিশীল রাখতে সমর্থ হত। যেমনটা গত ২০০৮ সালের সাব-প্রাইম সঙ্কটে সময়ে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই ঝুঁকির তহবিল রাখা বন্ধ হযে গেল বললেই চলে। মোদি সরকার এর পরে ঝুঁকির তহবিল আর রাখবে বলে মনে হয় না। বর্তমানে আরবিআই-এর ২.৩ লক্ষ কোটি টাকার মতো ঝুঁকির তহবিল আছে। যেভাবে বিমাল জালান কমিটিকে দিয়ে আরবিআই-এর মূলধনী অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের কথা বলিয়ে তহবিল নিয়ে নেওয়া হল, সেই ভাবেই সরকার নিজেদের তরফে কোনো অদক্ষতা ঘটলেই আরবিআই-এর তহবিলে হাত দেবে।
৩। কিন্তু সরকারতো ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা নিচ্ছে, বাকি ৫৩ হাজার কোটি টাকার হিসেব কী? সেখানে একটা বড় প্রশ্ন চিহ্ন আছে। আরবিআই যে সোনা ও বিদেশী মুদ্রার ভাণ্ডার আছে সেগুলির বাৎসরিক পুনর্মূল্যায়নের ফলে যে দাম বাড়ে তাকে মুদ্রা ও সোনা পুনর্মূল্যায়ন হিসেব নামক তহবিলে রাখা হয়। সেই তহবিলের ওঠানামা হয়। সোনা ও বিদেশী মুদ্রার দাম বাড়লে তহবিলের পরিমাণ বাড়ে, কমলে কমে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অনুরূপ পুনর্মূল্যায়ন বাবদ বর্ধিত পরিমাণ রিজার্ভ ফান্ডে রাখা হত। এখন তাকে পূর্বে উল্লেখিত তহবিলে রাখা হয়। (দেখুন সারণী-২)
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মুদ্রা ও সোনা পুনর্মূল্যায়ন তহবিল (লক্ষ কোটি টাকায়)
এই তহবিল সে অর্থে একেবারেই বিদেশী মুদ্রা ও সোনার দামের ওঠা পড়ার উপর নির্ভর করে। এটি কোনোভাবেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাজকর্মের উপর নির্ভরশীল নয়। যেহেতু টাকার দাম কমেছে বা বিদেশী মুদ্রা ও সোনার টাকার নিরিখে দাম বেড়েছে তাই এখন টাকার অঙ্কে ওই তহবিলের পরিমাণ বেড়েছে। যদি টাকার দাম বাড়ে তাহলে ওই তহবিল কমতে থাকবে। সম্ভবত মোদি-সীতারামন নিশ্চিত যে টাকার দাম আর বাড়বে না। ফলে তাঁরা অসুবিধেয় পড়বেন না। কিন্তু বিদেশী মুদ্রার ওঠানামার উপরে যে তহবিল তৈরি হয়েছে তাকে বাজেটে ব্যয় করা এক ধরনের ফাটকার উপরে নির্ভর করা। মনে হয়, এই তহবিল থেকেই বাকি ৫২, ৬৩৭ কোটি টাকা নেওযা হচ্ছে।
জালান কমিটি বলেছে যে, প্রকৃত মূলধন ও পুনর্মূল্যায়নের তহবিলের মধ্যে তফাৎ করতে হবে। কমিটি বলেছিল যে, প্রকৃত মূলধন ব্যালান্স শিটের ৬.৫% ও ৫.৫% এর মধ্যে থাকবে। আরবিআই বোর্ড বলছে যে, ওই নিরীখে ঝুঁকির জন্য যে তহবিল তা অতিরিক্ত আছে। যদি ৬.৫% ধরা যায় তাহলে ১১,৬০৮ কোটি টাকা, আর যদি ৫.৫% ধরা যায় তাহলে ৫২,৬৩৭ কোটি টাকা। বোর্ড সরকারের সুবিধার্থে ৫.৫% ই ধরেছে ও সরকারকে ৫২,৬৩৭ কোটি টাকা দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজস্ব ঘাটতিকে কম করে দেখানোর জন্যই এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। নতুবা নোট ছাপিয়ে ঘাটতি মেটানোর সঙ্গে তেমন কোনো তাত্বিক তফাৎ খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেহেতু হয়তো বা বহিবির্শ্বের লোকেরা এই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে থেকে তহবিল সংগ্রহ করার বিষয়টিতে খেয়াল করবে না তাই এই প্রক্রিয়ায় জিডিপির অনুপাত হিসেবে রাজস্ব ঘাটতিকে কম দেখানোর চালাকিটা করা যাবে।