স্বাধীনতার পর এই প্রথম সমরাস্ত্র তৈরির কারখানার শ্রমিকরা বুকে সাহস নিয়ে ধর্মঘটে নেমে কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। এক কঠিন অসম লড়াইয়ে শ্রমিকরা অবতীর্ণ হন। এই ধর্মঘটে শ্রমিকদের আর্থিক দাবি দাওয়া ছিল না, ছিল সরকারি সংস্থাকে বেসরকারিরণের বিরুদ্ধে নীতিগত লড়াই। দীর্ঘদিন বাদে দেশ দেখলো শ্রমিকরা সরকারের নীতি বদলের জন্যেও হিম্মতের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে জানেন।
মোট ৪১টি অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানা, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বিহার এবং পাঞ্জাবে ছড়িয়ে আছে। বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা শিল্প শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন এআইডিইএএফ, আইএনডিডব্লিউএফ, বিপিএমএস এবং সিডিআরএ ঐক্যবদ্ধভাবে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একমাসব্যাপী (২০ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর) ধর্মঘটের আহ্বান রেখেছিল। ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনের চাপে মোদী সরকার-২ আপাতত পিছু হঠতে বাধ্য হল। প্রতিরক্ষা শিল্প বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে এই ধর্মঘটে সামিল হয়েছে আরও অসংখ্য আঞ্চলিক ইউনিয়ন। যেমন এআইসিসিটিইউ সমর্থিত ‘কাশীপুর গান অ্যাণ্ড শেল ফ্যাক্টরি (পার্মানেন্ট) ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’ সহ অন্যান্য ইউনিয়নের সদস্যরা।
ধর্মঘটের পাঁচদিনের মাথায় দ্বিপাক্ষিক মিটিং-এ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এই মুহূর্তে কর্পোরেশন করা হবে না। সরকার ও ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করা হবে। ফেডারেশনগুলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের শীর্ষ আধিকারিকদের এই প্রতিশ্রুতিতে ধর্মঘট আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিল। কর্মী ইউনিয়নগুলি যৌথ বিবৃতি দিয়ে জানান, ২৬ আগস্ট ভোর ৬টা থেকে ধর্মঘট স্থগিত থাকবে। তবে আন্দোলন জারী থাকবে।
সারা দেশে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড(ওএফবি)-এর অধীনে ৪১টি কারখানা অস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত আছে। এই কারখানাগুলিতে তৈরি হয় সামরিক বাহিনীর পোশাক, তাঁবু থেকে গোলা, গুলি, ট্যাঙ্ক, কামান,বন্দুক ইত্যাদি। কারওয়া, আমেঠিতে ভারত-রাশিয়া যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘ইন্দো- রাশিয়া রাইফেলস প্রাইভেট লিমিটেড’। এখানে এ কে-২০৩ রাইফেল তৈরি হয়। এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে কালাশনিকভ সংস্থা, রোসোবোরোনেক্সপোর্ট এবং ওএফবি-কে।
প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থার হাতে ৬০ হাজার একর জমি আছে। কেন্দ্রীয় সরকার ৮২ হাজার কর্মীর জন্য বছরে ২ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করেছে। সেনাবাহিনী নিজের প্রয়োজনের ৮০ শতাংশ এই ৪১টি কারখানা থেকে কেনে। আরও ৫০ শতাংশ অর্ডার দিলে তা যোগান দেওয়ার ক্ষমতা ও এফ বি-র আছে। কিন্তু সরকার দাম বেশি ও গুণমান কম — এই অজুহাতে বাইরে থেকে কিনছে। ২০১৬ সালে এ কে সাক্সেনা অতিরিক্ত কন্ট্রোলার জেনারেল প্রতিরক্ষা বাজেটে বলেছিলেন সামরিক বাহিনীর সব কিছুরই দাম অতিরিক্ত বেশি। পোশাক থেকে ট্যাঙ্ক। এই তথ্যগুলো প্রচার করে কর্পোরেটায়ন করার রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে।
বহু বছর ধরে কর্পোরেটায়ন করার পরিকল্পনা ভারত সরকারের আছে। এর আগে কর্পোরেটায়নের সুপারিশগুলি জর্জ ফার্নান্ডেজ, প্রণব মুখার্জী, একে অ্যান্টনি কেউই বিশেষ আমল দেননি। কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং কর্পোরেশন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। বেসরকারিকরণ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে যে কমিটিগুলো হয়েছে তারা বেশ কিছু পরামর্শ ও সুপারিশ করে চলেছে। ২০০০ সালে টি কে এ নায়ার কমিটির পরামর্শ — ওএফবি-কে পরিবর্তন করে ‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি কর্পোরেশন’ করা হোক। ২০০৪ সালে একই প্রস্তাব বিজয় কেলকর দেন। ২০১৫ সালে ভাইস এডমিরাল রামন পুরি কমিটির সুপারিশ ওএফবি-কে তিন বা চারটি ভাগে ভাগ করা হোক। যেমন — অস্ত্র, গোলা-বারুদ এবং যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত গাড়ি।
ইতিমধ্যেই গত বছর থেকে ২৭৫টি নন কোর আইটেম বাজার থেকে কেনা শুরু হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারি ৭২ ঘন্টা ধর্মঘট করেছেন। এআইডিইএফ সেক্রেটারি সি শ্রীকুমার বলেছেন “ওএফবি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়, যুদ্ধের জন্য সংরক্ষিত।” তিনটি ইউনিয়ন বলছে ওএফবি কর্পোরেশন হলে বিএসএনএল-র মতো অবস্থা হবে। এবং তিন বছরের মধ্যে তা বিক্রি করা শুরু হবে। শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নগুলি বিপদ সংকেত বুঝতে পেরে একমাসব্যাপী ধর্মঘটে নেমেছিল।
২০ আগস্ট ধর্মঘটের প্রথম দিন উৎপাদন বন্ধ থাকে। এআইসিসিটিইউ প্রতিনিধিরা কাশীপুর, দমদম এবং ইছাপুর ধর্মঘটের সমর্থনে সকাল থেকে গেটে উপস্থিত হয়েছিলেন। ধর্মঘটে ৯৬.৮৬ শতাংশ শ্রমিক অংশ নেন। দ্বিতীয় দিন শ্রমিকদের উৎসাহ আরও বাড়ে। প্রথমদিন থেকে দ্বিতীয়দিনে শ্রমিকের অংশ গ্রহণ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় — ৯৭.১৬ শতাংশ। তৃতীয়দিন শ্রমিকরা কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ আরও বাড়িয়ে দিলেন। শ্রমিকের অংশ গ্রহণ বেড়ে দাঁড়ালো — ৯৭.২৬ শতাংশ। চতুর্থ ও পঞ্চম দিন শ্রমিকরা আরও এককাট্টা। ধর্মঘটে শ্রমিকের অংশ গ্রহণ — ৯৭.৩৭ শতাংশ। বোঝা যাচ্ছে সরকার কর্পোরেটায়ন করার জন্য যত আক্রমণাত্মক হবে, শ্রমিকরাও ততো বেশি বেশি করে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।
প্রতিরক্ষা শিল্পে শ্রমিক ধর্মঘটে অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব ট্রেড ইউনিয়নস সক্রিয় ভুমিকা পালন করেছে। এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ফেডারেশন (আইআরইএফ) অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির শ্রমিক ধর্মঘটের সমর্থনে ১৯ আগস্ট পাঞ্জাবের কাপুরথালায় রেল-কোচ কারখানায় একদিনের অনশন ধর্মঘট করেন। অন্যান্য জায়গায় প্রতিবাদ সভা হয়।
প্রতিরক্ষা শিল্পের সাথে যুক্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলি এআইডিইএফ, আইএনডিডব্লিউএফ, বিপিএমএস এবং সিডিআরএ শ্রমিক ঐক্যকে সুদৃঢ় করে টানা ৫ দিন ধর্মঘট পালন করে। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার ইউনিয়নগুলির সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। ইউনিয়নের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের যে চুক্তি হয়েছে তা পর্যালোচনা করা যাক
সচিব ডিফেন্স প্রোডাকশন সভাপতিত্বে ‘ওএফবি’ এবং ফেডারেশনগুলির বৈঠকের কার্যবিবরণী —
(১) অল ইন্ডিয়া ডিফেন্স এমপ্লয়িজ ফেডারেশন, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, ভারতীয় প্রতিরক্ষা মজদুর সংঘ এবং কনফেডারেশন অব ডিফেন্স রেকগনাইজড অ্যাসোসিয়েশন- এর কর্মকর্তাদের সাথে ২১ আগস্ট বৈঠকে মুখ্য শ্রম কমিশনার (কেন্দ্রীয়) প্রস্তাব দেয় প্রতিরক্ষা উৎপাদন দপ্তরের সচিব এবং কর্মচারী ফেডারেশনগুলির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হতে পারে। (২) সচিব (ডিপি) কর্মচারী ফেডারেশনের কাছে ব্যাখ্যা করেন যে ওএফবি-র কর্পোরেটায়ন বিষয়টি এখনও ভারত সরকারের কাছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তরে রয়েছে। আরও জানান এব্যাপারে সরকার কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসেনি। (৩) বৈঠকে ওএফবি-কে পাবলিক সেক্টর সংস্থায় পরিণত করলে কর্মচারীদের মজুরি, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা ও চাকুরিগত অন্যান্য বিষয় স্বার্থযে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা স্বীকার করা হয়েছে। কর্মচারী ফেডারেশনের তরফে বেতনের জন্য বাজেট বরাদ্দের কথাও তোলা হয়েছে। ফেডারেশন প্রস্তাবিত নতুন ব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎ চাহিদা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে, বর্তমান কাঠামোয় যে অসুবিধাগুলির সম্মুখীন হতে হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে।
সুপারিশ করা হয় যে বর্তমান স্তর থেকে নতুন প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় টার্ন ওভার ৩০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করার জন্য যে পরিকল্পনা নেওয়া হবে তাতে ফেডারেশনের প্রস্তাবগুলি যেন বিবেচনা করা হয়। ফ্যাক্টরিগুলির পাবলিক সেক্টরে যাওয়ার কার্যকারিতাকে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। (৪) বৈঠকে সম্মতিক্রমে ঠিক হয়েছে, যে একটি উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কমিটি গঠিত হবে। এই বিষয়গুলি খতিয়ে দেখা এবং উপযুক্ত (সরকারের জন্য) সুপারিশগুলি করার উদ্দেশ্যে ফেডারেশনের সাথে আলোচনা করা। (৫) উপরিউক্ত বিষয়গুলির ভিত্তিতে সচিব (ডিপি) ফেডারেশনগুলিকে ধর্মঘট প্রত্যাহার ও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। (৬) সভাপতিকে ধন্যবাদ দিয়ে মিটিং শেষ হয়।
সরকার ও ইউনিয়নগুলির দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় যে বিষয়গুলি উঠে এলো —
(১) সরকার কর্পোরেটায়ন/ পাবলিক সেক্টর করা থেকে বিরত হচ্ছে না। বলা যায় শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে সরকার তার পরিকল্পনাকে আপাতত আলোচনার টেবিলে রাখছে। (২) পাবলিক সেক্টর হলে শ্রমিকদের মজুরি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষতি হবে লিপিবদ্ধ আছে। (৩) প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ও ফেডারেশনগুলিকে নিয়ে কোনো স্থায়ী কমিটির কথা নেই, আছে আলোচনা চলবে। (৪) ধর্মঘটে অংশ গ্রহণকারীদের ওপর কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা (পিএফ, গ্রাচ্যুইটি, পেনশন) নেওয়া হবে না, লিখিত থাকলে ভালো হত।
শেষে বলা যায়, প্রতিরক্ষা শিল্পের শ্রমিক ও ইউনিয়নগুলির মধ্যে ধর্মঘট শুরু করতে এবং শেষে কোনো ভাঙন হয়নি। শ্রমিকদের সংগ্রামী মেজাজ অটুট আছে। পরাক্রমশালী সরকারকে যে পিছু হটানো যায় তার প্রমাণ প্রতিরক্ষা শিল্পের শ্রমিকরা দিলেন। কর্পোরেটায়নের বিরুদ্ধে অন্তিম লড়াইয়ের জন্য শ্রমিকরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রতিরক্ষা শিল্পের সংগ্রামী শ্রমিকদের লাল সেলাম।