১৯ জুলাই, ২০১৯। স্থান শোনভদ্র, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ। সেখানকার একটি গ্রাম আম্বা, তার গ্রাম প্রধান যাজ্ঞ দত্ত ভূর্তিয়ার নেতৃত্বে বন্দুকধারী বোঝাই বেশ কয়েকটি ট্রাক সেই গ্রামে ঢুকে নিজেদের জমিতে চাষরত গোন্ডা উপজাতির লোকেদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো শুরু করল। মাটিতে লুটিয়ে পড়তে শুরু করল একের পর এক আদিবাসী মানুষের দেহ। মোট ১০ জন আদিবাসী মানুষ অতর্কিত গুলি চালনায় মারা গেলেন।
এই গণহত্যা আরো একবার এটা প্রমান করল যে যোগী আদিত্যনাথের শাসনে উত্তরপ্রদেশ ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারের কবরখানায় পরিণত হয়েছে যেখানে দলিত, সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও মহিলারা হামলা, গণহত্যা এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অনুকম্পায় পরিণত হয়েছে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে, উত্তর প্রদেশ সরকার বা রাজ্য প্রশাসনের কোনও বরিষ্ঠ প্রতিনিধি নিহতদের পরিবার পরিজন ও বেঁচে যাওয়া লোকেদের সাথে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে আসেননি । পরিবর্তে, বিরোধী দলীয় নেতারা — উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সম্পাদকের নেতৃত্বে সিপিআই(এমএল)-এর একটি প্রতিনিধি দল প্রথম আম্বা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির সঙ্গে দেখা করে। ঘটনাস্থলে পৌঁছলে পুলিশ সিপিআই(এমএল) প্রতিনিধি দলকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে ও হুমকি দেয়। উত্তরপ্রদেশ সরকার চূড়ান্ত অসাংবিধানিকভাবে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকেও ওই গ্রামে যাওয়ার পথে আটকে দেয়ার চেষ্টা করে।
বিরোধীদল গুলি এই হত্যাকাণ্ডকে একটি ইস্যুতে পরিণত করার পরেই কেবলমাত্র আদিত্যনাথ ওই গ্রামে যান এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু পাশাপাশি এই উপলক্ষটিকে তিনি নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন এবং জমি দখলের বিবাদে ঘটা এই হত্যাকান্ডকে মিথ্যেভাবে তুলে ধরে সম্পূর্ণ কংগ্রেস এবং অন্য বিরোধীদল গুলির ঘাড়ে চাপিয়ে দেন।
প্রমাণ রয়েছে যে, ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসে শোনভদ্রের দুদ্ধির আদিবাসী বিধায়ক নিজে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে সতর্ক করে দেন যে আম্ভার আদিবাসীদের জমি কিন্তু জমি মাফিয়ারা দখলের চেষ্টা করছে, সঙ্গে ন্যায়বিচার এবং নিরাপত্তা চেয়ে আম্ভা গ্রামের অধিবাসীদের আবেদনের ভিত্তিতে একটি পিটিশন ওই চিঠিটির সঙ্গে যুক্ত করে দেন। এছাড়াও তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ বিজেপি সভাপতি ও বর্তমানে কেন্দ্রীয় দক্ষতা উন্নয়ন ও উদ্যোগ দফতরের মন্ত্রী মহেন্দ্র নাথ পাণ্ডের কাছে আম্ভা গ্রামের ২২ জন অধিবাসী জমি মাফিয়াদের কবল থেকে “তাদের জীবন রক্ষার” জন্যে তাকে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানান। মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি সভাপতি সাহায্যের জন্যে এই আর্তচিৎকারকে উপেক্ষা করেছেন, যেখানে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন আম্ভা গ্রামের অধিবাসীদের লাগাতার হয়রান করে গেছে, নিজেদের জমিতে চাষ করার অপরাধে গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে যাজ্ঞ দত্ত এবং তার দলবলকে এফআইআর করার সম্মতি দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন বিজেপি দল যদি জানুয়ারী মাসেই এই বিষয়ে সক্রিয় হতো তাহলে জুলাই মাসের এই হত্যাকান্ডকে ঠেকানো যেত।
এই গণহত্যার পরেও যারা বেঁচে আছে তারা বলছেন মাফিয়াদের জমি দখল করেনেওয়ার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ তাদের বিষয়টি আপোসে মীমাংসা করে নিতে বলে। পুলিশ আদিবাসীদের সতর্ক করে দিয়ে বলে যদি তারা আপসে বিষয়টি মিটিয়ে নিতে না পারে, তবে কোনো কিছু ঘটে গেলে তারা যেন প্রশাসনকে দায়ী না করে। এটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে আসন্ন আক্রমণ সম্বন্ধে পুলিশ অবহিত ছিল। এটাই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অপরাধীদের সঙ্গে পুলিশী যোগসাজশের প্রমাণ।
শোনভদ্র জমি বিবাদ বেশ কয়েক দশকের পুরোনো। গ্রাম সভার মালিকানাধীন কিছু জমি যা গোন্ড আদিবাসীরা চাষ করতো, ১৯৫৫ সালে তা বেআইনিভাবে একটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কো-অপারেটিভ সোসাইটির হাতে তুলে দেয়া হয়। এই সোসাইটি একটা সময় এই বেআইনি দখল করা জমির একটা বড় অংশ আরেকজন ব্যক্তি মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়, যে পরবর্তীতে আবার এই অংশটি এই হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত যাজ্ঞ দত্ত ভূর্তিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়।
২০১৭ সালে ভুর্তিয়া তার নামে জমির মিউটেশন করার দরখাস্ত করে, তখন থেকেই সংঘাত তীব্রতর হয় । ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাসে যাজ্ঞ দত্তর নামে মিউটেশন সম্পূর্ণ হয়। গ্রামবাসীরা এই মিউটেশনের বিরুদ্ধে সিভিল কোর্টে পিটিশন জমা দেয়। এই হত্যাকাণ্ডের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ৬ জুলাই ২০১৯ জেলা প্রশাসন মিউটেশনের বিরুদ্ধে গোন্ড গ্রামবাসীদের আবেদন খারিজ করে দেয়।
আর মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ কি করলেন? তার নিজের এবং তার পুলিশ প্রশাসনের এই জমি আত্মসাৎ ও গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি যোগসাজসকে আড়াল করতে পুরো বিষয়টিকেই কংগ্রেসের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন যারা নাকি ১৯৫৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতায় ছিল! কোনো সন্দেহ নেই, এই জমি আত্মসাৎ ওই বিগত দশকগুলিতে আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার কি এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারবে যে (১) তার প্রশাসনই ওই জমির মিউটেশন যাজ্ঞ দত্তের নামে করে দিয়েছিলো ও এই মিউটেশনের বিরুদ্ধে আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল (২) এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা পুলিশের গোচরে ছিল ও তাদের সঙ্গে যোগসাজসে তা ঘটেছে এবং (৩) ন্যায়বিচার চেয়ে গোন্ড আদিবাসীদের সরাসরি তার কাছে আবেদন মুখ্যমন্ত্রী নিজেও উপেক্ষা করেছেন।
আদিত্যনাথ এবং বিজেপির হাতে শোনভদ্র আদিবাসীদের রক্ত লেগে আছে । আদিত্যনাথ সরকার রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, গণধোলাই এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকে উৎসাহিত করতে ব্যস্ত, আর তা রাজ্যের দলিত-বিরোধী ও আদিবাসী-বিরোধী সামন্তী শক্তিকে উৎসাহিত করছে। এই শোনভদ্র হত্যাকাণ্ড, যা কিনা উত্তর প্রদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম আদিবাসী গণহত্যা, এর জন্যে উত্তরপ্রদেশ সরকারের পুলিশ ও প্রশাসন, মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট পর্যন্ত জড়িত সকলকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্যে অভিযুক্ত করতে হবে এবং তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
(এম এল আপডেট ২৩ জুলাই সম্পাদকীয়)