জাতীয় গণমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তরপ্রদেশের সোনভদ্রের ঘটনা এখন অন্যতম চর্চার বিষয়। আমাদের দেশে গরিব-গুর্বো, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের যে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই তা আগেও দেখা গিয়েছে। বর্তমানেও সোনভদ্রের ঘটনা সেই কথা পুনরায় তুলে ধরল। উত্তরপ্রদেশের সোনভদ্রে ১৭ জুলাই ২০১৯ আদিবাসী জনতার উপর যেভাবে হামলা হয়েছে তার ভিডিও প্রকাশ্যে আসতেই একে সকলেই ‘নৃশংস’ বলেছেন। সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে সেদিনের সেই হামলার মুহূর্তে একজন গ্রামবাসী মোবাইলে রেকর্ড করেছেন। সেই ফুটেজে দেখা গিয়েছে অকুস্থলে দুই তরফের লোকজন মাঠের মধ্যে উপস্থিত। চলে বাদানুবাদ। ওই গ্রামের (ঘোরাওয়াল) প্রধান যাজ্ঞ দত্তের নেতৃত্বে ২০০ জন লোক উপস্থিত ছিল সেদিন সেখানে। ঝামেলা চলাকালীন হঠাৎই যাজ্ঞ দত্তের গুণ্ডারা গুলি ছোঁড়ে। স্বাভাবিকভাবেই নিরস্ত্র গ্রামবাসীরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য হুড়োহুড়ি করে এদিক ওদিক দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। ভিডিওতে দেখা যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েকজনকে মাটিতে পড়ে যেতে। একেবারে পরিকল্পিত আক্রমণ।
এরপরে দেখা যায় হামলাকারীরা গুলিবিদ্ধ গ্রামবাসীদের লাঠিপেটা করছে। আতঙ্কে তখন মহিলারা পুলিশ ডাকার কথা বলছেন। অবাধে চলে গুলি ছোঁড়া ও লাঠিপেটা। গণমাধ্যমে প্রকাশ গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন বর্বরোচিত রূপে ঘটনা আধ ঘন্টা ধরে চলে। এরপরে পুলিশ আসে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার, যা ঘটার তা ঘটে গিয়েছে, এই হামলায় ১০ জন আদিবাসী মারা গিয়েছেন এবং ২৮ জন মৃত্যুর সঙ্গে হাসপাতালে শুয়ে লড়াই করছেন। ভিডিওটি ভাইরাই হয়ে যেতে উত্তরপ্রদেশে যে জঙ্গলের রাজত্ব চলছে তা প্রায় এক বাক্যে সকলে মনে করছেন। এই নৃশংস সোনভদ্রের ঘটনা ৩৬ একর জমির দখলকে কেন্দ্র করে ঘটে গিয়েছে। যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশের মসনদে বসার পর থেকেই সে রাজ্য হয়ে উঠেছে অরাজকতার প্রধান কেন্দ্রস্থল। হিংসা আর হিংসাতে জেরবার সে রাজ্যের মানুষ।
হিংসা বন্ধে চাই সমবেত প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। কিন্তু শাসকের দাপটে সাধুর বেশে চলছে শয়তানের রাজত্ব! উত্তরপ্রদেশে সোনভদ্রে যা ঘটল এক কথায় তা বর্বরোচিত। সাধারণ অসহায় ঘোরওয়াল গ্রামে আদিবাসী কৃষকদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তিন মহিলা সহ দশজনকে হত্যা করা হল। তাঁদের অপরাধ সাত দশক ধরে তাঁরা এই ৩৬ একর জমিতে চাষাবাদ করছেন। কোন সরকারের তরফেই আদিবাসীদের হাতে ওই জমির পাট্টা দেওয়া হয়নি। এতদিন ধরে ওই জমিতে চাষাবাদ করার সুবাদে এটি তাঁদের পাওয়ার হক। অথচ পুরোপুরি প্রশাসনিক মদতে জমি মাফিয়ারা জনজাতিদের উপর হামলা চালিয়েছে, তাঁদের বাস্তুচ্যুত করতে চেয়েছে, হত্যা করেছে। এই আদিবাসীদের উৎখাতের প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে। যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশে কুর্সিতে বসার পর থেকে জমি-মাফিয়ারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কৃষকদের কৃষি কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আদিবাসীরা স্থানীয় প্রশাসন ও রাজ্য সরকারের কাছে অভিযোগও জানান। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। জমি মাফিয়ারা তাঁর রাজত্বেই গজিয়ে ওঠে এবং জমির মালিকানা দাবি করে হামলা চালায়, সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। এই মাফিয়াদের সরাসরি মদত দেয় ওই এলাকার গ্রাম প্রধান যাজ্ঞ দত্ত। এই ঘটনাতে তোলপাড় শুরু হয় কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাঁকে ও তাঁর দলের সদস্যদের বারাণসীর অদূরে চুনার দূর্গে আটকে রাখা হয়। এই অবস্থায় প্রিয়ঙ্কা গান্ধী সেখানে অনশন শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশ রাজ্য প্রশাসন এতে বিপাকে পড়ে তাঁকে আদিবাসীদের সঙ্গে সাক্ষাতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। প্রিয়ঙ্কা গান্ধী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পিছু ২৫ লক্ষ টাকা, তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, নিপীড়ন বন্ধের দাবি তোলেন। এছাড়াও দোষীদের গ্রেপ্তার করার দাবিও তিনি করেছেন। তাঁর দলের তরফে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পিছু ১০ লক্ষ টাকা দেওয়ারও ঘোষণা করেছেন। সিপিআই(এমএল)-এর এক প্রতিনিধিদল সংঘর্ষস্থল পরিদর্শন করেন। আশ্চর্য লাগে দলিত নেত্রী, সমাজবাদী নেতা ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও বাম নেতাদের দুরবস্থা দেখে। এত বৃহৎ এক হত্যাকাণ্ডে যাঁদের প্রাণ কেঁদে ওঠার কথা তাঁরা মঞ্চ থেকে উধাও। চাপে পড়ে যোগী আদিত্যনাথ সোনভদ্রে গিয়েছেন কিন্তু ঘটনার দায় চাপিয়েছেন সমাজবাদী দলের উপর, বলেছেন, যাজ্ঞ দত্ত, গ্রাম প্রধান সমাজবাদী দলের।