কলকাতায় সংহতি ও প্রতিরোধ গণকনভেনশনে এসে সম্মিলিত হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। পশ্চিমবাংলা ও তার প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে। বারো হাজার আসন সংখ্যার নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়াম উপছে, বাইরের লন ছাপিয়ে লাল ঝাণ্ডা হাতে মানুষের ভিড় ছড়িয়ে পড়েছিল আসপাশের এলাকায়। আগের দিন দুপুর থেকে রাতভর সভাঘর প্রস্তুত করতে ডেকরেটর শ্রমিকদের সাথে কাজ করছিলেন যে সকল পার্টি ভলান্টিয়ার ও একঝাঁক ছাত্রী কমরেড তাঁরা ভোররাত থেকেই লাল ঝাণ্ডা হাতে ছোটো ছোটো জনতরঙ্গ দেখতে পান। বিহার বা ঝাড়খণ্ড থেকে আসা সাথী বন্ধুদের অনেকেই হাওড়া স্টেশনের ক্যাম্প থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছে যাচ্ছিলেন ইনডোর স্টেডিয়ামে। ছোটো ছোটো জনস্রোতগুলোর পিছু পিছু সকাল সাড়ে দশটা থেকে এসে পৌঁছতে থাকে একের পর এক সুসজ্জিত সুসংগঠিত বড় বড় মিছিলগুলি, অদম্য সাহসে প্রাণবন্ত ও শ্লোগানে মুখরিত, ফ্যাসিবাদী হামলার বিরুদ্ধে সংহতি ও প্রতিরোধে দৃঢ় সংকল্প। কিছুক্ষণের মধ্যেই পূর্ণ হয়ে ওঠে সিপিআই(এমএল) আয়োজিত গণকনভেশনের সুসজ্জিত সভাঘর।
পার্টি নেতৃত্ব এসেছিলেন সারা দেশ থেকেই। কাশ্মীর থেকে শুরু করে কেরালা, পন্ডিচেরী বা গুজরাট – ভারতের প্রায় সব রাজ্য থেকে পার্টি নেতৃত্ব এসেছিলেন এই গণকনভেনশনে যোগ দিতে। কৃষক আন্দোলনের জননেতা রাজারাম সিং, সাফাইকর্মী আন্দোলনের জনপ্রিয় তরুণ সংগঠক ক্লিফটন ডি রোজারিও, কার্বি আংলঙের লড়াকু নেত্রী প্রতিমা ইঙিপি সহ পার্টির বিভিন্ন সংগ্রামী নেতা-কর্মী, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংগ্রামরত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে মঞ্চে আহ্বান জানান কবিতা কৃষ্ণান ও অভিজিৎ মজুমদার, তাঁরা দুজন মিলেই সমগ্র সভা পরিচালনা করেন। সভা চলাকালীন আরও অনেকে মঞ্চে আসেন। তিস্তা শীতলাবাদ, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, মেরুনা মুর্মু, শামিম আহমেদ, চন্দন সেন, পাগান মুর্মু সহ অনেকে। প্রথম থেকেই মঞ্চে ছিলেন ক্যানিং লোকালে আক্রান্ত তরুণ মাদ্রাসা শিক্ষক শাহরুফ হালদার। সকলের মাঝে শাহরুফের বক্তব্য গণকনভেনশনের হৃদয় নিঃসারিত আবেদন হয়ে ওঠে।
সভায় স্বাগত ভাষণ দেন কমরেড অভিজিৎ মজুমদার বাংলায় ও রাজারাম সিং হিন্দিতে। কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা মহম্মদ সেলিম শোক প্রস্তাব পড়ে শোনান। দশ-বারো হাজার মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে এক মিনিটের নীরবতায় সমস্ত শহীদ ও নিপীড়িত নিহত আর্ত মানুষজনকে স্মরণ করে কনভেনশনের মূলপর্ব শুরু করে। আলোচনা ও বক্তব্য শুরুর আগে বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, আসাম ও দিল্লীর সাথীদের প্রায় পঞ্চাশ জনের সঙ্গীতদল বাংলা হিন্দি ও অসমীয়া ভাষায় ‘মুক্ত হবেপ্রিয় মাতৃভূমি’ গানটি পরিবেশন করেন। সমগ্র স্টেডিয়াম লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে সমস্বরে গলা মেলায়। বহুজনের লাইভ সম্প্রচারে সভাকক্ষ ছাপিয়ে সে গানের সুর ও আলো দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই কনভেনশনের প্রস্তাবনা পেশ হয় হিন্দি, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়।
পার্টির সদস্য, সমর্থক ও গণভিত্তি ছাড়াও এই কনভেনশনে যোগ দিয়েছিলেন আরও বহু মানুষ। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সামিরুল ইসলাম সহ অনেকে, আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের মিলন মান্ডি সহ কয়েকজন, জয় ভীম ইন্ডিয়া নেটওয়ার্কের সুকেশ মালি, ফুরফুরা সুন্নাতুল জামাতের সামসুল ইসলাম, সংখ্যালঘু মঞ্চের আবু রিদা সহ অনেকে উৎসাহভরে যোগ দিয়েছিলেন। সমাজের বহু ক্ষেত্রে কর্মরত বহু ব্যক্তিত্ব এসেছিলেন। বস্তুত বিগত দেড় মাস ধরে প্রচার ও সংগঠিত করার পর্ব জুড়ে ধীরে ধীরে পার্টির উদ্যোগ ছাপিয়ে এক গণ উদ্যোগে উন্নীত হয়েছিল এই গণকনভেনশন প্রক্রিয়া। অন্যান্য বামপন্থী দলের বহু কর্মী, সমর্থক অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের সকলকেই স্বাগত জানানো হয়।
পূরবী মুখোপাধ্যায় যখন পরিশীলিত তীব্রতায় তিক্ষ্ণ কন্ঠে ‘উঠা হ্যায় তুফান জমানা বদল রাহা, জাগা হ্যায় ইনসান জমানা বদল রাহা’ গাইতে শুরু করলেন তখন মুহুর্তে এক সত্যবদ্ধ সংকল্প ও আবেগের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল স্টেডিয়াম জুড়ে, ছড়িয়ে পড়ল স্টেডিয়ামের বাইরের জমায়েতে এবং ফোনে ফোনে লাইভ সম্প্রচারে দেশের অনেক প্রান্তে। ফ্যাসিবাদের সমূহ বিপদ সম্পর্কে যেমন সকলে অবহিত তেমনই তাকে রুখে দেওয়ার অমিত শক্তিও যে ভারতের জনতার আছে সেকথাই যেন অনুভব করছিল সকলে। কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সুগভীর অথচ সহজ সরল ভাষণ এই অনুভবকেই যুক্তিবদ্ধ বিশ্লেষণে সুদৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপন করে। সভার শেষপর্বে আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের সংগ্রামী সাথীদের হাতে হাত রাখা পায়ে পা মেলানো নাচ ও সাঁওতালী ভাষার গান এই অনুভবের শেকড়ের সন্ধান দেয় এবং কমরেড বাবুনি মজুমদারের লীডে ‘আমরা করব জয়’ গানটি নিছক সমাপ্তি সঙ্গীতের গন্ডি অতিক্রম করে এক জীবন্ত প্রত্যয় হয়ে ওঠে।
স্টেডিয়ামের সভাকক্ষের বাইরেও ছিল ঠাসা ভীড়। সেখানে বাঁধা মাইকে পৌঁছে যাচ্ছিল সভাঘরে চলা কনভেনশনের প্রতিটি শব্দ। আর সেখানে চলছিল বিভিন্ন স্টল ও প্রদর্শনী। মেডিক্যাল টিমের স্টল। হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত মার্কসবাদী প্রগতিশীল পত্রপত্রিকা ও পুস্তিকার স্টল। চারু মজুমদারের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে এখানেই ‘সম্প্রীতি মনন’ পত্রিকার তরফ থেকে প্রকাশ করা হয় স্নেহলতা মুখোপাধ্যায় বিরচিত ‘চারু মজুমদার : বিপ্লবী হয়ে ওঠার স্মৃতিকথা’ পুস্তিকাটি। প্রকাশ করা হয় চারু মজুমদার স্মরণে বিশেষ আলেখ্য সহ পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের পত্রিকা ‘‘নবান্ন’’ বাইরের এই চত্ত্বরটিতে ছিল পার্টির পঞ্চাশ বছর উপলক্ষ্যে ‘সংঘর্ষ ও নির্মাণের ৫০ বছর’ শীর্ষক প্রদর্শনী, প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রয়াত ব্যক্তিবর্গের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে প্রস্তুত করা প্রদর্শনী ও চলমান ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন ছবি পোস্টার ব্যানার। ছিল চারু মজুমদারের উদ্ধৃতি। সভাগৃহের ভেতরে ও বাইরে বড় বড় ব্যানারে ‘সংহতি ও প্রতিরোধ’ কথাগুলি লেখা ছিল ভারতের একুশটি ভাষায়। সভাঘরে প্রবেশের মুখে এই লনে সুবিশাল ব্যানারে জ্বলজ্বল করছিল : “আজকের কনভেনশন সংহতি ও প্রতিরোধের। জাত-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সংহতি। ভারতবাসীর সঙ্গে পৃথিবীর সব দেশের সাধারণ মানুষের সংহতি। আরএসএস-বিজেপির বিদ্বেষ-রাজনীতি ও তার পৃষ্ঠপোষক দেশী-বিদেশী কর্পোরেট লুটেরাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।”