(১) ইউএপিএ এবং এনআইএ আইনের যে বর্তমান চেহারাটা আছে, সেগুলি যথেষ্ট দানবীয়। আমাদের দেশের সবথেকে প্রান্তিক মানুষদের বিরুদ্ধে, তাদের অধিকার রক্ষার জন্য যারা কাজ করেন তাদের বিরুদ্ধে এই আইনগুলি প্রয়োগ করা হয়। প্রয়োগ করা হয় সরকারের বিরুদ্ধে যে সমস্ত কণ্ঠস্বর সরব, তাদের দমন করার জন্য। বর্তমান লোকসভায় এই আইনগুলিকে সংশোধন করে আরো দানবীয় চেহারা দেওয়া হচ্ছে। সংশোধিত আইনগুলি যে কোনও বিরোধী কণ্ঠকে নিশানা করার এবং যে কোনও বিরোধিতাকেই অপরাধমূলক হিসেবে দাগিয়ে দেবার ক্ষমতা দেবে সরকারকে। একজন ব্যক্তিকেও নয়া আইনের বলে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে, তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার মত অনেক নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে। নির্দোষ প্রমাণের দায়ভার এসে পড়বে অভিযুক্তের নিজের ওপরেই। এই কনভেনশন ইউএপিএ এবং এনআইএ আইনের সংশোধনগুলি বাতিল করার দাবি তুলছে। দাবি তুলছে – দানবীয় ইউএপিএ আইন বাতিল কর, এনআইএ-কে সংসদের নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে এসো এবং ইউএপিএ আইনের বলে যে সমস্ত সক্রিয় কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মুক্তি দাও।
(২) এই কনভেনশন তথ্যের অধিকার আইনে যে সংশোধনগুলি করা হয়েছে, সেগুলি বাতিলের দাবি জানাচ্ছে। নয়া আইন, যা এর মধ্যেই লোকসভায় পাশ হয়ে গেছে, কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতের পুতুলে পরিণত করবে। এর ফলে তথ্যের অধিকার আইনের ধারটাই ভোঁতা হয়ে যাবে। এই অধিকার আমাদের গণতন্ত্রের এক বড় স্তম্ভ এবং প্রতি বছর প্রায় ষাট হাজার মানুষ এই আইনটির সাহায্য নিয়ে থাকেন। আমরা তথ্যের অধিকার আইনকে রক্ষা করার এবং তাকে আরো শক্তিশালী করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাব।
(৩) সারা দেশ জুড়েই খনি মালিক, অন্যান্য কর্পোরেট এবং জমি মাফিয়াদের স্বার্থেজোর করে আদিবাসী ও বনবাসী মানুষকে তাদের জমি থেকে উৎখাত করা হচ্ছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হল সোনভদ্রের গণহত্যা। এখানে জমি মাফিয়া ও উত্তরপ্রদেশ সরকারের যোগসাজশে দশজন আদিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হল।
১৯২৭ সালের ভারতীয় অরণ্য আইনকে সংশোধন করার যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেই সংশোধন পাশ হলে আদিবাসী ও বনবাসীদের বিপুল পরিমাণ জমি মুনাফাবাজ কর্পোরেটদের কাছে চলে যাবে। বন বিভাগের আধিকারিকদের হাতে চলে আসবে যে কোনো কাউকে গুলি করার স্বেচ্ছাচার। বাজেয়াপ্ত করা জিনিসপত্রের ভিত্তিতেই এরপর থেকে যে কোনো কাউকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা বৈধ হয়ে যাবে। এই সব আইনী সংশোধনের মূল লক্ষ্য আদিবাসীদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের জমি কেড়ে নেওয়া। ১৯২৭ সালের ভারতীয় অরণ্য আইনে যে সমস্ত সংশোধনী আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এই কনভেনশন সেগুলি বাতিলের দাবি জানাচ্ছে। সেই সঙ্গে ১৯২৭ সালের পুরনো আইনটিকেও বাতিল করে অরণ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে একটি নতুন এমন আইন প্রবর্তন করার দাবি জানাচ্ছে এই কনভেনশন, যে আইন আদিবাসী ও বনবাসী মানুষদের অরণ্যে বসবাসের অধিকারের প্রতি পরিপূর্ণভাবে শ্রদ্ধাশীল হবে।
(৪) আসামে যেভাবে এনআরসিকে বিভাজন ও অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এই কনভেনশন তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করছে। আসামে যখন এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হবে, আশঙ্কা রয়েছে তখন বেশ কয়েক লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বেন।
নানা প্রশাসনিক জটিলতার কারণে অথবা কাগজপত্র ঠিকমত না থাকার কারণে যে লক্ষ লক্ষ গরিব শ্রমজীবী মানুষ নাগরিকত্বের জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ দখিল করতে পারবেন না, তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করার বিরুদ্ধে এই কনভেনশন মত প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ যতক্ষণ না সরকারিভাবে কাউকে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা চলবে না। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে এই সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করা প্রয়োজন বলে এই কনভেনশন মনে করছে।
সন্দেহজনক ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করে অনেক লোককে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি অবর্ণনীয় যন্ত্রণার। অবিলম্বে এই অমানবিক ডিটেনশন ক্যাম্পগুলি বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে এই কনভেনশন। দাবি জানাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভাজন সৃষ্টিকারি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে বাতিল করার। সারা ভারতে এনআরসি-কে ছড়িয়ে দেওয়ার যে পরিকল্পনা বিজেপির আছে, তার বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার হওয়ার জন্য এই কনভেনশন আবেদন জানাচ্ছে। এন আর সি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এর মধ্য দিয়ে বিজেপি যে সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা করতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে জনগণকে সক্রিয় ভাবে প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানাচ্ছে এই কনভেনশন।
(৫) জয় শ্রীরাম ধ্বনি মুসলিমদের ভয় দেখানো এবং হত্যা করার একটা অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। বিজেপির সাংসদ আর বিধায়করা দাবি করছেন মুসলিম সাংসদ এবং বিধায়কদেরও দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে জয় শ্রীরাম বলতে হবে। তাদের এই দাবি থেকে উশকানি পেয়েই গণহত্যাকারিদের দলবল জয় শ্রীরাম ধ্বনি কে নানা জায়গায় মুসলিমদের আক্রমণ করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ২০১৩ সালে মুজফফরপুরে যে সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়েছিল তার অভিযুক্তরা সবাই মুক্তি পেয়ে গিয়েছে। বর্তমান সময়ের ভীড় হিংসার ঘটনাগুলির দোষীরা সাজা পাচ্ছে না। বরং যারা আক্রান্ত তাদের এবং তাদের পরিবারের লোকজনদেরই এফআইআর-এর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই কনভেনশন দাবি তুলছে এইসব ঘটনাবলির বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য মোদি সরকারকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। যারা এই ভাবে হত্যাকাণ্ড সহ নানা ধরনের হিংসাত্মক কাজকর্মচালিয়ে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। এই কনভেনশন ভিড় হিংসায় আক্রান্ত ভারতের সংখ্যালঘুদের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছে।
(৬) অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের যে সব আইনগত অধিকার অর্জিত হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল ন্যূনতম মজুরী আইন, ঠিকা প্রথায় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি; প্রস্তাবিত লেবার কোড বিলের মধ্য দিয়ে এই সরকার সেগুলিকে বাতিল করে দিতে চায়।
সরকার দ্রুত গতিতে ভারতীয় রেল এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার বিলগ্নীকরণ এবং বেসরকারিকরণের দিকে এগোচ্ছে। সরকারি লাভজনক সংস্থাগুলির শেয়ার কর্পোরেটদের বেচে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে কর্মসংস্থান কমবে এবং কর্মী অধিকারের ব্যাপক সংকোচন ঘটবে। রেলের ক্ষেত্রে এই বেসরকারীকরণের ফলে টিকিটের দাম এবং অন্যান্য সাধারণ পরিষেবার খরচ অনেকটাই বাড়বে। বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাত্রী নিরাপত্তার দিকটির সঙ্গেও আপস করা হবে। এই কনভেনশন দাবি তুলছে লেবার কোড বিল প্রত্যাহার কর, রেল এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থায় বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত বাতিল কর।
(৭) দেশের অনেক জায়গায় মারাত্মক খরা চলছে। বর্ষা যদিও খরার তীব্রতাকে কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে কিন্তু এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে দেশ এক তীব্র জল সংকটে ভুগছে। পাশাপাশি একই সময় আসাম এবং বিহারের কিছু অংশ মারাত্মক ভাবে বন্যা কবলিত এবং এর ফলে অনেক প্রাণ এবং সম্পত্তি ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। এই কনভেনশন খরা ও বন্যা প্রতিরোধে জরুরি আপৎকালীন ব্যবস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলছে। আসাম এবং অরুণাচল প্রদেশে যে বড় বাঁধগুলি নির্মিত হচ্ছে তা বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই কনভেনশন তাই এই সমস্ত বাঁধ নির্মাণে অবিলম্বে স্থগিতাদেশের দাবি জানাচ্ছে।
(৮) এই কনভেনশন কৃষি সংকট নিয়ে সংসদের একটি আলাদা অধিবেশন দাবি করছে যেখানে দুটো বিল পাস করাতে হবে। এই দুটো বিলের কথা ২০১৮ সালে ৩০ নভেম্বর দিল্লির কিষাণ মুক্তি মার্চের পরে যে কিষাণ সংসদ বসেছিল, সেখান থেকে উঠে এসেছিল। এই বিল দুটির একটি হল — চাষিদের ন্যায্য মূল্য পাবার অধিকার সংক্রান্ত বিল ২০১৭। এটি কৃষকদের চাষের খরচের অন্তত ৫০ শতাংশ লাভ হিসেবে পাবার নিশ্চয়তা দেবে। অন্যটি হলো কৃষি ঋণ থেকে কৃষকদের মুক্তি সংক্রান্ত বিল ২০১৭। এই বিলটির লক্ষ্য হবে ফসল উৎপাদনের জন্য নেওয়া সমস্ত ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ থেকে কৃষকদের মুক্তি দেওয়া। এই কনভেনশন দাবি জানাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জারি করা সমস্ত রকম কৃষক বিরোধী নির্দেশাবলী বাতিল করতে হবে। যার মধ্যে পশু ব্যবসা নিষিদ্ধ করা থেকে শুরু করে অন্যান্য আরো কিছু জিনিস আছে। আমরা সেগুলিকে বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি। গোরক্ষা সংক্রান্ত আইনকে বাতিল করার দাবিও তুলছি আমরা কারণ একদিকে এটা পশু পালকদের কাছে একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়েছে, কৃষিবিজ্ঞানীরাও এর ফলে সমস্যায় পড়ছেন এবং অন্যদিকে এই আইনটি সংখ্যালঘু মুসলিমদের হত্যা করার অছিলা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
(৯) কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিজেপি পরিচালিত সরকারগুলি মহিলাদের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতার ওপর হামলা নামিয়েছে। বিজেপি ধর্ষণে অভিযুক্ত তাদের দলীয় নেতাদের পক্ষে সংগঠিতভাবে সমর্থনে নেমেছে। একই কাজ তারা করেছে তথাকথিত ধর্মীয় বাবাদের সমর্থনেও। এইসব মামলার অভিযোগকারী এবং স্বাক্ষ্যদাতাদের অনেককে হত্যা করা হচ্ছে, অনেকে নানা দুর্ঘটনায় রহস্যজনকভাবে মারা যাচ্ছেন। সঙ্ঘের বিভিন্ন শাখাগুলি মহিলাদের স্বাধীনতার ওপরে ক্রমাগত আঘাত নামিয়ে আনছে। বিশেষ করে আন্তঃবর্ণ এবং আন্তঃধর্মবিবাহের ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে এগুলি বেশি বেশি মাত্রায় ঘটছে। এই কনভেনশন উনার রেপ সার্ভাইভারের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপণ করছে, যিনি একটি তথাকথিত দুর্ঘটনা, যাকে খুনের চক্রান্ত বলেই সন্দেহ হয়, তাতে মারাত্মক জখম হবার পর এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। মহিলাদের স্বাধীনতার ওপর নামানো সমস্ত হামলার বিরুদ্ধে আমরা কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই। এই কনভেনশন লোকসভা ও বিধানসভায় মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করার আইনটির বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছে। তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিলকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছে এই কনভেনশন, কারণ এটা বেছে বেছে কেবলমাত্র স্ত্রী পরিত্যাগকারী মুসলিমদের অপরাধী বলে চিহ্নিত করছে, কিন্তু অন্য ধর্মের কোনো লোকজনকে একই অপরাধে এইভাবে অভিযুক্ত করছে না।
(১০) দেশজুড়ে গণস্বাস্থ্য মারাত্মক সংকটে পড়েছে। অনাহারে মৃত্যু, ভয়ঙ্কর রকম অপুষ্টি, হাসপাতালগুলিতে শিশু মৃত্যুর মহামারী, বিহারে মারাত্মক এনসিফ্যালোপ্যাথিতে মারা যাওয়া ইত্যাদি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্যদিকে সরকার আয়ুষ্মান প্রকল্পের নামে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সরকারি বরাদ্দকে বেসরকারি স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছে।
আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের নাটকবাজির পরিবর্তে এই কনভেনশনে দাবি করছে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামোকেই আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে এবং এজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করতে হবে।
(১১) শিক্ষানীতির যে খসড়া সামনে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে মোদি সরকারের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রর সাহায্য ও অনুদানে চলা স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থা এবং কলেজ স্তরের সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটা আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা। এই খসড়া স্কুল শিক্ষার বেসরকারীকরণ-এর পক্ষে কথা বলছে এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে টিউশন ফি কয়েক গুণ বাড়ানোর পক্ষে ওকালতি করছে। এটি আগের সমস্ত জাতীয় শিক্ষানীতি থেকেও সরে এসেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজের দুর্বলতর অংশগুলির জন্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত কোনওরকম কথাবার্তা এখানে নেই। অন্যান্য ভারতীয় ভাষাকে পেছনে ঠেলে দিয়ে এটি কেবলমাত্র হিন্দি এবং সংস্কৃত ভাষার প্রসারের কথাই বলেছে। এই কনভেনশনে দাবি তুলছে খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল করতে হবে এবং সারা দেশের শিক্ষক এবং ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে আর একটি নতুন খসড়া তৈরি করতে হবে।
(১২) জনকল্যাণ মূলক প্রকল্পগুলি থেকে সাধারণ মানুষকে বাদ দেবার একটা পদ্ধতি হিসেবে আধার প্রকল্পকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আধারকে রেশন, পেনশন এবং অন্যান্য বেশকিছু স্কিমের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ার ফলে সমাজের দুর্বলতর অংশ বিশেষ করে শিশু এবং বৃদ্ধরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং তাদের অনেকের এই কারণে অনাহার মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে।
সরকার ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে আধারকে সংযুক্ত করার কথা বলছে এবং এটা করা হলে অনেক গরিব মানুষ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। শেষ কেন্দ্রীয় বাজেটের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় জনগণের বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্যকে পর্যন্ত বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেবার প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্যও রয়েছে।
আধারের নামে যে পরিকাঠামো তৈরি করা হয়েছে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে এনআরসির মাধ্যমে লাখ লাখ লোককে শরণার্থী হিসেবে দাগিয়ে রাষ্ট্রহীন মানুষ করে দেওয়ার জন্য। এই কনভেনশন সমগ্র আধার প্রকল্পকেই বাতিল করার দাবি তুলছে। সেই সঙ্গে আধার এর তথ্যাবলি যেহেতু খাদ্যের অধিকার, ভোটের অধিকার এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে বিপর্যস্ত করছে, তাই এই কনভেনশন আধারের সমস্ত তথ্য পরিসংখ্যান নষ্ট করে ফেলার দাবি তুলছে।
(১৩) ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে বসানো চিপগুলি সম্পর্কেনির্বাচন কমিশন দাবি করেছিল যে এগুলি আসলে হল ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড। এটা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। তারা নিজেরাই নির্বাচন সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করে, সেখানেই ধরা পড়েছিল প্রদত্ত ভোট এবং গণনাকৃত ভোটের হিসেবের মধ্যে গরমিল আছে। এই গরমিলের কোনো ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। এই সমস্ত ঘটনা ইভিএম সংক্রান্ত সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করেছে। ভোটাররা কোথায় ভোট দিচ্ছেন সেটা স্বচক্ষে পরখ করার অধিকার তাদের আছে। ইভিএম ভোটারদের এই অধিকারকে ব্যাহত করে। ভারতের ভোটারদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, নির্বাচনী গণতন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্বচ্ছতার জন্য এই কনভেনশন দাবি তুলছে ভারতের নির্বাচন আবার ব্যালটে ফিরে যাক।
(১৪) একদিকে বিজেপি খুব নগ্নভাবে নানা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন বিধায়কদের কিনে বিপক্ষের সরকারকে ফেলে দিচ্ছে, অন্যদিকে মোদি সরকার এক জাতি এক দেশ এক ভোট এই স্লোগান তুলছে। এই প্রস্তাব ভারতকে সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন এর দিকে নিয়ে যেতে চায়, যা আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং গণতন্ত্রের পক্ষে একটা ভয়ঙ্কর বিপদ। মোদি সরকার যে ইলেকটোরাল বন্ড সিস্টেম নিয়ে এসেছে তা রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং কর্পোরেট সরকার আঁতাতকে (ক্রোনি চরিত্রকে) বাড়িয়ে তুলেছে। এই কনভেনশন এক দেশ এক ভোট এই প্রস্তাবকে খারিজ করছে এবং ইলেকটরাল বন্ড সিস্টেমকে বাতিল করার দাবি জানাচ্ছে। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত উপায়ের মধ্যে দিয়েই বিজেপি কর্ণাটকে আস্থা ভোটে জয়ী হয়েছে, তাই এই কনভেনশন দাবি তুলছে কর্নাটকে নতুন করে নির্বাচন করতে হবে।
(১৫) মোদির আবার কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন এবং রাজ্যে বিজেপির চমকপ্রদ উত্থানে উদ্দীপ্ত হয়ে সংঘ পরিবার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে নেমে পড়েছে এবং তারা ব্যাপক সন্ত্রাস ও গুণ্ডাগিরির করে চলেছে।
২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীদের ওপর নামানো মারাত্মক সন্ত্রাস, রাজ্য সরকারের ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্য, দুর্নীতি এবং তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের কর্মীদের নানা বেআইনি কার্যকলাপের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস ক্রমশই জন্য যত জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ততই তার সুবিধেজনক রাজনৈতিক পরিসর পেয়ে যাচ্ছে।
সংঘ ব্রিগেড এই সুযোগকে ব্যবহার করে নেওয়ার জন্য মরিয়া। লক্ষ্যে পূরণের জন্য তারা একদিকে ব্যাপক সংখ্যায় তৃণমূল বিধায়দের ভাঙিয়ে নিজেদের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে তারা বড় মাত্রায় গুণ্ডামি, রাজনৈতিক সন্ত্রাসসৃষ্টি এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, হিংসা, ঘৃণা ছড়ানোর কাজ করে চলেছে। বিজেপির এই সমস্ত কাজের উদ্দেশ্য শুধুই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল নয়। সে চায় পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পাল্টে দিতে এবং তার নিজের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির পরীক্ষাগার হিসেবে সে এখন পশ্চিমবঙ্গকে বেছে নিয়েছে।
এই কনভেনশন বাম, প্রগতিশীল এবং গণতন্ত্রপ্রিয় পশ্চিমবঙ্গবাসীকে এই হামলা প্রতিরোধ করে রাজ্যে সামাজিক সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ এবং শান্তি বজায় রাখার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গকে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্টদের নিষ্ঠুর গ্রাস থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে নেওয়া শপথ ও সংগ্রামে সংহতি জ্ঞাপণ করছে।
(১৬) এই কনভেনশন ভারতের নাগরিকদের কাছে ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিবাদী জমানার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানাচ্ছে। কোনও একজনের ওপর নামা আঘাত আসলে আমাদের সবার ওপরেই নামা আঘাত। যারা আক্রান্ত হচ্ছেন আমরা নীতিগতভাবে এবং দৃঢ়তার সাথে তাদের সবার পাশে দাঁড়াচ্ছি। আমরা আমাদের নিজস্ব অধিকারগুলো রক্ষা করার জন্য এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির গণতন্ত্র ও বৈচিত্র্যকে বজায় রাখার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ডাক দিচ্ছি। লাঞ্চনা, গ্রেপ্তারী, হত্যা প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে ভয় দেখিয়ে আমাদের চুপ করিয়ে দেওয়া বা সন্ত্রস্ত করে তোলার চেষ্টাকে আমরা সফল হতে দেব না। ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষকে আমরা কিছুতেই হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে দেব না।
এই কনভেনশন স্বাধীনতার মাস, অগস্ট মাস জুড়ে এক গণসংযোগ অভিযানের ডাক দিচ্ছে, যার লক্ষ্য আমাদের সংবিধান, নির্বাচনী গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর যে আঘাতগুলি নামছে তার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা।
ঐক্যবদ্ধ হোন এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। বিজয় আমাদের হবেই।