মোদী-যোগী-শাহ, শাসন ব্যবস্থায় ধর্ষণের শিকার মহিলাদের ন্যায়বিচার পাবার অধিকার ভীষণভাবে বিপর্যস্ত। তার সব চেয়ে বড় প্রমাণ উন্নাও-এর বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করা তরুণীকে ট্রাকের ধাক্কায় মেরে ফেলার চেষ্টা। না আমরা এই ঘটনাকে কখনই দুর্ঘটনা বলব না, এটা সম্পুর্নভাবেই পরিকল্পনা করে হত্যার চেষ্টা। এই নির্ভীক তরুণীর দু-বছর ধরেচলা লড়াইয়ের ঘটনাগুলি একটু পরপর বিবরণ দেওয়া যাক। ২০১৭ সাল চাকরি দেওয়ার নাম করে বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গার ষোল বছরের মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। তারপর বিধায়কের বিরুদ্ধে থানায় বহুবার অভিযোগ জানিয়ে কোন লাভ হয়নি। ২০১৮ সালে মেয়েটি ও তার মা যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির সামনে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এরপর সেঙ্গারের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে অস্ত্র আইনে তরুণীর বাবাকে গ্রেফতার করা হয় এবং থানার মধ্যেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। থানার মধ্যে মেয়েটির বাবার অত্যাচারের সাক্ষীরও হটাৎ করে মৃত্যু হয়, এরপর আন্দোলনের চাপে পরে সেঙ্গারকে গ্রেফতার করে পুলিশ কিন্তু বয়স সংক্রান্ত ভুয়ো নথিপত্র জমা দেওয়ার অভিযোগ তুলে নির্যাতিতা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে মহিলার কাকা ১৯ বছরের পুরনো একটি হত্যার চেষ্টার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন, এবং পুলিশী যোগসাজশে তাঁকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়। এই কাকার সাথেই জেলে দেখা করতে যাবার সময় উল্টো দিক থেকে আসা ট্রাকের সাথে মেয়েটির গাড়ির সাথে সংঘর্ষেমারা যান মেয়েটির মা ও মাসি এবং ড্রাইভার। মেয়েটি এবং তার আইনজীবী গুরুতর জখম হন। পুলিশ এটাকে প্রথমে দুর্ঘটনা বলে চালাবার চেষ্টা করে অথচ দেখা যায় ধাক্কা দেওয়া ট্রাকটির নাম্বার প্লেটকালো রঙের কালি দিয়ে মোছা ছিল। ঠিক সেদিনই মেয়েটির জন্য যে নিরাপত্তারক্ষীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। এ সবই কাকতালীয়?
এইটাই ঘটে বিজেপির মডেলে। আমরা দেখতে পারছি কিভাবে মধ্যপ্রদেশের ভ্যাপম কেলেঙ্কারির সব মৃত্যুই স্বাভাবিক হয়ে যায়। গুজরাটের কৌশর বাঈ-এর ধর্ষণ ও হত্যার আজ ১৪ বছর পরেও কোনো বিচার হয় না। হরিয়ানায় স্বঘোষিত ধর্মগুরু ধর্ষক রাম রহিমের বিরুদ্ধে সংবাদপপত্রে লেখার পর খুন হতে হয় সাংবাদিক রাম চন্দ্র ছত্রপতিকে। গুজরাটের সোহরাবুদ্দিন হত্যার সাথে অমিত শাহ নাম জড়িত থাকায় কোর্টে অমিত শা উপস্থিত হওয়ার আগেই অস্বাভাবিকভাবে মারা যান বিচারপতি লয়া। এই সব কেন হচ্ছে এর উত্তর আমাদের জানা। যে দল ধর্ষণের সপক্ষে মিছিল বার করে, সেই দলেরই সংসদ সাক্ষি মহারাজ জেলে গিয়ে এই কুলদীপ সেঙ্গারকেই অভিবাদন জানিয়ে আসেন তাদের কাছ থেকে কোন প্রত্যাশা নেই আমাদের। বরঞ্চ বিজেপি ‘বেটি বাঁচাও’ প্রচারের মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছে। মানুষ দেখছে কিভাবে এই বিজেপির রাজ্যে নারীদের বিরুদ্ধে এক অঘোষিত জরুরী অবস্থা চলছে। এর বিরুদ্ধে সবাই একত্রিত এবং একজোট হওয়া বড় প্রয়োজন।
উন্নাও-এর তরুণীকে হত্যার চেষ্টা করার পর থেকেই সারা দেশে পথে নামেন বিভিন্ন মহিলা-ছাত্র সংগঠন। ধর্ষণের বিচার এবং অভিযুক্ত বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গারের শাস্তি এবং পদত্যাগ চেয়ে সিপিআই(এমএল) এবং সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে ৩১ জুলাই মৌলালিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। সেই বিক্ষোভে আইপোয়ার সম্পাদিকা কবিতা কৃষ্ণান বলেন “উন্নাও-এর ধর্ষণের বিচার চাওয়া তরুণীকে ট্রাকে পিষে মেরে ফেলার চেষ্টা আসলে মোদী যোগীর রাজ্যে মহিলাদের ন্যায় বিচার পাবার লড়াইকে পিষে মেরা ফেলার চেষ্টা। এর বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে একজোট হতে হবে”। আইপোয়ার সাধারণ সম্পাদিকা মীনা তিওয়ারি বলেন নির্ভয়া আন্দোলনের সময় সরকার বাধ্য হয়েছিল মেয়েটিকে বাইরে চিকিৎসা জন্য পাঠাতে এই নির্লজ্জ বিজেপি সরকার সেটাও চায় না। তারা চায় মেয়েটি উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাক। এই সরকার নিগৃহীতার বদলে ধর্ষককেই নিরাপত্তা দেয়। জাতীয় নেত্রী সুচেতা দে বলেন এই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ফিরতে চাইছে, যে বিজেপি ধর্ষকদের আশ্রয় দেয় বাংলার মানুষ সেই দলকে কিছুতেই ক্ষমতায় আসতে দেবে না। দেশজুড়ে প্রতিবাদের ফলে বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে উন্নাও ধর্ষণ কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত মামলা লখনউ থেকে নয়াদিল্লিতে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাশাপাশি মেয়েটি ও তার আইনজীবীকে কেন্দ্রীয় সুরক্ষাবাহিনী বা সিআরপিএফের সুরক্ষা দেওয়ার কথাও ঘোষনা করা হয়। দেশজোড়া ক্ষোভের মুখে পড়েই অবশেষে উন্নাও কাণ্ডে অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গারকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে বিজেপি।
আন্দোলনই পারে অধিকার ছিনিয়ে আনতে। উন্নাও-এর নির্ভীক তরুণী যে সাহসের সাথে আজ দুবছর ধরে লড়াই করে এসেছে তার সাহসিকতাকে জানাই কুর্নিশ। আমাদের সবাইকে একজোট হয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়ে নারীদের বিরুদ্ধে বিজেপি’র জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
- মিতালী