২৩ জুন। জমায়েত হওয়ার সময় দেওয়া ছিল বিকেল ৫:৩০টা। কিন্ত ঘড়ির কাঁটা তখন ৫টাও ছোঁয়নি। নৈহাটি পৌরসভার সামনে তখন জনারণ্য। পথ চলতি মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে মিছিলে অংশগ্রহণকারী সেই নাগরিক সমাজকে। কারো হাতে শান্তির প্ল্যাকার্ড, কারো বা বুকে সম্প্রীতির পোস্টার ঝুলানো। নির্বাচনোত্তর একাধিক রাজনৈতিক হানাহানির ঘটনায় এই পৌরসভা চত্বর নৈহাটির মানুষের কাছে অশান্তির জায়গা হিসাবে চিহ্নিত। আজ সেই চত্বর কিনা শান্তিকামী নাগরিক সমাজের দখলে! সাধারণ জনগণের কাছে তা অবাক হওয়ার বিষয় বটে। নাগরিক সমাজের এই মিছিল দেখে রাস্তার দু’ধারের কৌতুহলী জনগণের চোখ মুখের অভিব্যক্তি জানান দিয়েছে যে এই দৃশ্য তাদের ভরসার জায়গাও।
এই মিছিলের সলতে পাকানোর প্রক্রিয়া চলেছে বেশ কিছুদিন ধরে। নৈহাটি-বীজপুর জুড়ে নির্বাচনোত্তর রাজনৈতিক হানাহানিতে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত। ভাটপাড়া জগদ্দল অঞ্চলে রাজনৈতিক হিংসার বলি সাধারণ মেহনতি মানুষ। ভয়ে জুট মিলে কাজে যাচ্ছে না শ্রমিক। দোকান-বাজার খুলছে না, রুটি-রুজি বন্ধ। প্রাণ হাতে করে ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে লুঠেরাদের হাতে সর্বস্বান্ত সংখ্যালঘু মানুষ। চলছে অবিরাম বোমবাজি, বাড়ি-দোকান লুঠ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। শুনশান এই মৃত্যুপুরীতে যেন প্রাণের কোনো সাড়া নেই। আছে কেবল পুলিশের বুটের আওয়াজ ও দুস্কৃতিদের আস্ফালনের অদ্ভুত সহবস্থান। বাতাসে বারুদের গন্ধ। আর বাতাসের থেকেও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে অপপ্রচার, ঘৃণা ও বিদ্বেষ। এই সমস্ত ঘটনা নৈহাটি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের ভাবিয়ে তোলে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংঘটিত করার আকাঙ্খায় শুরু হয় নৈহাটি অগ্নিবীণা সাংস্কৃতিক সংস্থার ঘরকে কেন্দ্র করে নিয়মিত মিলিত হওয়ার উদ্যোগ। তারই ধারাবাহিকতায় ২৩ জুন নাগরিক সমাজের এই দৃপ্ত মিছিল।
“নাগরিক সমাজের” আহ্বানে প্রায় চার শতাধিক নাগরিকের এই “শান্তি ও সম্প্রীতি” মিছিল নৈহাটি শহরের বিভিন্ন অঞ্চল পরিক্রমা করে। মিছিলে নৈহাটি ও তার পার্শ্বর্তী অঞ্চল ছাড়াও অশোকনগর, বারাসাত, বারাকপুর, চুঁচুড়া,ও কলকাতার অনেক মানুষ সামিল হন। মিছিলে পা মেলান সাংস্কৃতিক- মানবাধিকার-বিজ্ঞান-সিনে-পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা, বন্ধ গৌরীপুর মিলের ও অঞ্চলের জুট মিলের শ্রমিক, অসংগঠিত শ্রমিক, ছাত্র-যুব-মহিলারাও।
মিছিল থেকে শ্লোগান ওঠে-বিভেদ-বিদ্বেষসন্ত্রাস ছড়িয়ে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা চলবে না, সন্ত্রাস কবলিত ভাটপাড়া-কাঁকিনাড়ার সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। ভাটপাড়া-জগদ্দল অঞ্চলে সমস্ত হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই। স্টপ পলিটিকাল ভায়োলেন্স। জনগণের কাছে আবেদন রাখা হয় শান্তির দাবিতে জোটবদ্ধ হওয়ার। অগ্নিবীণা সহ পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের বন্ধুদের সম্প্রীতির গানে গলা মেলায় সমবেত মানুষ। মিছিলে অংশগ্রহণ করেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায়, মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা ধীরাজ সেনগুপ্ত, তাপস চক্রবর্তী, এআইপিএফ নেতা নির্মল ঘোষ, গণসঙ্গীত শিল্পী নীতীশ রায়, সরিৎ চক্রবর্তী, বাবুনি মজুমদার, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক অমিত দাশগুপ্ত, দীপক মিত্র, কবি অশোক চট্টোপাধ্যায়, লেখক জয়ন্ত ঘোষাল, তাপস গঙ্গোপাধ্যায়, বিজ্ঞান আন্দোলনের সংগঠক সোমনাথ বসু, সিনে সংগঠনের শুভাশিস ঘোষ, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী রবীন দাস, শ্রমিক নেতা মহ: জহিম, শম্ভু ব্যানার্জী, মহিলা সমিতির নেত্রী অর্চণা ঘটক, ছাত্র নেতা শুভ্রদীপ, আয়োজক সংগঠনের সীতাংশু চক্রবর্তী, দেবাশিস পাল, প্রদীপ বসু প্রমুখ সহ অঞ্চল ও জেলার বৌদ্ধিক জগতে ক্রিয়াশীল অনেক মানুষ।
বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে মিছিল শেষ হয় পৌরসভার প্রাঙ্গণে ফিরে এসে। সমস্ত অংশগ্রহণকারীদের আবেগ ও আকাঙ্খাকে সম্মান জানিয়ে ঘোষণা করা হয় যে ভাটপাড়া-জগদ্দলে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার হলেই সেখানেও হবে নাগরিক সমাজের এই শান্তি ও সম্প্রীতি মিছিল।