গত দুই বছর কোনও বাঙালি যদি ন্যাশনাল ফিগার হিসেবে উঠে এসে থাকেন তাহলে তিনি হলেন ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। হবেন নাই বা কেন? তিনি হলেন আশুতোষ মুখার্জীর ছেলে। যে আশুতোষ আধুনিক বাংলার অন্যতম স্থপতি, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষাসংস্কৃতির আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে গভর্নরের সাথে টক্কর দিয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালে বাংলায় আমেরির শাসনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রাতারাতি ন্যাশনাল ফিগার হয়ে যান। বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় গভর্নরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো গণ্ঠস্বরটি ছিল তাঁরই। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁর বেঙ্গল রিলিফ কমিটিতে লাখ লাখ টাকা এসেছিল। বাংলা বাঁচাতে যাকে লক্ষ লক্ষ টাকা দেওয়া হল সেই লোকটি তাঁর নিজের গ্রামে জীবনশিখা জ্বালিয়ে রাখতে কী করেছিলেন? আপনারা সকলে নিশ্চয় সেকথা জানতে চাইবেন।
তাই আমি, একজন সামান্য বাঙালি আর্টিস্ট, গেলাম হুগলি জেলার জিরাট গ্রাম দর্শনে। আশুতোষ ও শ্যামাপ্রসাদের বাড়ির গ্রাম। জুন মাসের প্রথম দিকে কয়েক মাইল হেঁটে ভেতর দিয়ে গেলাম এবং যা দেখলাম তা ভয়ঙ্কর। গ্রামগুলিকে দুভাগ করে বইছে বেহুলা নদী। ভয়াল বেহুলা নদী তার দুকূল প্লাবিত করে দুপাড়ের প্রায় সমস্ত গ্রামগুলিকে পলিমাটির চাদরে ঢেকে দিয়েছিল। তারপরও কেটে গেছে পুরো একটা বছর। কুঁড়ে ঘরগুলি সব জলের তোড়ে ভেসে গেছে। প্রতিটি গ্রামেই ধ্বংস হয়ে যায় সব ধানের গোলা। ১২ দিন ধরে ছয়টি গ্রাম জলের তলায় ছিল। ৭০০০ গ্রামবাসী সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। এ ছিল গত বছরের ঘটনা। গত বছরের অভিশাপ কি এবছর আশীর্বাদ হয়ে উঠল? নদীপাড়ের এই উর্বর পলিমাটি আবাদ করে কি এবছর সোনার ধানে ভরে উঠল মাঠ? মোটেই না! চাষ করার কোনও সুযোগ চাষিরা পাননি। বিধ্বংসী বন্যা পেরোতেই সারা বাংলাকে গ্রাস করেছে দুর্ভিক্ষ এবং বলাগড়কে অতিরিক্ত চড়া দরে ধান আমদানি করতে হয়েছে। নিজের ধান তার সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। সুতরাং নতুন করে ঘর তোলার জন্য সরকার চাষিদের যে দশ টাকা করে ঋণ দিয়েছিল তা খরচ করে ফেলেছে চাষিরা সামান্য একটু ধান-চাল কিনতেই। যখন ওই দশটা টাকাও চলে গেল তখন খাবার চাল কেনার মতো পয়সাও আর অবশিষ্ট থাকল না, নতুন করে চাষের জন্য বীজ বা হাল-বলদ কেনার কথা ছেড়েই দিন।
তো আমি ধানভরা মাঠের উচ্ছ্বাস দেখতে পেলাম না। কেবল পতিত মাঠ। রোদে পোড়া, ফাটল ধরেছে, ইতিউতি উঁকি মারছে ঘাস আর আগাছা। এখানে ওখানে কিছু পাট চাষ করেছে সম্পন্ন কৃষকেরা। কিন্তু এবারে বর্ষা দেরিতে এসেছে বলে সেগুলোও ঝলসে গেছে রোদে। তাঁরা আমাকে এটাও বলল যে বিলম্ব বর্ষণের কারণে আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি রবিশস্যও নষ্ট হয়ে গেছে। কলকাতার বাজারের জন্য ওইসব চাষ করেছিলেন তাঁরা। আমগাছগুলি বিশালাকার আর প্রাচীন। বন্যা তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। সেই কারণেই বলাগড়ের ২৫% পরিবার বেঁচে আছে কেবল আম আর আমের আঁটি খেয়ে। আম খাবারই জিনিস। কিন্তু শুধুমাত্র আম তো মানুষের খাদ্য নয়। ফলত যেখানেই যাই দেখি কলেরা, ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, চর্মরোগ ছেয়ে গেছে। রাজপুর গ্রামে যেমন বাহান্নটা পরিবারের মধ্যে মাত্র ছয়টি পরিবার টিকে আছে। তাঁরাও ধুঁকছে ম্যালেরিয়ায় আর অন্নবস্ত্রের নিদারুণ আভাবে। যতগুলি গ্রামে গেলাম প্রতিটিতেই এক অবস্থা। নিজের বাড়ির পাশের এই গ্রামগুলিকে সাহায্য করার জন্য শ্যামাপ্রসাদে কি কি করেছেন ? আমি এদিকে ওদিকে কিছু লোকজনকে জিজ্ঞেস করি। সত্যি কথা বলতে গ্রামগুলিতে তাঁর সম্পর্কে কাউকে একটি ভালো কথা বলতে শুনলাম না।
কীভাবে সরকারের তরফ থেকে লপ্সি খাওয়ানোর লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল, দুমাস ধরে ৪০০ জনকে দুবেলা খাওয়ানো হয়েছিল সেসব বললেন তাঁরা। কীভাবে সরকার গ্রামের প্রত্যেক পরিবারকে ১৫ আনা ও মাথাপিছু দুমুঠো চিড়ে দিয়েছিল সেসব বললেন। তারপর ইউনিয়ন বোর্ডের তরফ থেকে পুরুষদের ১৪ পয়সা করে, মহিলাদের ১০ পয়সা করে ও শিশুদের ৫ পয়সা করে দেওয়া হয়। স্টুডেন্টস ফেডারেশন ও মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ সম্পর্কে অনেক কথা বলেন তাঁরা। বন্যার ঠিক পরেপরেই ওরা জামাকাপড়, ১২ মণ শস্যবীজ, প্রচুর তরিতরকারি দিয়েছিল; কোনও কোনও গ্রামে পরিবার পিছু ৫ টাকা করে দিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টিও দুবার মাথা পিছু এক পোয়া করে চাল ও এক পোয়া করে আটা দিয়েছিল। ‘ডুমুরদহ উত্তম আশ্রম’ বাড়ি পিছু ২ টাকা দেয় এবং আট সের করে আটা কন্ট্রোল রেটে দিয়েছিল তিনমাস. এক কথায় সকলেই কিছু না কিছু সাহায্যের চেষ্টা করে কেবলমাত্র জেলার সবচেয়ে বিশাল ব্যক্তিটি ও সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠনটি – ডক্টর মুখার্জী ও তাঁর হিন্দু মহাসভা ছাড়া সকলেই। শ্রীকান্ত গ্রামের এক গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে আমি সরাসরিই প্রশ্নটা করে বসলাম : তাঁদের জন্য় বেঙ্গল রিলিফ কমিটি কী কী করেছে ? তিনি বেঙ্গল রিলিফ কমিটি বা শ্যামাপ্রসাদের নাম শোনেননি ... কিন্ত আশুতোষের নাম বলতেই সাথে সাথে বুঝলেন। ‘নাহ্, ওদের কাছ থেকে আমরা কিছু পাইনি’ জানালেন তিনি। এরপর জিরাট পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত আমি আর শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে কারও সাথে কোনও কথা বলিনি।
কিন্তু যতই আমি জিরাটের দিকে এগোতে থাকলাম তত বেশি করে জিরাট লাগোয়া এই গ্রামগুলির অবস্থা আমি বুঝতে পারছিলাম। এক কথায় বললে একটা গ্রামের স্বাভাবিক নেতাটিই যদি বিপদের দিনে পালিয়ে যায় তাহলে গ্রামের কী অবস্থা হতে পারে তা দেখলাম আমি। শ্যামাপ্রসাদ ওদের কোনও সাহায্য করেনি এবং ওই এলাকায় আর কোনও ক্ষমতাশালী লোকও ছিল না যে তাঁদে সাহায্য করতে পারে। ফলত খাদ্য বস্ত্র ও ঔষধপত্র ইত্যাদি যেটুকু সাহায্য বাইরে থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে পৌঁছেছিল তা চোর ছ্যাঁচোড়ে লোপাট করে দেয়। আরও উদাহরণ, শ্রীকান্ত গ্রাম এরকম এক ব্যক্তির ওপর তিতিবিরক্ত হয়ে ছিল (তার নাম জানানো থেকে আমি বিরত থাকছি), লোকটা সত্যিই একটা গলাকাটা, ইউনিয়ন বোর্ডের ত্রাণকার্যের দায়িত্বে আছেন। তিনি তাঁর নিজের লোকজনকে সপ্তাহে দেড় সের করে খাদ্য দিচ্ছিলেন। কিন্তু কদমডাঙ্গা গাঁয়ের কিসানেরা যখন তার কাছে সাহায্যের আশায় গেলেন তখন তিনি পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে এমনি এমনি তো আর চাল পাওয়া যায় না! আমার জমিতে বিনি পয়সায় কাজ করে দাও, আমি কন্ট্রোল রেটে বাড়িতে চাল পৌঁছে দেব। সারা গ্রাম তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল কিন্তু তবু ইউনিয়ন বোর্ড তাকেই ১৫ থান কাপড় দিল ৮৩টা পরিবারের মধ্যে ভাগ করে দিতে। সে যথারীতি আগের মতোই করল, গ্রামবাসীদের সে খালি হাতেই ফিরিয়ে দিল আর কাপড়ের পুরো স্টকটাই নিজের স্বজনদের মধ্যে উপহার হিসেবে বিলিয়ে দিল।
এইসব কাহিনীর গুঞ্জন কানে নিয়ে আমি অবশেষে শ্যামাপ্রসাদের নিজের গ্রামে পদার্পণ করলাম এবং সটান গিয়ে হাজির হলাম আশুতোষের সাবেক প্রাসাদে। আশুতোষের একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয়, কোনও এক গোস্বামী, প্রাচীন বাড়িটিকে ‘আশুতোষ স্মৃতি’ নামকরণ করেছিলেন। কিন্তু, আধুনিক বাংলার গর্বিত স্থপতি, যিনি একজন বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন এবং বৃহৎ মাপের পরিকল্পনা ও নির্মাণের কাজ করতেন সেই রয়াল বেঙ্গল টাইগারের (ওই নামেই বাংলায় জনপ্রিয় আশুতোষ) ভেঙ্গে পড়া, ধ্বসে যাওয়া, বিষণ্ণ এক স্মারকগৃহ দেখতে পেলাম আমি। আমি যে স্কেচটি করেছি তা থেকেই আপনারা বুঝতে পারবেন যে ক্লাসিক ডিজাইনের সুদৃঢ় থাম নিয়ে গঠিত সেই প্রাসাদ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। চওড়া সিঁড়ির অর্ধেকটাই ধ্বসে গেছে, বাকি অর্ধেকের ইঁট বেরিয়ে আসছে খুলে খুলে পড়ছে। শ্যাওলা আর বুনো ঝোপঝাড় জানলাগুলি ঢেকে দিয়েছে আর ফাটলে গজিয়ে ওঠা আগাছা থামগুলিকে ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত ফাটিয়ে দিয়েছে।
তাঁদের পিতা আশুতোষের স্মৃতিকে পুণ্য ভেবে যাঁরা ‘আশুতোষ স্মৃতি মন্দির’ (আশুতোষের চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি) খুলেছিল তাঁদেরকে আশুতোষের পুত্রেরা এই ধ্বংসস্তূপের মাঝে এক টুকরো দান ছুঁড়ে দিয়েছেন। ডিসপেনসারির দায়িত্বে থাকা বদমেজাজী ডাক্তারবাবু আমাকে জানালেন যে প্রতিদিন সকালে তিন ঘণ্টার জন্য ডিসপেনসারি খোলা থাকে এবং ৩০-৪০ জন রুগী প্রত্যহ আসে। কিন্তু আমি পরপর দুই দিন সকালে গিয়ে দেখলাম যে এক ঘণ্টার বেশি খোলা থাকে না। চারিদিকে এত লোক ম্যালেরিয়ায় কাহিল কিন্তু ৩০-৪০ জন রুগীকে দেখতে পাব ভেবে গিয়ে দেখতে পেলাম মাত্র ১০-১২ জনকে। গোটা জায়গাটাই এমন বিষাদগ্রস্ত আর এমন অদ্ভুতুড়ে আর অশুভ একটা ব্যাপার যা ঠিক প্রকাশ করা যায় না, আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল ...
বন্যা যখন বলাগড়ের সব বাড়িগুলিকে ধ্বসিয়ে দিচ্ছিল ঠিক তখন আশুতোষের পুত্রেরা একটি ঝকঝকে নয়া অট্টালিকা বানানো মনস্থ করলেন। আশুতোষের পুরানো বাড়ি আর তাঁদের জন্য তেমন যোগ্য ছিল না। দুর্ভিক্ষের মাঝে আশপাশে মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে আর সব বাড়ির মতোই আশুতোষের বাড়িও যখন ভেঙে পড়ছিল ঠিক তখনই শ্যামাপ্রসাদ ঝাঁ-চকচকে এক নয়া অট্টালিকা কেন বানাতে বসলেন তা আমার মাথায় ঢুকছিল না। আমি সেই ঘৃণ্য, কদর্য নতুন বাগানবাড়ি দেখতে চললাম। সমগ্র বলাগড় জুড়ে এই বাড়িটি বিগত বছরে তৈরি হওয়া একমাত্র নতুন বাড়ি হিসেবে ও দু-দুটি ধানগোলাওয়ালা একমাত্র বাড়ি হিসেবে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত অবশ্য কেবল বহির্মহলই স্থাপিত হয়েছে। সদর দরজার দুইপাশে বিলাসবহুল আসবাব সজ্জিত বৈঠকখানা ও গেস্টরুম। বলাগড়ের সবচেয়ে ধনশালী জায়গাটিকে সুরক্ষিত রাখতে ভারী শক্ত লোহার গেট আর জানালায় শক্ত লোহার গরাদ। আছে গ্রিন-হাউস সহ সুন্দর সাজানো একটি বাগান।
জায়গাটিকে মরুভূমির মধ্যে এক মরুদ্যানের মতো লাগে। ছুটির দিনে কলকাতা থেকে মুখার্জী পরিবারের পিকনিকদল মোটরে চেপে আসে গঙ্গাস্নানে, আবার মোটরে চেপে চলে যায়। ছেলেদের এই কদর্য নতুন বাড়িটি বাবার পুরানো ভেঙে পড়া গৌরবময় বাড়িটিকে যেন নিরন্তর অপমান করে চলেছে। এখানে জমা হওয়া সম্পদের পাহাড় চারপাশের হাজার হাজার ভূখা মানুষকে অপমান করে চলেছে। বিতৃষ্ণায় বিরক্তিতে আমি ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম। কিন্তু তখনও গল্পের শেষটা জানা আমার বাকি ছিল।
বলাগড়ের গ্রামগুলিতে এক নতুন হাটের গল্প – জিরাটে এই নতুন হাটের পত্তন করেছেন শ্যামাপ্রসাদ, মহা ধুমধামে অনুষ্ঠান করে, দুর্ভিক্ষের এক বছরে মোট যে দু-বার তিনি গ্রামে এসেছিলেন তার একবার। সব সদাশয় ব্যক্তিই ওই হাটটাকে অভিসম্পাত দেয়। কেন? কারণ সিজেই গ্রামে বহুদিন ধরে একটি চালু হাট ছিল, জিরাট থেকে দূরে নয়। একটা হাটই যথেষ্ট। বিপদের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে গ্রামবাসীদের ঠকিয়ে মুনাফা না করে, যাতে ন্যায্য মূল্যে জিনিস পায় গ্রামের মানুষ, তার ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে শ্যামাপ্রদাস আরেকটি হাট প্রতিষ্ঠা করলেন এবং সিজেই হাট যেদিন বসে সেই বুধবার করেই নতুন হাট বসার ব্যবস্থা করলেন। বলাই বাহুল্য যে, সিজেই হাটকে ভাঙার জন্যই এই ব্যবস্থা – প্রায় সমস্ত গ্রামবাসীই তাই মনে করে ...
এইভাবে শ্যামাপ্রসাদের বসানো হাটে প্রকাশ্য দিবালোকে মুনাফালোভী কারবার দেখে জিরাট গ্রামে হিন্দু মহাসভার ত্রাণকার্য সম্পর্কে জানার তেমন আগ্রহ আর ছিল না। কিন্তু তবু আমি আরও খোঁজখবর নিলাম কারণ জিরাটই ছিল একমাত্র গ্রাম যেখানে মানুষ শ্যামাপ্রসাদের ত্রাণকার্য সম্পর্কে কিছু কথা শুনেছে। এই ত্রাণকার্যকেও আমি ওই হাটের মতোই এক মুনাফাচক্র হিসেবে আবিষ্কার করলাম, অথবা ঠিক ওই দাতব্য চিকিৎসালয়ের মতো। চারটি ত্রাণকেন্দ্র থেকে সপ্তাহে একদিন মোট, যদ্দুর বুঝলাম ২৮ সের আটা ও ২৮ সের চাল বিতরণ করত হিন্দু মহাসভা। এছাড়া শ্যামাপ্রসাদের দুই ভাই একটি দোকান খুলে বসে যেখানে বাজার দরের অর্ধেক দামে চাল বিক্রি করে। কিন্তু তাতে কারোই উপকার হয়নি কারণ তখন বাজার দর ছিল ৪০ টাকা মণ! সেই কারণে গাঁয়ের গরিব কৃষক ও মৎসজীবীরা আমাকে বলে যে, ‘সব দানই তো বাবুদের জন্য। ২০ টাকা মণ দরে ধান কেনা ওই গুটিকয় লোক ছাড়া বাকিদের কাছে অনেক মহার্ঘ’।
মোটামুটি এগুলোই আমি জানলাম জিরাটে, শ্যামাপ্রসাদের বাড়ির গ্রামে। আমি বাংলার অনেক গ্রামে গেছি, যেসব গ্রাম আমাদের অনেক মনীষীদের জন্মস্থান – কিন্তু ধনীদের বিরুদ্ধে, বিশেষত গ্রামের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের এমন তিক্ত ঘৃণা আমি আর কোথাও দেখিনি।
কিন্তু আমার ফিরতি পথে আমি আরও এমন কিছু পেলাম যার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মনে হল মধ্যবিত্ত যুবদের এক পুরো প্রজন্ম বেহায়ার মতো মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে তাদের লিডার ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মহিমা কীর্তনে! বলাগড় জিরাটের সবাই আমাকে বলেছে যে, গত দুবছরে শ্যামাপ্রসাদ দুবারের বেশি বলাগড়ে আসেনি -- একবার দুর্ভিক্ষের সময়, আরেকবার জিরাটে হাট বসাতে। তথাপি, পাশের কাসালপুর বলে একটি গ্রামের এক ডাক্তার আমাকে বলল যে শ্যামাপ্রসাদ তো কলকাতা থেকে যাওয়া আসা করতেই আছে -- গত দুই মাসে চারবার, মানুষটা তার গ্রামকে ভালোবাসে! বিমলেন্দু গোস্বামী, যিনি জিরাট রিলিফ ক্যাম্পে ময়দা বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করেন, আমাকে বললেন যে তিনি কেবল রবিবার করে রিলিফের মাল দেন। অথচ হাই স্কুলের এক ছাত্র, যে কিনা হিন্দু মহাসভা নিয়ে গর্বিত, আমাকে বলল যে রিলিফ ক্যাম্পে একশ থেকে দেড়শো মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য প্রতিদিন ২৪ জন ছাত্র স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছে!
ধনীরা এভাবে নিজেদেরকে জিরাটে ঘৃণার বস্তুতে পরিণত করেছে। এবং অন্য যে কারও থেকে বেশি শ্যামাপ্রসাদকে ভয় ও ঘৃণা করে সবাই। কিন্তু আমার পরিদর্শনের শেষে আমি কিছু কথা শুনলাম যা থেকে বুঝলাম যে শ্যামাপ্রসাদের সমস্ত অপকর্ম সত্ত্বেও বাংলার প্রাচীন সমাজসভ্যতা ও আশুতোষের স্পিরিট এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। তালাবন্ধ ইস্কুল ঘরের সামনে জড়ো হওয়া ছেলেমেয়েরা চিল্লামিল্লি করে খেলছিল। কেউ একজন গালাগাল করল। সাথে সাথে এক জন বৃদ্ধ গর্জন করে উঠলেন : “কে বাজে কথা বললি রে? তোরা কি সব পশু হয়ে গেছিস নাকি?” ‘ইস্কুলই যখন বন্ধ হয়ে গেছে তখন আর মানুষ হবে কি করে?’ উত্তর দিল কেউ একজন। তারপর ওরা আমার কিসান-মজদুর গাইডটির দিকে এগিয়ে এলো। বলল : ‘দয়া করে আমাদের একজন ইস্কুল মাস্টার দিন! আমরা নিজেরা না খেতে পেলেও আমাদের খাবার থেকে ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করব। এক পোয়া কেরোসিনের দাম দশ আনা, কিন্তু আমরা যেভাবে হোক ব্যবস্থা করব, ভগবানের দোহাই! ইস্কুলটা আবার চালু করেন, যদি তা না পারি ... আশুর গ্রাম থেকে সভ্যতার আলো মুছে যাবে, আমাদের ছেলেরা সব গুণ্ডা হবে যাবে।’ বাঁচার জন্য শ্রমের জন্য কী গভীর আকুতি। ওরা বাঁচবেই, আর লড়বে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের মতো -- শ্যামাপ্রসাদ যাই করুক না কেন।
-- ভাষান্তর : মলয় তেওয়ারি