আগামী ৩০ জুলাই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ফ্যাসিবাদ বিরোধী একটি বড় সমাবেশ হতে চলেছে সিপিআই(এমএল)-এর উদ্যোগে। এই সমাবেশ ইতোমধ্যেই বেশ সাড়া ফেলেছে। আশা জাগিয়েছে অনেকের মধ্যে।
এই সময়টা নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় জীবনে এবং আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেও একটি বিশেষ সংকটের মুহূর্ত। ফ্যাসিবাদী শক্তি নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে তার শক্তিকে অনেক গুণ বাড়িয়ে নতুন নতুন হামলা চালাতে নেমে পড়েছে। পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে মানুষের কণ্ঠস্বর, আন্দোলনের স্বরও আবার তৈরি হচ্ছে অত্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মেই। এই কনভেনশন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যারা লড়ছেন, সংকল্প নিচ্ছেন, প্রতিরোধের কথা ভাবছেন সেই সমস্ত মানুষদের একসাথে আসার, মতবিনিময় করার, একসাথে পথ চলার, অঙ্গীকার নেওয়ার একটা সমাবেশ।
এই সমাবেশের সাফল্য কামনা করে এর মধ্যেই বার্তা দিয়েছেন বিভিন্ন বিশিষ্ট মানুষ। তারা নিজেরা এই সমাবেশে সামিল হওয়ার কথা যেমন বলেছেন, ঠিক তেমনি আবার আহ্বান জানিয়েছেন তাদের চারপাশে থাকা অন্যান্য মানুষজনদেরও। তারা চেয়েছেন আরো অনেক অনেক মানুষ এই সমাবেশে যুক্ত হয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইকে শক্তিশালী করে তুলুন। এদের মধ্যে রয়েছেন নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের পরিচিত মুখ আফরোজা খাতুন। রয়েছেন তরুণ সাহিত্যিক সাদিক হোসেন। রয়েছেন প্রখ্যাত উপন্যাসিক অধ্যাপক শামীম আহমেদ। রয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মু।
শামীম আহমেদ বলেছেন, আমরা একটা সন্ধিক্ষণে আছি, যে সন্ধিক্ষণে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প প্রত্যেক দিন আমাদের বিদ্ধ করছে। সংখ্যাগুরু মানুষের একটি অংশ সংখ্যালঘুদের ক্ষতি চাইছেন এবং সেখান থেকেই হিংসার অনেকগুলি ঘটনা নানা জায়গায় আমরা ঘটতে দেখছি। সংখ্যালঘুদের ওপর নিয়ম করে হামলা হচ্ছে, দলিতদের উপর নিয়ম করে হামলা হচ্ছে, আদিবাসী মানুষদের ওপর নানা রকমের হামলা নামছে।
সুপ্রিম কোর্ট তার এক সাম্প্রতিক রায়ে জানিয়েছেন যে আদিবাসী মানুষেরা, যারা জঙ্গলে থাকতেন, তারা আর জঙ্গলের জমির পাট্টা পাবেন না। এর ফলে প্রায় ২৩ লক্ষ আদিবাসী পরিবার জঙ্গল থেকে, তাদের বসবাসের, জীবন-জীবিকার জায়গা থেকে উৎখাতের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। অর্থাৎ প্রায় এক কোটি আদিবাসী মানুষ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে।
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা তো একটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ঝাড়খন্ডে দেখা গেল জোর করে একজন সংখ্যালঘু মানুষকে জয় শ্রীরাম বলানো হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গাতেই – জয় শ্রীরাম বলতে হবে — এই দাবি জানিয়ে সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর আক্রমণ নামানো হচ্ছে, হামলা চালানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও তাদের মেরেও ফেলা হচ্ছে। এই ভাবে তাদের মধ্যে একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
হামলা নামানো হচ্ছে নানাভাবে। আসামে এনআরসির মাধ্যমে প্রায় ৪০ লক্ষ বাঙ্গালীকে এক চরম অনিশ্চয়তার সামনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে তারা নাকি এ দেশের নাগরিকই নন, অনুপ্রবেশকারী এবং তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। বিপর্যয় নামছে অর্থনীতিতেও, আমাদের অর্থনীতির অধোগতি অত্যন্ত স্পষ্ট। এইরকম একটা সামগ্রিক দুঃসহ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে, আতঙ্কর পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই এর দরকার আছে। আগামী ৩০ জুলাইয়ের কনভেনশন সেই লক্ষ্যেই। শামীম আহ্বান জানিয়েছেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যারা লড়তে চাইছেন, তারা সবাই যেন এই কনভেনশনে আসেন।
সাদিক হোসেন বলেছেন, ২০১৪ সাল থেকেই ভারতবর্ষ শাসন করছে একটি ফ্যাসিস্ট দল। ২০১৯-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তারা আরো শক্তিশালী হয়ে ক্ষমতায় ফিরেছে। আমরা যা কিছু স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করেছিলাম সেই সব কিছুর উপরেই তারা হামলা নামাচ্ছে।
আমরা দেখেছি পছন্দের খাবার খাওয়ার জন্য মানুষকে খুন করা হয়েছে। পছন্দের মানুষকে ভালোবাসার জন্য মানুষকে খুন করা হয়েছে। বাসে ট্রামে ট্রেনে রাস্তায় শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ হবার জন্যই কিছু মানুষকে চিহ্নিত করে তাদের হেনস্থা করা হয়েছে, এমনকি কোথাও কোথাও খুন পর্যন্ত করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে ভীতিজনক। কিন্তু ভয় পেয়ে গেলে চলবে না, ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ করার প্রয়োজন খুবই বেশি। ৩০ জুলাই এর সংহতি ও প্রতিরোধ কনভেনশন এই নিরিখেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কনভেনশনে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সব মানুষকে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
আফরোজা খাতুনের কথা হল, আজকে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যেখানে মুসলিমদের প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ দিতে হচ্ছে যে তারা এই দেশকে ভালবাসেন। এই পরিস্থিতিটা খুবই সমস্যার। আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি। তার যে কোনো ভালোকিছুতে আনন্দিত হই, যে কোনো সমস্যায় চিন্তিত হয়ে ভাবি যে কিভাবে সেই সমস্যাটা দূর করা যাবে। গেরুয়া দল এসে আজকে মুসলিমদের বলছে যে তাদের কোনো কিছুতেই প্রতিবাদ করার কোনো অধিকার নেই। তাদের প্রতিবাদ করতে হলে এই দেশে আর থাকাই চলবে না। অথচ সংবিধান আমাদের দিয়েছে প্রতিবাদ করার অধিকার।
কোনো মুসলিম ছেলে কোনো হিন্দু মেয়েকে ভালবাসলে এখন একটা আতঙ্ক হয়। আশংকা হয় যে ও সত্যিই প্রাণে বাঁচবে তো? ভারতবর্ষের যে উন্মুক্ত আদর্শ — সেই আদর্শথেকে আমরা যেন ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি। এই পিছিয়ে যাওয়াটা খুব কষ্টের।
এইরকম দুঃসহ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে একটা জাগরণের খুব দরকার দরকার। আগামী ৩০ জুলাই সংহতি ও প্রতিরোধ কনভেনশনের যে ডাক দিয়েছে সিপিআইএমএল লিবারেশন, আফরোজা তাকে গভীরভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। মনে করেছেন এই ধরনের কনভেনশন অনেক হওয়া দরকার এবং এই ধরনের কনভেনশনের বার্তা ছড়িয়ে পড়া দরকার। তিনিও সবাইকে এই কনভেনশনে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। মেরুনা মুর্মুর বক্তব্য হল, দলিত-আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা চলছে তার উল্লেখ করেছেন। সংখ্যালঘুদের ওপর মব লিঞ্চিং-এর অত্যন্ত দুশ্চিন্তাজনক ঘটনাগুলির পাশাপাশি তিনি বিস্তারিতভাবে বলেছেন আদিবাসীদের ওপর নেমে আসা সংকটের কথা।
সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় আদিবাসীদের এতদিন ধরে জঙ্গলের উপর যে অধিকার ছিল, সেই অধিকারকেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সরকার এবং কর্পোরেটের যুগলবন্দী আগে থেকেই আদিবাসীদের ওপর নানাভাবে আক্রমণ নামাচ্ছিল। এই ধরনের রায় আদিবাসীদের জীবন জীবিকা বেঁচে থাকাকে আরো বেশি সংকটগ্রস্ত করে তুলবে। এই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে একটা ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের প্রয়োজন থেকেই ৩০ জুলাই এর কনভেনশন এর সফলতা চেয়েছেন মেরুনা এবং সবাইকে এই কনভেনশনে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।