দেশজোড়া আন্দোলনে ডাক্তাররা ওড়ালেন জয়পতাকা
“আমরা কারা?”
(অন্যরা একসাথে)” সোনার ছেলে”।
“আমরা কারা “? (আবার একসাথে) “লক্ষ্মী ছেলে”।

১৭ জুন। নবান্ন। বিকেল সাড়ে পাঁচটা। বৈঠক শেষের মুখে। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “আমার সোনা ছেলেরা, লক্ষ্মী ভাইরা, এবার তোমরা করছ তো (কাজে যোগদান)।” অনুনয় বিনয় তো করতেই হবে। হাতি যে কাদায় পড়েছে!

মুহূর্তে নবান্ন থেকে জয়ের খবর উড়ে এল নীলরতন সরকার হাসপাতালে। কদিন আগেই এ জায়গা রণক্ষেত্র ছিল। আজ সেই বিক্ষোভ অবস্থানস্থল জুড়ে ছাত্রছাত্রী জুনিয়র সিনিয়র সব ডাক্তাররা বাধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভেসে গেলেন। সাক্ষী থাকল অসংখ্য পুলিশ, রুগীদের আত্মীয়স্বজন, কলকাতার নাগরিক সমাজ। আর মেঘলা আকাশেও পূর্নিমার আস্ত একখানা চাঁদ।

“আবির কোথায়?”
“কী রঙের আবির?”
“আরে যে কোনো রঙের যা পাওয়া যায়”
ওদিকে আটদিন বন্ধ থাকার পর হাসপাতালের সিংহদরজা গেল খুলে। অবস্থানের অষ্টম দিনে।

গত ১০ জুন, এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নীলরতন সরকার কলেজ হাসপাতালে হামলা চালায় রুগীর লোকজন। মাথার খুলি ফেটে মৃত্যুর মুখে পড়ে তরুণ ডাক্তার পরিবহ মুখার্জি। সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তাররা ওপিডি ও এমারজেন্সি বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে সারা রাজ্য ও দেশ জুড়ে হাসপাতালগুলোতে যে অভূতপূর্ব অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তার সাক্ষী হয়েছে প্রায় প্রত্যেকটি মানুষ।

অন্যদিকে তিনি তো ভাঙেনও না মচকানও না। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী দিব্যি দীর্ঘ আটদিন বসে রইলেন জেদ ধরে। তার এক একটা মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলল। যে অপরিণত অসংগঠিত তরুণ ডাক্তাররা বন্ধুদের শরীর থেকে রক্ত ঝরা দেখে তীব্র আবেগে হাসপাতাল বন্ধ করে দিলেন তারা হয়ত তখনও জানতেন না পরবর্তী পদক্ষেপটি কী হবে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যেকটি চ্যালেঞ্জকে স্বাগত জানিয়ে ক্রমশ নিজেদেরকে পরিণত ও দর কষাকষিতে দক্ষ করে তুলছিলেন। তখন এক গলা কাদা থেকে উদ্ধার হতে মাননীয়ারও ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া ছাড়া অন্য পথ ছিল না। তাই হুমকি ধমকের রাস্তা ছেড়ে ডাক্তারদের সাথে বসতে বাধ্য হলেন।

ডাক্তাররা নবান্নের বৈঠকে বলেন যে, তারা চরম সংকটে পড়েই হাসপাতাল বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। তারা খুব তাড়াতাড়িই কাজে ফিরতে চান। মুখ্যমন্ত্রীর উপর তাদের পূর্ণ আস্থা আছে, তাই তারা মাননীয়াকেই ঘটনাস্থলে তাদের মাঝে চেয়েছিলেন। কিন্তু জনগণের দ্বারা নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ব্যক্তির ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেন না মুখ্যমন্ত্রী। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সাথে যুদ্ধে নেমে পড়লেন। উচ্চারণ করলেন অভব্য ভাষা। উদ্ধত শরীরী ভঙ্গিরও অভাব দেখা যায়নি।

ডাক্তারদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে বললেন, ‘‘কয়েকজন যোগ দিয়েছে, বাধ ভাঙলে সবাই আসবে।’’ মিথ্যা কথা। কেউ কাজে যোগ দেয়নি।

ডাঃ পরিবহ মুখার্জির দোষটা কী ছিল? তার মূল দোষটি ছিল, রুগীর লোকজনদের সে অসুস্থতার গভীরতা বোঝাতে পারেনি। ট্রাক ভরে লোক আসার হুমকি সত্ত্বেও পুলিশদেরকে ডাকার কথাও ভাবেনি। সদ্য পাশ করা একজন ইন্টার্ন মানে চিকিৎসাব্যবস্থার পরিবারে হামা দেওয়া একটি ছোট্ট শিশু। তার কাছ থেকে এত কিছু কি করে আশা করা যায়! তখন যে সিনিয়র ডাক্তারের তার সাথে ডিউটিতে থাকার কথা তিনি কোথায় ছিলেন? রুগীর চিকিৎসা করা সহ উদ্বিগ্ন আত্মীয় স্বজনকে বোঝানোর ভাষা ও ভঙ্গী ইত্যাদি মিলিয়ে চিকিৎসা একটি শিল্প একটি সংস্কৃতি। সেটাও একটা শেখার বিষয়। আর সে দায়িত্ব কিন্তু বড়দের।

এই ঘটনায় প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, ডাক্তাররা শারীরিক নিগ্রহের হাত থেকে বাঁচতে রুগী বিরোধী এত দীর্ঘ একটি কর্মবিরতির রাস্তায় নামলেন। কিন্তু তাদের নিরাপত্তার সংজ্ঞাটিও শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক শারীরিক আঘাত থেকে সুরক্ষিত থাকা নয়। এই নিরাপত্তার অভাব রাজনৈতিক ও সামাজিক।এ কথাটি আমরা প্রথম শুনি ১৯৮৩ সালে এবিজেডিএফ (অল বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তারস ফেডারেশন)-এর আন্দোলন থেকে। রুগী হাসপাতালে পৌঁছনো মাত্র যদি তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটি পেয়ে যান তখন সেটাই ডাক্তারদের নিরাপত্তার প্রাথমিক গ্যারান্টি হয়ে ওঠে। জুনিয়র ডাক্তাররা নবান্নের বৈঠকের সময় মুখ্যমন্ত্রীকে এরকম অনেক পরিকাঠামোগত অভাবের কথা বলেছেন। যা সরকারি হাসপাতালের ‘নেই রাজ্যের’ এক চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন ছবিকে প্রকট করেছে। শয্যা, অক্সিজেন, ট্রলি, স্ট্রেচার, অ্যাম্বুলেন্স নেই। ইকোকার্ডিও, এন্ডোস্কপি, ল্যাপারোস্কপি মেশিন নেই, ভেন্টিলেটর নেই। তিনি বললেন, ‘‘এসবের আর কি দাম, করে দাও।” বললেন, “২০১১-তে স্বাস্থ্যখাতে যে ব্যয়বরাদ্দ ছিল ৬৯০ কোটি, ২০১৮-তে বাড়িয়ে দিয়েছি। এখন তা ৯৬০০ কোটি টাকা। পরিকাঠামো! কত সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল, সদ্যোজাতদের আইসিইউ, মা ও শিশু হাব করেছি জানো?” তাহলে গ্রাম বা প্রান্তিক জেলাগুলো থেকে কলকাতায় ভীড় করছে কেন মানুষরা? রাজনৈতিক নেতারা পরিস্থিতি আরও ঘোরাল‍ো করছে শুনে স্বাস্থ্যসচিবকে বললেন, ‘‘এই, রাজীব, সারকুলার ধরিয়ে দাও।” মিটিং-এ সুরক্ষার জন্য অনেক রকম পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেমন এমারজেন্সির সামনে কোলাপ্সেবেল গেট হবে, একসঙ্গে দুজনের বেশি ঢুকতে পারবে না, জনসংযোগ আধিকারিক পোস্টিং হবে, তারাই পার্টির সাথে যোগাযোগ করবে, অভিযোগ জানানোর নির্দিষ্ট জায়গা থাকব সবার চোখের সামনে, এমারজেন্সি বোতাম থাকবে, যা টিপলেই সোজা থানায় অ্যালার্ম বেজে উঠবে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জানালেন তার ডাক্তার কম পড়েছে। কিন্তু কেন? এরাজ্য থেকে প্রতি বছর ৩০০০-এর উপর ডাক্তার পাশ করে বেরচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় চাকরিতে আসা ডাক্তারের সংখ্যা কম। এখন এমবিবিএস করার পর এমডি পড়তে গেলে তাকে একটি বন্ড সই করতে হবে। হয় তাকে তিন বছর সরকারি হাসপাতালে কাজ করতে হবে। অথবা ৩০ লক্ষ টাকা সরকারকে দিতে হবে। কথা ছিল এরা কলকাতা ও জেলাস্তরে কাজ করবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ব্লকে ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও পাঠানো হচ্ছে। এই সব ডাক্তারদের মাইনে কত জানা আছে? ৫০ থেকে ৭০ হাজারের মধ্যে। যাদের টাকা আছে তারা ৩০ লক্ষ টাকা ফেরত দিয়ে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে। এছাড়াও বিগত বেশ কিছু বছর ধরে স্থায়ী চাকরির বদলে চুক্তিপ্রথা চালু হয়েছে।

প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা ডাক্তাররা নাকি ঘন্টা মেপে কাজ করবে। এই সরকারই কিছুদিন আগে ডাক্তারদের কাজের ঘন্টাও বেঁধে দিয়েছিল। বাওমেট্রিকে উপস্থিতি মাপা হচ্ছিল। সরকারি ডাক্তারদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে দিয়ে নিষিদ্ধ হয়েছে স্বেচ্ছা অবসর। এই সমগ্র বিষয়টি থেকে কয়েকটি ছবি পরিষ্কার —

প্রথমত, চিকিৎসা ব্যবস্থা বলে বিশেষ কিছু নেই। আর পরিকাঠামো বলে যা আছে তা হল কয়েকটি নীল-সাদা বাড়ি। রুগী ও ডাক্তারদের মধ্যে বিশ্বাসের সেতুবন্ধন নেই। এইসব কিছুর উত্তর হচ্ছে একটি জনস্বাস্থ্য নীতি নির্মাণ। যার জন্য দরকার একটি জন আন্দোলন।

দ্বিতীয়ত, ডাক্তারদের আন্দোলনের একটা ঐতিহ্য আছে। তারা বরাবরই নিজেদের জন্য তেমন কিছু না চেয়ে জনগণের স্বাস্থ্যের দাবি তুলেছেন।

তৃতীয়ত, ডাক্তাররাও চাকুরিজীবী ও মানুষ। ছুটি, ডিউটির নির্দিষ্ট সময়, মাইনে বাড়ানো (কেন্দ্রীয় সরকারের ডাক্তারদের মাইনে অনেক বেশি), পরিকাঠামোহীন জায়গায় বদলি, ইত্যাদি হাজার সমস্যা আছে। ইস্তফা দিয়ে যার সমাধান হবে না। বরং ইস্তফার বদলে দাবি-ইস্তেহার রচনার সময় এসে গেছে।

চতুর্থত, ডাক্তারদের মার খাওয়াটাও এ দেশের ঐতিহ্য। কথায় কথায় পেটানি খাওয়া রুখতে একটি সঙ্ঘবদ্ধ দল নির্মাণ করে তৈরি থাকা আজকের আশু প্রয়োজন। নীলরতন কান্ডে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, “যখন কর্মবিরতি উঠেই গেছে তখন আর তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। গরমের ছুটির পর দেখা যাবে।” এই সংক্রান্ত খবর ডাক্তার ও জনগণকে সময়ে সময়ে জানাতে হবে।

পঞ্চমত, একজন রুগীর যেমন চিকিৎসা পাবার অধিকার আছে তেমন একজন ডাক্তারেরও সুস্থ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন কাজের পরিবেশ পাওয়ার অধিকার আছে।

ষষ্ঠত, ফলোআপটা রাখার দায়িত্ব জনগণেরও। কালকে গিয়ে দেখতে হবে অভিযোগ কেন্দ্রটি কোথায় তৈরি হল, অ্যালার্ম বোতামটা কোথায়, নোডাল অফিসারটাই বা কে। কে দেবে সে খবর? কেন পিআরও। সে কে? লালবাজারে একটি টোল ফ্রি টেলিফোন নম্বর (১৮০০৩৪৫৮২৪৬) চালু হয়ে গেছে। সেটা নিজেদের ফোনে রাখতে হবে।

সপ্তমত, মুখ্যমন্ত্রীকে তার ভাষা ও দেহভঙ্গিমা সংযত করতে হবে। ডাক্তাররা মানুষকে সুস্থ করেন। সমাজ তাদের সম্মান করে। ডাক্তাররা পদবি দেখে চিকিৎসা করে, ন্যাকামি মারছে, নাটক করছে, তার ছেলেরা হাতে চুড়ি পরে নেই—এসব কথার জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা উচিৎ।

জুনিয়ার ডাক্তাররা বলছেন, “হাসপাতালের অচলাবস্থা আমরাও আর মানতে পারছি না। আমরা যাতে নিরাপদে কাজ করতে পারি সেটা প্লিজ ব্যবস্থা করুন। আর আমাদের ছোটো ভাইটিকে একবার দেখে আসুন।” মন্ত্রী বললেন,”আগে তোমরা কর, তাহলেই আমি যাব।” এত কিছুর পরেও শর্ত!

খণ্ড-26