অবশেষে জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের মীমাংসা হল। অনেকদিনের জমা ক্ষোভ হঠাৎ করেই বিস্ফোরণের জন্ম দিল। ১০ জুন নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন বৃদ্ধ মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রুগীর বাড়ির লোক ও জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হয়, যাতে দুজন জুনিয়ার ডাক্তার আহত হন। ডাক্তার পরিবহ মুখোপাধ্যায়ের উপরে ভয়াবহ আক্রমণ হয় ও তার মাথার খুলিতে আঘাত লাগে যার থেকে ফ্রন্টললোবে আঘাত লাগে। তারপর আন্দোলন। বহু টানাপোড়েনের পর আলোচনা এবং এখনকার মতো মীমাংসা। এই আন্দোলনে কয়েকটি নতুন দিক উঠে এল, যেমন অন্ ক্যামেরা আলোচনাসভা এবং নিরাপত্তার দাবির বাইরে পরিকাঠামো নিয়ে আলোচনা। সিটিস্ক্যানের দাবি থেকে চিকিৎসক ও সেবিকা বাড়ানোর কথাও উঠে এসেছে। শেষে একজন ইন্টার্ন বললেন “উইথ ডিউ রেসপেক্ট ম্যাডাম, আমরা কিন্তু সারনেম দেখে চিকিৎসা করি না।” ক্রমশ কুঁজো হতে হতে অবার শিড়দাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানো। প্রশাসক ও দুঁদে আমলাদের চোখে চোখ রেখে এই আলোচনা আমাদেরকে নতুন করে জাগিয়ে দিয়ে যায়।
চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছিল। কখনও রাজনৈতিক মদতপুষ্ট লোকজন, কখনও লুম্পেন বাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা সবাই। বারংবার অবেদন, নিবেদন, ডেপুটেশন হয়েছে। গত দুবছরে ১৩৫টি আক্রমণ সংগঠিত হয়েছে। কখনও কখনও পুলিশকর্মীও আক্রমণকারীর ভূমিকায়। তার কোনোটারই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিবিধান হয়নি। ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম গত বছর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করে। তাতে প্রতিটি ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হয়। তারপরও অবস্থার কোনোরকম উন্নতি দেখা যায়নি।
আমরা অনেকেই চিকিৎসাক্রমী নিগ্রহকে পরিকাঠামোজনিত দুর্বলতার পরিণতি হিসাবে ভাবি। আর একটি ভাবনা হল এই আন্দোলন কেন ১৯৮৩-৮৪ সালের মতো জনস্বাস্থ্যের দাবিগুলিকে সামনে নিয়ে এল না। এই দুটি ভাবনাই অংশত সঠিক। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত প্রশ্ন একটু অন্যরকম। শুধুমাত্র পরিকাঠামোগত দুর্বলতার কথা বলে এটার উত্তর দেওয়া যাবে না। প্রচুর সামাজিক কুসংস্কার, লোভ, লুম্পেন মানসিকতা এই আক্রমণের পেছনে কাজ করে। এটা বৃহত্তর সামাজিক ব্যাধি। যার থেকে গণপিটুনীর মতো মধ্যযুগীয় ঘটনাগুলি ঘটে। রাজনৈতিক মদতপুষ্ট লুম্পেনরা কখনো কখনো তাদের নোংরা স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই ঘটনাগুলি তৈরি করে। এবার আসি পরিকাঠামোজনিত সমস্যায়।
আমাদের দেশে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ জিডিপি-র ১.২ শতাংশ। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশে ৮-১০ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়। ডাঃ শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশন বহুদিন আগেই প্ল্যানিং কমিশনের সমানে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়-বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাবনা রেখেছিলেন। তা গৃহীত হয়নি। আবার প্ল্যানিং কমিশন বাতিল করে নীতি আয়োগ তৈরি করা হয়েছে। নীতি আয়োগ চিকিৎসকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপরও হস্তক্ষেপ করেছে। মেডিকেল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া সহ অন্যান্য কাউন্সিলগুলিকে বাতিল করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়েনি। এই সময়ে পৃথিবীর বহু দেশ সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া সুনিশ্চিত করেছে। এই ব্যবস্থাপনাকে বলা হয় ইউনিভার্সাল হেল্থ কেয়ার। আমাদের দেশে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ যদি জিডিপি-র ৩ শতাংশের আশেপাশে হয় তাহলে এটা সম্ভব। আমাদের দেশে রুগীর সংখ্যা অনুযায়ী চিকিৎসক, সেবিকা ও বেডের সংখ্যা অনেক কম। যক্ষা রুগীর সংখ্যা, রক্তাল্পতা, অপুষ্টি শিশু ও মায়ের সংখ্যায় আমরা পৃথিবীর মধ্যে একদম প্ৰথমের দিকে। যাক এবারে রাজ্যের কথায় আসা যাক। এরাজ্যে বেশকিছু সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল ও কয়েকটি মেডিকেল কলেজ তৈরি হয়েছে। কিছু যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসক বা সেবিকার অভাবে সেগুলি পরিপূর্ণভাবে সচল হতে পারেনি। জুনিয়র ডাক্তারদের সাথে মুখ্যমন্ত্রীর মিটিং-এ এই কথাগুলি আলোচিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের প্রতিনিধি বললেন, ওখানে সিটিস্ক্যানের ব্যবস্থা নেই। অন্যান্য প্রতিনিধিরা বললেন রুগীরা কখনো একটি বেডে দুজন করে থাকছেন অথবা মেঝেতে থাকছেন। আউটডোরে ডাক্তারকে দেখিয়ে প্রয়োজনীয় টেস্টগুলি করতে সাধারণ মানুষকে অনেক হয়রানি হতে হচ্ছে। চিকিৎসা ঠিক শুরু হতে অনেক মূল্যবান সময় চলে যাচ্ছে। এই ধরনের বহুবিধ সমস্যা আছে হাসপাতালগুলিতে। এর সমাধান তো অবশ্যই জরুরি।
চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও রুগীদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক এই মিটিং-এ আলোচিত হয়েছে। এটা নিয়ে কী করা যায়, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। তাই যারা বলছেন, শুধুমাত্র নিরাপত্তাজনিত কথাবার্তা আলোচিত হয়েছে, তারা কিন্তু ঠিক বলছেন না।
১৯৮৩-৮৪ এবিজেডিএফ-এর আন্দোলন সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা উচিত। সমাজবদলের এক ঐতিহাসিক লড়াইয়ের ১২-১৩ বছর বাদে এবিজেডিএফ আন্দোলনের জন্ম। তাই তার দাবিসনদে সাধারণ মানুষের দাবি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। “হেল্থ ফর অল” এই ঘোষণাটি সদ্যসদ্য হয়েছিল। ‘আলমা-আটা’ ঘোষণার কথা বলতে চাওয়া হচ্ছে। তার মূল শ্লোগান ছিল, “সবার জন্য স্বাস্থ্য চাই”। এবার আসা যাক এই সময়ের আন্দোলনের কথায়। এই আন্দোলনও বেশকিছু বিষয়ে অনন্য। নীলরতন মেডিকেল কলেডে অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটবার পরের দিনই বিজেপি ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়েছিল। আর মাঝখানে মুখ্যমন্ত্রী তার বিতর্কিত মন্তব্যটি করেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সেই স্রোতে ভেসে যাননি। তাঁরা কোনো জাতপাত বা ধর্মকে প্রাধান্য দেননি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং-এর শেষ পর্যায়ে ঐ ইন্টার্নের কথাটি আন্দোলনের মূল সুর হয়ে বেজেছে। আর অন ক্যামেরা মিটিং-এর দাবি আদায় বোধহয় ভারতবর্ষের বুকে প্রথম ঘটনা। এই জয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের।
কাজের জায়গায় নিরাপত্তার প্রশ্নটি কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি সমাধান হওয়া উচিত। ইউনিভার্সাল হেল্থকেয়ার আজেকর সময়ের দাবি। এর সাথে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়তি হওয়া উচিত। সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় সরকারকেই সবার জন্য উন্নত আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
পরিশেষে বলি, অন্যায় রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে ডাক্তার কাফিল খানের লড়াই যেমন আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, ঠিক তেমনই ঐ তরুণ ইন্টার্ন চিকিৎসক যেভাবে শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে সত্য অথচ অপ্রিয় কথাটি বলতে ভয় পাননি, ওরাই আমাদের আগামীদিনের আশা।