এই শীতের পাতাঝরার মরসুম বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি জগৎকে অনেকটা রিক্ত করে দিল। অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে চলে গেলেন পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, পিনাকী ঠাকুর, দিব্যেন্দু পালিত, সব্যসাচী ভট্টাচার্য, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দিকপাল শিল্পী সাহিত্যিক মনন চর্চার মানুষেরা, যারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলার কৃষ্টি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পঞ্চাশের দশকের বিশিষ্ট কথাকার। মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দী, দিব্যেন্দু পালিত, শীর্ষেন্দুমুখোপাধ্যায়, দেবেশ রায় প্রমুখদের মতো স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে যাঁরা লেখালেখি শুরু করে বাংলা আখ্যানের জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাদেরই একজন ছিলেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সমসাময়িক অন্যান্য কথাকারদের থেকে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালেখির একটা বিশিষ্টতা আছে। সুনীল, শীর্ষেন্দু, সন্দীপনরা যেখানে মূলত নাগরিক জীবনের ভাষ্যকার, সেখানে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে বাংলার গ্রাম জীবনও অনেক বেশি করে ধরা দিয়েছে। অনেক সমালোচক তার মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকার খুঁজে পান।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাসগুলির জন্য, যার মধ্যে আছে মানুষের ঘরবাড়ি বা নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে, স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এটা ঠিকই। তবে ছোট গল্পের পরিসরেও তাঁর বিচরণ ছিল অনায়াস। খুব বেশি করেই চোখে পড়ে তাঁর ছোটগল্পগুলির নামকরণের বিশিষ্টতা, যা প্রচলিত ধরন থেকে অনেকটা আলাদা। কয়েকটি নাম উল্লেখ করলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে—কালের যাত্রা রূপক মাত্র, আউড়ি বাউড়ি, ট্রেন বেলাইন হলে, স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে না, কঠিন হ য ব র ল, দেরির এখন বয়েস হয়েছে, গীর্জার সিঁড়িতে সারারাত, হেঁসোতে ধার ঠিক আছে, প্রবঞ্জক প্রসাধন, পোকামাকড়েও খায়, বাঁচে ইত্যাদি। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পগুলির সাথে উপন্যাসের আত্মীয়তা মাঝে মাঝে দেখা যায়। তারাশঙ্করও যেমন নিজের গল্প থেকে উপন্যাস তৈরি করতেন, তেমনি অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়কেও দেখি চীনে মাটির পুতুল গল্পের বীজ থেকে অতি বিখ্যাত নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসের মহাকাব্যিক বিস্তারে পৌঁছে যেতে।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পগুলিতে পরিবারের পরম্পরা প্রায়শই হাজির হয়। পিতার আশাআকাঙ্ক্ষা কীভাবে বংশানুক্রমে চারিয়ে যাচ্ছে তাই নিয়ে মানুষের ভূমিকা, শেষ দেখা, আরোগ্য, ইহলোকের মতো গল্প বিশ্লেষণ করলেই সেটা আমরা বুঝতে পারি। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের আরেকটি দিক ভ্রমণ। সুদূরের দুঃখ বা নদী নারী নির্জনতার মতো গল্প এর সাক্ষ্য দেয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিচিত্র ধরনের জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন জীবনের বিভিন্ন পর্বে, তার মধ্যে ছিল নাবিকের চাকরীও। সেই জীবন অভিজ্ঞতা এই ধরনের গল্পের নির্মাণে সাহায্য করেছে। বস্তুতপক্ষে একজন মানুষ কখনো নাবিক, কখনো বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কখনো ট্রাকক্লিনার, কখনো কারখানার পরিচালক, কখনো প্রকাশন সংস্থার উপদেষ্টা – এত রকমের বিচিত্র জীবিকা নির্বাহ করছেন এটা খুব একটা দেখা যায় না। জীবিকার নানাত্ব থেকে জীবনকে নানাভাবে দেখতে শেখার অভিজ্ঞতা অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প উপন্যাসে এত বৈচিত্র সঞ্চার করেছে।
‘মানুষের ঘরবাড়ি’ শুধু অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়েরই নয়, বাংলা সাহিত্যেরই অন্যতম দীর্ঘ বহুপার্বিক উপন্যাস যেখানে অজস্র চরিত্ররা বিভিন্ন পরিবেশে ভীড় করে আসে। উপন্যাসটি পাঁচটি পর্বে বিন্যস্ত। প্রথম পর্বে বহরমপুর কাশিমবাজারের প্রেক্ষাপটে একটি পরিবারের আশ্রয় গড়ে তোলার প্রচেষ্টার কথা রয়েছে। বিলু, যার চোখে এই উপন্যাসের নির্মাণ, এখানে লড়াই করে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বেবিলুকে পাশ করার পরেই দ্রুত পরিবার সামলাতে রোজগারের কাজে নেমে পড়তে হয়। সে লেগে যায় মোটর গ্যারেজের কাজে। কিন্তু এই কাজ তার ভালো লাগে না। সে পালিয়ে আসে কোলকাতায়। আশ্রয় পায় ড্রাইভার রহমানের কাছে। তৃতীয় পর্বেবিলুর আশ্রয় জোটে কালীবাড়ির সেবাইতের কাছে, সেখানে সে গৃহশিক্ষকতায় নিযুক্ত হয়। বালবিধবা ও এই পরিবারের আশ্রিতা লক্ষীর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কও গড়ে ওঠে তার। চতুর্থ পর্বে লক্ষীর সান্নিধ্য, তার সাথে ছুটির সময়ে জঙ্গল বাড়িতে যাওয়ার কথা আছে। এই সময়েই বিলু কলেজে পড়ার সুযোগ পায়। পঞ্চম পর্বেবিলুর জীবনে নতুন নারী আসে। তার কলেজ জীবনের বান্ধবী রায়বাহাদুরের নাতনী মিমি। মিমির সঙ্গে বিলুর ঘনিষ্টতা লক্ষী সহ্য করতে পারে না। সে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। বিলু নিজের বাড়িতে ফিরে যায়। বাবা তাকে জানান কাজই হল পরমায়ু। কাজের মধ্যে থাকতে থাকতেই স্বাভাবিক জীবনে ক্রমশ ফিরতে থাকে সে।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বিখ্যাত লেখা দুই পর্বেবিন্যস্ত নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসটি। এটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ক্লাসিক বলে বিবেচিত হয়। উপন্যাসের প্রথম পর্বে পূর্ববাংলার পটভূমিতে দেশভাগ পূর্ববর্তী সময়ের কথা রয়েছে। হিন্দুমুসলিম যৌথ জীবন অসংখ্য চরিত্রদের সূত্র ধরে এখানে উপস্থাপিত। ধনকর্তার সন্তানের জন্মের খবর দিতে যায় ঈশম, আবেদালি উৎকন্ঠিত হয় উন্মাদ বড়কর্তার জন্য, মালতীর জন্য জোটন বিবি। তবু বিভেদের করাল ছায়া আসে দাঙ্গার সূত্রে, ঢাকার রায়টে মালতী তার স্বামীকে হারায়। সামসুদ্দীন বলে, “একবার চোখ তুইল্যা দেখ, চাকরি তগ, জমি তগ, জমিদারী তগ। শিক্ষা দীক্ষা সব হিন্দুদের”। মালতী তিনটি পুরুষের দ্বারা ধর্ষিতা হয়, তার গর্ভসঞ্চারও ঘটে। একদিন যে রঞ্জিতের সাথে ঘর ছাড়ার আহ্বান সে গ্রহণ করতে পারে নি, তার হাত ধরেই সে যাত্রা করে, খুঁজে ফেরে নীলকন্ঠ পাখি। উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বেভেঙে যাওয়া জীবনের ছড়ানো ছিটানো চেহারাকে তুলে আনেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। এটি দাঙ্গা দেশভাগ পরবর্তী সময়ের পর্ব। প্রথম পর্বের শুরুতে যাদের গ্রামীণ যৌথ জীবনের কথা পেয়েছিলাম, এই পর্বের শেষে তাদের মর্মান্তিক ছবি। ঈশম তরমুজের খেতে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। তার কবরে সোনা নিজের হাতে মাটি দেবে এ তার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন পূরণের উপায় নেই। কারণ সোনা তখন অনেক দূরে কলকাতার কিং জর্জেস ডকে জাহাজের ট্রেনি। মালতী বা ফতিমা কেউই শান্তি পায় নি। এক কামুক পুরুষের কন্ঠনালি ছিঁড়ে নিয়েও মালতীর রক্তাক্ত শরীর শান্তি পায় নি। ফতিমাও হারিয়ে ফেলেছে সফিকুরের নরম ভালোবাসা, ঘর গড়ার স্বপ্ন। জীবনের মহাকাব্যকে যেভাবে এই নীলকন্ঠ পাখির খোঁজেতে লিখতে শুরু করেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, তাকেই আরো এগিয়ে নিয়ে যান অলৌকিক জলযান, ঈশ্বরের বাগান প্রভৃতিতে। তার হাতে বাংলা উপন্যাসের এপিক চেহারাটি সেই সময়ে ব্যতিক্রমী ভাবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে যখন উপন্যাসের বিস্তার কমতে কমতে নভেলেটের প্রাচুর্য দেখা দিয়েছে চারদিকে।