মিড ডে মিল রন্ধন কর্মীরা, যাদের এক ধরনের ‘‘আধুনিক দাসত্ব”র মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে,তারা আজ নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে সরকার ও প্রশাসনের মুখোমুখি। নদীয়ার কৃষ্ণনগরে প্রায় দুই হাজার রন্ধনকর্মী মহিলা জেলা শাসকের দপ্তরে সমাবেশিত হয়ে দাবী তুলেছেন, ‘‘আমরা রন্ধন কর্মীরা সরকারী কর্মচারীর স্বীকৃতি চাই, ১৮ হাজার টাকা মজুরী চাই”। গত ২৭ ডিসেম্বর জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত রন্ধনকর্মীরা কৃষ্ণনগর রেল স্টেশন থেকে মিছিল করে জেলাশাসকের দপ্তরে যান, গোটা প্রশাসনিক চত্বর শ্রমজীবী মহিলাদের শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে, সমাবেশের জেরে পার্শ্ববর্তী ব্যস্ত রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় বিক্ষোভ সভা, সভাপতিত্ব করেন এ আই সি সি টি ইউ জেলা সম্পাদক, শ্রমিক নেতা অমল তরফদার। বক্তব্য রাখেন,নদীয়া জেলা মিড-ডে মিল রন্ধনকর্মী ইউনিয়ন নেতা কৃষ্ণগোপাল দাস। এই ইউনিয়নটি জেলার অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত একটি স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন,সম্প্রতি এ আই সি সি টি ইউ-র অন্তর্ভূক্ত হয়ে ‘‘এ্যাফিলিয়েশন” নিয়েছে, নাকাশীপাড়ায় এদের মূল কার্যালয়। এই ইউনিয়নের ডাকেই অধিকাংশ রন্ধনকর্মী সমাবেশিত হয়েছিলেন, জেলার প্রায় সাত-আটটি ব্লক থেকে।এছাড়া অন্য দুই একটি ব্লক থেকে পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী মিড-ডে মিল রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের প্রায় একশত কর্মী অংশ নেন। বক্তব্য রাখেন ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদিকা জয়শ্রী দাশ। রন্ধনকর্মীদের এই দুই সংগঠনের যৌথ উদ্যোগেই বিক্ষোভ-ডেপুটেশন কর্মসূচী সংগঠিত হয়।এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন সংগ্রামী রন্ধনকর্মী বিভিন্ন মহিলা সংগঠকরা। বক্তারা বলেন, শিশু শিক্ষার অধিকার, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড—এ জাতীয় অনেক কথাই আজ সরকারের মুখে শোনা যায়। ‘‘মিড-ডে মিল” প্রকল্পর সাফল্য নিয়েও বিরাট মাত্রায় প্রচার চলে। ‘‘স্কুল ছুট” কমিয়ে আনার জন্য একে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।কিন্তু যারা ‘‘জাতির ভবিষৎ” শিশুদের মুখে অন্ন তুলে দেয়, তাদের মোটেই দুবেলা অন্ন জোটেনা।এদের বেতন যৎসামান্য। এক জন রাঁধুনির মজুরী (সরকারী পরিভাষায় সান্মানিক!) মাসে ১৫০০ টাকা।স্কুলে রান্নার দায়িত্বে থাকে একটি “স্বনির্ভর গোষ্ঠী” অর্থাৎ ১০/১২ জন মহিলা। ৫০ ছাত্র/ছাত্রী পিছু এক জন রাঁধুনি। অর্থাৎ এক জন রন্ধন কর্মী পায় গড়ে মাসিক ৩০০/৪০০ টাকা। অর্থাৎ দিনে ১০/১২ টাকা মজুরী! তাও ১২ মাস কাজ করে পায় ১০ মাসের টাকা! বহু স্কুলে একাধিক গোষ্ঠী থাকলে কাজ ও মজুরী আরও কমে যায়! একে দাসত্ব ছাড়া আর কি বলা যায়! অপর দিকে কেন্দ্রীয় সরকার মিড-ডে মিলে বরাদ্দ অর্থের ভাগ তথা দায় কমিয়ে দিচ্ছে, ৪০ ভাগ থেকে, ৩০ ভাগ করে দিয়েছে। তৃণমূল সরকার হাত গুটিয়ে রেখেছে।রাজ্যের ক্লাবগুলিকে যত টাকা দেওয়া হয়েছে, সেই টাকায় মিড-ডে মিলে শিশুদের একদিন ডিম খাওয়ানো যেতো। অর্থাৎ সরকারের অগ্রাধিকার শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি, মূল্যবৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে যা নির্ধারিত হয়। জাতীয় শ্রম সম্মেলনের সুপারিশকে মান্যতা দিয়ে রন্ধনকর্মীসহ সমস্ত প্রকল্পকর্মীদের ন্যায্য মজুরী ও সামাজিক মর্যাদার দাবী সরকারকে মেনে নিতেই হবে বলে তিনি দাবী জানান।
এর পর অতিরিক্ত জেলা শাসকের কাছে ডেপুটেশনে গিয়ে প্রতিনিধিদল ক্ষোভের সাথে জানান, রন্ধনকর্মীরা মজুরীর নামে যা পায়,তাতে তেল সাবানের পয়সা জোটে না, তো পেটের ভাত জুটবে কি ভাবে? অথচ এরাও তো একজন গ্রুপ ডি শিক্ষাকর্মীর সমগোত্রীয় কাজ করে থাকে। কিন্তু এদের স্বীকৃতি নেই,মর্যাদা নেই, কোন সামাজিক সুরক্ষা নেই। এমন কি একটা পরিচয় পত্রও নেই। প্রচুর পরিমাণে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি গড়ে তোলা হয়েছিলো মহিলাদের আর্থিক- সামাজিক ভাবে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য। বাস্তবে এ কাজে সরকার চরম ব্যর্থ। তাই গোষ্ঠীগুলিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে স্কুলে রান্নার কাজে। এভাবে যেন তেন প্রকারেণ একটা ‘‘কাজ পাইয়ে দেওয়া”র ফয়দা তুলছে শাসক দলের নেতারা। কাজ কম-লোক বেশী, তাই লাগছে নিজেদের মধ্যে অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ। রন্ধনকর্মীদের দলবাজী করে রান্নার কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া বা একই জায়গায় নতুন করে আরও মহিলাদের ঢুকিয়ে কাজ কমিয়ে দেওয়া যাতে না হয় সে বিষয়ে প্রশাসনিক নির্দেশ জারী করার দাবী জানানো হয়। অতিরিক্ত জেলা শাসক এতে মৌখিক সন্মতি দেন। মাসের বেতন মাসে না দিয়ে নদীয়া জেলায় যে অনিয়ম চলছে,সেটা বন্ধ হবে বলে প্রশাসন গ্যারান্টি দেয় এবং জানায় যে, এনজিও-দের হাতে এই প্রকল্প তুলে দেওয়া হবে না।প্রতিনিধিদলে ছিলেন, রন্ধনকর্মী ইউনিয়নগুলির নেত্রী চায়না সেখ, অসীমা মন্ডল। এ ছাড়াও ছিলেন, এ আই সি সি টি ইউ নেতা বিজয় সাহা, সহযোগী সংগঠন কিষাণ মহাসভার সম্পাদক জয়তু দেশমুখ। বিক্ষোভ ডেপুটেশন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে যে বার্তা তুলে ধরা হয় তা হলো সারা দেশেই আজ প্রকল্পকর্মীরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। জাতীয় শ্রম সম্মেলনের সুপারিশকে মান্যতা দিয়ে এদের স্থায়ী কর্মচারীর স্বীকৃতির দাবীতে, সম্মানজনক মজুরী, বোনাস, পেনশন, মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটি প্রভৃতি দাবীতে সারা দেশের পাশাপাশি এরাজ্যেও গড়ে উঠছে আন্দোলন-সংগঠন। মিছিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচী থেকে ৮-৯ জানুয়ারী সাধারণ ধর্মঘটে সামিল হয়ে তাকে সফল করে তোলার আহ্বান জানানো হয়।