চলে গেলেন মৃণাল সেন

মৃণাল সেন চলে গেলেন ৯৫ বছর বয়সে। তিনি তো মৃণাল সেন, তার মতো করেই গেলেন—শরীর দান করে গেলেন, আর মরদেহ নিয়ে কোন আড়ম্বর যাতে না হয় সেই ইচ্ছে স্পষ্ট করে জানিয়ে গেলেন মৃত্যুর আগে। ফলের রাজপথে তাঁর প্রিয় জনতার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে বিদায় নিলেন মৃণাল সেন।

সারা জীবন অনেকগুলি ফিল্ম করেছেন, পুরস্কার পেয়েছেন, বহু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক সম্মান তাঁর কাছে এসেছে অনায়াসে। কিন্তু এসব কিছুর পরেও তাঁকে আমরা খুঁজে পাই জনতার কল্লোলে, কারখানার গেট মিটিংয়ে আর লাল পতাকার মিছিলে। জীবনে কোনদিনই বিচ্ছিন্ন হননি মানুষের কাছ থেকে। গজদন্ত মিনারের শিল্পী তিনি ছিলেন না। যারাই তার সঙ্গে মিশেছে প্রত্যেকের কাছেই শুনেছি তার সরল জীবন যাপনের কথা; শুনেছি স্পষ্টভাষী এই মানুষটি চিরকাল নিজেকে কমিউনিস্ট পরিচয় দিয়ে গেছেন। আজীবন বামপন্থী মৃণাল সেনের জীবন তার কাজের মতই আমাদের কাছে আদর্শ হয়ে থেকে গেল।

সেই কবেতিনি শুরু করেছিলেন পথ চলা। গণনাট্য সংঘ, ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টি মিছিল-মিটিং অবশেষে থিতু হয়েছিলেন চলচ্চিত্রে। ‘‘নীল আকাশের নিচে’’ থেকে ‘‘আমার ভুবন’’ কত ছবি তিনি উপহার দিয়েছেন আমাদের। আজও ‘‘ভুবন সোম’’ বা ‘‘কলকাতা ৭১’’ দেখলে শিরদাঁড়া টানটান হয়ে ওঠে, দেখতে পাই কি আশ্চর্য উৎসাহ নিয়ে মৃণাল সেন শ্রেণী সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত নাগরিক, বিপ্লব, বুভুক্ষা, খিদের দিনলিপি তাঁর ছবির শরীরে ধারণ করছেন। যে অঙ্কন দৃশ্যকলায় শুরু করেছিলেন জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ ও সোমনাথ হোর সেই অন্যরকম সব শরীর, কালো পেন্সিলে আঁকা লড়াকু কৃষকের ছবি, রাগী যুবকের বিদ্রোহ যেন মৃণাল সেনের চলমান চিত্রমালায় প্রাণ পাচ্ছে।

তাঁর ছবি দেখতে দেখতে আমরা একটা অন্য কলকাতাকে দেখতে পাই। যে শহরের প্রাণস্পন্দন মিছিলে, যে শহর বেঁচে আছে আমাদের মধ্যবিত্ত হতাশায়, যে শহর অপমানকে রাগে আর খিদেকে বিদ্রোহে রূপান্তরিত করতে পারে, সেই রাজপথের শহরের দিনলিপি লিখেছিলেন মৃণাল সেন। কলকাতা ৭১-এর দেবরাজ রায়। কী আশ্চর্য দক্ষতায় মৃণাল সেন তাকে এঁকেছেন তাঁর ছবিতে। কখনো মনে হয় তথ্যচিত্র, কখনো মনে হয় আত্মকথা, কখনো মনে হয় ইতিহাসের পাঠ। তাঁর ছবির ছকভাঙা আঙ্গিক সব ক্ষেত্রে যে সফল হয়েছে তেমনটা বলা যাবে না, তবে মৃণাল সেনের ছবি দেখার সবচেয়ে বড় আনন্দ তিনি নিরন্তর পরীক্ষা- নিরীক্ষা কলে চলেন ছবিতে। থাকে আত্মসমীক্ষা, থাকে সমাজকে ব্যবচ্ছেদ করে তাকে নতুন করে বোঝার চেষ্টা। ফলে তাঁকে কখনোই আমরা সত্যজিৎ রায় বা ঋত্বিক ঘটকের মতো নির্দিষ্ট বিষয়, নির্দিষ্ট বক্তব্য নিয়ে সারা জীবন ছবি করতে দেখি নি। বিষয় আর আঙ্গিকে বারবার পরিবর্তন এনেছেন তিনি। তার কারণ তিনি নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে থেকেছেন। সমাজকে বোঝা বিশ্লেষণের জন্য যে বিষয় বা যে আঙ্গিক উপযুক্ত সেটাকেই তিনি তখন ব্যবহার করেছেন।

‘‘নীল আকাশের নিচে’’ এবং ‘‘আকাশ কুসুম’’ এই দুটি ছবিতে তাকে দেখা যায় বাংলা ছবির যে মূলধারা তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে চমৎকার ভাবে দুটি গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। গল্প তিনি কত ভালোভাবে বলতে পারেন তা ‘‘আকাশ কুসুম’’ দেখলে বোঝা যায়। আবার ‘‘বাইশে শ্রাবণ’’-এর মত ছবি যখন করছেন, যে ছবি দুর্ভিক্ষের কথা বলে, যে ছবি বাংলার কৃষক নিম্নবিত্ত মানুষের দুর্দশার কথা বলে, সে ছবিতে তাকে দেখি গল্প বলার সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন একটু তথ্যচিত্রের ঢং। যখন তিনি ভুবন সোম করছেন তখন তা কেবল রাশভারী আমলা ভুবন সোমকে নিয়ে রসিকতা নয়, সে ছবি আসলে শিক্ষিত ও ভালো চাকুরে স্বচ্ছল মধ্যবিত্তের মনস্তত্ত্বের ব্যবচ্ছেদ হয়ে উঠছে। সেখানে তাঁর ছবির আঙ্গিক কিছুটা বদলে যাচ্ছে, অনেকটা আড্ডা দেওয়ার ঢঙে ভুবন সোমকে দেখাচ্ছেন তিনি। কখনও বর্ণনা, কখনো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, কখনো কেবল আমলা মশাইকে নিরীক্ষণ, এইভাবে ছবিটা চলতে থাকছে। কখনো কখনো ছবির গল্পটা থামিয়ে ইতিহাস আর রাজনীতির অনেকগুলো ছবি ঢুকিয়ে দিচ্ছেন ফিল্মের মধ্যে।

আবার যখন ‘‘ইন্টারভিয়্যু’’ করছেন তখন ছবিতে আমরা দেখছি একটা টান টান উত্তেজনা, গল্প বলায় ব্রেশটীয় ভাঙচুর, অপ্রথাগত সম্পাদনার ব্যবহার আর রাগের হঠাৎ বহিঃপ্রকাশ। আসলে এটাই ছিল সে দশকের বৈশিষ্ট্য। যে বৈশিষ্ট্য তিনি তার শহরের বাস্তবতার মধ্যে দেখছেন সেই বৈশিষ্ট্যকেই ছবির আঙ্গিকে অনুবাদ করার চেষ্টা করছেন। বিষয়বস্তুতে তো বটেই মৃণাল সেন অনন্য, কারণ বাস্তবতা কেবল তাঁর ছবির বিষয় নির্ধারণ করে দেয় তাই নয়, বাস্তবতা তাঁর ছবির আঙ্গিককেও ঠিক করে দেয়। আরেকটি ছবির কথা অন্তত না বললে মৃণাল সেন সম্পর্কে বলাটা অপূর্ণ থেকে যায় সে ছবি হল ‘‘আকালের সন্ধানে’’। আকাল তাঁর ছবিতে বেশ কয়েকবার এসেছে। আকালের সন্ধানে দেখলে যেমন মনে হয় একটা সমাজকে তিনি দেখছেন যে সমাজে ধনীর ক্রুরতা, নৈতিক অবক্ষয়, দুর্নীতি, এসবের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে প্রান্তিক কৃষকের ক্ষুধা আর চাপা বিদ্রোহ; আকালের সন্ধানে ছবির অদ্ভুত সব রাতের দৃশ্যগুলো মনে পড়ে।

কোনদিনই মৃণাল সেন নিজেকে কেবল একজন ‘বাঙালি’ চলচ্চিত্র পরিচালক মনে করতেন না, তাঁর মধ্যে একটা আন্তর্জাতিকতার বোধ ছিল আর সে আন্তর্জাতিকতার বোধ তৈরি হয়েছিল শ্রেণী সংগ্রামের আন্তর্জাতিকতা থেকেই ফলে যখন ছবি করেছেন তখন কেবল বাংলাদেশের মাটি-প্রকৃতি-মানুষ আর শহরে আটকে থাকেননি। হিন্দিতে ছবি করেছেন, ওড়িয়া ভাষায় ছবি করেছেন, ছবি করেছেন তেলেগু ভাষায়—ভাষা আর জাতিগত পরিচয়ের গণ্ডি তাঁকে কখনো আটকে রাখে নি, কারণ তিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদে বিশ্বাসী মানুষ, যার কাছে শ্রেণিচেতনা ছিল সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়।

মৃণাল সেন আজ সশরীরে নেই। কিন্তু তাঁর মৃত্যুঞ্জয়ী ছবিগুলি আমাদের আরো অনেককাল অনুপ্রেরণা দেবে। কৃষক-শ্রমিকের হাতে মিছিলের লাল পতাকার মতো মৃণাল সেন আমাদের সঙ্গে পথ হাঁটবেন আরো অনেককাল। - মানস ঘোষ

“পদাতিক”-এর অন্তিম যাত্রায় জনতার “কোরাস”-এ পা মেলালেন কবি শঙ্খ ঘোয, অঞ্জন দত্ত, মমতা শঙ্কর, অপর্না সেন, শ্রীলা মজুমদার, মাধবী মুখার্জী, সন্দীপ রায়, নন্দিতা দাস, কৌশিক সেন, বিমান বসু, রজত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখদের সাথে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের অমিত দাশগুপ্ত, নীতীশ রায় সহ শত শত অনুরাগী।

খণ্ড-26
সংখ্যা-1