আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ, হুগলি জেলা কমিটির ডাকে ২ জানুয়ারী চুঁচুড়া ঘড়ি মোড়ে বিক্ষোভ অবস্থান সংগঠিত হয়। দুপুর একটা নাগাদ বেশ কয়েকশ আদিবাসী নারী ও পুরুষ জমায়েত হন। তাঁরা অনেকেই সাঁওতাল সমাজের প্রথাগত পোশাক, ধামসা, মাদল ও তীর ধনুক টাঙ্গিতে সুসজ্জিত ছিলেন। সভা চলে সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। মাঝে চুঁচুড়া সাব ডিভিশনাল অফিসারের কাছে ও তথ্য সংস্কৃতি অফিসে স্মারকলিপি দিয়ে বিক্ষোভের কারণ ও দাবিসনদ পেশ করা হয়।
বিক্ষোভ অবস্থানের মূল পরিচালক ছিলেন মঞ্চের হুগলী জেলা সম্পাদক পাগান মুর্মু ও মঞ্চের নেতা সজল অধিকারী। এই দুজন ছাড়াও সভাকে সম্বোধিত করে আদিবাসীদের প্রতি সরকার ও প্রশাসনের বঞ্চনা ও অবহেলার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন হুগলী জেলার পোলবা ব্লকের নেত্রী সংগঠক সুমিতা মুর্মু, মালতী সরেন, ধনেখালি ব্লকের মহাদেব মুর্মু, পান্ডুয়ার রাম হাঁসদা, বলাগড়ের ভুট্টো সরেন এবং উত্তর ২৪ পরগনার রামু সরেন। বর্ধমান জেলা থেকে আসা নেত্রী ফুলমনি মান্ডি ও নদীয়ার চাকদহ থেকে আসা বিনোদ হাঁসদা। এছাড়া ভাষণ দেন সি পি আই
(এম এল) নেতা কার্তিক পাল। তাঁরা আদিবাসীদের প্রতি সরকারগুলির বঞ্চনা আর গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য আদিবাসী সমাজের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। মাতৃভাষা ও শিক্ষা সংক্রান্ত প্রশ্ন, মুন্ডারি, সাদ্রি, হো প্রভৃতি ভাষার স্বীকৃতি, আদিবাসী এলাকায় সরকারি কাজে আদিবাসীদের মধ্যে থেকে নিয়োগ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলের প্রসঙ্গ, অরণ্যের অধিকার আইন, আদিবাসীদের ওপর চাপানো মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা ইত্যাদি প্রসঙ্গ উঠে আসে তাঁদের বক্তব্যে।
দশ মিনিট অনেকগুলি ধামসা ও মাদল বাজিয়ে, প্রথাগত সাঁওতালী নাচ ও গানের সাথে সকলে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতীকি বিক্ষোভ চলে। তারপর পাগান মুর্মু ও নিরঞ্জন বাগের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল যায় ডেপুটেশনে। এই প্রতিবেদকও প্রতিনিধিদলে ছিলেন। সার্বিক দাবিগুলির সাথে নির্দিষ্টভাবে জেলার কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়: আবিলম্বে পরিকাঠামো উন্নয়ন ও শিক্ষক নিয়োগ করে আলিনগর ও মুড়িগেড়িয়ার এস টি হস্টেল দুটির দুরবস্থা দূর করতে হবে, জেলার সব এস টি হস্টেলই কম-বেশী দূর্দশাগ্রস্ত; সাঁওতালী লোকশিল্পীদের নথীভুক্তকরণ/নিয়োগ বন্ধ করা চলবেনা, ভাতা বাড়াতে হবে ও সরকারকে সাঁওতালী লোকশিল্প একাদেমি গড়তে হবে; বিভিন্ন আদিবাসী এলাকায় মারঘাটি ও জাহেরগাঢ় প্রাচীর ঘিরে সুব্যবস্থিত করতে হবে; এস টি সার্টিফিকেট, মৃত্যুর সার্টিফিকেট সহ বিবিধ সরকারী সংশাপত্র সরবরাহ সহজ সরল পদ্ধতিতে করতে হবে, হয়রানি ও দুর্ব্যবহার বন্ধ করতে হবে; আদিবাসীদের কৃষক পেনশন, বিধবা ভাতা বি পি এল কার্ড, সরকারি গৃহ নির্মাণ এবং এন আর ই জি এ-র কাজ ও মজুরি প্রদানে টালবাহানা বন্ধ করতে হবে। এসডিও দাবিগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং কোন কোন বিষয়গুলি তাঁর এক্তিয়ার/ক্ষমতার মধ্যে পড়েনা তা জানান এবং পলিসি সংক্রান্ত দাবিগুলি সরকারের কাছে পাঠাবেন বলেন। এস টি ছাত্রছাত্রীদের হস্টেলের বিষয়টি তাঁর এক্তিয়ারের মধ্যেই পড়ে, কিন্তু সেগুলির অবস্থা সম্পর্কে তাঁর কাছে কোনও তথ্য নাই বলে স্বীকার করেন, দ্রুত এই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। এসটি শংসাপত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে হয়রানি হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, এ কাজের জন্য সরকার প্রতিটি ব্লকে মাত্র একজন করে কর্মচারী রেখেছে, ফলত এর থেকে বেশী দ্রুততায় সার্টিফিকেট ইস্যু করা সম্ভব হচ্ছেনা, বিশেষত অনেক অ-আদিবাসীও এস টি সার্টিফিকেট বাগিয়ে নিতে চাইছে এমন অভিযোগ ওঠায় (যে অভিযোগ সত্যি বলেই মনে করেন তিনি) আবেদনপত্র একটু বেশী সময় ধরে খতিয়ে দেখতে হচ্ছে বলে জানান। বিধবা ভাতা ও বার্ধক্য ভাতার ক্ষেত্রে চুঁচুড়া সাবডিভিশনে নতুন একজনকেও ভাতা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। কারণ সরকার এই ভাতা প্রাপকের সংখ্যার সুনির্দিষ্ট সীমা বেঁধে রেখেছে এবং সেই সীমা ইতিমধ্যেই পূরণ হয়ে গেছে, বর্তমান প্রাপকদের কেউ প্রয়াত হলে অথবা সরকার সংখ্যা-সীমা বাড়ালে তবেই একমাত্র নতুন আবেদন নিতে পারবেন। এরপর রবীন্দ্রভবনে তথ্যসংস্কৃতি অফিসে যায় প্রতিনিধিদল, অফিসার জানান যে আদিবাসী লোকশিল্পীদের নথীভুক্তকরণ/নিয়োগের কাজ অবিলম্বে শুরু করা হবে, ফর্ম জমা নেওয়া হবে।
ঘড়ির মোড়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা বিক্ষোভ অবস্থান ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত, আনন্দময় ও উদ্দীপ্ত। বক্তাদের বক্তব্য, গানের সুর, শতাধিক মহিলার সমবেত নাচ, ধামসা মাদলের তান এক নতুন অঙ্গীকারে মিলেমিশে যাচ্ছিল। মূলত সাঁওতালী ও বাংলা ভাষাতে সভার কাজ চলে। নৈহাটি অগ্নিবীনার বাবলি সরিৎ চক্রবর্তী বাংলা গণসঙ্গীতে লড়াইয়ের ডাক তোলেন। ডেপুটেশন থেকে ফিরে এসে সজল পাল ও পাগান মুর্মু ডেপুটেশনের আলোচনা সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন। এরপর আদিবাসী মঞ্চের পক্ষ থেকে আগামী ৮-৯ জানুয়ারির দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটকে সক্রিয় সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা করা হয় এবং ৮ তারিখ সকাল ৯টায় পোলবা ব্লকে একটি মিছিল কর্মসূচী ঘোষিত হয়। ধামসা মাদল বাজিয়ে আরেক পর্ব নাচ গানের মধ্যে দিয়ে বিক্ষোভ সভা শেষ হয়।