নিজের রক্তঘামে তৈরি ফসল রাস্তায় ঢেলে দিলো কৃষক। মহারাষ্ট্রের অপর একজন চাষি এক কেজি পিঁয়াজের দাম পেলো মাত্র ৫০ পয়সা। অথচ শহরের বাজারে সেটা বিক্রী হচ্ছে, ২৫-৩০ টাকায়। রাগে ক্ষোভে এক গাড়ী পিঁয়াজ বিক্রীর যৎসামান্য টাকা সেই চাষি মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দিলো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে। অন্যদিকে রাজধানী দিল্লীর রাজপথ দখল করে লক্ষ কৃষকের মিছিলের গর্জন শোনা গেলো—কৃষক বিরোধী মোদী সরকার হঠাও! সেদিন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরে কৃষকরা মোদী সরকারকে মোক্ষম আঘাত দিতে সক্ষম হয়েছিলো। প্রথমত, কর্পোরেট-পুঁজিপতিদের দালালী করে তাদের তিন লক্ষ কোটি টাকা লুঠ করতে সহায়তা করা হল, অথচ সরকারের নীতির ফলে সৃষ্ট কৃষি সংকটে আক্রান্ত কৃষকদের ঋণমুক্তির দাবীকে "ফ্যাশন" বলে ব্যঙ্গ করা হলো কেন? দ্বিতীয়ত, ধর্ম-জাত-বর্ণগত বিভাজন সৃষ্টির চক্রান্তর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বৃহত্তর কৃষক ঐক্য নির্ধারক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলো। লক্ষ কৃষকের মিছিলে লাল, সবুজ, হলুদ, সাদা, নীল—নানা রঙের সমাহারে সেই রণধ্বনি বারংবার প্রতিধবনিত হয়েছিলো-"কিষাণ একতা জিন্দাবাদ, "আওয়াজ দো-হাম এক হ্যায়" রাস্তাই সেদিন রাস্তা দেখিয়েছিল, যে কৃষকরাই পরিবর্তনের অন্যতম কান্ডারী। তৃতীয়ত, অতি উৎপাদনের ফলে দাম কমে যাওয়ার মিথ্যাকে 'মিথ' করে দেওয়ার চক্রান্ত উন্মোচিত করে তারা দেখিয়েছিল, কৃষকের থেকে কম দামে ফসল কিনে সরকারের ঘরে বা বাজারে বিক্রী করে ফড়ে মহাজন মালিকরা লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা করে নিচ্ছে। তাদের সহায়তা করছে সরকার। বলা হয় কৃষি নাকি আর লাভজনক নয়, কিন্তু দেখা যাচ্ছে ওদের কাছে অবশ্যই লাভজনক। সরকারী নীতির ফলে ঘটে চলেছে কৃষকের সর্বনাশ, মালিকদের পৌষমাস।
মোদী সরকারের চটকদার প্রতিশ্রুতি এবং ধোঁকাবাজীকে কৃষক সংগঠনগুলি উন্মোচিত করে দিয়েছিলো। যথা—মোদী সরকার বলেছিলো কৃষকের আয় নাকি ৬ বছরে দ্বিগুন হবে। বাস্তবে বিগত ৪ বছরে এ জন্য বাজেটে পৃথকভাবে এক পয়সাও বরাদ্দ করা হয়নি। স্রেফ একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। যারা ১৪ খন্ডের এক রিপোর্ট পেশ করেছে, যাকে ঠান্ডাঘরে ফেলে রাখা হয়েছে।মোদী সরকার বাজেটের ২ শতাংশ,এবং জিডিপি-র মাত্র ০.৩ ভাগ কৃষির জন্য খরচ করেছে। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার বরাদ্দ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি থেকে কমিয়ে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা করে দিয়েছে। "প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা"কে ঐতিহাসিক আখ্যা দেওয়া হয়েছিলো। বাস্তবে এটা নতুন কিছু নয়,বিগত ৩০ বছর ধরে চলা তথাকথিত বীমা যোজনার নতুন সংস্করণ! এই খাতে ব্যায়বরাদ্দ নাকি ৪৫০ গুণ বাড়ানো হয়েছে! কিন্তু উপভোক্তার সংখ্যা ১০ গুণও বাড়েনি। বীমা চালু হওয়ার পর কৃষকদের পাওয়ার কথা (ক্লেম) ২১,৬০৮ কোটি থেকে কমে ১৫,৫০৫ হয়ে গেলো। অথচ বীমা কোম্পানী গুলির মুনাফা হলো ৬৩০২ কোটি টাকা! উত্তরপ্রদেশে ২০১৬ সালে ৩৭.১৭ লক্ষ কৃষক বীমা করেছিলো। সে বছর ভয়াবহ খরা জনিত কারনে সমস্ত চাষিরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু ক্ষতিপূরণ পায় মাত্র ২.০৯ লক্ষ। অর্থাৎ ৬ শতাংশ! অথচ বীমা কোম্পানী ২০০ কোটি টাকা মুনাফা করে নেয়। নোট বন্দীর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের কৃষক সমাজ। খোদ কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রালয় এ বিষয়টা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। ৮ নভেম্বর, ২০১৬—নোটবন্দীর সময়কালটা ছিলো রবিশস্য ওঠার সময়, আলুর দাম রাতারাতি অর্ধেকেরও কম হয়ে যায়। সমবায় ও গ্রামীণ ব্যাঙ্ক যাদের গ্রাহকরা মূলতঃ কৃষকরা। অথচ তাদের নোট বদলের অধিকার দেওয়া হয় না।ফলে কৃষকরা বিরাট ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এর প্রভাবে আজও বাজারে মন্দা চলছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ৮-৯ জানুয়ারী সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটে কৃষকরাও সামিল হবে। ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের আহ্বানে ধর্মঘটের অন্যতম দাবী ফসলের ন্যায্য দাম ও ঋণমুক্তি। সর্বভারতীয় কৃষক মঞ্চ ধর্মঘটে সক্রিয় ভাবে অংশ নেবে। দেশ জুড়ে আওয়াজ উঠবে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক কৃষক ঐক্য জিন্দাবাদ।