লালবাতির নিষেধ ছিল না,
তবুও ঝড়ের বেগে ধাবমান কলকাতা শহর
অতর্কিতে থেমে গেল;
ভয়ঙ্করভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেমপো, বাঘমার্কা ডবল-ডেকার।
'গেল গেল' আর্তনাদে রাস্তার দুদিক থেকে যারা
ছুটে এসেছিল—
ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার—
এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে।
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ এক উলঙ্গ এক শিশু।
খানিক আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে চৌরঙ্গিপাড়ায়।
এখন রোদ্দুর ফের অতিদীর্ঘ বল্লমের মতো
মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে
নেমে আসছে;
মায়াবী আলোয় ভাসছে কলকাতা শহর
২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের মায়াবী আলোয় যখন ভাসছে কলকাতা শহর, তখনি 'কলকাতার যীশু'র রচয়িতা, বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চলে গেলেন। বর্ষীয়ান এই কবির কবিতা বাঙালি জীবনের কথোপকথনের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। তাঁর বেশ কিছু পংক্তি পরিণত হয়েছে প্রবাদে। 'কলকাতার যীশু' বা 'অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল' বা 'উলঙ্গ রাজা'র কথা শোনেন নি, এমন শিক্ষিত বাঙালি বিরল।
১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন নীরেন্দ্রনাথ। পাঠশালায় গুরুমশাইয়ের ছত্রছায়ায় প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে ১৯৩০ সালে কলকাতায় আসেন তিনি। মিত্র ইনস্টিটিউশনে স্কুলের পড়াশোনা সেরে প্রথমে ভর্তি হন বঙ্গবাসী কলেজে। তারপর সেন্ট পলস কলেজ থেকে পাশ করে ১৯৫১ সালে কর্মজীবন শুরু করেন আনন্দবাজার পত্রিকায়।
কবি হিসেবেই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর খ্যাতি সর্বাধিক। দীর্ঘ সাত দশকের কবিজীবনে লেখা তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বইগুলোর মধ্যে আছে অন্ধকার বারান্দা, আজ সকালে, আর রঙ্গ, উলঙ্গ রাজা, কলকাতার যীশু, খোলা মুঠি, ঘর দুয়ার, ঘুমিয়ে পড়ার আগে, চল্লিশের দিনগুলি,জঙ্গলে এক উন্মাদিনী, নক্ষত্র জয়ের জন্য, নীরক্ত করবী, নীলনির্জন, পাগলা ঘন্টি, যাবতীয় ভালোবাসাবাসি, সত্য সেলুকস, সময় বড় কম—ইত্যাদি। ১৯৭৪ সালের সাহিত্য আকাদেমী সহ অনেক পুরস্কার তাঁর কবিখ্যাতিকে স্বীকৃতি জানিয়েছে।
কবি পরিচয়ের পাশাপাশি রয়েছে তাঁর আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। বিশিষ্ট সম্পাদক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গদ্যকার হিসেবেও তিনি স্মরণীয়। দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার সাথে। লেখক সম্পাদকদের হ্যাণ্ডবুক হিসেবে তাঁর "বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন" বইটি ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। এই কাজটি বাংলা ভাষার ব্যবহারবিধির একটি প্রমিত রূপ তৈরির চেষ্টা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষাচর্চায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অবদান নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণে ভাষাবিদ পবিত্র সরকার লিখেছেন, “নির্ভুল এবং নিঁখুত লেখার ভাষা নির্মাণ করতে হলে, অনেক কিছু জানতে হয়। বানান, শব্দের প্রয়োগ ইত্যাদি।কঠিন শব্দকেও কী ভাবে সহজের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়, যার ফলে শৈলিতে একটা ঢেউ তৈরি হয়, এটা নীরেনদা ছাড়া সত্যি সত্যি আর কেউ পারতেন না। কারণ, ভাষাটাকে তিনি স্রষ্টার জায়গা থেকে তো বটেই ভাষা-ভাবুকের দিক থেকেও সৃষ্টি এবং ব্যবহার করতেন।
বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁর নানা ধরনের চিন্তা ছিল। ছিল ভাষাসংক্রান্ত নানান কাজকর্মও। সেটা আশির দশকের গোড়ার দিক। নীরেনদা তখন আনন্দমেলার সম্পাদক। কিছু দিন আগেই শঙ্খ ঘোষ তাঁর অনুরোধে কুন্তক ছদ্মনামে ‘ভাষার খেলা’ লিখেছেন। আমাকে নীরেনদা বললেন, ছোটদের জন্য লিখতে। বিষয়টাও বলে দিলেন। কী ভাবে বাংলা উচ্চারণ করতে হবে, সেই বিষয়েই প্রকাশিত হল ‘বাংলা বলো’।এ সব লেখা তিনি ভেবে আমাদের দিয়ে লেখাতেন। তাঁর নির্দেশেও আমরা বাংলা ভাষার নতুন নতুন কাজ করতে পেরেছি।
পরে নীরেনদা পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি হয়েছিলেন। তখন বেশ কয়েকটা ভাল ভাল অভিধান বেরিয়েছে। সবগুলোর প্রুফ নীরেনদা নিজে দেখেছেন। শুধু তাই নয়, যত্ন করে দেখে কোন শব্দ অভিধানে দরকার নেই, আর কোন শব্দ যোগ করার প্রয়োজন— সেগুলো তিনি আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দিতেন। খানিকটা নেপথ্যে থেকে কাজ করলেও বাংলা ভাষা নিয়ে তার কাজ কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
আমিও বাংলা ভাষা এবং বানান নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু, নীরেনদার সঙ্গে কখনও মতের অমিল হয়নি। তিনি যখন আনন্দবাজারের জন্য বানান সংক্রান্ত বই সম্পাদনা করেছেন, আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বানান নিয়ে আমার যুক্তি মেনেও নিয়েছেন।
কবি হিসাবে নীরেনদাকে মনে রাখবে বাঙালি। কিন্তু, বাংলা ভাষা নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের তো বাঙালি তেমন করে চেনে না। বিশেষ খেয়ালও রাখে না তারা। তবে, নীরেনদা গোটা কাজটা এমন পর্যায়ে গিয়ে করেছেন, তাতে বাঙালি তাঁকে এই ক্ষেত্রেও মনে রাখবে”।
আনন্দমেলা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে পত্রিকাটিকে বিশেষভাবে শিশু কিশোরসহ সর্বস্তরের পাঠকের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার কৃতিত্ব তাঁর।অনেক বিশিষ্ট লেখককে তিনিই শিশু কিশোরদের লেখক করে তুলেছিলেন। এখানেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজ, বিমল করের কিকিরা সিরিজ, সমরেশ বসুর গোগল সিরিজ ইত্যাদি লেখা শুরু হয় এবং এগিয়ে চলে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সস্নেহ সম্পাদকীয় প্রেরণায়। হার্জ এর টিনটিন এর সবকটি বইয়ের অনুবাদ তিনি করেছিলেন। এই অনুবাদসৃষ্টি একইসঙ্গে মূলানুগ ও স্বাদু অনুবাদের এক অনন্য ও দৃষ্টান্তমূলক নিদর্শন। হার্জ এর লেখার স্নোয়িকে কুট্টুসে রূপান্তরিত করা বা ফ্যান্টমকে অরণ্যদেবে রূপান্তরিত করা ছিল এক অসামান্য কাজ, যা এই বিদেশী কমিকস সিরিজগুলিকে বাঙালি পাঠকের আত্মার কাছাকাছি নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে।
মূলত কবি হিসেবে খ্যাত হলেও বিপুল পরিমাণ গদ্যসাহিত্যও তিনি লিখেছেন। কবিতা বিষয়ক লেখালেখিও রয়েছে তাঁর মধ্যে। রয়েছে নানা ধরনের নানা স্বাদের উপন্যাস এবং কিশোর সাহিত্য। ভাদুড়ী মশাই নামে এক গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করে তিনি যে রহস্য উপন্যাসগুলি লিখেছিলেন, সেগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর কবিতা বিষয়ক বইগুলোর মধ্যে রয়েছে কবিতা কী ও কেন, কবিতার ক্লাস, কবিতার দিকে ও অন্যান্য রচনা ইত্যাদি।
'কবিতা ও সংস্কৃতি' নামক এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, "বঙ্গসংস্কৃতি যদি শুধু জারি সারি, আউল বাউল, পালপার্বণ, আলপনা আর পাঁচালির মধ্যেই আটকে থাকত, তাহলে বুঝতে হত যে, এর প্রাণশক্তি কবেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা হয়নি বলেই তার পরিসর এখন আগের তুলনায় অনেক বড়ো। একদিকে সে যেমন গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বাড়িয়ে নিয়েছে তার রাজ্যপাট, অন্যদিকে তেমনই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত থেকে মাইকেল কি হেম নবীন পর্যন্ত এসেই তার দম ফুরিয়ে যায়নি। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ, সবকিছুকেই সে অক্লেশে আত্মসাৎ করতে পেরেছে। আরও পারবে।" এই তালিকাটি ক্রম প্রসারমান এবং সেখানে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে নীরেন্দ্রনাথও যে অন্তর্ভুক্ত তা বলাই বাহুল্য।
যে কোন স্বৈরাচারী নির্লজ্জ শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, প্রতিবাদে বাঙালি বারবার আশ্রয় খুঁজেছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর 'উলঙ্গ রাজা' কবিতায়। আজ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানেও বারবার স্মরণযোগ্য এই কবিতার অমোঘ পংক্তিগুলি -
সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে : শাবাশ, শাবাশ!
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম, চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।
গল্পটা সবাই জানে।
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ
স্তাবক ছিল না।
একটি শিশুও ছিল।
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।
নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু;
জমে উঠেছে
স্তাবকবৃন্দের ভিড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।
শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো।
সে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক;
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?
শঙ্খ ঘোষ শোকবার্তা উদ্ধৃত করেই পরিশেষে বলি “জীবনের প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টিশীল থেকে গেছেন, এমন একজন স্রষ্টার জীবনাবসান সমস্ত বিচ্ছেদ বোধের মধ্যেও একটা সফলতার স্পর্ধা এনে দেয়। সহজ ভাষার টান টান চেতনার স্পর্ধিত সেই কবি চলে গেলেন আজ। তাঁকে আমাদের প্রণাম”।