ভয়াল সিলিকোসিস কেড়েছে বাঁচার অধিকার, ফুসফুসে পাথরকুচি নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় ওরা। পেট চালাতে পাথর ভাঙতে গিয়েছিলেন ওঁরা। পাথরভাঙা কলে নিংড়ে দিয়েছিলেন নিজেদের। বুঝতেই পারেননি যে, একটু একটু করে জড়িয়ে পড়েছেন মৃত্যুফাঁদে। যখন বুঝলেন, ততক্ষণে ফুসফুসে পাথরকুচি আর বিষাক্ত গ্যাস জমে ওঁরা মৃত্যুপথযাত্রী। পাথর ভাঙা কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে সিলিকোসিস বেশি দেখা যায়। পাথরের ধুলিকণা নাক, মুখ এমনকি চোখ দিয়ে ঢুকলে শ্রমিকরা এ রোগে আক্রান্ত হন। রোগের লক্ষণ হিসেবে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়। হাত-পা শুকিয়ে যেতে থাকে। শেষ পরিণতি মৃত্যু। ভূমি খনন করে পাথর উত্তোলন, পাথর নেটিং, ডাম্পিং ও ক্র্যাশিংয়ের সময় নাক মুখ দিয়ে ধুলাবালি শরীরে প্রবেশ করে। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছেন পাথর শ্রমিকরা। ফুসফুসের এই দুরারোগ্য রোগে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে। সিলিকোসিস রোগীর প্রয়োজন অক্সিজেন ও জরুরি ইঞ্জেকশন। কিন্তু এই গ্রামের কৃষক থেকে শ্রমিকে পরিণত হওয়া মানুষ এতটাই গরিব যে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। হাড় জিরজিরে শরীরগুলো ক্রমশ বিছানায় মিশে যাচ্ছে। কাশির দমকে কারও মুখ থেকে রক্ত ওঠে। কেউ বা বুক ভরে বাতাস টানতেই জেরবার। ভারতের গ্রামের পর গ্রাম একই ছবি। সাম্রাজ্যবাদী দেশ আমেরিকা। ১৯৩৮ এর আমেরিকা; সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তারা সিলিকোসিস-এর বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে লড়াই করেছিল। নিজেদের দেশের মানুষকে রক্ষা করতে সেই সময়ের আমেরিকান মিডিয়া সিলিকোসিসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আজ আমেরিকা প্রায় সিলিকোসিস মুক্ত।
এই মুহূর্তে কমপক্ষে প্রায় ১.৫ কোটি শ্রমিক আক্রান্ত সিলিকোসিসে। আরও ১.৫ কোটি শ্রমিক পাথর খাদানে এই মুহূর্তে কাজ করছে যারা ধীরে ধীরে সিলিকোসিসের মৃত্যু ফাঁদের দিকে এগোচ্ছে। মিডিয়া সম্পূর্ণ চুপ, কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ভূমিকা নেই প্রায়, দক্ষিণপন্থী পার্টিগুলো স্বাভাবিকভাবে পুঁজির পক্ষে, মালিকের পক্ষে, শ্রমিক হত্যার পক্ষে। রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা, নীতি নেই সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকদের জন্য। আসলে সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকরা মারা যাচ্ছে না, মালিকপক্ষের হাতে রাষ্ট্রের সহযোগিতায় খুন হচ্ছেন প্রতিদিন। আজ ২০১৮-তে ভারতে এক কোটি মানুষ সিলিকোসিসে আক্রান্ত যার অর্থ এক কোটি মানুষেরই মৃত্যু অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর হত্যা মালিকের দ্বারা রাষ্ট্রের সহযোগিতায়।
স্বরজিৎ, গিয়াসুদ্দিনরা চাষির ছেলে; বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনায়। বর্তমানে আর্থসামাজিক অবস্থায় চাষের কাজে যে অর্থ উপার্জন তাতে সংসার চালানো মুশকিল তাই কাজের খোঁজে বেড়িয়ে পরে এবং কাজ জুটেও যায়। পাথর খাদানে ২৫০ টাকা রোজে চাষি শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়; কিন্তু সে জানতেই পারল না অতি মুনাফার লোভে পাথর ভাঙ্গার কারখানার মালিক তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্মরজিৎ ও গিয়াসউদ্দিন মারা গেছেন। এই মুহূর্তে ভারতের ১.৫ কোটি সিলিকোসিস আক্রান্ত মানুষ হিন্দু অথবা মুসলিম নয়, রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে ওদের সবার পরিচিতি ওরা শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধি। কাজ করে যা আয় হয়েছিল তার সবটুকু খরচ হয়ে গেছে ওদের চিকিৎসায়, তারপর পরিবার লাখ টাকা ধার করে চিকিৎসা চালিয়ে গেছে কিন্তু ফল ... শুধু মৃত্যুর প্রতীক্ষা; সিলিকোসিস আক্রান্তদের সন্তান, স্ত্রীর, অসহায় বৃদ্ধ বাবা মায়েদের ভবিষ্যৎ কি ?
আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করি (১) কোনো পাথর খাদানের মালিক সিলিকোসিসে মারা যায় না; বরং লাফিয়ে লাফিয়ে তাদের মুনাফা এবং সম্পত্তি দুই বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন। (২) মেডিকেল ব্যবসাতে এদের কল্যাণে মুনাফা বাড়ছে। (৩) এই শ্রমিকদের সন্তানরা হয় আরও সস্তা শ্রমিকে রূপান্তরিত হবে অথবা ভদ্রলোকদের ভাষায় সমাজ বিরোধী হয়ে উঠবে এবং তাকে রাষ্ট্রের শাসকরা ব্যবহার করবে।
সিলিকোসিস নিয়ে লড়াই, আক্রান্তদের মৃত্যু, ঐক্যবদ্ধ শ্রেণীর লড়াই, কলকাতা হাই কোর্টের রায় নিয়ে কিছু মানুষ অবগত। এইবার আরও বৃহত্তর লড়াইয়ের দিকে আক্রান্ত শ্রমিকরা জোট বাঁধছে। হিন্দু মুসলিম রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে বৃহত্তর শ্রমিক শ্রেণী নিজেদের অধিকারের লড়াইতে জোট বাঁধছে।
‘সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি’র ডাকে উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার (ক্যানিং, বাসন্তী সহ) শ্রমিক কৃষকরা সিলিকোসিস আক্রান্তদের অধিকার এবং অবৈধ পাথার খাদানগুলো বন্ধের দাবিতে গত ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৮ মালঞ্চ বাজার থেকে মিনাখা পর্যন্ত একটি মিছিল করে। কমিটির পক্ষ থেকে সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন ও বিশিষ্ঠ ব্যক্তির কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছিল এই মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য।
ঐদিন সকাল ১১ টায় মালঞ্চ বাজার থেকে সহস্রাধিক সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের মানুষ মিছিল শুরু করেন। প্রখর রোদকে উপেক্ষা করে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ১১ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে মিছিল পৌঁছায় মিনাখাঁর মাঠে। মিছিলে মহিলা ও শিশুদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ঐ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন বিশিষ্ঠ আইনজীবি বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য্য, বামপন্থী বুদ্ধিজীবী আজিজুল হক, কবি মন্দাক্রান্তা সেন, এআইসিসিটিইউ, আরওয়াইএ, এআইকেএম, এআইপিএফ নেতৃবৃন্দ যথাক্রমে দিবাকর ভট্টাচার্য, রনজয় সেনগুপ্ত, কৃষ্ণ প্রামানিক, প্রবীর দাস প্রমুখ। সিআইটিইউ সহ আরো কয়েকটি সামাজিক ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠন ও কর্মীরা এই মিছিলে সামিল হন। সংক্ষিপ্ত সভার মধ্যে দিয়ে কর্মসূচীটি শেষ হয়। মিছিল শেষে গ্রামে ফেরার পর সন্দেশখালির ১ নম্বর ব্লকের ভাটিদাও গ্রামে শাসক দলের গুন্ডারা অংশগ্রহণকারীদের মারধর করে এবং বাড়িঘর ভাঙচুড় করে। প্রায় ৩০ জন গ্রামবাসী আহত হন। পুলিশ এলাকায় এলেও নিষ্ক্রিয় থাকে। পরেরদিন গ্রামের মানুষ এলাকার শাসক দলের নেতার বাড়ীর সামনে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ঐ নেতা গ্রামের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়।