রুশ বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এর আগে সব সময়েই রাষ্ট্র চালিয়েছে সম্রাট সুলতান জার প্রভৃতি রাজারাজড়ারা বা জমিদার পুঁজিপতিদের মতো প্রবল ধনী মানুষেরা বা তাদের প্রতিনিধিরা। সংখ্যালঘু অল্প কিছু মানুষ এবং তাদের স্বার্থে শাসন শোষণ চলেছে সংখ্যাগুরু মানুষের ওপর। রুশ বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য ব্যাপারটা উল্টে গেল এবং সমাজের গরিষ্ঠ অংশের প্রতিনিধিদের হাতে এল রাষ্ট্র ক্ষমতা।
এর আগে ফরাসী বিপ্লব বা প্যারি কমিউনও এরকম চেষ্টা করেছিল, কিন্তু অল্পদিন পরেই সেগুলি বেহাত হয়ে যায়। অন্যদিকে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় শ্রমিক কৃষক মেহনতি সাধারন মানুষদের প্রতিনিধিত্বে রাষ্ট্র ক্ষমতা কেবল দীর্ঘস্থায়ী হল তাই নয়, তা সারা পৃথিবীর সমস্ত দেশে এর প্রেরণা সঞ্চারে সমর্থ হল। সারা পৃথিবীর নানা দেশে অসংখ্য মানুষ রুশ বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের দেশে এইরকম ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টায় সামিল হলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চিন সহ অনেক দেশে কালক্রমে সাফল্যও এল। ভারত সহ পৃথিবীর নানা দেশে এই চেষ্টা শুরু হয়। মনে রাখতে হবে রুশ বিপ্লবের সময়ে ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলন গণ চরিত্র নিতে শুরু করেছে। জাতীয় কংগ্রেসের বিশেষত নবীন নেতাদের অনেকেই, যেমন জওহরলাল নেহরু বা সুভাষচন্দ্র বসু সমাজতন্ত্রের আদর্শের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। লেনিন ও রুশ বিপ্লবকে নিয়ে এমনকি মহাত্মা গান্ধীর আবেগমাখা শ্রদ্ধার্ঘও পাওয়া যায় কয়েকটি লেখায়। অচিরেই নানা দেশের মতো গড়ে ওঠে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনে যারা বড় ভূমিকা রাখেন। ভগৎ সিং এর মতো বিপ্লবী ফাঁসির আগে জীবনের প্রেরণা খুঁজে পান লেনিনের “রাষ্ট্র ও বিপ্লব” বইটি থেকে। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অসংখ্য সেনানী পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন ও জনগণের সার্বিক স্বাধীনতার লড়াইতে আত্মোৎসর্গ করেন। সেই সার্বিক মুক্তির লড়াই ভারত সহ বিভিন্ন দেশে এখনো চলছে, কোটি কোটি মানুষ এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে লড়াই করে চলেছেন। এই অর্থে রুশ বিপ্লব একশো বছর পরেও কেবল ইতিহাসের ব্যাপার নয়, বর্তমানের অনুপ্রেরণাও।
এই প্রভাব বা অনুপ্রেরণা প্রসঙ্গে একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। রুশ বিপ্লবের যেমন একটি বিশ্বজনীন আবেদন আছে, তেমনি আছে একটি নির্দিষ্ট দেশকালের প্রেক্ষাপট। বিশ্বজনীন আবেদনটা হল মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থবাহী শোষণ ও দমনমূলক শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থবাহী শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করা। দেশে দেশে মুষ্টিমেয় মানুষের শাসন শোষণের ইতিহাস ও প্রকৃতিটা কিন্তু অনেকটাই আলাদা আলাদা। তাই কিছু সাধারণ সূত্র থাকলেও দেশভেদে বিপ্লবের চেহারা চরিত্র ধরন-ধারণ এর মধ্যে মিল অমিল দুইই আছে। এটা মাথায় রেখেই আমরা রুশ বিপ্লব বা অন্যান্য সফল বিপ্লব থেকে প্রেরণা উৎসাহ শিক্ষা নিয়ে থাকি।
একটি গুরূত্বপূর্ণ রচনায় লেনিন লিখেছিলেন, “আমরা মার্কসের তত্ত্বকে পরিসমাপ্ত ও স্পর্শাতীত কিছু একটা বলে দেখি না। উল্টে আমরা বরং মনে করি যে তা একটা বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করেছে। জীবন থেকে পিছিয়ে পড়তে না চাইলে তাকে সব দিক থেকে আরো বিকশিত করতে হবে সমাজতন্ত্রীদের।” মার্কসীয় তত্ত্বের প্রতি এই ধরনের সৃজনমূলক মনোভাব রুশ বিপ্লবের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি ছিল। মার্কস-এঙ্গেলস মনে করেছিলেন উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব এবং একগুচ্ছ ধনতান্ত্রিক দেশে বিপ্লব না হলে তাকে রক্ষা করা কঠিন। লেনিনবাদ তার সৃজনীশক্তি দিয়ে রাশিয়ার মত তুলনামূলকভাবে পশ্চাদপদ একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশ, যেখানে সামন্ততন্ত্রের প্রবল উপস্থিতি থেকে গিয়েছে, সেখানেও যে প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে শ্রমিক ও গরীব কৃষকদের মধ্যে মৈত্রীর ভিত্তিতে বিপ্লব সফল করে তোলা যায়—তা দেখাল। সেইসঙ্গে অন্য কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশের উপস্থিতি ছাড়াই কেবলমাত্র দেশের ভেতরের শ্রমিক, কৃষক, সেনাবাহিনী ও জনগণের ব্যাপকতম অংশের আস্থা জয় করে দেশের মধ্যেকার কুলাক ও প্রতিবিপ্লবী শক্তি এবং বাইরের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে (আমেরিকা, জাপান, ফ্রান্স, ইংলন্ড, জার্মানী ইত্যাদি) লড়াই করে বিপ্লবকে টিঁকিয়ে রাখতে সক্ষম হল। ইউরোপীর রাশিয়া থেকে শুরু করে এশীয় রাশিয়ার কোণে কোণে তাকে ছড়িয়ে দিতে পারল। এই ব্যবহারিক অর্জনগুলি হয়ে উঠল নতুন তাত্ত্বিক শিক্ষা। লেনিনবাদের এই সৃজনী শক্তিই মার্কসবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে, দেশে দেশে মেহনতি মানুষের জয়ের ক্ষেত্রে বারবার গুরূত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, চীন বিপ্লবের ক্ষেত্রে মাও সে তুং চিন্তাধারার মধ্যে যার এক ভিন্ন প্রকাশ আমরা দেখেছি। কৃষকের বিপ্লবী শক্তি এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে এশিয়া তথা চিনের নির্দিষ্ট বাস্তবতায় প্রয়োগ করে মাও সে তুং ভিন্ন ধরনের সমাজ রাষ্ট্রে মার্কসবাদের নতুন সম্প্রসারণ ঘটালেন, যা অন্যান্য অনেক জায়গার মতো আমাদের দেশেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
রুশ বিপ্লব ছিল খাঁটি গনবিপ্লব। বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিলোপ ঘটল এর মধ্য দিয়ে। মানব ইতিহাসে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হল প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব, স্থাপিত হল শ্রমিক কৃষকের রাষ্ট্র। নভেম্বর বিপ্লব শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলছিল না। রাশিয়ার জনগণের জীবনে এক গভীর সামাজিক অর্থনৈতিক রদবদল সূচীত করলো এই বিপ্লব, শুরু হল দেশের বৈপ্লবিক পুনঃনির্মাণ—নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সূত্রপাত হল। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের মধ্যে দিয়ে শুরু হল সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের নতুন যুগ। শুধ রাশিয়া নয়, বিশ্বের প্রতিটি কোণায় কোণায় তার উজ্জ্বল রশ্মি ছড়িয়ে পড়ল। সারা পৃথিবীর শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষ ও বিবেকী বুদ্ধিজীবীরা এর প্রেরণায় উদ্বেল হলেন। দেশে দেশে সূচীত হল নতুন স্বপ্নের পৃথিবী গড়ার লড়াই। সেই লড়াই এবং স্বপ্নের শরিক হিসেবেই আমরা কাজ করে চলেছি।
রুশ বিপ্লবকে বিজয়ের পর থেকে গৃহযুদ্ধ ও নানা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ঘেরাও এর মধ্যে কাজ করে যেতে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদীদের আক্রমন তাকে মারণ আঘাত দিতে চেয়েছিল। সোভিয়েতের দৃপ্ত লড়াই এর ওপর নির্ভর করেই হিটলার মুসোলিনিদের সে সময়ের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নির্ণায়ক জয় এসেছিল। ফ্যাসিবাদের ভয়ংকর চেহারা যখন আমাদের দেশে এবং পৃথিবীর অন্যান্য নানা প্রান্তে আবারো নতুন নতুন চেহারায় আত্মপ্রকাশ করেছে, তখন মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে তাকে নির্ণায়কভাবে পরাজিত করাটাই এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ পালনের মুহূর্তে এই চ্যালেঞ্জ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।