সম্প্রতি দেশের রাজধানী দিল্লী-বাণিজ্য নগরী মুম্বাই উত্তাল হয়ে উঠেছিল লক্ষ লক্ষ কৃষকের লংমার্চ ও বিক্ষোভে। দেশের গ্রামীণ সমাজের গভীরে জমে ওঠা কৃষি সংকট থেকে উঠে এসেছে অমোঘ দাবি “ফসলের ন্যায্য দাম চাই”। বর্তমানে এ রাজ্য এবং পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের লক্ষ লক্ষ পাটচাষিরা লাভজনক দামের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। বিগত দুই মাস ধরে গ্রামে পাট উঠতে শুরু করেছে। অথচ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার হাত গুটিয়ে বসে আছে-পাট চাষিদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে ফড়ে দালাল মহাজনদের কাছে অভাবী বিক্রির পথে। সবটাই ওদের পৌষ মাস, চাষিদের সর্বনাশ। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৭ অক্টোবর নদীয়া জেলার পাট চাষিদের বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত হল কৃষ্ণনগরে জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া-র (জেসিআই)-এর আঞ্চলিক সদর দপ্তরে। অবিলম্বে গ্রাম পঞ্চায়েত ক্যাম্প করে জেসিআই-কে পাট কিনতে হবে, ৬০০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল দাম চাই এই দাবিতে বেলা ২টায় কৃষ্ণনগর টাউন হলে জমায়েত হয়ে শতাধিক কৃষকের মিছিল শুরু হয়। এআইকেএম (কিষাণ মহাসভা)-র ব্যানারে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন সংগঠনের জেলা নেতা ধনঞ্জয় গাঙ্গুলী, আলতাফ হোসেন, রাজ্য নেতা সুবিমল সেনগুপ্ত, জয়তু দেশমুখ প্রমূখ।
কেন্দ্রীয় সরকার মে মাসে কুইন্টাল প্রতি মাত্র ২০০ টাকা বৃদ্ধি করে ২০১৮-১৯ সালের পাটের সরকারী সংগ্রহ মূল্য ৩৭০০ টাকা (গড়পড়তা গুনমান সম্পন্ন) নির্ধারণ করেছে। অথচ এই দরেও গ্রামে গ্রামে সরকারী ক্রয়ের কোনো ব্যবস্থাই নাই। ফলে কুইন্টাল পিছ সরকারী দরের থেকে ৮০০-১০০০ টাকা কম দামে তথা বিপুল লোকসানে চাষিরা পাট বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ মোদী সরকার বড় গলা করে বলে চলেছে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনেই নাকি উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দামে সরকার ফসল কিনবে ! চাষিদের আয় দ্বিগুণ হয়ে যাবে! এফসিআই দপ্তরে ডেপুটেশনে গিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেন, বর্তমানে এক কুইন্টাল পাটের উৎপাদন খরচ কমপক্ষে ৩০০০-৩৮০০ টাকা। সম্প্রতি সার-বীজ-ওষুধের দাম বেড়েছে; মাঠ থেকে পাট কেটে জলাশয়ে পচাতে নিয়ে যাওয়া আসার পরিবহন খরচ ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে বিরাট মাত্রায় বেড়েছে; অথচ মোদী সরকার মুমুর্ষূ মানুষকে দু’চার ফোটা জল ছিটিয়ে দেওয়ার মতো করে মাত্র ২০০ টাকা বৃদ্ধির ঘোষণা করলেন কেন ? জেসিআই-এর আঞ্চলিক অধিকর্তা ফাইল খুলে দেখালেন বিভিন্ন গ্রামের চাষিদের স্বাক্ষর সম্বলিত পাট উৎপাদনের কুইন্টাল পিছু খরচের হিসাব ৩৭০০-৪২০০ টাকা। প্রতিনিধিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দপ্তরের কাছেই এই তথ্য যখন মজুত আছে তখন সঠিক ভাবে সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে না কেন? জেসিআই-এর সূত্রে জানা গেল রাজ্যে ১৭১টা কেন্দ্র আছে-অথচ তার মধ্যে মাত্র ২৭টি চালু আছে। বাস্তবে সেখানে গ্রাম থেকে পাট নিয়ে এসে সরকারী দরটুকুও গরিব মাঝারি চাষিরা পাচ্ছে না। এই চাষিদের অধিকাংশই দেনার দায়ে মহাজনদের কাছে ‘আগাম বিক্রি’ করতে বাধ্য হন।
এ বছর পাট কেনার লক্ষ্যমাত্রা বিপুল; কিন্তু এখনও পর্যন্ত যৎসামান্য পরিমাণ (৫ শতাংশ মাত্র!) কেনা হয়েছে। এছাড়া ৫০ কুইন্টালের বেশি পরিমাণে পাট একজন চাষির কাছ থেকে কেনা হবে না-নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যর শংসাপত্র লাগবে-এই সমস্ত নিয়মাবলীর দ্বারাই নাকি মহাজনদের বদলে প্রকৃত উৎপাদকদের কাছ থেকে ‘সরাসরি’ কেনার ব্যবস্থাবলী নেওয়া হয়েছে বলে জেসিআই আধিকারিক জানান। প্রতিনিধি দলের নেতৃবৃন্দ বলেন, পুরো বিষয়টাই বাস্তবে লোক দেখানো অন্তঃসারশূন্য, দুর্নীতি-দলবাজিতে পরিপূর্ণ। তারা বলেন, গ্রামে পাটের ক্রয় কেন্দ্র করা, চাষ শুরুর পরেই উৎপাদকের তালিকা তৈরি করা; এ কাজে কৃষক সমিতিগুলিকে যুক্ত করা, স্বনির্ভর গোষ্ঠী-সমবায় সমিতির মাধ্যমে ক্রয় করা - এই দাবিগুলিকে কার্যকরী করতে হবে। সরকারী ক্রয়ের সুবিধাগ্রহণ করে, কমদামে কেনা পাট বেশি দামে বিক্রি করে মুষ্টিমেয় দালাল মহাজনরাই লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা করে নিচ্ছে-কৃষকের রক্তচোষা এই ব্যবস্থাকে মদত দেওয়া বন্ধ কর। জেসিআই সূত্রে জানা গেল, তারা পাট কেনার জন্য রাজ্য সরকারের সহায়তা চেয়েছিলেন। রাজ্য সম্মতি দিলে বেনফেড, কনফেড প্রভৃতি এজেন্সির মাধ্যমে গ্রামীণ সমবায়গুলি পাট কিনতে পারত-চাষিরা কিছুটা হলেও উপকৃত হতো, কিন্তু মা মাটি মানুষের সরকার ক্লাবগুলোকে টাকা দিল, অথচ অসহায় পাট চাষিদের অভাবী বিক্রি ঠেকাতে এক টাকাও দিল না। পাট চাষিদের স্বার্থে সরকার কিছুই করল না।
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এই বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে এক দৃপ্ত মিছিল কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে ‘সদর’ মোড়ে যায়। এই কর্মসূচীতে নেতৃবৃন্দ বলেন, মোদী সরকার জুট কর্পোরেশনকে শুকিয়ে মারছে, যথাযথ অর্থ বরাদ্দ করেনি। এর ফলে চাষিরা বঞ্চিত হচ্ছে, ওরা অনেক দেরী করে যখন পাট কিনতে নামে ততদিনে গরিব মধ্য চাষীরা অভাবী বিক্রি করে ফেলেছে। সরকারী নীতির ফলেই আজ ৪০ লক্ষ পাটচাষি এবং এর সাথে যুক্ত ২.৫ লক্ষ জুট মিল শ্রমিকের জীবন-জীবিকা চরম সংকটের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে সংকটের কারণে পাট চাষের এলাকা কমলেও উৎপাদন বেড়েছে উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার ও বাঁচার তাগিদে পারিবারিক শ্রমের বর্ধিত ব্যবহারের সম্ভাব্য কারণ। ২০১০-১১ সালে ৫ লক্ষ ৮০ হাজার হেক্টরে চাষ হয়েছিল, ২০১৫-১৬ সালে ৫ লক্ষ ১৯ হাজার হেক্টরে নেমে আসে; অথচ উৎপাদন বেড়ে যায়। পাট এক প্রাকৃতিক তন্তু, যাকে পরিবেশ/মৃত্তিকা বান্ধব বলে গণ্য করা হয়। ইউনেস্কো খাদ্যদ্রব্য প্যাকেজিং-এ পাটজাত ব্যাগ ব্যবহারের জন্য কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। আমাদের দেশে জুট প্যাকেজিং মেটেরিয়াল আইন ১৯৮৭ চালু হয়েছিল; যাতে খাদ্যদ্রব্য-চিনির প্যাকেজিং-এর জন্য জুট ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক ছিল। এর ফলে পাট চাষি ও জুট মিল শ্রমিক উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা হতো, কিন্তু বর্তমানে কর্পোরেট-সিন্থেটিক লবির চাপে সেই আইন শিথিল করা হয়েছে, ফলে সামগ্রিকভাবেই পাট চাষ ও জুট শিল্প গভীর সংকটে পড়েছে। এছাড়া ফাটকাবাজ প্রোমোটার জুট মালিকদের মুনাফার স্বার্থে পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনে আধুনিকীকরণ-বৈচিত্রকরণ করছে না। এর পরিণতিতে শ্রমিক ছাঁটাই-মজুরি সংকোচন—অস্থায়ী কাজের তীব্র শোষনের মধ্যে জুট শ্রমিকরা রয়েছেন। তাই আগামীদিনে পাটচাষি ও জুটমিল শ্রমিকদের যৌথ আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের নীতি বদলের লড়াইকে তীব্র করে তোলার আহ্বান নেতৃবৃন্দ জানান।