আজকের দেশব্রতী : ২২ ডিসেম্বর ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-22-dec

State Conference aipwa

নারী তথা সমগ্র দেশের মানুষের গণতন্ত্রের উপর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট আক্রমণকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে, নারীর কর্মসংস্থান, সমানাধিকার, মর্যাদা, গণতন্ত্র ও নির্ভয় স্বাধীনতার লড়াইকে জোরদার করার বার্তা নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর কলকাতার মৌলালী যুবকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হল সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ১১ তম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন। রাজ্যের ১৩টি জেলা থেকে মধ‍্যবিত্ত গৃহবধু, শিক্ষিকা, গবেষক, ছাত্রী, গৃহ সহায়িকা, বিড়ি বাঁধা শ্রমিক, চা-শ্রমিক, তাঁত শিল্প কিংবা অঙ্গনওয়াড়ির কর্মী, আশা ও মিড-ডে মিল কর্মী, কৃষিমজুর নারীরা, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও সমাজের অনগ্রসর অংশের সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০ জন মহিলা প্রতিনিধি অংশ নেন। এসেছিলেন সমিতির প্রতিষ্ঠা লগ্নের সমকালীন নেত্রীগণ ও বর্তমান সময়ের নতুন লড়াকু শ্রমজীবী ও চিন্তাশীল প্রজন্ম। তেভাগা আন্দোলনের ৭৫তম বর্ষে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন উপলক্ষে কলকাতা শহরকে নামাঙ্কিত করা হয়েছিল শহীদ ‘অহল্যা মা’র নামে, সভাগৃহ উৎসর্গ করা হয় ফ্যাসিস্ট শক্তির হামলায় নিহত নির্ভীক সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের নামে, আর সমিতির লড়াকু রাজ্য নেত্রী কণা সরকারের নামে মঞ্চের নামকরণ করা হয়েছিল।

এমন একটি সময় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল যখন সারা দেশে ফ্যাসিবাদী শক্তি নারীদের উপর ব্যাপক মাত্রায় আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, আধুনিক বহুত্ববাদী সাংবিধানিক কাঠামোকে ধ্বংস করে এক প্রাচীনপন্থী, মনুবাদী, সংকীর্ণ হিন্দুরাষ্ট্র গড়তে চাইছে ওরা। একদিকে “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও” স্লোগান, অন্যদিকে সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বললে তাদের ওপর চরম হেনস্থা ও হামলা। বিলিকিস বানোর দলবদ্ধ ধর্ষণকারীদের মুক্তি দিয়ে সরকার প্রমাণ করে দিল দেশের নারীদের ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা দিতে তারা বিন্দুমাত্রও ভাবিত নন। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাসের দাম হাতের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় সংসার চালাতে মেয়েদের নাভিশ্বাস উঠছে। দেশে যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান নেই।

এদিকে এই রাজ্যেও আজ ৬০০ দিনের বেশি হবু শিক্ষকরা রাস্তায় বসে। চাকরি নিয়ে দুর্নীতিতে শিক্ষামন্ত্রী জেলে। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিডডেমিল কর্মীরা ন্যুনতম ভাতায় কাজ করছে। কেন্দ্ররাজ্যের টালবাহানায় ১০০ দিনের কাজের মজুরি নেই। রাজ্যে বাড়ছে ধর্ষণ ও নারীনির্যাতনের ঘটনা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হাঁসখালি, টিটাগড় সহ বেশ কিছু ধর্ষণ ঘটছে তৃণমূল দলের সদস্যদের দ্বারা। বধু নির্যাতনের শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ।

State Conference of AIPWA was completed

সম্মেলনের শুরুতে শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও পতাকা উত্তোলনের পর প্রতিনিধি সম্মেলনের পর্ব শুরু হয় মীরা চতুর্বেদির উদ্বোধনী সংগীতের মাধ্যমে। সৌমি জানা আমির আজিজের ‘সব মনে রাখা হবে’ কবিতার হুঁশিয়ারি ধ্বনিত করেন। সভাপতি মন্ডলী ও সহায়ক সঞ্চালক মন্ডলী গঠন হয়। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৃষ্ণা অধিকারী তাঁর ভাষণে বলেন, “নারীর বহু লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও স্বাধিকারকে কেড়ে নিয়ে মনুবাদী সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবার জন্য ফ্যাসিস্ট বিজেপি নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। নারী অর্ধেক আকাশ, তাই তাদেরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ফ্যাসিস্টরা সংবিধান প্রদত্ত আইনগুলোতে দলিত-বিরোধী ও নারী-বিরোধী পরিবর্তন আনছে। গরিব মহিলাদের মিথ্যে আর্থিক প্রলোভন দেখাচ্ছে। সমাজকে বিভাজিত করার জন্য ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। সিভিল কোর্ট, তিন তালাকের বিরোধিতার কথা বলে মনুবাদী সংস্কৃতির ঠান্ডা জল ছিটিয়ে মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের আগুনকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। নতুন প্রজন্মকে তাই আজ মনুবাদ-বিরোধী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। তাদের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি জানতে হবে, মার্কসবাদসহ অতীত ইতিহাসকে অধ্যয়ন ও অনুধাবন করতে হবে। মধ্যপন্থী সংগঠনগুলো ক্ষমতার প্রশ্নে বিজেপি-বিরোধী হলেও মহিলাদের দাবিয়ে রাখার প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে তাদের অবস্থানে কোনো পার্থক্য নেই। মহিলাদের জন্য এটা এক অন্ধকার যুগ হলেও মেয়েরা প্রতিবাদে জ্বলে উঠছেন। এনআরসির বিরুদ্ধে, হিজাবের বিরুদ্ধে মেয়েদের লাগাতার সাহসী লড়াই আমাদের অনুপ্রেরণা।”

সম্মেলনে আমন্ত্রিত সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরোর সদস্য কার্তিক পাল বলেন, আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততা চাই। অধিকারের প্রশ্নে রাস্তায় আন্দোলন চলছে। মহিলা সংগঠনে এসব উপাদান আগামীদিনে খুঁজতে হবে। গ্রামীণ শক্তির কথা মাথায় রেখে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহিলাদের ভূমিকার কথা ভাবতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে শুধু প্রতিবাদ সংহতিতে সীমাবদ্ধ থাকা নয়, পরিকল্পিত ও ধারাবাহিকভাবে সংগঠিত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সামাজিক শক্তি হয়ে উঠতে হবে।

Conference of Women's Association was completed with confidence

এরপর আইপোয়া রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্তর পেশ করা খসড়া প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে প্রতিনিধিরা প্রাণবন্ত আলোচনা করেন। উঠে আসে তাঁদের জীবনের, লড়াইয়ের নানা অভিজ্ঞতা। একজন একশো দিনের কাজে মেয়েদের উপর চাপ ও হেনস্থা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ন্যায্য পাওনা আদায়ের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। আধার লিংক ছাড়া রেশন মিলছে না। বয়স্কদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলছে না অনেক ক্ষেত্রে। এই সমস্যায় সমিতিকে পাশে থাকার পরামর্শ দেন জনৈকা প্রতিনিধি। চা বাগানে মজুরি বৈষম্য ও নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং আদিবাসী মহিলাদের হেনস্থা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তুলে ধরেন উত্তর বাংলার চা শ্রমিক সেমন্তী এক্কা। কলকাতার এক প্রতিনিধি বলেন যে নারী নির্যাতনের ধরন আজ আরও উগ্র হচ্ছে। সমাজে মূল্যবোধ পাল্টাচ্ছে বহিরঙ্গে। এই পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে মহিলা আন্দোলনের ধরনকেও পাল্টাতে হবে। একজন প্রতিনিধি রাস্তাঘাটে জল ও আলোর জন্য আন্দোলনে মহিলা সমিতিকে পাশে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন। মুর্শিদাবাদের এক প্রতিনিধি বলেন যে মহিলারা আজ প্রকল্পের কাজে বাড়ির বাইরে পা রেখেছে। আশা, মিড-ডে মিলের ডেপুটেশনে অংশ নিচ্ছে। এদের মধ্যে থেকে মহিলা সমিতি গড়ে তোলা প্রয়োজন বলেন তিনি। হুগলির এক প্রতিনিধি প্রতিবেদনে পরিবেশের তথা দূষণ সমস্যার উল্লেখ থাকা প্রয়োজন বলে মত দেন। গার্হস্থ হিংসা সমাজে সুনির্দিষ্টভাবে কিভাবে রয়েছে তার উল্লেখ থাকা প্রয়োজন মনে করেন তিনি। আরেকজন সাথী তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন যে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে মেধা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়ার পরও কর্মক্ষেত্রে অসম্মানিত হতে হয় শুধু ‘মহিলা’ বলে। প্রতিমুহূর্তে পুরুষ সহকর্মীদের কাছে নিজের পেশাগত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাওয়ার নিত্যদিনের লড়াইটা লড়তে হয় আজও মেয়েদের। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত কাজেও পিতৃতন্ত্র লিঙ্গ হিংসা ও নারীবিদ্বেষের মুখোমুখি হতে হয় প্রতিদিন। নদীয়ার এক প্রতিনিধি বিড়ি শ্রমিকদের সমস্যার আরো উল্লেখ দাবি করে জানান যে তিনি নিজে বিড়ি-শ্রমিক ছাড়াও অন্যান্য স্তরের মহিলাদের নিয়ে সমিতির কাজে অংশ নেন ও সমিতির প্রসারে সচেষ্ট হন। অন্য এক প্রতিনিধি জানান যে হস্তশিল্পী ও সুচি শিল্পে নিযুক্ত কর্মীদের অত্যন্ত কম মজুরি দেওয়া হয় অথচ সেসব সামগ্রী বিদেশে চড়া দামে রপ্তানি হয়। এদের নিয়ে আন্দোলনের দাবি রাখেন তিনি।

বর্ষীয়সী নেত্রী মীনা পাল সম্মেলনের আয়োজকদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রগতিশীল মহিলা সমিতির আত্মপ্রকাশের পটভূমি এবং এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস তুলে ধরেন। উত্তরসূরিদের তিনি সতর্ক করে দেন যে শুধু দাবি দাওয়ার আন্দোলনে আটকে থাকলে হবে না, সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে ব্যাপক মানুষকে সামিল করে এগোতে হবে।

এআইসিসিটিইউ-এর রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু বলেন, বিজেপির বুলডোজার রাজে শ্রম-কোড মহিলাদের নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শ্রমজীবী মহিলাদের সামাজিক মর্যাদার জন্য লড়তে হবে। আইসার রাজ্য সভাপতি নীলাশিস বসু মহিলা সম্মেলনকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। সভায় ৪৩ জন বক্তার মধ্যে ৩৬ জন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। এরপর বিদায়ী কমিটির সম্পাদিকা ইন্দ্রানী দত্ত জবাবী ভাষণে বলেন যে সারা দেশজুড়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মহিলা আন্দোলনের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে হবে।

সংযোজনী সহ খসড়া প্রতিবেদন সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ৭৩ জনের রাজ্য কাউন্সিল ও ২৯ জনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। কমরেড ইন্দ্রানী দত্ত রাজ্য সম্পাদিকা এবং কমরেড চৈতালি সেন সভানেত্রী হিসাবে ঘোষিত হন। এছাড়া কাজল দত্ত চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী ও মিতালী বিশ্বাস সহ-সম্পাদিকা এবং অর্চনা ঘটক, মমতা ঘোষ ও মলিনা বক্সি সহ সভানেত্রী হিসাবে ও কল্যাণী গোস্বামী কোষাধ‍্যক্ষ মনোনীত হন। নীতীশ রায় মীরা চতুর্বেদী এবং সুমেলী মোহলির গান সম্মেলনকে উদ্দীপ্ত করে। আন্তর্জাতিক সংগীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে।

Housing Scheme

১১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৪৮৮

প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় উল্লিখিত সংখ্যক বাড়ি তৈরির অনুমোদন এল অবশেষে। প্রায় আটমাস পরে এরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার কেন্দ্রীয় বরাদ্দের জট কাটল। বারবার দুর্নীতির জালে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়া রাজ্য সরকারকে বিপাকে ফেলতে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বিপুল সংখ্যক গৃহ নির্মানের কঠিন এক পরীক্ষায় রাজ্য সরকারকে ফেলে কেন্দ্র অনুমোদনের ছাড়পত্র দিল বেশ কিছু কন্টকিত শর্তের বিনিময়ে। অন্যতম প্রধান শর্ত হল, নিয়ম মেনে বাড়ির কাজ করতে হবে — না হলে ধার্য করা হবে জরিমানা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে বাড়ি পিছু করা হবে জরিমানা। আর, সেই জরিমানার টাকা কেটে নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের প্রশাসনিক তহবিল থেকে।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়া এখন সময়ের অপেক্ষায়। আর, বলাই বাহুল্য, ২০২৪’র সাধারণ নির্বাচনের আগে সামনের বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচন বিশেষ রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করছে। গ্রামাঞ্চলে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তারের জন্য তাই মোদী সরকার ঠিক এই সময়টাকেই বেছে নিল। ২৩ নভেম্বর পুরুলিয়ার লুধুড়কা গ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এক জনসভায় মিঠুন চক্রবর্তী প্রতিশ্রুতি দেন যে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের বাড়ি তৈরির টাকা দেবে। ঠিক তার পরের দিনই রাজ্যের কোষাগারে ঢুকে পড়ে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রকল্প অনুসারে, রাজ্য ও কেন্দ্র দেবে যথাক্রমে ৪০ ও ৬০ শতাংশ টাকা। সেই অনুসারে ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার বাড়ি তৈরির জন্য রাজ্য সরকার প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা বাবদ সেই টাকা পেয়েছে। তবে বাড়ির প্রাপকদের তালিকা ত্রুটি মুক্ত করতে রাজ্য সরকারই উপভোক্তা নির্বাচনে ১৫ দফা শর্ত আরোপ করেছে। বিভিন্ন সময়ে ওই শর্তগুলো মেনেই গরিব মানুষদের নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে আবাস প্লাস তথ্যভান্ডারে। প্রতিটি গ্রাম ধরে এই তথ্যভান্ডারে ৪৯ লাখ ২২ হাজার নাম নথিভুক্ত হয়েছে।

তৃণমূলের শাসনকালে রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছে দুর্নীতিই এই সরকারের শাসনতন্ত্র হয়ে উঠেছে। নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির দগদগে ঘা নিয়ে গোটা শিক্ষা দপ্তরই জেলখানায় বন্দি, যা এই রাজ্যে বিরল। একশ দিনের কাজে পুকুর চুরি, গ্রামাঞ্চলে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া তৃণমূলের ক্ষমতাসীন হোমড়া-চোমড়াদের কায়েমি স্বার্থান্বেষীর দল ও নিজেদের নাম ঢুকিয়ে নিয়েছে এই আবাস প্রকল্পে। আর কে না জানে, কাটমানি ছাড়া একটা প্রকল্পেরও সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়না। সিএজি রিপোর্টও দেখাল, কেন্দ্রীয় সরকারের আবাস প্রকল্পকে ‘বাংলার বাড়ি’ নাম দিয়ে মমতা সরকার যে কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তাতেও শেষ রক্ষা হল না। তাই এবার উপভোক্তাদের উপযুক্ততা যাচাই করতে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে। আর এই কাজটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। ২৩টি জেলাকে দৈনিক ২২ হাজার উপভোক্তার উপযুক্ততা যাচাই করে অযোগ্যদের বাদ দিতে হবে। দিনরাত এক করে ২৪ ঘণ্টা কাজ করলেও দৈনিক ২২ হাজার উপভোক্তার দাবি যাচাই করা খুবই কঠিন। এবার এই কাজে পঞ্চায়েত কর্মী, আশা কর্মী, সরকারি আধিকারিকদের যুক্ত করা হয়েছে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা হেনস্থার শিকার হয়েছেন, একজন আশাকর্মী আত্মঘাতীও হয়েছেন। যে আশাকর্মীদের নেই সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি, যাঁদের নেই ন্যূনতম মজুরি ও কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা, তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল অমানুষিক কাজের বোঝা পারিশ্রমিক ছাড়াই। পঞ্চায়েত সচিবকে মাথায় বসিয়ে গোটা কর্মকাণ্ডকে সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন ও পরিচালিত করতে তৈরি হয়েছে এক টাস্ক ফোর্স।

নির্বাচন বড় বালাই। আর তাই, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নিজ নিজ রাজনৈতিক স্বার্থে আবাস যোজনার প্রকল্পটি নামিয়ে আনল ভোট কুড়োনোর লক্ষ্যে। জনতার হিতৈষী সেজে। ইতিমধ্যেই রাজ্যের নানা প্রান্তে হানাহানি, প্রাণনাশের উদ্বেগজনক খবরাখবর আসছে। এই প্রকল্পের প্রতিযোগিতা রাজনৈতিক ময়দানে কিভাবে আছড়ে পরছে, তাই দেখার ভবিষ্যতে।

ignoring environment and public interest

গৌতম আদানি নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠতম পুঁজিপতি বলেই সুবিদিত। মোদী জমানায় জাঁকিয়ে বসা ক্রোনি ক্যাপিট্যালিজম বা স্যাঙাতি পুঁজিতন্ত্রের কেন্দ্রে থাকা পুঁজিপতিদেরও অন্যতম হলেন এই গৌতম আদানি। অর্থের প্রবল প্রতিপত্তি সম্পন্ন এই পুঁজিপতির কোনো প্রকল্পের অনুমোদন লাভের পথে সরকারি বিধিনিষেধ কি কোনো প্রতিবন্ধক হতে পারে? যদি তা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখাও দেয়, সেই অন্তরায়কে নস্যাৎ করে তার অপসারণ কি তাঁর কাছে অনায়াসসাধ্য হবে না? মধ্যপ্রদেশের সিংরউলি জেলার সুলিয়ারি কয়লা খনি প্রকল্পের অনুমোদন লাভের প্রক্রিয়া ছিল সরকারি বিধিনিষেধকে, পরিবেশকে বিপন্ন না করার বিধানকে খারিজ করার আদানির এরকমই এক আখ্যান যা আমরা এখানে বিধৃত করব।

এই খনির মালিকানা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা অন্ধ্রপ্রদেশ খনি উন্নয়ন কর্পোরেশনের হাতে থাকলেও এখন ঐ খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের অধিকারী আদানির মালিকানাধীন সংস্থা। খনি এলাকার বিস্তার ১২৯৮ হেক্টর জুড়ে যার মধ্যে বন অঞ্চল হলো ২৫৯ হেক্টর, কৃষি জমি ২৫২ হেক্টর, গ্ৰাম এলাকা ৫২ হেক্টর, জলাশয় ৪৬ হেক্টর ও বাকিটা ঊষর ভূমি। সংলগ্ন অঞ্চলে একাধিক নদী ও জলাশয়ও রয়েছে। এই প্রকল্পকে চালু করার আবেদন অনেক আগে কংগ্ৰেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জমানাতে হলেও সেই প্রক্রিয়া তখন গতিলাভ করতে পারেনি। আবার ইউপিএ জমানায় কয়লা ব্লক বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক রায়ে বন্টন হওয়া ২০৪টে কয়লা ব্লকের অনুমোদনকে বাতিল করে, যার মধ্যে সুলিয়ারি কয়লা খনিও ছিল। পরে অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে কয়লা খনিগুলোতে খননের অনুমোদন দেয় এবং সুলিয়ারি খনি কালক্রমে আদানির হস্তগত হয়।

মধ্যপ্রদেশের সিংরউলি জেলাতে বান্ধা ও বিরাউলি নামে দুটো কয়লা খনি থেকে শীঘ্রই কয়লা উত্তোলন শুরু হবে। এছাড়া, জেলায় চালু তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে ছাই নির্গমন এবং জমা হওয়া ছাই-এর আধার থেকে দূষিত পদার্থের বহির্গমনের জন্য এই জেলা “অত্যন্ত দূষিত” বলে চিহ্নিত। এই ধরনের বৈশিষ্ট্যের এক জেলায় কয়লা খননের অনুমোদন প্রদানে যে বিষয়গুলো বিবেচ্য হওয়া উচিৎ তা হল –খনির জন্য জমি অধিগ্রহণের ফলে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ, পরিবেশের সুরক্ষা, খনি এলাকা সংলগ্ন নদী ও অন্যান্য জলাশয়গুলোকে দূষণমুক্ত রাখা। এই সমস্ত বিষয়কে খতিয়ে দেখতেই কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটি (ইএসি) ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আদানি গোষ্ঠীকে খনি প্রকল্পের সামাজিক প্রভাব সংক্রান্ত মূল্যায়নের রিপোর্ট দিতে বলে। পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের বিবেচনায় ঐ রিপোর্টের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এরপর ২০২০ সালের ১৭ এপ্রিল বিশেষজ্ঞ কমিটি অর্থাৎ ইএসি-র বৈঠকে (কোভিড অতিমারির জন্য তখন লকডাউন চালু থাকায় বৈঠক হয়েছিল ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে) আদানিরা সামাজিক প্রভাবের সমীক্ষা রিপোর্টে শুধু জানায় – কত পরিবার উচ্ছেদ হবে তার সংখ্যা, সেই পরিবারগুলোর জাতভিত্তিক বিন্যাস, তাদের জীবিকা ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা। সেদিন কিন্তু আদানিদের কয়লা খনি, অর্থাৎ, সুলিয়ারি কয়লা খনি সম্পর্কে বিবেচনার কথা প্রাথমিকভাবে ইএসি-র এজেন্ডায় ছিল না। ইএসি-র সেদিনের বৈঠকের মিনিটসে উল্লেখ রয়েছে – “মন্ত্রক সেটি অতিরিক্ত বিচার্য বিষয় হিসাবে বিবেচনা করার অনুমোদন ইএসি-কে দেওয়ার পর ইএসি এই বিষয়টার বিবেচনা করছে। প্রস্তাবকে বিশদে খুঁটিয়ে দেখার সময় ইএসি সদস্যদের ছিল না।” অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রকই সেদিন আদানির প্রস্তাব নিয়ে বিবেচনার জন্য ইএসি-কে চাপ দেয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য যথেষ্ট সময় না থাকলেও ইএসি সেদিন প্রস্তাব করে – খনি এলাকার একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ ৪৬ হেক্টরে বিভিন্ন জলাশয় থাকায় নদীগুলোর সুরক্ষার জন্য এক সর্বাঙ্গীন পরিকল্পনা জরুরি হয়ে দেখা দিচ্ছে। ইএসি সেদিন আরো প্রস্তাব দেয়, হুরদুল নালার (যা এক নদীর শাখা) গতিপথকে ঘুরিয়ে দেওয়া এবং অন্যান্য জলাশয় ও জলাধারের ওপর খনন কার্যের প্রভাব কী হবে তা সমীক্ষার জন্য ইএসির এক সাব-কমিটি সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করবে।

এরপর ইএসি তাদের ২০২০র ৩০ জুনের বৈঠকে আদানিদের সুলিয়ারি খনি প্রকল্পের অনুমোদন নিয়ে আলোচনা চালায়। আদানিরা ইএসি-কে জানায়, হুরদুল নালার গতিপথকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করার শর্তসাপেক্ষ ছাড়পত্র তারা মধ্যপ্রদেশ সরকারের (এক বিজেপি শাসিত রাজ্য) জলসম্পদ বিভাগের কাছ থেকে পেয়েছে। ইএসি-র কাছে আদানিরা আরও প্রস্তাব দেয় – যেহেতু কোভিড অতিমারি চলছে, ইএসি যেন তাদের সাব-কমিটির সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শনের কর্মসূচিকে স্থগিত রাখে। এইভাবে, ইএসি-র কী করা উচিৎ তার পরামর্শ ইএসি-কে দিতেও আদানিরা দ্বিধা করে না! আদানিরা আরও জানায়, গোপাদ নদীর (যার সঙ্গে হুরদুল নালা মিশেছে) শাখা নদীগুলোর ওপর সুলিয়ারি খনি প্রকল্পের নিকাশী ব্যবস্থার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। যেটা  সাব-কমিটির এলাকা সরজমিনে পরিদর্শন করে নির্ধারণ করার কথা, আদানিরাই তার ফলাফল আগেভাগে জানিয়ে তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে বলে দেখা যাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, আদানিদের পেশ করা এই বক্তব্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন স্থগিত রেখে এবং সুলিয়ারি খনির নিকাশি ব্যবস্থা জলাশয়গুলোতে কোনো দূষণ সৃষ্টি করবে কী না তা পরখ না করেই ইএসি ‘এক বছরের জন্য’ সুলিয়ারি খনি প্রকল্পে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়। তার হঙ্গে কিছু শর্তও অবশ্যও জোড়ে, যার অন্যতম ছিল খনির কাজের জন্য হুরদুল নালার কোনো জল ব্যবহার করা যাবে না।

আদানির প্রকল্পের ওপর শর্ত চাপানোটাকে তাদের পক্ষে কতদূর মানা সম্ভব? আসরে নেমে গেল নরেন্দ্র মোদীর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক। ইএসি-র কাছে তাদের প্রশ্ন এল–পরিবেশ ছাড়পত্র ‘মাত্র এক বছরের জন্য’ দেওয়া হল কেন? আর, কোভিড অতিমারীর মধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন ও সমীক্ষার প্রয়োজনটাই বা কোথায়! ইএসি-র কাছে সংকেত সুস্পষ্ট হয়ে গেল। ২০২১-এর ২৬ ফেব্রুয়ারির তাদের বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত নিল – “আলাপ আলোচনার পর ইএসি মনে করছে যে, বাঁধ নির্মাণ ও বন্যা সুরক্ষা ব্যবস্থার যে প্রস্তাব খনি প্রকল্পের প্রস্তাবকরা করেছে তা সন্তোষজনক এবং এলাকা পরিদর্শনের শর্ত বাদ দিয়ে … সুলিয়ারি কয়লা খনি প্রকল্পে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের প্রস্তাব করা হচ্ছে।”

খনির জন্য জমি অধিগ্রহণের ফলে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সংখ্যা ১৩৮৬ বলে আদানিরা জানালেও প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে কিছুটা অতিরিক্ত, ১৫০০র বেশি। জমি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে এবং পরিবেশের ওপর খনি প্রকল্পের প্রভাব সম্পর্কিত রিপোর্টেও প্রান্তিক ও ক্ষতিগ্ৰস্ত জনগণ কি ধরনের সমস্যা ও সংকটের মুখে পড়ছেন তার কোনো বিস্তৃত আলোচনা নেই। খনিটা মধ্যপ্রদেশে আর উচ্ছেদ হওয়া জনগণের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের ভার মধ্যপ্রদেশ সরকারেরই। কিন্তু এই ব্যাপারে বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারের দায়বদ্ধতার নিদর্শন একেবারেই নিকৃষ্ট ও উপেক্ষার। খনির জন্য জমি অধিগৃহীত হয়েছে এমন একটা গ্ৰাম হল মাঝোলিপাথ। সেই গ্ৰামের এক যুবক সুমিত কুমার শাহ জানিয়েছেন, খনির জন্য তাঁদের জমি নিয়ে নেওয়া হয়েছে, তবে, “কোভিড অতিমারীর আগেই আমাদের বাড়ির সমীক্ষা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের বাড়ি নিয়ে নেওয়ার জন্য ক্ষতিপূরণ কখন দেওয়া হবে কোভিডের পর সে সম্পর্কে কোনো কথা শোনা যায়নি।”

অতএব, আদানিরা যা চেয়েছিল তাই হল। পরিবেশগত ছাড়পত্র তারা পেল, ‘শুধু এক বছরের জন্য’ নয়, স্থায়ীভাবেই। উচ্ছেদ হওয়া জনগণের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ অবহেলিত রইল। ‘অতি দূষণগ্ৰস্ত’ সিংরউলি জেলা সম্ভবত আরো দূষণের কবলে পড়ল। আর একটা প্রশ্নও বড় হয়ে মাথাচাড়া দিল। খনিতে কর্মসংস্থান হবে মাত্র ১১৫৭ জনের। তার জন্য পরিবেশকে দূষণের এত ঝুঁকির বধ্যে ঠেলে দেওয়া, এত পরিবারকে জমি-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলা, যথেষ্ট পরিমাণ বন ধ্বংস করা (ভারতের জাতীয় গ্ৰিন ট্রাইব্যুনালের ২০২২-এর মে মাসের রিপোর্ট জানাচ্ছে, ৫০০০০ গাছ কাটার কর্মযজ্ঞ অতি উৎসাহে শুরু হয়ে গেছে), বহু জলাশয়কে বিপন্ন করে তোলা–সুলিয়ারি খনির কয়লা খনন থেকে প্রাপ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক লাভ কি এই ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ হবে?

উড়িষ্যার সম্বলপুর জেলায় আদানি পরিচালিত তালাবিরা-১ কয়লা খনির কৃষিজমি ধ্বংস ও স্থানীয় স্তরে জলসরবরাহে দূষণ সৃষ্টির জন্য খনি পরিচালনার কোম্পানিকে ভালো পরিমাণ আর্থিক জরিমানা করা হয়েছিল এবং সুপ্রিম কোর্টও সেই জরিমানাকে বজায় রেখেছিল। ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ জেলার গোন্ডালপুরায় আদানি পরিচালিত প্রস্তাবিত কয়লা খনির জমি ও জীবিকা ধ্বংস, স্বাস্থ্য ও জলদূষণের অনিবার্য সম্ভাবনার বিরুদ্ধে স্থানীয় গ্ৰামগুলোর জনগণ প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আদানি পরিচালিত কোম্পানিগুলোর দূষণ সৃষ্টির এমন নজির থাকার কারণে সুলিয়ারি কয়লা খনির পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানে আরো সতর্কতা অবলম্বনই ন্যায়সংগত হতো। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর পরিচালনাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের কাছে নতিস্বীকার করে ইএসি-কে দূষণ নিরোধক ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার নিজেদের প্রস্তাবিত পদক্ষেপকে হিমঘরে পাঠিয়ে পরিবেশগত ছাড়পত্র দিতে হল, অবহেলিত হল পরিবেশ-সমাজ-জনগণের স্বার্থ। তবে, সরকার-পুঁজিপতি গাঁটছড়ার প্রতাপে কোথাও কি স্যাঙাতি স্বার্থের ওপরে দেশ-সমাজের স্বার্থ অগ্ৰাধিকার পেয়েছে?

– জয়দীপ মিত্র

Hindutva forces in Tamil Nadu

ওপর-ওপর দেখলে তামিলনাড়ু হল বিজেপির সবথেকে দুর্বল রাজ্যগুলোর অন্যতম যে রাজ্য থেকে লোকসভায় তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই আর রাজ্যে রয়েছে মাত্র চারজন বিধায়ক। এখানে দ্রাবিড় আন্দোলনের গভীর শিকড় ওপ্রগতিশীল সামাজিক মূল্যবোধ থাকার জন্য মনে করা হয়ে থাকে যে এই রাজ্য বিজেপি ও তার পশ্চাদমুখী হিন্দু আধিপত্যের মতাদর্শের কাছে দুর্ভেদ্য। তবে তামিলনাড়ুতে বিজেপির ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উপস্থিতি ও মতাদর্শগত প্রভাবকে উপেক্ষা করলে সেটা এক বড় ভুল হবে। উপদলীয়তায় জর্জরিত এআইএডিএমকে ও তামিলনাড়ুর অন্যান্য ডিএমকে-বিরোধী দলগুলোর ওপর ভর করে গেরুয়া শিবির বেশি আলোড়ন সৃষ্টি না করে কিন্তু দৃঢ়ভাবে এই রাজ্যে জায়গা করে নিচ্ছে।

রাজনৈতিক জোটের স্তরে নানান রকমফের প্রচেষ্টা ছাড়াও সংঘ বর্তমানে জোর দিচ্ছে বৈধতা অর্জন এবং তামিল সমাজের মতাদর্শগত পরিমণ্ডলকে পাল্টানোর ওপর। এই লক্ষ্যে তারা ভিওসি (ভি এম চিদাম্বরনার, যিনি ছিলেন কংগ্ৰেসের দৃঢ়চিত্ত নেতা যাঁর সঙ্গে গান্ধির মতপার্থক্য ছিল) এবং মহান লেখক ও স্বাধীনতা সংগ্ৰামী সুব্রমানিয়া ভারথিয়ারের মতো তামিল আইকনদের আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে। সংঘের অবশ্য সমস্যা রয়েছে পেরিয়ার ও তাঁর প্রগতিশীল ঐতিহ্যকে নিয়ে যা ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যুক্তিবাদকে জনপ্রিয় করেছিল, এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ ও পিতৃতান্ত্রিক বিধানের বিরুদ্ধে নারীর অধিকারের জন্য এবং মনুস্মৃতির নাগপাশের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায়কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল। যখন সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ যথেষ্ট শক্তিশালী ও নাছোড় প্রকৃতির ছিল সেই সময় তামিলনাড়ুই ছিল প্রথম রাজ্য যা এক বৃহৎ গণআন্দোলনের অংশ হিসাবে জাতের উপাধিকে বর্জন করেছিল।

বেশ কিছু বছর ধরে সামাজিক ন্যায় ও যুক্তিবাদ আন্দোলনের প্রখরতা হ্রাস পেতে থেকেছে এবং আরএসএস এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিয়ে তার পাল্টা বক্তব্যকে এনে পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করছে। তারা গণেশ পূজো ও ঐ ধরনের অন্যান্য উৎসব বাড়িয়ে চলেছে, তাদের এজেণ্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মন্দির কমিটিগুলোকে দখল ও ব্যবহার করছে, এবং উত্তর ভারতে রাম যেমন ঠিক তেমনি সমাবেশ ঘটানোর আবেগসঞ্চারী আইকন হিসাবে প্রাচীন তামিল দেবতা মুরুগানকে তুলে ধরছে। এই পাল্টা আখ্যান এবং তার সাথে আগ্ৰাসি সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংকে যুক্ত করা ও রাজনৈতিক জোট গড়াটা তামিলনাড়ুতে হিন্দুত্ব রাজনীতির বিকাশে আরএসএস’এর সূত্র বলে ধরে নেওয়া যায়। আরএসএস গান্ধী জয়ন্তিতে সারা তামিলনাড়ুতে মিছিল সংগঠিত করতে চেয়েছিল, কিন্তু রাজ্য সরকার আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনার গোয়েন্দা রিপোর্টের যুক্তিতে মিছিলের অনুমতি দিতে অস্বীকার করলে হাইকোর্ট ৬ নভেম্বর মিছিলের অনুমতি দিতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। প্রশাসন এমন তিনটে জেলার তিনটে স্থানে মিছিলের অনুমতি দেয় যেখানে আরএসএস’এর উপস্থিতি তেমন শক্তিশালী নয়, ২৪টা স্থানে মিছিলের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে এবং ২৩টা স্থানে ঘেরা জায়গায় মিছিলের অনুমতি দেয়। আদালতও লাঠি নিয়ে যাওয়া, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হলে তার দায় নিতে হওয়া, ইত্যাদির মতো কঠোর শর্ত নির্দিষ্ট করে। এই সমস্ত শর্তে হতাশ হয়ে আরএসএস এখন সুরাহার জন্য সুপ্রিম কোর্টে গেছে, আর ৬ নভেম্বর যে তিনটে স্থানে মিছিল বের করে সেগুলো আরএসএস’এর মানদণ্ডে তেমন উল্লেখযোগ্য হয়নি।

বিরোধী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলও এখন কিছুটা বিজেপির অনুকূলে। দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এড্ডাপাডি পালানিস্বামী এবং ও পনিরসিলভমের মধ্যে কাজিয়ায় এআইএডিএমকে অভ্যন্তরীন বিবাদে জর্জরিত। এর পরিণামে এআইডিএমকে নেতৃবৃন্দ যথাযত স্থান লাভের প্রত্যাশায় বিজেপির কাছে ভিড়ছে। মিডিয়ার একটা অংশের সমর্থনে বিজেপি এখন তামিলনাড়ুতে চোখে পড়ার মতো বিরোধী পক্ষের ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করছে। পিএমকে আবার উৎকৃষ্টতর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় বিজেপি-এআইএডিএমকে শিবিরের সঙ্গে লেগে থাকছে। ডিএমকে’র সঙ্গে জোট বেঁধে কয়েকটা বিধায়ক পাওয়া সত্ত্বেও শক্তিশালী রাজ্য নেতৃত্বের অভাবে কংগ্ৰেস শিবির এখন বিভাজিত। এই প্রেক্ষাপটে আরএসএস-বিজেপি তামিলনাড়ুতে কংগ্রেসের সামাজিক ভিত্তিকে নিজেদের পক্ষে আনার লক্ষ্যে চেষ্টা চালাচ্ছে। গান্ধিকে শ্রদ্ধা জানানোর নামে গান্ধী জয়ন্তিতে গোটা রাজ্যে ৫২টা স্থানে মিছিল সংগঠনের প্রয়াসও ছিল কংগ্ৰেসের উচ্চবর্ণ, ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ ভিত্তিতে হানা দেওয়ার একটা কৌশল। কয়েক দশকের তাদের প্রচেষ্টায় সংঘ-বিজেপি তামিলনাড়ুর দক্ষিণে সংখ্যায় ভারী ‘মাল্লার’ (আগে ছিল পাল্লার) নামে দলিতদের একটা ধনী অংশের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। বস্তুত, ঐ জাতের তথাকথিত রাজকীয় অতীতের কথা বলে কিছু দলিত সংগঠনকে তাদের জন্য সংরক্ষণ প্রত্যাখান করাতেও তারা সফল হয়েছিল। এটাও ঠিক যে মোদী সরকার এবং আগে এআইএডিএমকের রাজ্য সরকারও চতুর কৌশলে তফশিলি জাতের তালিকা থেকে সাতটা দলিত জাতকে বাদ না দিয়ে ঐ প্রক্রিয়াকে সহজসাধ্য করেছিল এবং তাদের ‘দেবেন্দ্রকুলা ভেলালার’ বর্গে একত্রিত করেছিল, যা ক্ষত্রিয় জাত থেকে উদ্ভবের দাবি করে দেবতা ইন্দ্রর সঙ্গে একাত্মতাকে বোঝায়। কন্যাকুমারি জেলায় ‘নাদারা’ নামক তামিল ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যেও সংঘের তাৎপর্যপূর্ণ ভিত্তি রয়েছে। এআইএডিএমকে’র সহায়তায় সংঘ-বিজেপি শিবির প্রভাবশালী ওবিসি জাত ‘গৌন্ডার’দের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করছে, যে জাতটা হলো পূর্বতন এআইএডিএমকে মুখ্যমন্ত্রী এড্ডপাডি পালানিস্বামীর জাত। বিজেপি এমএসএমই লোনের হাতিয়ারকে বেছেবেছে ব্যবহার করে গ্ৰামীণ এবং পশ্চিম তামিলনাড়ুর শহরাঞ্চলের উঠতি উদ্যোগপতিদের মধ্যে তাদের প্রভাবকে আঁটোসাটো করছে। এই অঞ্চলের সাফাই কর্মীদের জাত অরুণাদাথিয়ারসদের মধ্যে প্রভাব অর্জনের প্রণালীবদ্ধ প্রচেষ্টাও কিছু সুফল এনে দিয়েছে, তবে পশ্চিম তামিলনাড়ুতে ঐ দলকে এখনও অনেক উদ্যোগ নিতে হবে। মোদী মন্ত্রিসভায় বিজেপির পূর্বতন সভাপতি এল মুরুগানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ঐ জাতকে পক্ষে আনার লক্ষ্যে।

মোদী ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণকে এমনভাবে কাজে লাগাচ্ছেন যাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে তামিলনাড়ুতে বিজেপির হস্তক্ষেপ ও প্রভাবের বৃদ্ধি ঘটানো যায়। জিএসটি’র মাধ্যমে আর্থিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ওপর আক্রমণ থেকে নিট এবং ২০২০’র জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলা পর্যন্ত বিস্তৃত উদ্যোগ নিয়ে বিজেপি এই লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছে। নিয়োগ করা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্তাব্যক্তিদের প্রবল রাজনীতিকরণ ঘটানো হচ্ছে যাতে আরএসএস অনুগত অফিসারদের রাজ্যে বসানো যায়, এবং ন্যায়পরায়ণ অফিসারদের ফিরিয়ে নিয়ে কেন্দ্রীয় কাজে রাজ্যের বাইরে নিয়োগ করা হচ্ছে। রাজ্যপালও সাংবিধানিক অনুমোদনকে আটকে দিয়ে এবং সংস্কৃত আর নানান পশ্চাদমুখী হিন্দুত্ববাদী ধারণাগুলোতে মদত দিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের এজেন্ট হিসাবেই কাজ করছেন।

ডিএমকে সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয়তার রক্ষায় যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে, তবে কর্পোরেটদের তুষ্ট করার ব্যাপারে তারা বিজেপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রত হচ্ছে। হিন্দু পরিতুষ্টির লক্ষণও দেখা যাচ্ছে, যেমনটা দেখা যাচ্ছে অনেক বিরোধী দলের ক্ষেত্রেই। উদাহরণস্বরূপ, মন্দিরের জমি দখলমুক্ত করার নামে ভাড়াটেদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। দখলমুক্তির এই উদ্যোগ দরিদ্র এবং ক্ষমতাহীনদের বিরুদ্ধেও চালিত হচ্ছে আর ধনী এবং ক্ষমতাবানদের নানা উপায়ে রেহাই পাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। কোয়েম্বাটুর এবং নাগেরকয়েল জেলাতেও আমরা গেরুয়া অনুগত পুলিশ প্রশাসনকে দেখতে পাচ্ছি যেখানে গান্ধী স্মরণ দিবসে গডসের সমালোচনা করার জন্য প্রগতিবাদী ব্যক্তিদের আটক করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে দলিতদের ওপর আক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কথাও সুবিদিত। যে ডিএমকে সরকার তিন কৃষি আইনের বিরদ্ধে প্রস্তাব পাশ করেছিল তারা বিধানসভায় শ্রম বিধির বিরুদ্ধে একই ধরনের প্রস্তাব গ্ৰহণে অনিচ্ছুক।

ডিএমকে অবশ্য কিছু মাত্রায় কল্যানবাদকে যুক্ত করে তার কর্পোরেটপন্থী মডেলে ভারসাম্য আনতে চাইছে। তারা কিন্তু কল্যাণবাদকে কাজে লাগাচ্ছে বেসরকারিকরণ এবং নানা কর্পোরেটপন্থী পদক্ষেপের পক্ষে এক বীমা হিসাবে। ডিএমকে তার অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার করছে নয়া-উদারবাদের সঙ্গে কল্যাণবাদকে যুক্ত করে তাকে অর্থনীতির দ্রাবিড়িও মডেল বলে চালিয়ে, এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত করছে তার রাজনৈতিক আখ্যান যা আত্মমর্যাদা, সামাজিক ন্যায়, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা এবং রাজ্যের হাতে আরও ক্ষমতার কথা তুলে ধরে। তারা ৬৯ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকছে এবং জাতীয় শিক্ষানীতির মোকাবিলা করছে তাদের নিজস্ব শিক্ষা নীতি দিয়ে এবং সংস্কৃত ও হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিজেপির প্রচেষ্টার বিপরীতে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে। সামগ্ৰিক দৃষ্টিতে, ডিএমকে মোদী সরকার এবং তার ফ্যাসিবাদী আগ্ৰাসন ও আক্রমণাত্মক হিন্দু এজেন্ডার বিরুদ্ধে প্রতিরোধে অধিকাংশ আঞ্চলিক ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে আছে।

থোলাপ্পিয়ানের নেতৃত্বাধীন ভিদুথালাই চিরুথাইকাল কাচি দল (লিবারেশন প্যান্থার পার্টি, ভিসিকে), সিপিআই ও সিপিআই(এম) যারা ডিএমকে নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হিসাবে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, তারা রাজ্য সরকারে নেই। বিজেপির ফ্যাসিস্ট এজেন্ডার বিরুদ্ধে এখন প্রয়োজন বাম ও প্রগতিবাদী শিবিরের স্বাধীন ভূমিকাকে বাড়িয়ে তোলা এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং শ্রমজীবী জনগণের প্রয়োজন ও আকাঙ্খা পূরণে সক্রিয় হওয়ার জন্য ডিএমকে সরকারকে দায়বদ্ধ করা। সিপিআই(এমএল) এই লক্ষ্যে তার সংগঠনের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে ও বিভিন্ন ফ্রন্টে উদ্যোগকে বাড়িয়ে চলেছে এবং ভিসিকে, সিপিআই ও সিপিআই(এম) এবং তার সাথে নানান আম্বেদকরপন্থী ও পেরিয়ার অনুগামী ধারা, গণতান্ত্রিক শক্তি ও সংগ্ৰামের সহযোগিতা ও সমর্থন লাভে উদ্যোগী হচ্ছে।

– ভি শঙ্কর
(লিবারেশন ডিসেম্বর)

Dhanekhali riots in marches

আদিবাসী বর্গাদারদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা চলবে না। প্রোমোটার-প্রশাসনের অশুভ আঁতাত ধ্বংস হোক। গণআন্দোলনের নেতাদের ওপর মিথ্যা মামলা চাপিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা যায় না, যাবে না — শত কণ্ঠের এমনতর বলিষ্ঠ আওয়াজ, প্রতিবাদী জনতার রণধ্বনিতে যেন ফিরে আসছে সংগ্রামী বাংলার সেই চিরচেনা ছবি। স্থান- হুগলী জেলার ধনেখালি কলেজ মোড়। ১৪ ডিসেম্বর বিকেল ৩টে। তাঁতশিল্পের নাম জড়ানো ছোট্ট শহরের রাজপথ শত শত লাল পতাকার ঢেউয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে। দৃপ্ত এ মিছিলে অংশ নিয়েছেন খেতমজুর, গরিবচাষি, গ্রামীণ মেহনতিদের সাথে সাথে শহরের শ্রমিক, ছাত্র-যুব — এক কথায় সর্বস্তরের প্রতিবাদী মানুষ। মিছিলে সামিল দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আসা মানুষদের এক বড় অংশই ছিলেন মহিলা। পার্টির হুগলী জেলা কমিটির পরিচালনায় এই মিছিল রাজ্যের দুর্নীতিবাজ শাসকদের অন্যতম ঘাঁটি বলে পরিচিত ধনেখালির মাটিতে নিশ্চিতভাবেই নতুন সমীকরণের সূচনা ঘটালো।

বৃহৎ পুঁজি বা মালিক শ্রেণীর আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য মমতা ব্যানার্জী যেদিন রাজ্যে ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ তৈরির ঘোষণা করেন সেদিন থেকেই সরকারি বীজ খামার থেকে শুরু করে অবণ্টিত খাস জমি, বনাঞ্চলের সরকারী জমি — সবই বিভিন্ন ফাটকাবাজরা হাতিয়ে নিতে শুরু করে। গ্রাম বাংলার বহু জায়গায় খাস ও বর্গা জমি থেকে গরিবদের উচ্ছেদযজ্ঞ শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে ছোট ছোট প্রতিবাদও জায়গায় জায়গায় সংগঠিত হতে দেখা যায়। আর এই প্রতিবাদ অবশেষে প্রতিরোধের রূপ নেয় ধনেখালির মাটিতে। প্রায় বছর খানেক আগে ধনেখালির যদুপুর গ্রামে প্রোমোটারচক্র টাকার লোভ দেখিয়ে আদিবাসী বর্গাদারদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য আসরে নামে। গরিব বর্গাদারদের কয়েকজন জমির দাবি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও রাসমণি মুর্মু, সিদ্ধেশ্বর মুর্মুদের মতো কয়েকজন বর্গা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। পার্টির ধনেখালি লোকাল কমিটি কৃষিমজুর সমিতি এবং আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চকে সামিল করে বর্গা জমি রক্ষার আন্দোলনের পাশে দাঁড়ায়।

গত মরশুমে আমন ধান রোয়ার সময় রাসমণি মুর্মুর ওপর প্রোমোটার চক্র প্রাণঘাতী হামলা চালায়। স্থানীয় পুলিশ রাসমণিদের সুরক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে প্রোমোটারদেরই মদত দেয়। পার্টির প্রচেষ্টায় আদালতে আদিবাসী নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়। কিন্তু অনমনীয় প্রোমোটাররা স্থানীয় পুলিশ ও ভূমি দপ্তরকে প্রভাবিত করতে থাকে। ‘ওয়ারিশন বর্গার’ কিছু ফাঁক ফোকরকে কাজে লাগানোর বিস্তর অপচেষ্টা চলতে থাকে। পার্টির পক্ষ থেকেও জেলা ভূমি সংস্কার আধিকারিক, পুলিশ সুপার (গ্রামীণ)-এর দপ্তরে বার বার ডেপুটেশন দেওয়া হয়। উজ্জীবিত বর্গাদারদের অন্যতম রাসমণি মুর্মু গত ১৪ নভেম্বর বর্গা জমির ধান কেটে তাঁর খামারে নিয়ে যান। ক্ষিপ্ত প্রোমোটাররা রাসমণি সহ কয়েকজনের নামে চুরি, অস্ত্র নিয়ে হামলা ইত্যাদি অভিযোগ এনে এফআইআর করে। এই মিথ্যা মামলায় পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য তথা সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির (আয়ারলা) রাজ্য সম্পাদক সজল অধিকারীকেও জড়িয়ে দেওয়া হয়। পার্টির হুগলী জেলা কমিটির উদ্যোগে দ্রুততার সঙ্গে ধনেখালি থানা, এসপি (গ্রামীণ), জেলা ভূমি সংস্কার দপ্তর, আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর ও মহকুমা শাসকের (সদর) নিকট জোরদার ডেপুটেশন দেওয়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতির দাবি ছিল আরও বেশি কর্ম উদ্যোগের। যে মাটিতে জমিচোর লুটেরাদের তান্ডব চলছে সেই ধনেখালির মাটিতেই জমির আন্দোলনকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবা সম্ভব ছিল না। যেভাবে জেলা জুড়ে খাস ও বর্গা জমি থেকে গরিব মানুষ উচ্ছেদ হচ্ছেন তাকে অন্তত একটা জায়গায় রুখে দেওয়া প্রয়োজন।

Dhanekhali riots in marches, protests

এই লক্ষ্যে জেলা জুড়ে সমগ্র পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে ধনেখালি অভিযানের ডাক দেওয়া হয়। কোনও সন্দেহ নেই, কনকনে ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে শয়ে শয়ে গ্রামীণ গরিবদের পাশাপাশি শহরাঞ্চলের শ্রমিক ও নওজোয়ানরাও মিছিলে সামিল হয়ে ধনেখালির মাটিতে সঞ্চার করলেন গণআন্দোলনের এক নতুন উত্তাপ। যে কারণে কলেজমোড় থেকে শুরু হওয়া মিছিল বিএল এন্ড এলআরও দপ্তরের সামনে এসে এক জনবিষ্ফোরণে ফেটে পড়ে। সমাবেশের জঙ্গী মেজাজ দেখে ধনেখালির ভূমি দপ্তরের আধিকারিকরা এবার আর কোনও ভুল করেন না। সজল অধিকারীর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল ভূমি দপ্তরে প্রবেশ করলে বিএলএলআরও তাঁদের স্বাগত জানান। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, মৃত বর্গাদারের বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে রাসমণি মুর্মু, সিদ্ধেশ্বর মুর্মুদের নাম অবিলম্বে নথিভুক্ত করা হবে। তিনি অন্যান্য বর্গাদার ও খাস জমি বিষয়ক আরো কিছু সমস্যারও দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন। সমাবেশ থেকে তপন বটব্যালের নেতৃত্বে আর এক প্রতিনিধিদল ধনেখালি বিডিওর সাথে সাক্ষাৎ করে। সেখানে প্রোমোটার-পুলিশ আঁতাতের বিরুদ্ধে এবং গরিব আদিবাসীদের সুরক্ষার প্রশ্নকে জোরের সাথে তুলে ধরা হয়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সমাবেশ এবং এই গণডেপুটেশনের সফলতার বার্তা ধনেখালি ছাড়িয়ে জেলার এক বৃহত্তর অংশে নিশ্চিতভাবেই ছড়িয়ে পড়বে। বয়ে আনবে সাফল্যের আরো আরো নতুন সংবাদ।

deprived people

নিয়োগ দুর্নীতি, ১০০ দিনের কাজে দুর্নীতির পাশাপাশি আবাস দুর্নীতি! যা নিয়ে এখন গোটা গ্রামবাংলা উত্তাল। সম্প্রতি প্রকাশিত আবাস যোজনা তালিকায় দেখা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের নাম রয়েছে যাদের আছে পাকা বাড়ি, এমন কী তালিকায় একই বাড়ির একাধিক নাম রয়েছে। বিপরীতে এমন বহু সংখ্যক গরিব মানুষের নাম নেই যারা প্রকৃতই ঘর পাওয়ার যোগ্য। মাটির ঘর ভেঙ্গে পড়েছে এমন বহু মানুষ বঞ্চিত। কী করে এমন তালিকা তৈরি হল? ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শাসক তৃণমূলের তৈরি করা এই তালিকায় সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মালদা থেকে পুরুলিয়া মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ ফেটে পড়ছে। যাদের নাম নেই তারা দলে দলে ব্লক অফিসে গিয়ে সরকারের দুয়ারে হাজির হচ্ছেন। কিন্তু তাদের জানানো হচ্ছে নতুন নাম যুক্ত করা যাবে না। তিন দফায় তদন্ত করা হবে, অযোগ্যদের নাম বাদ দেওয়া হবে। এই প্রথমবার বিনা পারিশ্রমিকে গ্রামীণ মহিলা প্রকল্পকর্মীদের আবাস তালিকার তদন্ত অনুসন্ধানের কাজে লাগানো হয়েছে। বলা হচ্ছে দলীয় প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ তদন্ত হবে। কিন্তু সমীক্ষাকারী মহিলারা শাসকদলের চাপ হুমকী এমন কী শারীরিক নিগ্রহের সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেকেই মাঝপথে সমীক্ষা ছেড়ে দিয়ে ব্লক দপ্তরে কাগজ জমা দিয়ে আসছেন। অর্থাৎ তৃণমূলের মাতব্বরি দলবাজি ঘুষের কারবার পঞ্চায়েত ভোটের আগে ওদের কায়েমী স্বার্থান্বেষী নেতাদের বড়ো অবলম্বন হয়ে উঠেছে।

কিন্তু এই দুর্নীতির সমাধান কোথায়? যে যায় লঙ্কায় সেটাই কি আমাদের ভবিতব্য? দুর্নীতি প্রশমনে মোক্ষম দাওয়াই হলো গণতদারকী। মানুষের চোখের সামনে সমস্ত তথ্য খোলাখুলি রাখলে দুর্নীতি কিছুটা হলেও কমতে বাধ্য। এ কারণেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে গ্রামসভার আয়োজন করা, মতামত গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক হয়েছিল৷ কিন্তু শাসক তৃণমূল একে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দলতন্ত্র কয়েম করেছে। আবাস প্লাস তালিকা প্রকাশের পর রাজ্য পঞ্চায়েত দপ্তর এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল যে তিন স্তরে তদন্তর পর বাছাই করা তালিকা গ্রামসভায় রেখে অনুমোদন নিতে হবে। আইনত গ্রামের ভোটার সংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশ উপস্থিত হলেই চলবে। কিন্তু বেশ কয়েকটি জেলায় এ জাতীয় গ্রামসভায় তুমুল হট্টগোল শুরু হয়। শেষে পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়৷ তালিকায় থাকা নাম দেখে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাই তাড়াতাড়ি নতুন নির্দেশিকা জারি করে বলা হয়, গ্রামসভা নয়, পুলিশই নাকি তদন্ত অনুসন্ধানের কাজ করে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেবে! বলা বাহুল্য এভাবে দলতন্ত্রর হাত ধরে আমলাতন্ত্রকে আরও শক্তপোক্ত করা হল। পুলিশী ব্যবস্থাই এখন তৃণমূলের গণতন্ত্র হয়ে উঠেছে। কথায় কথায় বিরোধীদের মিথ্যা মামলায় পুলিশী হয়রানি করা চলছে।

এই প্রেক্ষাপটে ১৯ ডিসেম্বর নদীয়া জেলার ধুবুলিয়ায় ব্লক দপ্তরে পার্টি ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিরা ডেপুটেশন সংগঠিত করেন। পার্টির পক্ষ থেকে আবাসের সংশোধিত তালিকা সরবরাহের দাবি জানালে বিডিও সেটা দিতে অস্বীকার করলেন। অথচ তিনি জানালেন পঞ্চায়েত অফিসে নাকি সেই তালিকা টাঙ্গিয়ে দেওয়া হবে। তাহলে সেটি হাতে দিতে অসুবিধা কোথায়? প্রশাসন নিরুত্তর! নতুন করে তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবি জানালে বলা হয় নতুন দরখাস্ত জমা দেওয়া যাবে, কিন্তু বাক্সে ফেলে দিতে হবে, কোনও প্রাপ্তি স্বীকার করা হবে না। অর্থাৎ পুরোটাই লোক দেখানো বিষয়। এই অবস্থায় আগামীতে আবাসের অধিকারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন পার্টির ধুবুলিয়া এরিয়া কমিটি সদস্য আনসারুল হক, অমিত মন্ডল, সাইদুল মোল্লা, আব্বাস সেখ প্রমূখ।

Murshidabad District

১৫ ডিসেম্বর ২০২২ সিপিআই(এমএল) লিবারেশন মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির পক্ষ থেকে জেলাশাসক অভিযানেরর জমায়েত করে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করা হয়। ৬ই ডিসেম্বর বেলডাঙ্গা পৌরসভা অফিসের সামনে সভা করে জেলা জুড়ে জ্যাঠা কর্মসূচি উদ্বোধন করা হয়। এই উদ্বোধনী সভায় প্রথমে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন গণসংস্কৃতি পরিষদের বাবুনী মজুমদার। বক্তব্য রাখেন জেলা সম্পাদক রাজীব রায় ও জেলাকমিটি সদস্য আবুল কাসেম সেখ। উপস্থিত ছিলেন জেলা কমিটির অন্যান্য সদস্য ও রাজ্য কমিটি সদস্য সজল পাল। তারপর পতাকা ব্যানার সুসজ্জিত জ্যাঠা পায়ে হেঁটে বেলডাঙ্গা শহর পরিক্রমা করে এগিয়ে চলে। দাবি উঠে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপুর্ণ করতে হবে। আবাস যোজনার তালিকায় সমস্ত গরিব মানুষের নাম যুক্ত করতে হবে। MGNRREGA আইন অনুযায়ী সমস্ত গরিবদের কাজ দিতে হবে। বছরে ২০০ দিন কাজ ও ৬০০ টাকা দৈনিক মজুরি দিতে হবে।

বর্তমানে আবাস যোজনার ঘর নিয়ে ব্যাপক চর্চা চলছে। আবাস যোজনার তালিকা নিয়ে চাপান-উতর চলছে। রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ প্রতিবাদ এবং আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে চলেছে। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নাম বাদ দেওয়ার জন্য সমীক্ষা চলছে। তার মানে এই তালিকা তৈরির সময়ও লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে গরিবদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। যেসব গরিবদের বাস্তু ও ঘর নেই এবং তালিকায় নাম নেই তাদের নাম যুক্ত করার এবং যেসব কর্মচারী এই ভুয়া তালিকা তৈরি করেছে তাদের শাস্তি দেওয়ার কোনও বিধান সরকারী কর্মসূচিতে নেই। জেলার ১৩টা ব্লক জুড়ে বিভিন্ন গ্রামে এই প্রচার পরিক্রমা করে ১২ই ডিসেম্বর বহরমপুরে সমাপ্ত হয়। এই প্রচার অভিযানের বিভিন্ন দিনে, পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতারা অংশগ্রহণ করেন। জয়তু দেশমুখ, রণজয় সেনগুপ্ত, জীবন কবিরাজ ও নিতিশ রায় অংশগ্রহণ করেন। ১৫ ডিসেম্বর জেলার বিভিন্ন ব্লক থেকে বহরমপুর শহরের YMA মাঠে জমায়েত হয়ে সহস্রাধিক মানুষের লাল পতাকায় সুসজ্জিত মিছিল সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক রাজীব রায়ের নেতৃত্বে বহরমপুর শহর পরিক্রমা করে বেলা ২টার সময় টেক্সটাইল মোড়ের সভায় উপস্থিত হন। মিছিলের সামনে সারিতে ছিলেন অপুর্ব লাহিড়ী, রবি মন্ডল, হায়দার সেখ, সৈয়দ ফজলে আলম, বাসুদেব বোস ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন মিড-ডে-মিল, আশাকর্মী, অঙ্গওয়ারী, বিড়ি শ্রমিক, ঋণগ্রস্থ ও গ্রামীণ কৃষিমজুর পরিবারের মহিলারা। সভার শুরুতে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন বাবুনি মজুমদার। সভাপতি নির্বাচিত হন জেলা সম্পাদক রাজীব রায়। বক্তব্য রাখেন হায়দার সেখ, আবুল কাসেম সেখ, মীনা পাল ও বাসুদেব বোস। অপুর্ব লাহিড়ীর নেতৃত্বে ৫ জনের টিম জেলা শাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দেয় এবং আলোচনা করে। দাবি নিয়ে আলোচনার বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর সভা সমাপ্ত হয়। গরিবদের বাস্তু ঘর, MGNREGA আইন অনুযায়ী কাজ, বছরে ২০০ দিন কাজ ৬০০ টাকা দৈনিক মজুরি, মিড-ডে-মিল কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি ও সামাজিক সুরক্ষা, আশা-অঙ্গনওয়ারী কর্মীদের চাকরী স্বীকৃতি, ফসলের দাম MSP চালুকরা, পাটের দাম ৮০০০ টাকা কুইন্টাল দরে সরকারকে ক্রয় করা, বিড়ি শ্রমিকদের সুরক্ষা ঋণ মুক্তি সহ আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপুর্ণ করার দাবিতে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।

retired CTC employees

সিটিসি-র শতাধিক কর্মী অবসর নেওয়ার পর (২০১৭ সালের এপ্রিল মাসের পর থেকে) শ্রমিক সমবায়ে তাঁদের নিজেদের গচ্ছিত টাকা ফেরত পাননি। বহু অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা পেনশনও পান না। ফলে তাঁরা অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এদিকে শ্রমিকদের টাকা কোথায় গেল তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এই আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত দাবি করছেন সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা।

এআইসিসিটিইউ সংগঠনের পক্ষ থেকে ২১ ডিসেম্বর সিটিসি-র অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের শ্রমিক সমবায়ের টাকা প্রদান, পেনসন চালু করা এবং অস্থায়ী, ঠিকা প্রথা বাতিল করে ওড়িশা সরকারের ন্যায় সকল কর্মীদের স্থায়ীকরণ, ত্রিপাক্ষিক চুক্তি কার্যকরী করা ও ছাঁটাই কর্মীদের কাজে পুনর্বহালের দাবিতে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপো গেটে বিক্ষোভ অবস্থান এবং ডেপুটেশন কর্মসূচি করা হয়। প্রায় তিন শতাধিক কর্মী সভায় অংশগ্রহণ করেন।

সমবায়ের চেয়ারম্যানকে এবং পার্সোনেল অফিসারকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন এআইসিটিইউ নেতা দিবাকর ভট্টাচার্য, বাসুদেব বসু সিটিসি ইউনিয়ন নেতা গৌরাঙ্গ সেন, পেনসন এসোসিয়েশনের নেতা মধুসূদন চক্রবর্তী প্রমুখ।

Death of jute workers

সময় মতো চিকিৎসা না পেয়ে ১৭ ডিসেম্বর বজবজ জুট মিলের কর্মক্ষম শ্রমিক অভিজিৎ ধাড়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

জুট শিল্পের কর্তৃপক্ষ জুট শ্রমিকদের ওপর বহুবিধ অত্যাচার চালাতে চালাতে এতদূর পৌঁছেছে যে মুমূর্ষু রোগীর জীবন নিয়েও অবহেলা করার সাহস দেখাতে পিছুপা হল না। বুধবার পেটের ব্যথা নিয়ে বজবজ ইএসআই হাসপাতাল গেলে বৃহস্পতিবার মেডিসিনে চিকিৎসা হওয়ার কথা, কিন্ত ইএসআই কর্তৃপক্ষ রোগীর পরিবারকে জানায় চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট টাকা জমা নেই তাই চিকিৎসা করা যাবে না। অথচ অভিজিৎ-র বেতন শ্লিপে ইসএসআই-র জন্য কাটা টাকা যথেষ্ট পরিমাণ জমা আছে বলে পরিবারের মানুষ জানালেন। আনুমানিক ১২/১৩ ঘণ্টা বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ঘুরে যখন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বজবজ জুট মিলের মতো চালু একটি মিলের ইএসআই-র নথিভুক্ত শ্রমিকদের টাকা কেন নিয়মিত জমা পরছে না, তা দেখার জন্য ইএসআই-র কর্তৃপক্ষের কোনও দায় যেন নেই। শ্রমিকদের অভিযোগ ম্যানেজমেন্ট — ইএসআই বাবদ নিয়মিত টাকা কাটে কিন্তু তা জমা দেয় না। ইএসআই ও মিল কর্তৃপক্ষের মধ্যে অশুভ গোপন আঁতাতের ফলে কোনও শ্রমিক অসুস্থ হলে সেই শ্রমিকের কাটা টাকা তৎক্ষনাত ইএসআই-তে পাঠিয়ে দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। অভিজিৎ ধাড়ার ক্ষেত্রে এই বোঝাবুঝিটা সময় মতো গড়ে উঠতে পারিনি বলেই মনে হয় এবং তাই আসল ঘটনা জনসমক্ষে চলে এসেছে। ম্যানেজমেন্ট মৃত শ্রমিকের পাশে না থাকলেও সহ কর্মী, পাড়া প্রতিবেশীরা পাশে ছিলেন। তারা সবাই ক্ষোভে ফেটে পড়েন। লিখিত অভিযোগ থানায়, মিলের কর্তৃপক্ষ, ইএসআই-তে জমা দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকরা গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে।

এখন দেখার কর্তৃপক্ষ মৃত জুট শ্রমিক অভিজিৎ ধাড়া-র পরিবারের জন্য কী ন্যায্য অধিকার পাইয়ে দেয়। ইউনিয়ন নেতৃত্বই বা কী ভূমিকা পালন করেন। এআইসিসিটিইউ দাবি করেছে, দোষী উভয় কর্তৃপক্ষকে শাস্তি দিতে হবে, ক্ষতিপূরণ হিসাবে ইএসআই ও মিল কর্তৃপক্ষ — এই দু-তরফ থেকে ১০ লক্ষ টাকা করে মোট ২০ লক্ষ টাকা মৃত শ্রমিক পরিবারকে প্রদান করতে হবে।

Railway Workers

এআইসিসিটিইউ অনুমদিত রেলওয়ে কর্মচারীদের ফেডারেশন, ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের তৃতীয় জাতীয় সম্মেলন শেষ হল। সম্মেলনে মোট ৬৫ জন কার্যনির্বাহী ও ৪০ জন পদাধিকারী নির্বাচিত হন। ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের তৃতীয় দু’দিনের কনভেনশন ধানবাদে (ঝাড়খণ্ড) ১১ এবং ১২ ডিসেম্বর ২০২২ অনুষ্ঠিত হয়, যাতে রেলের ১৫টি জোনের কয়েকশ কর্মী অংশ নিয়েছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে, ভারতীয় রেলে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ফেডারেশন হল একমাত্র সংগঠন যা ভারত সরকারের কর্মচারী বিরোধী এবং জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পুরাতন পেনশন পুনরুদ্ধার, রেলওয়ে থেকে অ্যাক্ট অ্যাপ্রেন্টিস পাস যুবকদের রেলওয়েতে নিয়োগ, রেলে বেসরকারিকরণ/কর্পোরেটাইজেশন ষড়যন্ত্র অবিলম্বে নিষিদ্ধ, শ্রমকোডের বিলুপ্তি ও শ্রম আইনের বহাল, শূন্য পদে অবিলম্বে নতুন নিয়োগ প্রভৃতি গুরুতর দাবির বিষয়ে। রেলওয়ের সরকারি মান্যতা প্রাপ্ত ফেডারেশনগুলোকে বাদ দিয়ে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ফেডারেশন একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করেছে। ভারতীয় রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের এই অধিবেশনে, সর্বজিৎ সিং জাতীয় সাধারণ সম্পাদক এবং মনোজ পান্ডে জাতীয় সভাপতি হিসাবে পুনঃনির্বাচিত হন।

এই কনভেনশনে নতুন পেনশন প্রকল্পের আওতায় আসা কর্মচারীরা, রেলওয়েতে ফ্রন্ট এগেইনস্ট এনপিএস’এর জাতীয় নেতাসহ ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হন। ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী সভাপতি হিসেবে অমরিক সিং সভাপতি এবং ফ্রন্টের জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রাজেন্দ্র পাল ফেডারেশনের অতিরিক্ত সম্পাদক নির্বাচিত হন। এছাড়াও, নতুন পেনশন প্রকল্পের বিরুদ্ধে লড়াই করা অনেক কর্মচারী সহকর্মী ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হয়েছেন। ভারতীয় রেলওয়ে কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সর্বজিৎ সিং এবং সভাপতি মনোজ পান্ডে বলেছেন যে ভারতীয় রেলে বিভিন্ন ধরনের চাকরি রয়েছে। কাজগুলি বিভিন্ন কর্মচারী এবং বিভিন্ন সেক্টর/বিভাগ দ্বারা সম্পন্ন করা হয়, যারমধ্যে কর্মচারীরা দিনরাত বিভিন্ন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়, এটি ছাড়াও, ভারত সরকারের কর্মচারী বিরোধী এবং দেশবিরোধী নীতির কারণে, নির্বিচার আউটসোর্সিং, কর্পোরেটাইজেশন/বেসরকারিকরণ, চুক্তি প্রথা, পিপিপি, এফডিআই ইত্যাদি প্রচার করা হচ্ছে, যার কারণে ভারতীয় রেলের দুর্দশা আরও বেড়ে যাচ্ছে। এই নীতিগুলির মোকাবেলায়, ভারতীয় রেলওয়ে কর্মচারী ফেডারেশন রেলকে বাঁচাতে এবং রেলওয়ের কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর এবং সর্বদা সংগ্রামের পথে রয়েছে।

National Conference of Railway Workers

সর্বজিৎ সিং বলেন, ভারতীয় রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ফেডারেশন রেলওয়ে কর্মচারীদের মধ্যে একটি বিকল্প ফেডারেশন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে এবং আমরা কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য যেকোনো মাত্রায় সংগ্রাম করব। ন্যাশনাল মুভমেন্ট ফর ওল্ড পেনশন স্কিমের জাতীয় সভাপতি মাননীয় বিজয় কুমার বন্ধু এবং রেলওয়েতে এনপিএসের বিরুদ্ধে ফ্রন্টের জাতীয় সভাপতি। অমরিক সিং যৌথভাবে বলেন, ২০১২ সালে রেল কোচ ফ্যাক্টরি, কাপুরথালার জমি থেকে পুরনো পেনশন পুনরুদ্ধারের লড়াই শুরু হয়েছিল, আজ সারা দেশে রেলওয়েতে NMOPS এবং FANPS’এর নেতৃত্বে তা শেষের দিকে এগোচ্ছে। এই অতুলনীয় সংগ্রামের কাছে আত্মসমর্পন করা পাঁচ রাজ্যের সরকার পুরনো পেনশন ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। নেতৃবৃন্দ বলেন, আগামী লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত গোটা দেশে পুরনো পেনশন পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রেখে সংগ্রামকে আরও জোরদার করতে হবে, যারজন্য রেলের প্রতিটি কর্মচারীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে, কারণ লড়াকু ও পরিবর্তনকামী সংগঠন ভিন্ন অন্য সংগঠন এই সংগ্রাম লড়তেও পারবে না জয়ীও হবে না।

অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফট্রেড ইউনিয়নের জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রাজীব ডিমরী, যিনি বিশেষ অতিথি হিসেবে অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন, নবনির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটির ভাষণে বলেন যে ভারতীয় রেলওয়ে কর্মচারী ফেডারেশনকে সামনের সারিতে লড়াই করতে হবে, হতাশা দূর করে। বাগোদরের (ঝাড়খণ্ড) বিধায়ক বিনোদ কুমার সিং, যিনি প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন, ভারত সরকারকে জনবিরোধী এবং দেশবিরোধী বলে সমালোচনা করেন। তিনি কর্পোরেটপন্থী নীতির উন্মোচন করেন এবং এর বিরুদ্ধে সারাদেশের শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ইন্ডিয়ান রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়ন, সাউথ সেন্ট্রাল রেলওয়ে সেকেন্দ্রাবাদ, আরসিএফ এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন কাপুরথালা, ডিএলডব্লিউ রেল মজদুর ইউনিয়ন বারাণসী, আরসিএফ এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন রায়বেরেলি, সিএলডব্লিউ এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন চিত্তরঞ্জন, ইস্ট কোস্ট রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন ভুবনেশ্বর, ডিএমডব্লিউ কর্মচারী ইউনিয়ন, উত্তর-মধ্য রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন প্রয়াগরাজ, নর্থ ইস্টার্ন রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন গোরখপুর, পশ্চিম-মধ্য রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন জবলপুর, পূর্ব-মধ্য রেলওয়ে কর্মচারী ইউনিয়ন হাজিপুর, নর্দান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন নয়াদিল্লি, ইস্টার্ন রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন কলকাতা, দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়ন কলকাতা, ভারতীয় রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে জয়পুর জোন যোগ দেন।

All India Kisan Mahasabha

সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন দেশের গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্নে বড়ো ভূমিকা নিয়েছে। আগামীদিনে ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী হামলা প্রতিরোধে সেটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে। এই পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে মহারাষ্ট্রের পুনেতে সম্পন্ন হ'ল কিষাণ মহাসভার জাতীয় কার্যকরী সমিতির বৈঠক। গত অক্টোবরের শেষে বিক্রমগঞ্জে কিষাণ মহাসভার (এআইকেএম) ৭ম জাতীয় সম্মেলনের পর ১৯-২০ ডিসেম্বর পুনে শহরে অনুষ্ঠিত হল সংগঠনের নবগঠিত জাতীয় কার্যকরী সমিতির প্রথম বৈঠক। বৈঠকে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও কৃষক আন্দোলনের সাম্প্রতিক গতি প্রকৃতির ওপর বিস্তৃত আলোচনা হয়। স্থির হয়, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার শরীক সংগঠন রূপে এআইকেএম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সাথে সাথে মোর্চার অন্তর্গত এবং মোর্চার বাইরে থাকা বিভিন্ন সংগ্রামী কৃষক সংগঠনের সঙ্গে এআইকেএম নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা ও বজায় রাখার প্রয়াসকে বাড়িয়ে তুলবে। পাশাপাশি নিজেদের উদ্যোগে কৃষক আন্দোলনের বিকাশ বৃদ্ধির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেবে। বৈঠকে জিএম বীজ চাষের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে অনুমতি দিয়েছে তার তীব্র বিরোধিতা জানানোর পাশাপাশি মোদি সরকারের বিদ্যুৎ বিল ২০২২ প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এছাড়াও বৈঠক থেকে বনভূমি ও পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী গরিব বিশেষত আদিবাসীদের বনাধিকার কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার অরণ্য আইন ২০০৬-কে যেভাবে বদলে দিতে চাইছে তাকে তীক্ষ্ণ ভাষায় নিন্দা করা হয়। বনভূমিতে আদিবাসীদের পরম্পরাগত অধিকার বজায় রাখার সাথে সাথে তাদের বনের জমি দখলে রাখার সুযোগ ও জমি বণ্টনের দাবি জানানো হয়। বৈঠকে পঞ্জাবের ফিরোজপুরের জীরাতে অবস্থিত মদ কারখানার সামনে ধারাবাহিক আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের তীব্র নিন্দা জানানোর পাশাপাশি পাঞ্জাবে এক পানীয় জল প্রস্তুতকারক কারখানায় জলের মধ্যে বিষাক্ত পদার্থ মেশানোর ঘটনার প্রকৃত তদন্ত ও দোষী কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানানো হয়। দিল্লীর ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী পাঞ্জাবী গায়ক কুঁয়র গ্রেবাল ও রণজিত বাবার বাড়িতে আয়কর হানার বিরুদ্ধেও বৈঠক থেকে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। বৈঠক থেকে কেন্দ্র ও রাজ্যে এমএসপি গ্যারান্টি আইন প্রণয়ন, কৃষক এবং কৃষিমজুর-গ্রামীণ গরিবদের ঋণ মকুব, গ্রামের গরিব পরিবারগুলির মধ্যে সিলিং বহির্ভূত জমি বণ্টনের দাবি জানানোর সাথে সাথে পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ইত্যাদি রাজ্যে জলসঙ্কটের স্থায়ী সমাধান ও উত্তরপ্রদেশের আখচাষিদের বকেয়া পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার দাবিতেও আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

AIKM National Executive Committee meeting in Pune

এআইকেএমের জাতীয় কার্যকরী সমিতির এই সভায় ১৪টি রাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভা থেকে সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি হিসেবে রুলদু সিং এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং-এর নাম পুনর্ঘোষণার পাশাপাশি ৯ জন সহ সভাপতি ও ১৩ জন সম্পাদকের নাম ঘোষনা করা হয়। এই সভা পুনা মহানগর পালিকা কামগর ইউনিয়নের অফিস শ্রমিক ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। এআইকেএমের অনুমোদিত দুই সংগঠন মহারাষ্ট্র রাজ্য শ্রমিক শেতকারি (কৃষক) সংগঠন ও সত্যশোধক শেতকারি সভা যৌথভাবে এই বৈঠকের দায়িত্ব ও আয়োজন সম্পন্ন করে।

বৈঠকের পর সর্বভারতীয় সম্পাদক রাজারাম সিং বলেন, কৃষক আন্দোলনের প্রধান দাবি এমএসপি বা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কেবল কৃষকের স্বার্থেই নয়, দেশের খাদ্য সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সারা পৃথিবীর মধ্যে ক্ষুধার্ত দেশের তালিকায় ভারতের স্থান ১২৭। কৃষকের হাতে খাদ্য ব্যবস্থা থাকলে দেশের গরিবরা ভূখা মরবে না। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে কর্পোরেটদের হাতে চলে গেলে দেশে অনাহার অর্ধাহার চরম আকার নেবে। কারণ কর্পোরেটদের কাছে মুনাফাই প্রথম ও শেষ কথা। মোদী সরকার ওদের হাতে সমস্ত কিছু তুলে দিতে চাইছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেছেন চাল, গম জোয়ার বাজরা প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য থেকে ইথানল তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হবে। যা পরিবহনে জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হবে। সরকার তথ্য হাজির করছে যে, ডিজেল পেট্রোলে নাকি বছরে ২ লক্ষ কোটি টাকা ব্যায় হয়। আর ইথানল থেকে আসে ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা আগামীতে বাড়িয়ে তুলে জ্বালানির বিকল্প তৈরি করা হবে। এর ফলে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হলেও সরকার এগিয়ে যাবে। অর্থাৎ সরকারের কৃষক বিরোধী ও জনবিরোধী দিশা পরিস্কার। এর বিপরীতে খাদ্য নিরাপত্তা তথা গণবন্টন ব্যবস্থাকে আরও প্রসারিত করার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার কৃষি-উপকরণের দাম বিপূল পরিমানে বাড়িয়ে চলেছে, অথচ কর্পোরেটদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ভর্তুকি দিয়ে কৃষি উপকরণ সরবরাহ, কালোবাজারি মজুতদারীর বিরুদ্ধে আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলতে হবে।

biggest strike in its 106-year history

১৫ ডিসেম্বর ২০২২ গ্রেট ব্রিটেনের নার্স আন্দোলন নতুন এক ইতিহাস গড়ল। লক্ষাধিক নার্স ওইদিন তাঁদের কাজ ছেড়ে ধর্মঘটে সক্রিয়ভাবে যোগ দিলেন, ১০৬ বছরের ইতিহাসে যা আগে কখনো ঘটেনি। নার্সদের দ্য রয়্যাল কলেজ অফ নার্সিং’এর নেতৃত্বে সংঘটিত হল অদ্যাবধি বৃহত্তম এই ধর্মঘট। ইংল্যান্ড, ওয়েলস্ ও নর্থান আয়ারল্যাণ্ডে নার্সরা এই ধর্মঘটে সামিল হন।

নার্সদের এই ধর্মঘটের সমর্থনে গাড়ির চালকেরা সংহতি জানান অভিনব পদ্ধতিতে। ইংল্যান্ড, ওয়েলস্ ও নর্থান আয়ারল্যান্ডে চালকেরা গাড়ির হর্ণ বাজিয়ে, জানালার কাঁচ নামিয়ে ধর্মঘটিদের অভিবাদন জানান। ওই সমস্ত স্থানে পথচারীরা তাঁদের চকোলেট বিতরণ করেন। দেখা গেল বিভিন্ন হাসপাতালের বাইরে নার্সরা হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এই স্লোগান নিয়ে, “কোভিডের সময়ে তোমরা আমাদের কাজের জন্য করতালি দিয়েছিলে। সময় এসেছে, এখন আমাদের জন্য মুখ খোলো”। অল্প সংখ্যক নার্সদের দিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে গিয়ে কাজের বিরাট বোঝায় তাঁদের নাভিশ্বাস উঠছে। তার সাথে রয়েছে বিপুল মূল্যস্ফীতি, যা তাঁদের প্রকৃত মজুরির ক্ষয় ঘটাচ্ছে। হাতে গোনা নার্স দিয়ে কাজ চালানোর ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থাই বিপন্ন হয়ে পড়ছে। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, এক একজন নার্সকে চার পাঁচজনের কাজ করতে হচ্ছে। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাস্থ্য পরিষেবা।

ধর্মঘটিদের বক্তব্য, এই অপ্রিয় সিদ্ধান্ত তাঁরা একান্ত বাধ্য হয়েই নিয়েছেন। সরকার জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতির সাথে সাযুজ্য রেখে নার্সদের বেতন বৃদ্ধি সম্ভব নয়। এদিকে, কোভিডের নামে বিভিন্ন সংস্থা ধাপ্পাবাজি দিয়ে বেশ কয়েক বিলিয়ন পাউন্ড ঋণ নিয়েছিল, তা মুকুব করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি শোনা যাচ্ছে, সরকার প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল ব্যয় বৃদ্ধি করবে। জনমতের প্রবল চাপ এমনকি রক্ষণশীল পার্টির তরফ থেকেও সরকারের কাছে নার্সদের দাবি মেনে নেওয়ার কথা বললেও সরকার অনড়। স্বাস্থ্যসচিব জানিয়েছেন, “প্রতি এক শতাংশ বেতন বৃদ্ধি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ৭০০ মিলিয়ন পাউন্ডের বাড়তি বোঝা বাড়াবে, যা মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলবে।”

প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক বলেছেন, “এই ধর্মঘটকে কড়া হাতে মোকাবিলা করতে নতুন কিছু কঠোর আইন আনা হবে যা আগামীদিনে যারা যারা ধর্মঘট বা কর্মবিরতির হুমকি দিয়ে রেখেছে, তাদেরও সবক শেখানো যায়”। ধর্মঘট, কর্মবিরতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথাও ভাবা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছেন, “ইউনিয়ন নেতারা যদি অবিবেচনাপ্রসূত ধর্মঘট বা কর্মবিরতির মতো পদক্ষেপ নেয়, তবে আমার দায়িত্ব রয়েছে ব্রিটিশ জনতার জীবন-জীবিকা বাঁচাতে কঠোর আইন প্রণয়ন করা। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার পর থেকেই আমি জনগণকে রক্ষা করতে কঠোর আইন প্রবর্তনের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছি।”

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এই বিবৃতি এল ঠিক একদিন পর, যখন ইউনাইট ইউনিসন ও জিএমবি ইউনিয়ন — যারা সম্মিলিতভাবে অ্যাম্বুলেন্স চালক, প্যারামেডিক্স, ফোনে বিভিন্ন কল গ্রহণ করে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন, জরুরি বিভাগের কর্মীদের প্রতিনিধিত্ব করেন, জানিয়েছেন ডিসেম্বর ২১ ও ২৮ একসাথে কর্মবিরতি পালন করবেন। এর সাথেই ডিসেম্বরের শেষে রেলকর্মী, ডাকবিভাগ, বাস, শিক্ষা কর্মীরাও গোটা ব্রিটেন জুড়েই সর্বাত্মক ধর্মঘটের আগাম বার্তা দিয়ে রেখেছেন।

ব্রিটিশের রাষ্ট্রায়ত্ত সেক্টরের শ্রমিকরা মূল্যস্ফীতির হারের উপরে তাঁদের বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে, যে মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যেই ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। জ্বালানি, পেট্রোপণ্য, গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে গতবছর থেকেই।

সরকারের সমস্ত হুমকিকে তোয়াক্কা না করেই ব্রিটেনের শ্রমিকশ্রেণি তৈরি হচ্ছেন বৃহত্তর লড়াইয়ের জন্য।

The Oscar-winning actress

ইরানে তিনমাস ধরে চলা বিক্ষোভে সমর্থন দেওয়ায় এক খ্যাতিমান অভিনেত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। গত শনিবার (১৭ ডিসেম্বর ২০২২) তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে ইরানের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। গ্রেপ্তার অভিনেত্রীর নাম তারানেহ আলিদুস্তি (৩৮)। ২০১৬ সালে অস্কারজয়ী ‘দ্য সেলসম্যান’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। ইরানি বার্তা সংস্থা তাসনিমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুয়া ও বিকৃত আধেয় (কনটেন্ট) প্রকাশের পাশাপাশি বিশৃঙ্খলা উসকে দেওয়ার অভিযোগে তারানেহকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তারানেহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবশেষ পোস্ট দিয়েছিলেন ৮ ডিসেম্বর ২০২২। একই দিনে ইরানি কর্তৃপক্ষ সরকারবিরোধী বিক্ষোভে জড়িত থাকার দায়ে মোহসেন শেকারি নামের ২৩ বছর বয়সী এক তরুণের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। ৮ ডিসেম্বর নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে একটি ছবি শেয়ার করেছিলেন তারানেহ। তিনি লিখেছিলেন, “আপনাদের নীরব থাকার মানে হল, দমনপীড়ন ও দমনপীড়নকারীদের সমর্থন করা”। পোস্টের ক্যাপশনে তারানেহ লিখেছিলেন, “যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা এই রক্তপাতের ঘটনা দেখছে, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, এর অর্থ দাঁড়ায়, মানবতার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন।”

কৈশোর থেকেই ইরানি চলচ্চিত্রে কাজ করছেন এই অভিনেত্রী। সম্প্রতি তিনি ‘লিলাস ব্রাদারস’ নামের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। চলতি বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি প্রদর্শন করা হয়।

কঠোর পর্দাবিধি মেনে হিজাব না পরার অভিযোগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ইরানের রাজধানী তেহরানে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনিকে (২২) গ্রেপ্তার করে নীতি-পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর পুলিশি হেফাজতে ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।

নির্যাতনে মাসার মৃত্যু হয়েছে দাবি করে ইরানের মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। মাসার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বিক্ষোভ ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। চলমান বিক্ষোভকে ‘দাঙ্গা’ বলে অভিহিত করে দমনপীড়নের পথ বেছে নিয়েছে ইরানের কর্তৃপক্ষ।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে ইরানে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তিন শতাধিক বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজারো ব্যক্তি। এছাড়া বিক্ষোভে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে দুজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

মাসার মৃত্যুর দিনই অভিনেত্রী তারানেহ তাঁর ইনস্টাগ্রামে একটি ছবি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “এই বন্দীত্ব নরকের মতো”। ইনস্টাগ্রাম পোস্টে দেওয়া ক্যাপশনে তারানেহ লেখেন, ইরানের নারীরা কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা ভুলে যাবেন না। মানুষকে সব জায়গায় মাসার নাম ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন এই অভিনেত্রী। তিনি বলেছিলেন, মাসার নাম বলুন, বিশ্বে ছড়িয়ে দিন।

৯ নভেম্বর ২০২২ তারানেহ নিজের একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। ছবিতে দেখা যায়, তাঁর মাথায় হিজাব নেই। তাঁর হাতে থাকা একটি কাগজে লেখা, “নারী, জীবন, স্বাধীনতা”। এটি চলমান বিক্ষোভের প্রধান স্লোগান।

শেকারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিয়ে সমালোচনার মধ্যে ১২ ডিসেম্বর ২০২২ মাজিদরেজা রাহনাভার্দ নামের ২৩ বছর বয়সী আরও এক বিক্ষোভকারীর ফাঁসি কার্যকর করে ইরান।

বিক্ষোভে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার আরও ৯ ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ইরান।

ইরানের বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে সম্প্রতি জানানো হয়, বিক্ষোভে জড়িত থাকার দায়ে ৪০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁদের কারও কারও সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হয়েছে।

(এটি প্রথম আলো সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে সংগৃহীত।)

an important step forward in gender awareness

২ ডিসেম্বর ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে জার্মানি খেলতে নামল কোস্টারিকার বিরুদ্ধে। গ্রুপ লিগের ম্যাচ। মাঠে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক আর টিভির পর্দায় থাকা কোটি কোটি চোখ সেদিন এক নতুন অধ্যায়ের সুচনা হতে দেখলেন বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে। এই প্রথম বিশ্বকাপের মূল পর্বের আসরে পুরুষদের খেলা পরিচালনা করলেন এক মহিলা রেফারি। তাঁর নাম স্টিফানি ফ্রাপার্ট। ফ্রান্সের এই রেফারির সঙ্গী ছিলেন দুই লাইন্স পার্সন — ব্রাজিলের নিউজা ব্যাক আর মেক্সিকোর কারেন ডিয়াজ। রেফারির সাহায্যকারীদের লাইন্সম্যান বলে ডাকার রীতিটিকেই এইসূত্রে এবার তুলে দিয়ে নতুন শব্দবন্ধ নিয়ে আসার দরকার পড়ল। লাইন্স পার্সেন বা লাইন্স অফিসিয়াল জাতীয় শব্দ ব্যবহৃত হল দুনিয়া জুড়ে। নিঃসন্দেহে এটি খেলার দুনিয়ায় লিঙ্গসচেতনতা ও সাম্যের নিরিখে এক বিরাট মাইলস্টোন।

বিশ্বজুড়ে চলমান মহিলা আন্দোলন ও লিঙ্গ সচেতনতা বিষয়ক প্রচার সমাজ ও ব্যক্তিমনের অনেক পুরনো অভ্যাস ও ধ্যানধারণাকে নিয়মিত বদলে দিচ্ছে। এরই অঙ্গ হিসেবে পুরুষদের ফুটবল খেলায় মহিলা রেফারি ও লাইন্স পার্সনদের ব্যবহারের কথা ভেবেছে ফিফা। এরআগে ২০২০ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগের জুভেন্টাস ও ডায়নামো কিয়েভের এক গুরুত্বপূর্ণ খেলায় রেফারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফ্রাপার্ট। তারও একবছর আগে ২০১৯-এ ইউএফা সুপার কাপে চেলসি বনাম লিভারপুলের খেলা পরিচালনার দায়িত্ব বর্তেছিল তার ওপর। এই বছরেই মহিলাদের বিশ্বকাপ ফাইনালের যে খেলা হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর নেদারল্যান্ডের মধ্যে, তারও প্রধান রেফারি ছিলেন এই স্টিফানি ফ্রাপার্ট।

তবে এইসব খেলার চেয়েও বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে মহিলা রেফারি ও লাইন্স পার্সনদের পুরুষদের খেলা পরিচালনার অতিরিক্ত গুরুত্ব আছে। এর বিশ্বজোড়া প্রচার ও তার মধ্যে দিয়ে লিঙ্গ সচেতনার নতুন পাঠের বিস্তার নিঃসন্দেহে এক মাইল ফলক। কাতার বিশ্বকাপে এর আগে মহিলা আন্দোলন ও লিঙ্গ সচেতনতার প্রশ্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ আমরা দেখেছিলাম। ইরানের ফুটবলাররা তাদের প্রথম খেলাতেই জাতীয় সঙ্গীতের সময় নীরব থেকে তাদের দেশে চলমান মহিলা আন্দোলনের ওপর তীব্র রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ করেছিলেন। কাতারে সমপ্রেমের অধিকারের ওপর দমনের প্রতিবাদ জানিয়ে অনেক সাংবাদিক ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড পরে মাঠে আসেন। অনেক দেশের ফুটবলাররা এই ব্যান্ড পরতে চাওয়ায় ফিফা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তার বিরুদ্ধে আবার পালটা প্রতিবাদ হয়। জার্মান ফুটবলাররা তাদের খেলার সময় জাতীয় সঙ্গীত চলাকালে মুখে হাত রেখে বোঝাতে চান যে তাদের জোর করে চুপ করিয়ে রাখা হচ্ছে।

বিশ্বকাপ ফুটবলের ওপর দুনিয়াজোড়া প্রচারের আলো থাকে। মহিলা আন্দোলন তথা লিঙ্গ সচেতনতার আন্দোলন এই মঞ্চকে ব্যবহার করে যেভাবে সাহসী বার্তা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে তা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।

- সৌভিক ঘোষাল

impact around the world

সমুদ্রপথে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল আমদানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা গত ৫ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে কার্যকর হয়েছে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার পেছনে এটিকে একটি কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’এর এমন একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ করে রুশ বার্তা সংস্থা ‘রাশিয়া টুডে’র এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়েছে।

সমুদ্রপথে রাশিয়ার আমদানি করা তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ৬০ ডলার বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদন বলছে, বিশ্ববাজারে রাশিয়ার তেলের দাম বাড়লে পশ্চিমা ভোক্তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৈশ্বিক বাজারে প্রভাব বজায় রাখতে গিয়েও সমস্যার সম্মুখীন হবে পশ্চিমারা।

ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর থেকে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মস্কোকে চাপে ফেলার চেষ্টায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্ররা। সেই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার ২ ডিসেম্বর রাশিয়ার জ্বালানি তেলের দাম বেঁধে দেওয়া হল। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে এই প্রস্তাব দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও জাপান নিয়ে গঠিত জোট জি-৭ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

রুশ তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন বলেছেন, এরই মধ্যে রাশিয়ার অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। দেশটির জাতীয় বাজেটও আকারে ছোট হয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে তেলের দাম বেঁধে দেওয়ায় পুতিনের আয়ের সবচেয়ে বড় খাতটি ধাক্কা খাবে। জি-৭, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়ার এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তেল বিক্রির আয় দিয়ে ইউক্রেনে যুদ্ধ করছেন পুতিন। সেই পথ এবার অনেকটা বন্ধ হবে। তবে আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তেলের মূল্য পশ্চিমারা বেঁধে দিলেও সংকট কাটাতে রাশিয়া তার তেলের জন্য ক্রেতাদের সন্ধান চালিয়ে যাবে।

৫ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে রাশিয়ার ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন একটি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে যাচ্ছে। সেদিন থেকে এই জোটের কোনো দেশ সমুদ্রপথে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে পারবে না। একই সময়ে নতুন করে দাম বেঁধে দেওয়ার অর্থ হলো, ইউরোপের বাইরে অন্য দেশগুলোতেও রাশিয়ার তেল রপ্তানিকে সমস্যার মুখে ফেলা।

এখন থেকে পশ্চিমাদের বেঁধে দেওয়া দামের সঙ্গে একমত দেশগুলোকে সমুদ্রপথে রাশিয়ার তেল কেনার ক্ষেত্রে প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলার বা এর কম দাম পরিশোধ করতে হবে। অন্যদিকে যেসব দেশ এই প্রস্তাব মানবে না, সেসব দেশে রুশ তেল সরবরাহকারী জাহাজগুলোকে বিমা সুবিধা দেবে না ইউক্রেনের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলো।

তবে রাশিয়া কিন্তু আগে থেকেই ভারত ও চীনের কাছে কম দামে তেল বিক্রি করছে। বর্তমানে এই দুই দেশ তাদের তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তাই দাম বেঁধে দেওয়া রাশিয়ার ওপর চরম কোনো আঘাত হানবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রাশিয়ার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ লিওনিড স্লুতস্কি বলেছেন, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে পশ্চিমারাই নিজেদের জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ার জ্বালানি তেলের অর্ধেকের বেশি কিনত ইউরোপের দেশগুলো। সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল যথাক্রমে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও পোল্যান্ড। তবে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রুশ তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দেশগুলো। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র রুশ তেলের আমদানি বন্ধ করেছে। আর যুক্তরাজ্য এই বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করবে বলে জানিয়েছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ইউক্রেনের চাওয়া ছিল, পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৩০ থেকে ৪০ ডলারে বেঁধে দেবে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার প্রস্তাব অনেকটাই মেনে নিয়েছে। পুতিনের চাওয়া ছিল, ৬০ ডলারেই তেল কিনবে পশ্চিমারা। সেই ৬০ ডলারে তেল কেনার ব্যাপারে একমত পশ্চিমারা।

৫ ডিসেম্বর থেকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের আগেই একটা ঐকমত্যে পৌঁছানো ইউরোপের জন্য বেশ জরুরি ছিল। কারণ, যেসব জাহাজ রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল পরিবহন করবে, তাদের ক্ষেত্রে বিমা প্রযোজ্য হবে না। এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে চীন, ভারতসহ আর যেসব দেশ রাশিয়া থেকে তেল কিনছে, তারা বিপাকে পড়বে। কারণ, জাহাজের অধিকাংশ বিমাকারী ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক।

আরটির প্রতিবেদনে এই দাম বেঁধে দেওয়াকে জ্বালানির বাজারে শক্তিশালী ধাক্কা হিসেবে মনে করা হচ্ছে। তেলের ট্যাংকারগুলোর ৯৫ শতাংশ ইনস্যুরেন্স যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণ করে। রাশিয়ার তেল বিক্রি নিয়ন্ত্রণের জন্য এটি পশ্চিমাদের একটি কৌশল বলে মনে করা হচ্ছে।

যদি রাশিয়ার তেল বাজারে জায়গা করে নিতে না পারে, তাহলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে পারে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পশ্চিমা ভোক্তারা।

ইকোনমিস্টের খবর বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিভাগ শুরু থেকেই রাশিয়ার তেলের বাজার নিয়ে ছক কষছে। ইউরোপীয় সংস্থাগুলোকে সুবিধা দিতে পশ্চিমারা রাশিয়াকে তেল কেনাবেচায় দর বেঁধে দিয়েছে।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন বলছে, পশ্চিমাদের তেলের দর বেঁধে দেওয়ায় রাশিয়া কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দর বেঁধে দেওয়ায় ক্রেমলিন তেল রপ্তানি কমিয়ে আনতে পারে। যারা পশ্চিমা নয়, সেসব ট্যাংকার ও ইনস্যুরারদের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে পারে। এতে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে পারে।

আরেকটি অনিশ্চয়তা হলো, বৈশ্বিক তেলের বাজারে পশ্চিমারা কতটা প্রভাব বজায় রাখবে।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন বলছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধ এড়িয়ে চলতে চায়। এই দেশগুলো প্রতিনিয়ত ইনস্যুরেন্সের বিকল্প উৎসগুলো খুঁজছে। কারণ, ছ’মাস আগে এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়। আর নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়ার মতো সময় এখনো আছে।

ইকোনমিস্ট বলছে, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার পর তেলের বাজার কতটা ভারসাম্যপূর্ণ থাকবে, তা ৫ ডিসেম্বরের পরের কয়েক দিনে বোঝা যাবে। কারণ, এ সময়ে তেলের দাম অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে।

এ ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমাদের ব্যাংকিং–ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা শক্তিশালী করেছে। এতে পশ্চিমাদের জ্বালানি অবকাঠামো এড়িয়ে গিয়ে চীন ও ভারত নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পাবে।

বিশ্বজুড়ে রাশিয়ার তেল সরবরাহে নিযুক্ত জাহাজগুলোর বিমা ও অর্থায়নকারী ইইউ’র কোম্পানিগুলো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে। তবে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত রাশিয়ার তেলের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা নেই।

আল-জাজিরায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) তথ্যানুযায়ী, রাশিয়া থেকে ইইউ দিনে ২২ লাখ ব্যারেল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল আমদানি করে থাকে। এরমধ্যে পাইপলাইন দিয়ে প্রতিদিন সাত লাখ ব্যারেল তেল সরবরাহ হয়। পাশাপাশি দিনে ১২ লাখ ব্যারেল পরিশোধিত জ্বালানি পণ্যও সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আইইএ আরও বলেছে, প্রতিদিন ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং ১১ লাখ ব্যারেল জ্বালানি পণ্যের জন্য ইইউ’কে এখন বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।

ওই প্রতিবেদনে ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের জ্বালানি নীতিমালা বিষয়ক বিশ্লেষক ফিলিপ লসবার্গ একই রকমের কথাই বলেছেন। তিনি মনে করেন, তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে তেলের মূল্যের ওপর। তেলের দাম বেড়ে যাবে। যেদিন রাশিয়ার তেলের দাম বেঁধে দেওয়া হয়, সেদিনই বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য দুই শতাংশ বেড়েছে।

তেলের মূল্য বেঁধে দেওয়ার প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে আল-জাজিরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৬৪ সালে চালু হওয়া দ্রুজবা তেল পাইপলাইন দিয়ে জার্মানি, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, অস্ট্রিয়াসহ ইউরোপের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলীয় অনেক দেশে রাশিয়ার তেল সরবরাহ করা হয়ে থাকে। জার্মানি, পোল্যান্ড ও অস্ট্রিয়া ইতিমধ্যে এ নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন দিয়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে দেশগুলো।

হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া ও বুলগেরিয়া এখনো রাশিয়ার পাইপলাইনে সরবরাহকৃত তেলের ওপর নির্ভরশীল। বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এসব দেশকে সাময়িকভাবে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি করতে দেওয়া হবে। ইউরোপীয় কমিশনের বক্তব্য অনুযায়ী, পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা এসব তেল ইইউ’ভুক্ত দেশ কিংবা ইইউ’র বাইরের দেশে আবার বিক্রি করা যাবে না।

ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর আগে ২৭ সদস্যের এই জোট রাশিয়ার তেলের ওপর প্রচণ্ড রকমে নির্ভরশীল ছিল। ২০২১ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৭ হাজার ৪৮০ কোটি ডলার মূল্যের অপরিশোধিত তেল ও পরিশোধিত জ্বালানি পণ্য আমদানি করেছিল।

মাৎস কুভেলিয়ার বলেন, ছ’মাস ধরে এ বিধি নিয়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো তেল সরবরাহের বিকল্প পথ খুঁজে বের করার মতো যথেষ্ট সময় পেয়েছে। ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের জ্বালানি নীতিমালা বিষয়ক বিশ্লেষক ফিলিপ লসবার্গ একই রকমের কথাই বলেছেন। তিনি মনে করেন, তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে তেলের মূল্যের ওপর। তেলের দাম বেড়ে যাবে। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ব্রেন্ট তেল অনেক ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। এরজন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকে প্রস্তুত থাকতে হবে। যেদিন রাশিয়ার তেলের দাম বেঁধে দেওয়া হয়, সেদিনই বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে লসবার্গ বলেছেন, বিশ্ব অর্থনীতির ধীরগতি আসন্ন মাসগুলোতে আন্তর্জাতিকভাবে তেলের চাহিদা কমিয়ে দেবে। এতে আরও একবার তেলের দাম কমবে। তেলের দাম বেঁধে দেওয়া ও তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে কোম্পানিগুলো সমুদ্রপথে রাশিয়ার তেল তৃতীয় কোনো দেশে পৌঁছে দিতে বিমা ও অর্থায়ন করত, তারাও বাধার মুখে পড়বে। ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের জ্বালানি নীতিমালা বিষয়ক বিশ্লেষক ফিলিপ লসবার্গ মনে করেন, এতে বিশ্বের বাকি দেশগুলোতে অপরিশোধিত তেল ও জ্বালানি পণ্য রপ্তানি অব্যাহত রাখাটা রাশিয়ার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

ভারত, চীন ও অন্য দেশগুলোর অনেক জাহাজেরই ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের কোম্পানিগুলোতে বিমা করা। এসব জাহাজকে এখন ইইউ, জি-৭ ও অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগে তৈরি বিধিগুলো মেনে চলতে হবে।

যদিও রাশিয়া বলছে, তাদের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এ বিধিগুলো স্বীকৃতি পায় না। এই নতুন বিধিগুলোর আওতায় এসব দেশে ক্রেমলিন কীভাবে তেল রপ্তানি অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা করছে, তা এখন দেখার বিষয় বলে মনে করছেন লসবার্গ। আইইএ বলছে, সমুদ্রপথে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির ওপর ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে আগামী বছর রাশিয়ার তেল রপ্তানির পরিমাণ দিনে ১৪ লাখ ব্যারেল কমে যেতে পারে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্রাসেলসভিত্তিক আইনজীবী মাৎস কুভেলিয়ার মনে করেন, রুশ জাহাজগুলো মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ বা লাইবেরিয়ার সঙ্গে নিবন্ধিত হয়ে কিংবা রাশিয়ার পতাকা সরিয়ে ফেলে এসব নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। তবে এ ধরনের পরিস্থিতি যেন না হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে ইইউ সমুদ্রসীমায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।

ভারত, চীন ও তুরস্কের মতো দেশগুলো রাশিয়ার তেলের ওপর নির্ভরশীল। এসব দেশ মস্কোর কাছ থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখবে। নয়া দিল্লী ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো বিবেক মিশ্র আল-জাজিরাকে বলেন, ভারত ও চীনের মতো বড় ক্রেতা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়া আলোচনা চালাতে পারে এবং মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা চালু করতে পারে। তবে বিবেক মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে ইউরোপ থেকে রাশিয়া যে রাজস্ব পেত, তা পূরণ করা যাবে না ঠিকই, তবে তা মস্কোর অর্থনৈতিক মন্থরতায় কিছুটা হলেও গতি জোগাবে। বিবেক আরও বলেন, “আমি মনে করি, রাশিয়ার তেলের বড় ক্রেতা হিসেবে ভারতের খুব বেশি একটা ক্ষতি হবে না। রাশিয়া ও ভারত দুই পক্ষের বিবৃতি খেয়াল করলে আমরা দেখি, ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখবে।”

(লেখাটি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৈরি।)

afganistan

তালিবানি শাসকেরা এবার সরকারি আদেশনামা দিয়ে ঘোষণা করল, এখন থেকে মহিলারা কোনও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবেন না। এরআগে, মেয়েদের প্রাইমারি ও উচ্চ-প্রাইমারী স্কুলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। মহিলাদের বাড়ির বাইরে কর্মস্থলে যোগদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পার্ক বা জিমে প্রবেশের উপর জারি হয়েছে অনেক শর্ত।

আফগানিস্তান আবার প্রবেশ করল মধ্যযুগীয় বর্বতার গভীর অন্ধকারে!

wages of worker

সংসদে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই ২০ ডিসেম্বর ২০২২ পেশ করলেন হাড় হিম করা এক রিপোর্ট। এনসিআরবি’র তথ্য উল্লেখ করে তিনি জানান,

(১) ২০২১এ ৪২,০০৪ দিনমজুর, ২৩,১৭৯ গৃহবধু আত্মঘাতী হয়েছেন।

(২) অন্যান্য অংশের মানুষ, যারা আত্মঘাতী হয়েছেনঃ ২০,২৩১ স্বনিযুক্ত কাজের সাথে যুক্ত, ১৫,৮৭০ বেতনভোগী, ১৩,৭১৪ কর্মহীন, ১৩,০৮৯ ছাত্র, ১২,০৫৫ ব্যবসার সাথে যুক্ত, ১১,৪৩১ ব্যক্তি মালিকাধীন সংস্থার সাথে যুক্ত।

বলাই বাহুল্য, বেকারি, আর্থিক অনটন, গার্হস্থ্য হিংসা, শিক্ষা জীবনে ক্রমে ঘনিয়ে ওঠা অনিশ্চয়তা, ছাঁটাই প্রভৃতি কারণে এতজন সহনাগরিককে আমরা হারালাম।

Ratan Biswas

প্রয়াত কমরেড রতন বিশ্বাসের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় ৮ ডিসেম্বর ২০২২ পূর্ব বেলঘরিয়ায়, ১৫ ডিসেম্বর শহীদ মহল, দেশপ্রিয়নগরে ও ১৬ ডিসেম্বর কামারহাটি শ্রমিকাঞ্চলে। তিনটি স্মরণসভায় ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন মানুষের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়। বেলঘরিয়ায় সবাই ছিলেন পার্টি কর্মী, কামারহাটিতে চটকল শ্রমিক এবং দেশপ্রিয়নগর শহীদ মহল প্রাঙ্গনের স্মরণসভায় উপস্থিত বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন পার্টির বাইরের। ছিলেন সমর্থক, বন্ধুবর্গ, প্রতিবেশী ও শুভানুধ্যায়ী মানুষজন। শহীদ মহলের সভায় রতনের বোন তাপসী লৌহ এসেছিলেন। প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও নীরবতা পালন করে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কমরেড সরিৎ চক্রবর্তীর একক সংগীতের মধ্য দিয়ে সভার সূচনা হয়। পার্টির বেলঘরিয়া লোকাল কমিটির সম্পাদক অশোক সাহা শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন।

বক্তরা রতনের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। ৭০’র দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলন অনেকের মতো রতনকেও প্রভাবিত করেছিল। বর্তমানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এবং রাজ্য সরকারের দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রতন একজন সামনের সারির কর্মী ছিলেন। তার মৃত্যুতে অঞ্চলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। অনেকেই বলেন রতনের বন্ধুবাৎসল্যের টানেই এসেছেন। কেউ বলেন, রতন নির্দিষ্ট কেন্দ্রে (সিপিআই-এমএল লিবারেশননের মধ্যে থেকে) কাজ করেছেন, আর তারা সেই বৃত্তের মধ্যে থেকে একই কাজ করে চলেছেন। মহিলারা জানালেন, রতনের উদার হৃদয়, মরমী মন সমাজে মহিলাদের অবস্থানগত দুর্বলতা ও যন্ত্রণাগুলো বুঝতে পারতো। যেকোন ভুল বোঝাবুঝি শেষে তার অনাবিল সারল্যমাখা হাসি ভোলার নয়। এক পর্বতারোহী জানালেন, রতন পাহাড়ে যেতেন না কিন্তু ওদের যাত্রার সব খুঁটিনাটি খবর রাখতেন। উর্দুভাষী একজন বললেন রতনের আর একটা ঘর ছিল কামারহাটি। এই ধরনের মানুষের সহচার্য আমরা খুব কমই পাই। একজন বক্তা জানালেন, এলাকার পুকুর ভরাট, পুরকর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এবং দূষণ প্রতিরোধের আন্দোলনে রতনের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। সংখ্যালঘুদের পাশে থাকার বার্তা নিয়ে প্রতিদিন কামারহাটিতে যাওয়া নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। তিনি মানবাধিকার কর্মী ছিলেন। ধারাবাহিকভাবে জনগণের সেবার উজ্জ্বল উদাহরণ। সভার বক্তা হিসেবে সবসময় না থাকলেও, সভার প্রস্তুতি ও সভা শেষের নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর কিন্ত অপরিহার্য কাজগুলো অবশ্যকৃত্য হিসেবে করে যাওয়া প্রকৃত অর্থে একজন কমিউনিস্ট অ্যাক্টিভিস্টের পরিচয়।

বিজ্ঞানের স্বার্থে রতনের মরণোত্তর দেহদানে বোন তাপসীর ভূমিকাও মহৎ।

নিপীড়িত মানুষের কষ্টে কাতর, সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী রতনের জীবনেও খুব স্বাভাবিক নিয়মেই প্রেম এসেছে, চলেও গেছে। কিন্তু চেতনার চলমানতা থামেনি। “কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়” — তার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে, নিজের সম্পর্কে উদাসীন, পদাতিক রতনের হঠাৎ থেমে যাওয়া সকলের বুকে বড় বাজছে। রতন বিশ্বাস লাল সেলাম!

উপস্থিত বক্তারা ছিলেন ঝন্টু মজুমদার (সিপিআইএম), বরুণ চক্রবর্তী (সিপিআই), ডা. শুভজিৎ ভট্টাচার্য (জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের সংগঠক), মাজাহার খান, নাভাল মাহাতো, আশ মহমদ, বানারশী রাম, নুর আলম, রাজেশ সরোজ (বিসিএমএফ), অশোক রায়, ভুপেন সরকার, মৃণাল জানা (এমকেপি), সন্দীপ পাল (সিপিবি), সেরাজ নোমানি, শ্যামল চক্রবর্তী (টিএমসি), বরুণ দাস, জয়ন্তী দাশগুপ্ত, মলয় ব্যানার্জি (পর্বতারোহী), ভানু সরকার, মৈত্রেয়ী বিশ্বাস, নবেন্দু দাশগুপ্ত, নারায়ণ দে, সুব্রত সেনগুপ্ত। সঞ্চালক ছিলেন পার্টির জেলা কমিটির সদস্য শিবশঙ্কর গুহরায়।

party congress

 

খণ্ড-29
সংখ্যা-49