প্রতিবেদন
কর্মপ্রার্থী যুবকদের নিয়ে মিথ্যাচার
job-seeking youth

নির্বাচনের সময় এখন। উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, উত্তরাখন্ড, মণিপুর ও গোয়া ৫ রাজ্যের নির্বাচনের ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। ফলে খবরের কাগজের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে। রাজ্যগুলি কীভাবে এগিয়ে গিয়েছে মোদী-যোগীর রাজত্বে। দেশ গত ৭ বছরে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ ও ‘সবকা বিশওয়াস’এর রাস্তায় এতটাই এগিয়েছে যে একদিকে ‘বুল্লি বাই এ্যাপ’ ঘুরে বেড়ায় শতাধিক কৃতি মহিলাদের নিলামে চড়িয়ে, অন্যদিকে ৫৬ ইঞ্চি ছাতির প্রধানমন্ত্রী ফি’বছর খুন হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত থাকেন, ধারাবাহিকভাবে সুরক্ষা বাড়তে থাকে, এসপিজির নিরাপত্তা, ১৪ কোটি টাকার নিরাপদ গাড়ির সুরক্ষা সত্বেও তাঁর প্রতিনিয়ত প্রাণ সংশয় ঘটে।

গত ৭ বছরে দেশে কত মানুষ বিনা চিকিৎসায় বা অপর্যাপ্ত চিকিৎসার দরুণ মারা গেছে, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে লাখো রোগী হাসপাতালে শয্যার অভাবে অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছে, শ্মশানে স্থানাভাবে গঙ্গার পাড়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে কত মানুষের মৃতদেহ; ওদিকে সরকার অবলীলাক্রমে মিথ্যা বলেছে যে, কোন মৃত্যুই অক্সিজেনের অভাবে বা শয্যার অভাবে হয়নি। সরকারের পোষা প্রচারমাধ্যম গলা মিলিয়ে বিজ্ঞাপিত করেছে, বিপণন করেছে সরকারের মেকি সাফল্যের কথা, ঢাকা দিতে চেষ্টা করেছে দেশজোড়া লকডাউন ও মহামারিতে বেকারি-ক্ষুধা-অশিক্ষা-স্বাস্থ্যপরিষেবাহীনতার বিভৎসা।

দেশ বা রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে মিথ্যাচার কেবল বিজেপি করছে তাই নয়, কংগ্রেস-টিএমসি যেখানে ক্ষমতায় আছে সেখানেও করছে। দেশ বিদেশের অর্থনীতিবিদরা বারংবার ভারতীয় অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু যেদেশে প্রচারমাধ্যম প্রধানমন্ত্রীর প্রাননাশের গল্প ফাঁদতে পারে অনায়াসে সেদেশে কেই বা পরিসংখ্যানের কারচুপি নিয়ে মাথা ঘামায়। ২০১৯ সালে নির্বাচনের আগে, কেবল নির্বাচনী সুবিধের জন্য, তৎকালীন জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর দ্বারা প্রস্তুত জাতীয় নমুনা সমীক্ষা দফতরের নিয়োগ-বেকারি সমীক্ষাকে অসম্পূর্ণ বলে প্রকাশ করা হয়নি। পরে ওই সমীক্ষাকেই প্রকাশ করা হয়েছিল। বেকারির হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ ছিল, ৬.১%। অবশ্য এরমধ্যে জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরে আমূল পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে, তোতা পাখিরা এসে গিয়েছে, নির্বাচন হয়ে গিয়েছে, পুলওয়ামাকে ঢাল করে বেকারি-মূল্যবৃদ্ধি-স্বাস্থ্যহীনতা-কুশিক্ষা-অশিক্ষাকে শত শত যোজন দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মোদী জিতে গিয়েছেন। ‘সবকা বিকাশ’এর রাস্তায় চলতে থাকা মোদীজি, ‘সবকা বিশওয়াস’ জুড়ে নিয়েছেন। কিন্তু বেকারি বেড়েই চলেছে, সাথে বেড়ে চলেছে শেয়ার সূচক। ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি সমীক্ষার এপ্রিল-মার্চ ২০২১’র প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ভারতের শহরগুলিতে ওই সময়ে বেকারির হার দাঁড়িয়েছে ৯.৪%। মনে রাখা দরকার, সেই সময়ে অর্থনীতি এগোচ্ছিল, পরিসংখ্যান অনুসারে, কোভিডের পরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ওই ত্রৈমাসিকে জিডিপি বেড়েছে তার আগের বছরের ওই ত্রৈমাসিকের তুলনায় ১.৬% হারে। কিন্তু বেকারির হার বেড়েছে। ২০১৯-২০’র ত্রৈমাসিকে শহুরে বেকারির হার ছিল ৯.১%। ফলে কোভিড পরবর্তী সমস্যাকে সুযোগে পরিণত করার কারিগর প্রধানমন্ত্রী বেকারদের বিকাশ করতে পারেননি, বিশ্বাসের কথা বাদই দিলাম।

about job-seeking youth

জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের উপরোক্ত সমীক্ষাই শ্রমশক্তি বিষয়ক শেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন। ওদিকে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমি (সিএমআইই) প্রতিমাসেই এমনকি দৈনন্দিন ভিত্তিতে বেকারির হার প্রকাশ করে থাকে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী গত ডিসেম্বরে বেকারির হার আগস্ট পরবর্তী হারের মধ্যে সর্বোচ্চ, ৭.৯১%। শহরাঞ্চলে তা ৯.৩০% ও গ্রামাঞ্চলে ৭.২৮%। শহরাঞ্চলে ক্রমাগত বিপুল সংখ্যক বেকারি নির্বাচনে তেমন ছাপ ফেলছে না বলেই মনে হচ্ছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গ। ২০২১’র মে মাসে বেকারির হার ছিল ১৯%’র বেশি, কিন্তু রাজ্যে একদশক ধরে ক্ষমতায় থাকা শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ২৯৪টির মধ্যে ২১৩টি আসন পেয়েছিল, ৪৮% ভোটও। কোভিডকালে বহু সময়েই পশ্চিমবঙ্গে বেকারির হার যথেষ্ট বেশি ছিল। কিন্তু ভোটের বাক্সে তার ছাপ পড়েনি। এখন যখন ৫ রাজ্যে নির্বাচন আসছে তখনও দেখা যাচ্ছে দেশে বেকারির হার ভয়ঙ্কর। তাছাড়া কিছুদিন আগেই সরকারের তরফে জানানো হয়েছে যে ছোট শিল্পের অন্তত ৯% কোভিডের জন্য ঝাঁপ ফেলেছে। ফলে বেকারি বেড়েছে। এমনিতেই দেশে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার অত্যন্ত কম, জানুয়ারি-মার্চ ২০২১এ শহরাঞ্চলে তা ছিল ৩৭%। অর্থাৎ দেশের শহুরে মানুষের দুই-তৃতীয়াংশ কাজ খুঁজতেই চাইছেন না। কারণ তাঁরা কাজ পাবেন না সেটা নিশ্চিত। মেয়েদের মধ্যে ৮৩% ও পুরুষদের মধ্যে ৪২% কাজ খুঁজতেই চাইছেন না। এরমধ্যে অবশ্য শিশুরাও রয়েছে। যদি ১৫’র বেশি বয়স্ক মানুষদের ধরা হয় তাহলে শহরে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার দাঁড়াবে ৪৭%, মহিলাদের মাত্র ২১% ও পুরুষদের ক্ষেত্রে ৭৪%।

সারাদেশে বেকারির হার ভয়ঙ্কর হলেও কোনো কোনো রাজ্যে তা অতি প্রকটভাবে ভয়ঙ্কর, আবার কোথাও তেমন খারাপ নয়। কিন্তু কিছু রাজ্যের সরেজমিন অবস্থা যতটা ভয়ঙ্কর তা সিএমআইই’র বেকারির তথ্য ধরতে সক্ষম হয়নি, কারণ সেইসব রাজ্যে বহু মানুষ কাজের বাজারে আর আসছে না, হতাশ হয়ে। আগামী ৫ রাজ্যের নির্বাচনের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশের কথাই ধরা যাক। সারা ভারতে বেকারির হার যখন ৭.৯১% ঠিক তখনই উত্তরপ্রদেশে সেই হার কম, ৪.৯%। অবশ্যই শাসক বিজেপি ও যোগী এই তথ্য নিয়ে নিজেদের সাফল্য প্রচার করবে, যদিও ৪.৯% বেকারির হারই যথেষ্ট সংকটজনক। কিন্তু আদতে ওই তথাকথিত সাফল্যের পিছনে লুকিয়ে আছে পরিসংখ্যানের রহস্য। বেকারির হার নির্ভর করে কত শতাংশ মানুষ কাজ চাইতে আসছে তার উপরে, অন্য কথায় কত শতাংশ মানুষের মনে আশা আছে যে কাজ পাওয়া সম্ভব। যদি পূর্বে উল্লেখিত ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি সমীক্ষার এপ্রিল-মার্চ ২০২১’র প্রকাশিত প্রতিবেদনকে দেখা যায়, তাহলে সারা ভারতে শ্রমশক্তিতে জনগণের অংশগ্রহণের হার ছিল ৩৭.৫%, পুরুষদের মধ্যে ৫৭.৫% ও মহিলাদের মধ্যে ১৬.৯%। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে সেই হার ছিল যথাক্রমে ৩৩.৬%, ৫৫.২% ও ৯.৭%। লিপিবদ্ধ ২২টি রাজ্যের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের স্থান ছিল ২০তম। ফলে চাকরি পেতে ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা উত্তরপ্রদেশে কম, কারণ হতাশ হয়ে উত্তরপ্রদেশে জনতা কাজ করার জন্য ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না।

উদাহরণ হিসেবে দেখানো যায় ‘অমর উজালা’য় প্রকাশিত প্রতাপগড় জেলা সংক্রান্ত প্রতিবেদন যেখানে যোগী সরকারের প্রতিশ্রুত মাসিক ৫০০ টাকা ভাতা (যা ২০২২’র মার্চ পর্যন্ত দেওয়া হবে)-র জন্য শ্রমিক কার্ড পেতে ১২ লক্ষ ৫০ হাজার যুবক-যুবতী নাম লিখিয়েছে। প্রতাপগড় জেলার জনসংখ্যা ৩২ লক্ষ। অর্থাৎ ওই জেলায় ৪০% বেকার। বালিয়াতে বিএ-এমএ পাস নাম নথিভুক্ত করেছে শ্রমিক কার্ডের জন্য ওই মাসিক ৫০০ টাকা ভাতা পেতে। ওই জেলায়ও ১১ লক্ষ ৫০ হাজার বেকার হিসেবে নথিভুক্ত করেছে। উত্তরপ্রদেশ সরকার নিজেরাই বিজ্ঞাপন দিচ্ছে যে দেড় কোটি মানুষকে দুইমাসের ভাতা হিসেবে ১,৫০০ কোটি টাকা দিয়েছে। ফলে উত্তরপ্রদেশে কর্মহীনতার প্রকোপ ওই ৪.৯% বেকারির হার দিয়ে বোঝা যাবে না। ওই রাজ্যে ‘ইউপি রোজগার সঙ্গম’ নামক একটি ওয়েবসাইট রয়েছে যেটিতে কর্মপ্রার্থী ও নিয়োগকর্তার মধ্যে সংযোগ ঘটানো হবে। ওই সাইটে ৪১ লাখ কাজ চাইছে, ৮,০০০ কাজ রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে কত চাকরি আছে। কিন্তু আগেই বলেছি সরকারি মিথ্যাচারের কথা। যোগী সরকারের বিজ্ঞাপন অনুযায়ী সরকার সাড়ে-চার লাখ চাকুরি দিয়েছে। কিন্তু যদি সরকারের কাছে তালিকা চাওয়া যায় তাহলে কেউ পাবেনা। এটা কেবল বিজেপি সরকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, কংগ্রেস শাসিত বা তৃণমূল কিংবা অন্যদল শাসিত রাজ্যেও এমনটাই হাল। অন্যদিকে সরকারি চাকরির প্রক্রিয়া শুরু হলেই বিভিন্ন অনিয়ম বা বেআইনি কাজের জন্য আদালতে মামলা হয় ও পুরো প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গে এব্যাপারে আমরা ওযাকিবহাল। তবে সেই অনিয়মও এরাজ্যের একচেটিয়া নয়, সারাদেশেই তা চলছে।

সিএমআইই’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০ সালের মাঝামঝি মোট চাকরিরতের সংখ্যা ছিল ৪০৯ লক্ষ, ২০২১’র ডিসেম্বরে লকডাউনের ২১ মাস বাদে ৩০ লক্ষ কম হয়ে রয়েছে। যে চাকরি রয়েছে তাতে বেতনপ্রাপক কর্মরতের অনুপাত ক্রমাগত কমছে। ফলে যে কাজ পেলে শ্রমিক কর্মচারি কিছুটা নিরাপদ থাকে বা আনন্দ অনুভব করে তার পরিমাণ কমছে। সিএমআইই’র পরিসংখ্যানের সঙ্গে যদি জনগণনার তথ্যকে মিলিয়ে দেখা হয়, তাহলে ১৫-৫৯ বছরের মধ্যে থাকা কর্মঠ প্রায় ৯০ কোটি জনগণের মধ্যে ৫০ কোটি প্রকৃত অর্থে বেকার। এবং যারা কর্মরত তাদের কাজের শর্ত ও পরিবেশ ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে।

কর্মপ্রার্থী যুবকদের নিয়ে ছেলেখেলা শাসকরা করেই চলেছে। কারণ এখন ‘দেশপ্রেম’এর জোয়ারে, ‘রামমন্দির’এর ভক্তিতে, আর সাম্প্রদায়িক ঘৃণায় ভরপুর হৃদয়ে বেকারদের অনেককেই নেশাগ্রস্ত করা গেছে। তার উপরে ভর করে নির্বাচনে জিততে পারা কর্মসংস্থান করে জেতার থেকে অনেক সহজ কাজ, দেশ ও দেশের মানুষ তাতে গোল্লায় গেলেই বা।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-2