খবরা-খবর
মুক্তির নির্দেশের পর সরকার বন্দিকে আটক রাখতে পারে না, বলল জম্মু-কাশ্মীরের হাইকোর্ট
prisoner-after-the-order-of-release

ভিত্তিহীন ও গুরুতর নয় এমন অভিযোগের ভিত্তিতে এফআইআর করে সরকারের সমালোচকদের গ্রেপ্তার করা ও তাদের দীর্ঘদিন আটক রাখাটা মোদী জমানায় এক ধারাবাহিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। এই ধরনের গ্রেপ্তারি ও আটক যে ক্ষমতার অপব্যবহার, আদালত সে কথা বলার পরও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর হানাদারি ও শাসক-বিরোধীদের গ্রেপ্তারিতে ছেদ পড়েনি। কাশ্মীরের সাংবাদিক সাজেদ আহমেদ’এর আটক রাখার নির্দেশকে খারিজ করতে গিয়ে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ হাইকোর্ট সুস্পষ্টভাবেই বলেছিল, সরকারের সমালোচকদের আটক রাখাটা “নিবর্তনমূলক আটক আইনের অপব্যবহার”। তবে, শুধু এই ধরনের বেআইনি আটকই নয়, আটকের নির্দেশ আদালতে খারিজ হয়ে যাওয়ার পরও জেলবন্দি ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে প্রশাসনের অনেক ক্ষেত্রেই অনীহা দেখা যায়। যেমন ঘটেছে কাশ্মীরের জেলবন্দি মুনিব রসুল শেরওয়ারির ক্ষেত্রে। শেরওয়ারির বিরুদ্ধে ২০২০ সালে এই অভিযোগ দায়ের হয় যে, রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে সে বিপজ্জনক। গ্রেপ্তার করে তাকে পাঠানো হয় উত্তরপ্রদেশের জেলে। তবে, অভিযোগ প্রমাণিত হয় না এবং বারমুলার বিশেষ এনআইএ আদালতের বিচারক তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেন ২০২৩ সালের ১৫ মার্চ। কিন্তু বন্দির মুক্তি মেলে না। হাইকোর্ট ২০২৩ সালের ২৩ ডিসেম্বরের রায়ে বলে, বন্দিকে যে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সে বিষয়টায় জেল কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। আদালত দ্বিধাহীনভাবে বলেছিল, এটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনা বোধের অভাবকেই প্রতীয়মান করছে এবং “বন্দির আটক থাকাটা অন্যায্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে।” কিন্তু আদালত মুক্তিদানের মতো সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করা সত্ত্বেও শেরওয়ারিকে মুক্তি দেওয়া হল না। ফলে বন্দির হয়ে আদালতে আবার আবেদন জানাতে হল শেরওয়ারির মাকে। হাইকোর্টের বিচারপতি রাহুল ভারতি জেলা শাসক ও পুলিশ কর্তৃপক্ষকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তদের উপস্থিতিতেই বিচারপতি বলেন, কোনো আইনি ভিত্তি ছাড়াই আবেদনকারীকে নিবর্তনমূলক আটক আইনে বন্দি থাকতে হয়েছে। তার জীবনের মূল্যবান ৭৯টা দিন হারিয়ে গেছে এবং আদালতের কাছে সেটা গভীর উদ্বেগের বিষয়। তিনি আটক আবেদনকারীকে অবিলম্বে মুক্তির নির্দেশ দিলেন মার্চ মাসের শেষে।

তবে, অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েও জেলে আটক থাকার ব্যাপারটা শুধু জম্মু ও কাশ্মীরেই ঘটছে না। কেরল, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ সহ ভারতের বহু রাজ্যেই এমন নজির অনেক রয়েছে। শাসকের সুনজরে না থাকলে আদালত মুক্তির নির্দেশ দিলেও মুক্তি বিলম্বিত হওয়াটা অভাবনীয় ব্যাপার নয়। আবার মুক্তিলাভকে আটকাতে নতুন অভিযোগ দায়েরকেও শাসক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। মুক্তির পরই নতুন অভিযোগের ভিত্তিতে পুনরায় গ্রেপ্তারির বহু দৃষ্টান্তই রয়েছে। গুজরাটে ২০১৮ সালে জানুয়ারি মাসের একটা ঘটনায় জামিন লাভের পরও সরকার আটক ব্যক্তিকে মুক্তি না দেওয়ায় আদালত রাজ্য সরকারকে ৫০,০০০ টাকা জরিমানা করে। সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার চরিতার্থতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগের মূল বিষয় হয়ে থাকে অভিযুক্ত ব্যক্তি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী, দেশদ্রোহী, আইন-শৃঙ্খলার পক্ষে বিপজ্জনক। সরকারের বিরোধীদের আটক করতে দেশে যে দানবীয় আইনগুলো চালু রয়েছে ও যেগুলোর প্রয়োগ হয়ে চলেছে সেগুলোর কয়েকটা হল — জম্মু ও কাশ্মীরের জনসুরক্ষা আইন, ইউপিএ, গুজরাটের সমাজবিরোধী কার্যকলাপ দমন আইন; এছাড়াও রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর গুণ্ডা দমন আইন, ইত্যাদি। সব আইনেই জামিন লাভকে অত্যন্ত কঠোর করে তোলা হয়েছে এবং অভিযুক্তদের মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিনাবিচারে আটক থাকতে হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট নিবর্তনমূলক আটক আইনগুলোকে দানবীয় ও ভীতিজনক বললেও সেগুলো অসাংবিধানিক নয় বলে অভিমত প্রকাশ করেছে। তবে, একই সাথে স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে সংবিধানে সুরক্ষার যে বিধান রয়েছে, ব্যক্তি স্বাধীনতার যে রক্ষাকবচ রয়েছে সেগুলোকেও ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বলেছে, এই সমস্ত আইনের প্রয়োগে সেই অধিকারগুলো লঙ্ঘিত হতে পারে না। আলোচ্য মুনিব রসুল শেরওয়ারি মামলাতেও বিচারপতি রাহুল ভারতি কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসনকে সতর্ক করে বলেছেন, “এই আদালত আশা করে যে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না; জেলে বন্দির নিবর্তনমূলক আটক বাতিল হয়ে গেলেই জম্মু ও কাশ্মীরের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকারকে যথাযথ দ্রুততায় ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে অসংগত সময় হানি না ঘটিয়েই হেফাজত থেকে আটক ব্যক্তির মুক্তি লাভ সম্ভব হয়।” বিচারপতির এই নির্দেশ শুধু জম্মু ও কাশ্মীরে নয়, সারা দেশে প্রযোজ্য হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু কেন্দ্রের ও বিভিন্ন রাজ্যের শাসকরা কি এই কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা দেখাবেন? মোদী জমানায় ৩৭০ ধারা বিলোপের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সিএএ বিরোধী আন্দোলন, যৌননিগ্ৰহের বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগীরদের আন্দোলন, কৃষকদের আন্দোলনের মতো শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদও যখন রাষ্ট্রের নিপীড়নের মুখে পড়ে, সেই জমানায় মানবাধিকারের সুরক্ষা কতটা প্রত্যাশিত ও সম্ভাব্য হতে পারে!

খণ্ড-31
সংখ্যা-13