খবরা-খবর
কৃষি সংকটের জ্বলন্ত প্রশ্ন তুলে ধরে পূর্বস্থলীতে নির্বাচনী প্রচার
agricultural-crisis

“সোনার ফসল ফলায় যে তার দুই বেলা জোটে না আহার …”

যে দিকে তাকানো যায় সবুজ ক্ষেত খামার। পূর্বস্থলী ব্লকের গঙ্গা তীরবর্তী উর্বরা জমিতে শস্য বৈচিত্র চোখে পড়ার মতো। ধান, পাট, আলু পিঁয়াজ, রশুন, ফুলচাষ, রকমারী সব্জি কী নেই! কিন্তু এই সোনার ফসল ফলায় যারা সেই ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিরা, ভাগচাষি, চুক্তি চাষিরা, যারা গ্রামীণ জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ। সকাল থেকে সন্ধ্যা ১২ /১৪ ঘণ্টা কাজ করেও তাঁদের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা এ সব কিছুর সংস্থান করতে নাভিশ্বাস উঠছে। সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর এই এলাকায় কোন ফসলের চাষে খরচ কম প্রধানত সেটা বিবেচনা করেই শস্য ফলান চাষিরা। এ কারণে এই এলাকায় আলুর বদলে পিঁয়াজ চাষ কয়েকবছর ধরে বেড়েছে। চাষিদের নিজস্ব তাগিদেই ঘটছে শস্য বৈচিত্র! কৃষি সংকট সমাধানে সরকারের অন্যতম দাওয়াই হচ্ছে শস্যবৈচিত্র! কিন্তু সেটা কেবলমাত্র তখনই ফলপ্রসূ হতে পারে যদি চাষিরা ফসলের লাভজনক দাম পায়। সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনে। কিন্তু হায়! “আশায় মরে চাষা”। বাস্তবে ফসলের দামের কোনো গ্যারান্টি নেই! পিয়াজের দাম কখনও ২০ টাকা তো কখনও বা ৬ টাকা! সব্জির দামও এমনই ওঠানামা করে। হিমঘর না থাকায় প্রায় ৪০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এই সমগ্র প্রশ্নে রাজ্য  সরকারের কোনো ভূমিকাই নেই। সবটাই ফড়ে মহাজনরা নিয়ন্ত্রণ করছে। অপরদিকে উৎপাদন উপকরণ তথা সার বীজ কীটনাশক জল বিদ্যুৎ প্রভৃতির দামের বিপুল বৃদ্ধি ঘটছে। পুঁজির জন্য আজকের নয়া মহাজন মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির চড়া সূদে ঋণের উপর নির্ভর হয়ে পড়ছে মানুষ। এই প্রেক্ষাপটে ঘটছে আলু চাষির আত্মহত্যার ঘটনা। দুই মাস আগে এই ব্লকে অকাল বর্ষণে আলু নষ্ট হয়ে যাওয়া পর দেনার দায়ে এক যুবক চাষি গলায় দড়ি দিয়েছে। এই নির্মম বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে মোদীর গ্যারান্টি চাষিদের কাছে স্রেফ ভাঁওতা ছাড়া কিছুই নয়! চাষির আয় দ্বিগুণ বেড়েছে বলে মোদী যে প্রচার করছে সেটা এক নির্মম রসিকতা! এই ব্লকে দারিদ্র্যসীমার নীচে রয়েছে ৪৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার। যাদের আয় মাসিক ৩০০০ হাজার টাকার কম! এটা ২০১১ সালে সরকারি তথ্য। এখন সরকার সব রকম তথ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে৷ তবুও নিশ্চিত বলা যায় বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়েছে বই কমেনি। সব মিলিয়ে গ্রামীণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দুবেলা খাবার জোটানো দায়! কৃষি কাজে মজুরি গড়ে ২০০-২৫০ টাকা। দুই বছর হয়ে গেল ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। সম্প্রতি ১০০ দিনের কাজে মজুরি ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। তাতে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মজুরি সরকার নির্ধারিত মজুরির থেকেও কম। অর্থাৎ সরকার চাইছে বেকাররা কাজ না পেয়ে এবং মজুরির নিম্ন হারের কারণ পরিযায়ী হয়ে যাক। এ সবের ফলে গ্রামাঞ্চলে দলে দলে যুব শক্তি চলে যাচ্ছে বাইরে পরিযায়ী হয়ে। এই এলাকার অধিকাংশ যুবকরা যাচ্ছেন কেরালায়। যেখানে মজুরী কিছুটা বেশি। এই বিষয়গুলিকে তুলে ধরে গত ৬ এপ্রিল পূর্ব বর্ধমান কেন্দ্রের পূর্বস্থলী এলাকায় এক প্রচার পরিক্রমা করা হয়। তাতে ৮০ জন কর্মী সহ প্রার্থী সজল কুমার দে অংশগ্রহণ করেন। এলাকা সংগঠনের কর্মীরা উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে নির্বাচনী কর্মকান্ডে যুক্ত হয়েছেন। কৃষি সংকটের জবাব কৃষক আন্দোলন, যুব সমাজের স্বচ্ছ নিয়োগ ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে এই রাজ্যে এবং দেশ জুড়ে আন্দোলন। সেই আন্দোলনের একমাত্র প্রতিনিধি সিপিআই(এমএল) প্রার্থীকে পতাকায় তিন তারা চিহ্নে ভোট দিন - এই বার্তা তুলে ধরে প্রায় ৪০ কিমি রাস্তা ১৫টি টোটো গাড়িতে তিন তারা লাল পতাকায় সুসজ্জিত প্রচার পরিক্রমা ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিভিন্ন বাজার গঞ্জ জনবহুল এলাকায় মিছিল করা হয়। সকাল ৯ টায় শুরু হয়ে দুপুরে কিছুটা বিরতি দিয়ে বিকেল ৫ টায় ফলেয়া রেল বাজারে এক পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন রাজ্য ও জেলা নেতৃবৃন্দ যথা, সজল পাল, ইন্দ্রানী দত্ত, বাবলু ব্যানার্জি, অশোক চৌধুরী, রণজয় সেনগুপ্ত  জয়তু দেশমুখ প্রমূখ।

the-burning-question-of-agricultural-crisis

প্রচারে কেন্দ্রের মোদী সরকারের সর্বনাশা নীতিগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণের পাশাপাশি রাজ্যের তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও বঞ্চনা প্রতারণার বিরুদ্ধে বক্তারা সোচ্চার হন। যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয় তা হল — 

মোদীর রাজত্বে চাষির আয় তো বাড়েইনি উল্টে খরচ চারগুন বেড়েছে। কৃষিতে ব্যয় বরাদ্দ সরকারি ভর্তুকি ক্রমাগত কমছে। এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৬.১ লক্ষ কোটি টাকা। আর কৃষি ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে ১.২৭ লক্ষ কোটি টাকা। যে প্রধানমন্ত্রী দু’বছরের মধ্যে চাষিদের উৎপাদন দ্বিগুণ করার কথা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা সর্বনিম্ন বরাদ্দ করছেন কৃষিতে। কৃষি উপকরণের বিপুল মূল্যবৃদ্ধির একটা তথ্য দেখা যায়। সার কারখানার নাম বিভিএফসি। সে ইউরিয়া তৈরি করেনা, শুধু প্যাকেজিং ও মার্কেটিং করে। ৪৫ কেজির দাম ২৬৬ টাকা ৮০ পয়সা। অথচ মোদী সরকার এই সার আমদানি করেছে ৩ হাজার ৩৭৫ টাকায়। ২০২০-তে এক বস্তা (৫০ কেজি) পটাশের দাম ছিল ৮০০ টাকা। এখন তার দাম ২০০০ টাকা। সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র চাষিদের জন্য কোনো সরকারি ঋণ সহায়তা নেই। প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে ছোট ভাগচাষি ও চুক্তিচাষিরা চাষাবাদ করে থাকে। এদের কৃষক স্বীকৃতি নেই। কোনোরকম সরকারি সহায়তা এরা পায় না। ফসল কেনার সরকারি ব্যবস্থাপনা নেই! গালভরা নাম দিয়ে ব্লক দপ্তরের লাগোয়া একটা কৃষক বাজারের বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে সরকারি গুদাম আছে, অকশন বা নিলাম শেড আছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের কোনো প্রতিনিধি সেখানে ফসল কেনে না। এমন কী তাতে হিমঘরও নেই। সুলভে কৃষি ঋণ সহায়তা, ন্যায্যমূল্যে সার বীজ নেই। বিগত বছরগুলিতে নদীর জল উত্তোলন প্রকল্প বা সেচের কোনো ব্যবস্থাই হয়নি। ১০০ দিনের কাজ ধাপে ধাপে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত চালাচ্ছে মোদী সরকার। গত বছরের তুলনায় তিনভাগের এক ভাগ টাকা বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে ওরা।এছাড়া স্থানীয় কয়েকটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় যথা — আমাদের পার্টির নেতৃত্বে এই এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামে খাস ও চরের জমি দখল করা হয়েছিল। সেখানে গরিবরা সারা বছর চাষ করলেও আজও তারা কেউ পাট্টা পায়নি। ফলে তারা সরকারের কোনো প্রকল্পের সাহায্য পায় না। তাই পাট্টা ও পরচার দাবিতে নতুন ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলছে। গঙ্গার চরে দেবনগর গ্রাম যেখানে এবার আমাদের পার্টি প্রতিনিধি পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতেছে। সেই গ্রামের পার্শ্ববর্তী চরের মাটি প্রশাসনের মদতে মাটি মাফিয়ারা মাটি তুলে বিক্রি করে দিচ্ছে। এর ফলে চাষের যেমন ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে তেমনি অদূর ভবিষ্যতে দেবনগর গ্রামটাই গঙ্গায় তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। এই মাটিমাফিয়া ও প্রশাসনের যোগসাজসের বিরুদ্ধে আন্দোলন এর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। মেড়তলা থেকে কমলনগর একসময় তাঁতের রমরমা ছিল। সরকারের উদাসীনতা ও বঞ্চনার কারণে তাঁত আজ মৃতপ্রায়। করোনার পর শয়ে শয়ে মানুষ মজুরে পরিণত হয়ে পড়েছে। এই এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য আমাদের পার্টির বলিষ্ঠ ভূমিকা আজও এক উজ্জ্বল ইতিহাস হয়ে রয়েছে। একে পাথেয় করে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসীবাদকে পরাস্ত করা এবং সিপিআই(এমএল)-এর সংগ্রামী ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রচারাভিযান চলছে।

- জয়তু দেশমুখ

খণ্ড-31
সংখ্যা-13