ধর্ষিতাকে বিবস্ত্র হতে বলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে
magistrate-asking-the-victim-to-disrobe

রাজস্থানের করৌলি জেলার এক ধর্ষিতা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়েছিলেন বয়ান নথিবদ্ধ করতে। বয়ান নথিবদ্ধ হল, কিন্তু হিন্দাউন কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটের মনে হল তাঁর আরও কিছু করার আছে। গমনোদ্যত তরুণীকে তিনি আবার ডাকলেন। বন্ধ ঘরে ধর্ষিতাকে বললেন বিবস্ত্র হতে, অছিলা, তিনি তার দেহের আঘাত খুঁটিয়ে দেখবেন। ধর্ষিতা তাঁর জামা-কাপড় খুলতে অস্বীকার করলেন। তিনি দেখলেন, বিচার বিভাগের যে দায়িত্বশীলের কাছ থেকে সহানুভূতিশীল আচরণ প্রত্যাশিত তিনিই তাঁর শ্লীলতাহানিতে উদ্যত।

ধর্ষণের ঘটনাটা ঘটে ১৯ মার্চ ২০২৪। ১৮ বছরের দলিত তরুণীর বাবা-মা ও অন্যান্য সদস্যরা ঘরে ছিলেন না। তিন যুবক তাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে। এই ঘটনায় এফআইআর দায়ের হয় ২৭ মার্চ। ধর্ষণ বিচার প্রক্রিয়ার অঙ্গ হল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বয়ান নথিবদ্ধ করা, যার উদ্দেশ্য পুলিশের কাছে দেওয়া বিবৃতির সঙ্গে ঐ বয়ানকে মিলিয়ে দেখা, পুলিশের কাছে দেওয়া বিবৃতি সঠিক কিনা তা পরখ করা। তরুণী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বয়ান নথিবদ্ধ করতে যায় ৩০ মার্চ। এবং এই প্রক্রিয়ার নিয়ম অনুসারেই তরুণীর সঙ্গে যায় এক মহিলা পুলিশ এবং বাড়ির সদস্যরা। মহিলা পুলিশ কর্মী এবং বাড়ির সদস্যদের নিজের চেম্বারের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ম্যাজিস্ট্রেট বন্ধ ঘরে তরুণীকে বিবস্ত্র হতে বলেন। তরুণী ম্যাজিস্ট্রেটের কথায় সায় না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিবস্ত্র হতে বলার কথা মা এবং ভাইকে জানান। তাঁরা চলে যান হিন্দাউনের এসপির কাছে, অভিযোগ দায়ের করেন ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে। ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে তাঁর অভিযোগে তরুণী জানায়, “আমাকে পুনরায় ডাকা হয় এবং জামা-কাপড় খুলতে বলা হয় যাতে তিনি আমার আঘাত দেখতে পারেন। আমি বললাম, “কি করে আমি আপনাকে আমার আঘাত দেখাতে পারি? কোনো মহিলা থাকলে জামা-কাপড় খোলা আমার পক্ষে স্বস্তিদায়ক হতো, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট জোরাজুরি করতে থাকলেন। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাটা কাউকে বলতে বারণ করলেন। এই ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।” অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে রাজস্থান হাইকোর্টের ভিজিল্যান্স রেজিস্ট্রার অজয় চৌধরী হিন্দাউন গিয়ে ঐ ম্যাজিস্ট্রেটকে তিন ঘন্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৪৫ ধারা (বেআইনি আটক) এবং দলিত নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে এফআইআর দায়ের করে। ধর্ষণের পর পুলিশ তরুণীর মেডিক্যাল পরীক্ষা করিয়েছিল। তরুণীর আঘাত আবার পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন কি ম্যাজিস্ট্রেটের ছিল? যৌন আকাঙ্খা তাড়িত হয়েই কি তিনি তরুণীকে বিবস্ত্র হতে বলেননি? তরুণী দলিত বলেই কি বিবস্ত্র হতে বলার কুণ্ঠাবোধ তেমন জাগেনি?

ধর্ষণের পর নারীরা যে চরম মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যান সে কথা বিবেচনা করে প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থার দায়িত্বশীলদের ধর্ষিতার প্রতি যথেষ্ঠ সংবেদনশীল হওয়ারই কথা। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতি, সামাজিক প্রতিপত্তি, অর্থনৈতিক প্রতাপ এবং এমনকি জাত বিচারও প্রাধান্য পাওয়ায় ন্যায়বিচার উপেক্ষিত হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। উন্নাও, হাথরস, পার্কস্ট্রিট, কামদুনি — এরকম বহু নজিরই রয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় সে সময়ের প্রধান বিচারপতি শারদ অরবিন্দ বোবদের কথা, যিনি ২০২১ সালের মার্চে এক ধর্ষককে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে সে যেন ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে বিয়ে করে, অন্যথায় তাকে বাঁচানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কর্মী মোহিত সুভাষ চবনকে তিনি বলেছিলেন, “তুমি যদি ওকে বিয়ে করতে চাও আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি। আর তা না হলে তুমি চাকরি খোয়াবে আর জেলে যাবে।” ধর্ষকের অপরাধ, মেয়েটির সংকটজনক মানসিক পরিস্থিতি, তার সম্মান-মর্যাদা প্রধান বিচারপতির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হল না। এক সরকারি কর্মচারীকে বাঁচানোর স্পৃহার কাছে সঁপে দেওয়া হলো ন্যায়বিচারকে। আলোচ্য ঘটনাটিতেও ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার পরিবর্তে তার নগ্ন দেহ ও যৌনাঙ্গ দর্শনের মাধ্যমে নিজের কাম চরিতার্থতায় অভিলাষী হলেন ম্যাজিস্ট্রেট। বিচার ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও যাঁরা বিচারকে প্রহসনে পরিণত করতে প্রয়াসী হন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই তাঁদের প্রাপ্য। আলোচ্য ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হলেও তাতে তাঁর নাম উল্লেখিত হয়নি। একমাত্র জনগণের নজরদারিই পারবে ম্যাজিস্ট্রেটের অপরাধের জন্য তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিকে সুনিশ্চিত করতে।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-31
সংখ্যা-13