চটকলে নতুন করে শ্রমিক অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছে
labor-discontent-is-simmering

চটকলের ত্রিপাক্ষিক চুক্তির তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল চুক্তির পর থেকেই ইউনিয়নগুলোর অভ্যন্তরে চুক্তি কার্যকর করার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। মিল কর্তৃপক্ষ  এটাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে চুক্তি কার্যকর করতে অনীহা দেখাচ্ছে। এরই মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়েছে এবং ইউনিয়নগুলো নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে।

মিল কর্তৃপক্ষ প্রথমে অল্প সংখ্যক শ্রমিককে ১৫ দিনের মধ্যে ১২ দিন কাজ করলে উৎসাহ ভাতা হিসেবে প্রতিদিন আতিরিক্ত ২০ টাকা করে দেওয়া শুরু করে। ফলে বেশিরভাগ  শ্রমিকের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়। ইউনিয়নগুলো শ্রমমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানায় ইংরেজি ভাষার যে ফাঁক ফোঁকর আছে মিল কর্তৃপক্ষ তা কাজে লাগিয়ে সেখান থেকে নিজেদের মতো করে চুক্তির ব্যাখ্যা করছেন। অতিরিক্ত শ্রম সচিব তা মেনে নিয়ে ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে সংশোধনী দেন। তিনি লেখেন ৩ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে স্বাক্ষরিত চটকলে শিল্পব্যাপী ত্রিপাক্ষিক চুক্তি চূড়ান্ত করার সময়, টাইপে ভুল হয়েছে। ৩ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে উপস্থিত সব পক্ষ সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে হাজিরা ভাতা, মজুরি বোর্ডের অধীনে থাকা কর্মীরা বাদে, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত এন্ট্রি-লেভেল কর্মী সহ সমস্ত কর্মীরা এক পাক্ষিকে ১২ দিন কাজ করলে প্রতিদিন ২০ টাকা করে অতিরিক্ত ভাতা পাবেন। এই চিঠি প্রকাশের পরে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ কিছুটা স্তিমিত হয়।

১৪ মার্চ ২০২৪ তারিখে চটকলের মনিটরিং কমিটির প্রথম মিটিং হয়। এই বৈঠকে উঠে আসে – বেশ কয়েকটি চটকলের কর্তৃপক্ষ এখনও ত্রিপাক্ষিক চুক্তি মানছে না। মনিটরিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে ১১৩টি মিলকে অতিরিক্ত শ্রম সচিব এক কড়া চিঠিতে লেখেন – “চটকলে ৩ জানুয়ারি ২০২৪ সর্বশেষ শিল্পব্যাপী ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছিল এবং পরবর্তী সংশোধনী ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ সহ পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত অপারেটিং জুট মিল (বড় বা ছোট) এবং যে কোনো নতুন চটকলের জন্য প্রযোজ্য হবে। এই চুক্তি কোনভাবে লঙ্ঘিত হলে, রাজ্য সরকার সেই সব মিলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এবং চটের ব্যাগের পরবর্তী বরাত দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য জুট কমিশনারকে জানাবেন”।

চুক্তির পর থেকে হাতে গোনা কয়েকটা মিল ছাড়া বেশিরভাগ মিল কর্তৃপক্ষ নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী চুক্তির ব্যাখ্যা দিতে থাকে। সেই অনুযায়ী ফ্লোরে তা কার্যকর করার চেষ্টা চালায়, ফলে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। একাধিক মিলে বিক্ষোভ, ধর্ণা ও কর্মবিরতি শুরু হয়। ম্যানেজমেন্ট কয়েকটি মিলে সাস্পেনশন অফ ওয়ার্ক বা লক আউট ঘোষণা করেছে। ভিক্টোরিয়া জুট মিলে ৬ এপ্রিল থেকে লক আউট ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে চার হাজার শ্রমিক কর্মহারা হলেন। নর্থ শ্যামনগর মিলে বেশ কয়েকদিন লড়াই চালানোর পর ১ এপ্রিল থেকে সাস্পেনশন অফ ওয়ার্ক জেলা শ্রম দপ্তরের মধ্যস্থতায় প্রত্যাহার করা হয়। চুক্তিতে চটকল আধুনিকীকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের ধাপে ধাপে তা কার্যকর করার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ম্যানেজমেন্ট একতরফাভাবে বাছবিচার ছাড়াই শ্রমিকদের বিভিন্ন বিভাগে ট্রান্সফার করছে। বিশেষ করে তাঁত ডিপার্টমেন্ট থেকে অন্য বিভাগে। পুরনো তাঁত তুলে দিয়ে তার জায়গায় এস ৪ লুম (চায়না লুম নামে খ্যাত) বসাচ্ছে। যেখানে পুরোনো তাঁতে একজন তাঁতিকে দুটো তাঁত চালাতে হোত, মিল কর্তৃপক্ষ একজন তাঁতিকে কোথাও ৬টা বা তার বেশি তাঁত চালানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করছে। এই চায়না লুমে উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে। যেখানে চুক্তিতে বলা হয়েছে প্রডাক্টিভিটি কাউন্সিল বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে ম্যান- মেশিন রেশিও এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করবে, সেখানে কর্তৃপক্ষ আগেই  চুক্তিতে আধুনিকীকরণের বিষয়টি তাদের নিজেদের স্বার্থে নিজেদের ইচ্ছামতো একতরফাভাবে লাগু করছে। কোথাও স্ট্রেট ডিউটি, কোথাও মহিলাদের রাতে কাজ করানো ইত্যাদি যা সব ইউনিয়নের সহমতের ভিত্তিতে হওয়ার কথা, তা মানা হচ্ছে না। বিপরীতে শ্রমিকদের স্বার্থে স্থায়ীকরণ করা, হাজিরা ভাতা দেওয়া, ঠিকা ও ভাউচার প্রথা তুলে দেওয়া, বকেয়া গ্র‍্যাচুইটি প্রদানের ব্যবস্থা করা, নতুন শ্রমিকদের গ্র‍্যাচুইটি ইন্সিওরেন্সের সাথে যুক্ত করা, মহিলা শ্রমিকদের যৌন হয়রানি রোধে আইসিসি গঠন প্রভৃতি বিষয় কার্যকর করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কোনো হেলদোল নেই। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের উপর নতুন নতুন কায়দায় আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে।

অর্ডারের অভাব দেখিয়ে মিলে কাজের সময় ও দিনের সংখ্যা কমানো হচ্ছে। আইন অনুযায়ী খাদ্যশস্য রাখার জন্য চটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কেন্দ্রীয় খাদ্য নিগম সেই মতো চটকলগুলোকে বরাত দেয়। চটকল মালিকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ গত রবি মরসুমে সেপ্টেম্বর – অক্টোবর যত বরাত দেয়া হয়েছিল, নেওয়া হয়েছে তার থেকে কম। আইজেএমএ-এর তথ্য অনুযায়ী, “২২.৮৬ লক্ষ বেল চটের বস্তা (১ বেল মানে ৫০০ বস্তা) কিনবে। কিন্তু বাস্তবে তারা কিনেছে ১৪.৫২ লক্ষ বেল। ৮.৩৪ লক্ষ বেল কম কিনেছে। এর ফলেই চটকলগুলি বস্তার উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে” (সূত্র আনন্দবাজার)।

চটকলে উৎপাদন কমানোর ফলে কাঁচা পাটের চাহিদা কমেছে। ফলে পাট চাষিরা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের থেকেও কুইন্টাল প্রতি ৮০০-১০০০ টাকা কমে কাঁচা পাট বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।

আইজেএমএ-র চেয়ারম্যান রাঘবেন্দ্র গুপ্ত বলেন, “বরাতের অভাবে ইতিমধ্যেই চটকল বন্ধ হতে শুরু করেছে। অনেক কলে সপ্তাহে ৪-৫ দিনের বেশি কাজ হচ্ছে না। শিফট কমেছে। প্রায় ৫০,০০০ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হস্তক্ষেপের জন্য আর্জি জানিয়েছি আমরা।” (সুত্র আনন্দবাজার)

জুট এন্ড টেক্সটাইল ডিপার্টমেন্ট জানাচ্ছে বরাতের পরিমাণে কোনো ঘাটতি নেই। তথ্য অনুযায়ী তারা জানাচ্ছে মার্চ মাসে বরাতের পরিমাণ ৫৫৮২৪৪ যা বরাতের ১০০ শতাংশ। বরং বেশ কিছু মিল বরাত অনুযায়ী চটের ব্যাগ সরবারহ করতে পারেনি। রাজ্য শ্রম দপ্তরকে কেন্দ্রীয় টেক্সটাইল মন্ত্রকের তথ্য এবং আইজেএম-এর বক্তব্যের সত্যতা যাচাই কর জরুরি। কেন্দ্রীয় সরকারের বরাত এবং কাঁচাপাটের সহায়ক মূল্য বাড়ানোর জন্য রাজ্য সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নির্বাচনের সময় কেন্দ্র ও রাজ্যে সরকারের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের পালা চলছে। তার শিকার হচ্ছেন সাধারণ শ্রমিকরা। অনেকেই বলছেন এস ৪ লুম (চায়না লুম) দিয়ে অধিক উৎপাদন করানোর ফল হল কাজের সময় ও দিন কমানো এবং একই মজুরিতে শ্রমিকদের অতিরিক্ত খাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অধিক উৎপাদনের জন্যে শ্রমিকরা অতিরিক্ত উৎপাদন ভাতা পাচ্ছেন না। এমন কী দিন বা সময় কমানোর জন্য কর্তৃপক্ষ চটকলের স্ট্যান্ডিং অর্ডারের নিয়ম অনুযায়ী লে-অফ দিচ্ছে না। স্ট্যান্ডিং অর্ডারের ১২ নং ধারা অনুযায়ী শ্রমিকরা লে-অফ পাওয়ার অধিকারী। ১২ নং ধারার (ক) নিয়োগকর্তা, যে কোনো সময়, আগুন, বিপর্যয়, যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে যাওয়া বা বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হওয়া, মহামারী, নাগরিক গোলযোগ, কয়লা বা কাঁচামাল বা আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রীর সরবারহের ঘাটতি, উৎপাদনের লাইনের পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণের অতীত অন্যান্য কারণে, কোনও বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই যে কোনও এক বা একাধিক সময় পর্যায়ের জন্য, আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠানের কোনও একটি বা একাধিক বিভাগ বন্ধ করে দিতে পারে। (খ) এইভাবে কাজ বন্ধ করার ক্ষেত্রে, একজন শ্রমিক বা কর্মী শিল্প বিরোধ আইনের বিধান অনুযায়ী, মজুরি পাওয়ার অধিকারী।

কিন্তু এই ধারা অনুযায়ী শ্রমিকদের লে-অফ দেওয়া হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ইউনিয়ন ছাড়াই শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভে সামিল হচ্ছেন। রাজ্য শ্রম দপ্তর এই প্রশ্নে অদ্ভুতভাবে বধির, নিষ্ক্রিয় ও নিরুত্তর। বিসিএমএফ ইতিমধ্যে রাজ্য শ্রমমন্ত্রীকে ২ এপ্রিল চিঠি দিয়ে আবেদন করেছে চটকলের বর্তমান অবস্থায় হস্থক্ষেপ কারার জন্য। শ্রমমন্ত্রীকে লেখা বিসিএমএফ-এর চিঠি — “বেশ কিছু চটকল কর্তৃপক্ষ অপর্যাপ্ত অর্ডারের অজুহাতে শিফট ও কর্মদিবস কমিয়ে দিচ্ছে। এতে হাজার হাজার শ্রমিক গভীর আর্থিক সংকটে পড়ছেন। মিল মালিকদের এই স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত পবিত্র রমজান মাস ও সাধারণ নির্বাচনের সময়, স্পষ্টতই শিল্পে অশান্তি সৃষ্টি করছে এবং শিল্প-সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

আমরা মিলে স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে এবং শিল্পে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য এবং অবিলম্বে এই বিষয়টির সমাধানের উদ্দেশ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক আহ্বান করার জন্য আপনাকে একান্ত অনুরোধ করছি”।

অন্যান্য ইউনিয়নগুলোর সাথেও যোগাযোগ করা হচ্ছে ঐক্যবদ্ধভাবে মিল কর্তৃপক্ষ ও সরকারের উপর চাপ বাড়ানো জন্য। পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, নির্বাচনের আগেই কিছু একটা করতেই হবে। অন্যথায় ২.৫ লক্ষ চটকল শ্রমিক ও ৪০ লক্ষ পাট চাষির মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে যার প্রতিফলন ঘটতে পারে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে। শেষ বিচারে শ্রমিকদের আইনি অধিকার ও কৃষক স্বার্থের পরিপন্থী হবে।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত

খণ্ড-31
সংখ্যা-13