প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভোপালে বুথস্তরের বিজেপি কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। সেখানে তিনি অভিন্ন দেওয়ানী বিধি নিয়ে শোরগোলের মাত্রাটা সবে চড়িয়েছেন — ঐ রাজ্য থেকেই এক ভিডিও ‘ভাইরাল’ হয়ে উঠল যেখানে ক্ষমতা-মত্ত এক বিজেপি যুবনেতা প্রভেশ শুক্লাকে এক আদিবাসী শ্রমিক দশমত রাওয়াতের গায়ে মূত্রত্যাগ করতে দেখা যাচ্ছে। এই ভিডিওটি আসলে প্রায় দু’দশক ধরে বিজেপি রাজত্বে থাকা মধ্যপ্রদেশের মাটিতে কী ধরনের (অ)সভ্য বিধি চালু রয়েছে তারই এক কুৎসিত কদর্য প্রতিচ্ছবি! পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের প্রায় সবকটি বিজেপি-শাসিত রাজ্যেই প্রান্তিক করে তোলা এবং নিপীড়িত সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতি এই ধরনের বর্বর নিষ্ঠুরতা চলে অবাধে, বিনা শাস্তিতে — এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয়। মনুস্মৃতিতে জাতি ও লিঙ্গবৈষম্য ও হিংসার চরম নমুনাগুলোর সামাজিক অনুমোদন আছে, আর সঙ্ঘ বাহিনী তো এটিকেই তাদের আসল সংবিধানের মান্যতা দেয়।
তফসিলী জাতি ও উপজাতি (নির্যাতন প্রতিরোধ) আইন, ১৯৮৯তে জাতি হিংসার এই কুৎসিত সমাজ বাস্তবতার কথা মেনে নিয়ে তার নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোরতর আইনি সংস্থানের কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি ও তার আক্রমণাত্মক হিন্দুত্বের রাজনীতির উত্থানের পর, এই আইনটি তার কার্যকারিতা হারিয়েছে শুধু তাই নয়, এটিকে আরও লঘু, এমনকি বাতিল করার জন্য চেঁচামেচি ক্রমশ বাড়ছে। একই সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিদ্বেষমূলক অপরাধ বিরাটভাবে বেড়ে গেছে। মোদী জমানায় সামাজিক পরিসরে বিকেন্দ্রীকৃত ব্যক্তিগত হিংস্রতার এক নয়া নমুনা হিসেবে ভীড়হিংসার উদ্ভব হয়েছে। আর বুলডোজার হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের, বিচারবিভাগের পরোয়া না করে প্রতিহিংসা ও সন্ত্রাসমূলক কাজের চরিতার্থ তার এক নয়া প্রতীক। সাম্প্রদায়িক হিংসা, জাতিগত উৎপীড়ন এবং লিঙ্গ হিংসা যেন একে অন্যের ‘প্ররোচনা’ হয়ে যুগপৎ বেড়ে চলেছে। প্রভাবশালী মিডিয়া কিন্তু প্রায়ই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে অপরাধকে লঘু করে দেখিয়ে, এমনকি তাকে বৈধতা পর্যন্ত দিয়ে কার্যত এইসব দুষ্কর্মের সহযোগী হয়ে উঠছে।
সামনেই নির্বাচন আর মধ্যপ্রদেশ নির্বাচনে আদিবাসী ভোটের যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে, তাই শিবরাজ সিং চৌহান সরকার মরিয়া হয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা করছে। মুখ্যমন্ত্রী এক ‘প্রায়শ্চিত্ত’ ভিডিও প্রচার করেছেন যেখানে তাকে দেখা যাচ্ছে এক অনুষ্ঠানে তিনি দশমত রাওয়াতের পা ধুইয়ে দিচ্ছেন, তাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ওদিকে প্রভেশ শুক্লার বাড়ির একাংশ ভাঙার জন্য বুলডোজার পাঠানো হল এবং আরেকটি প্রচারিত ভিডিও’তে দেখানো হয়েছে, পুলিশ ভ্যানে প্রভেশকে তাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। যদি (অত্যাচারের) ভিডিও’টি ভাইরাল না হত এবং নির্বাচন আসন্ন না হত, এসব কিছুই ঘটতো না — এটা একদম পরিষ্কার। এটাও পরিষ্কার — প্রচারে আসা প্রতিটি ঘটনা পিছু এরকম আরও অন্তত এক ডজন ঘটনা ঘটে গেছে যা কখনও গ্রাহ্যই করা হয়নি। এমনকি ভীত সন্ত্রস্ত দশমতকে তার ওপর অত্যাচারকারী প্রভেশকে ‘ক্ষমা’ করার আবেদন জানাতে দেখা গেলেও, ভাইরাল হওয়া আরেকটি নতুন ভিডিও’তে ইন্দোরে দুই আদিবাসী তরুণের ওপর নৃশংস অত্যাচার হতে দেখা গেছে।
সামাজিক বৈষম্য আর অত্যাচার, ঘৃণা ও হিংসা এবং উৎপীড়নকারীদের রাজনৈতিক মদত ও সব অপরাধ থেকে অব্যাহতি যেখানে অবাধে চলে, একমাত্র যদি না মধ্যপ্রদেশের প্রাসঙ্গিক উপাখ্যানে প্রভেশ শুক্লার মতো কোনো উৎপীড়ক নির্বাচনী দায় হয়ে পড়ে — এমন একটি ব্যবস্থায়, মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের প্রাতিষ্ঠানিক অস্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে আমরা অভিন্ন দেওয়ানী বিধির বিষয়টিকে কীভাবে দেখব? ২২তম ল’কমিশন, কী ধরনের অভিন্ন বিধি চাপানো হবে সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা না দিয়েই এই বিষয়ে একমাসের মধ্যে জনমত জানতে চেয়েছে। ইতিহাস আমাদের বলে, এই বিষয়ে এক তীব্র বিতর্কের পর গণপরিষদ এটিকে সংবিধানে ‘রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতি’র অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, সংজ্ঞা অনুসারে যা আইনগতভাবে বলবৎযোগ্য নয় বা আদালতের বিচার্য নয়। বাবাসাহেব আম্বেদকর অভিন্ন দেওয়ানী বিধির ভাবনাটিকে নাগরিকদের জন্য ‘ঐচ্ছিক’ হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন। বস্তুত ২১তম ল’কমিশন অভিন্ন দেওয়ানী বিধিকে, এই বর্তমান সংকট মুহূর্তে, ‘প্রয়োজনীয়’ বা ‘সম্ভবপর’ বলে মনে করেনি। বরং সমস্ত পার্সোনাল ল’এর চৌহদ্দির মধ্যে লিঙ্গন্যায় ও লিঙ্গ সমতাকে সুনিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত আইনি সংস্কারের কথা বলেছিল। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে ২২তম ল’কমিশনের এই বিষয়ে নজর কেন্দ্রীভূত করার এত তাড়া পড়ে গেল!
অভিন্ন দেওয়ানী বিধির ভাবনা নিয়ে সরকার এখনও পর্যন্ত কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখতে পারেনি অথচ সঙ্ঘ-বিজেপি প্রচারকরা ইতিমধ্যেই মুসলিম সম্প্রদায়ের কুৎসায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং অভিন্ন দেওয়ানী বিধির ভাবনার যেকোনো বিরোধিতাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্ররোচনা বা তোষণ বলে চিত্রিত করছে। বাস্তবে আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি, গভীর আশঙ্কা ও বিরোধিতার স্বর উঠে এসেছে, মুসলিম সম্প্রদায়ের থেকে ততটা নয়, যতটা মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডের মতো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো এবং গোটা ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের থেকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং আইন বিষয়ক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান সুশীল মোদী ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে খৃস্টান সম্প্রদায় ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে অভিন্ন দেওয়ানী বিধির আওতা থেকে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। ঠিক এই কারণেই সংবিধানের রূপকাররা ইউসিসি’র ভাবনাকে নির্দেশাত্মক নীতির মধ্যে রেখেছিলেন। এমনকি, এতকাল পর ২০১৮তেও, ২১তম ল’কমিশন ইউসিসি’কে ‘প্রয়োজনীয়’ বা ‘সম্ভবপর’ কোনোটাই মনে করেনি। বস্তুত পার্সোনাল ল’(ব্যক্তিগত আইন)-এ রীতিনীতি আচার আচরণ প্রথার বৈচিত্র্য হিন্দুদের নিজেদেরই ভাবনার কারণ হতে পারে যেহেতু তাদেরও বিভিন্ন অঞ্চলে প্রথাগত বৈচিত্র্য বিপুল ও ব্যাপক, অ-হিন্দু ধর্ম ও সম্প্রদায়গুলির মতোই।
২১তম ল’কমিশন, একতার নামে ‘অভিন্নতা’ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার পরিবর্তে সমতার সঙ্গে বৈচিত্র্যের সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে সঠিক কাজ করেছিল। বেশ আশ্চর্যের বিষয়, এমনকি আরএসএস প্রধান গোলওয়ালকারও, ভারতের মতো একটি বিশাল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে অভিন্ন দেওয়ানী বিধি চাপিয়ে দেওয়ার ভাবনার বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছিলেন। ভারতের ঐক্যের জন্য অভিন্নতা নয়, বরং সম্প্রীতির, সমন্বয়ের (হারমোনি) প্রয়োজন — ১৯৭১-এ আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গ্যানাইজার’এর সম্পাদক কে আর মালকানিকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বলছিলেন স্বয়ং গোলওয়ালকার। তবে মোদী সরকারের আজ বড় তাড়া তাদের নিজেদের মতাদর্শগত ও প্রশাসনিক পূর্বসূরীর সতর্কীকরণকে পরিত্যাগ করার, কারণ তারা বিশ্বাস করে যে তারা আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে কোনো বাধা, কোনো সংযমকে তাদের মান্যতা দেওয়ার দরকার নেই। তারা আরও মনে করে, এই ইউসিসি হল বিভ্রান্তি তৈরি করে আজকের জনজীবনকে পিষে দেওয়া সমস্যাগুলো থেকে মানুষের মনোযোগ সরানো এবং সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারতের মেরুকরণ করার জন্য এক শ্রেষ্ঠ বাজি।
সমতা ও ন্যায়কে সুনিশ্চিত করার জন্য আইনি সংস্কার একটি স্থায়ী অ্যাজেন্ডা এবং সংবিধানের ৪৪নং অনুচ্ছেদের (আর্টিকেল) নির্দেশক্রমে রাষ্ট্রের উচিত সমস্ত সম্প্রদায়ের মহিলাদের জন্য লিঙ্গন্যায় সংক্রান্ত আইনগুলি সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে লাগাতার সচেষ্ট থাকা। এবং ৪৪নং অনুচ্ছেদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে সমস্ত অংশভাগীদের (স্টেহোল্ডারদের) যৌথ অংশগ্রহণ ও সহমতের ভিত্তিতেই তা করতে হবে। তাছাড়াও, মোদী সরকার যদি রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতির রূপায়নকে ত্বরান্বিত করতে চায়, তাহলে একই রকম মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ অন্য নির্দেশাবলী, যেগুলি সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৩৬ থেকে ৫১’র অধীনে সংশ্লিষ্ট ধারায় আছে, সেগুলিকে উপেক্ষা করে, বেছে বেছে শুধু ৪৪নং অনুচ্ছেদে গুরুত্ব দিলে হবে না। কারণ উল্লিখিত ঐ ধারাগুলিতে রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে — কাজের সার্বজনীন অধিকার ও জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে হবে। আয়ের বৈষম্য ও মাত্র কয়েকটি হাতে সম্পদ ও উৎপাদনের উপকরণের কেন্দ্রীভবন হ্রাসকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
ইউসিসি কার্যকর করার ব্যাপারে বিজেপির এই সাম্প্রতিক গুরুত্বের সঙ্গে লিঙ্গন্যায়কে সুনিশ্চিত করা বা রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতির চেতনায় প্রাণিত হওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমরা মনে করতে পারছি না। বাস্তবে, ইউসিসি অ্যাজেন্ডাকে সামনে নিয়ে আসাটা হল বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে ‘দানবীয়’ চেহারায় উপস্থাপিত করার বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের একটা অংশ মাত্র! ‘লাভ জিহাদ’এর বিদ্বেষভরা অলীক কল্পকাহিনির সঙ্গে ‘মুসলিমরা সংখ্যায় হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে’ — এই অযৌক্তিক ভুল ন্যারেটিভের নির্লজ্জ আশ্রয় নিয়ে (এবং সেটাও প্রায় প্রকাশ্যেই) ইউসিসি’র ভাবনাকে তুলে ধরা হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ওপর বহুবিবাহের প্রভাব নিয়ে মোদীর কুখ্যাত এবং অর্বাচীন ভুল দাবির সারাৎসার হল ঐ নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ ন্যারেটিভ! বিরোধীদের অবশ্যই এই অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করতে হবে, ক্রমশ বেড়ে চলা জীবনধারণের সংকট ও বেকারত্বের সমস্যার ওপর নজর কেন্দ্রীভূত করতে হবে, আর ভারতীয় সংবিধানের এক আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের দূরদর্শী স্বপ্নকে রক্ষা করতে হবে। আর এটা করতে হবে সামাজিক অত্যাচার ও হিংস্রতার সংহিতা মনুস্মৃতিকে সর্বজনীন করে দেশকে পিছনে ঠেলার প্রতিটি অপচেষ্টাকে প্রতিহত করেই। লিঙ্গন্যায় ও লিঙ্গসাম্যকে স্বাগত! ইউসিসি’র নামে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও মুসলিমদের কুৎসিত অপবাদ দেওয়ার রাজনীতির ঠাঁই নেই!
- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১১ জুলাই ২০২৩