এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সফরে প্রধানমন্ত্রী মোদী মাইক্রনের সাথে এক চুক্তি করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। বিশেষ করে ভক্তের দল তো এই বাণিজ্যিক চুক্তিকে বিরাট এক সাফল্যের জন্য স্বঘোষিত বিশ্বগুরুকে অনেক উচ্চাসনে বসিয়েছে। মাইক্রন হচ্ছে সেমি-কন্ডাক্টার সেক্টরে আমেরিকার এক দৈত্যাকার সংস্থা, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছে। তাদের সাথে চুক্তি করে ভারতে চিপ তৈরি শিল্পে ‘নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হবে’ গোদী মিডিয়ার সাথে ভক্তকুল এইজন্য আকুল।
মাইক্রন হল মেমোরি চিপস্’এর এক গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদক, আর এই ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিশ্বে সেমি-কন্ডাকটার শিল্পে প্রথম সারির এক সংস্থা হিসাবে মাইক্রন আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু, মাইক্রন মোদীর রাজ্যে ঠিক কি করতে চলেছে? যে চুক্তি নিয়ে এত সোরগোল, তার আসল স্বরূপ কী?
মাইক্রন গুজরাটে একটা প্ল্যান্ট বানাবে যা শুধুমাত্র ‘অ্যাসেম্বলিং-প্যাকেজ-টেস্ট’ করবে, যেগুলো এই সংস্থাটি অন্য কোথাও ফ্যাব্রিকেট করাবে। এই চিপ ফ্যাব্রিকেশনের প্ল্যান্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে রয়েছে, যেখান থেকে উৎপাদিত পণ্য ভারতে পাঠানো হবে পরীক্ষা করার জন্য। অর্থাৎ, চিপ তৈরি যদি ভারতের অভিষ্ঠ লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে সেই অভিপ্রায়ের গুড়ে বালি। কারণ, মাইক্রনের সাথে চিপ তৈরির কোনো চুক্তি মোদীর হয়নি। মোদী যা আদায় করেছে তা হল, চিপ তৈরি প্রযুক্তির সবচেয়ে নিম্নতর প্রযুক্তি, অ্যাসেমব্লিং ও চিপগুলোর টেস্টিং, যেগুলো অন্যত্র তৈরি হচ্ছে। এ’ক্ষেত্রে আমেরিকা, চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ভারত কিন্তু প্রতিযোগিতা করবে না, করবে মালয়েশিয়ার সাথে। তবে ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া এই প্রশ্নে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে — এই ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৩ শতাংশ বাজার এখন তার দখলে। মাইক্রনের মতো মার্কিন বহুজাতিকগুলো ব্যবসায়িক ঝুঁকি এড়াতে প্রথমে মালয়েশিয়া, পরে ভারতকে খুঁজে নিচ্ছে চিপ তৈরির নিম্নতর উৎপাদনকে স্থানান্তরিত করতে আর উন্নতমানের প্রযুক্তি সম্পন্ন চিপ — ফ্যাব্রিকেশনের উৎপাদনের জন্য বেছে নিচ্ছে আমেরিকা, যেমন, মাইক্রনের ১০০ বিলিয়ন ডলারের সংস্থাটি হচ্ছে ওয়াশিংটনের ক্লে’তে।
যে চুক্তি নিয়ে এত ঢক্কানিনাদ, তাতে ভারত কতটা খরচ করছে নিজের গ্যাঁটের কড়ি? আর মাইক্রনই বা কতটা দিচ্ছে তার পকেট থেকে?
গুজরাটে মাইক্রনের জন্য প্ল্যান্ট তৈরি করতে খরচ হবে ২.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৫০ শতাংশ দেবে ভারত সরকার আর গুজরাট সরকার দেবে ২০ শতাংশ। সমগ্র বিনিয়োগকৃত পুঁজির মাত্র ৩০ শতাংশ দেবে মাইক্রন। অর্থাৎ, প্ল্যান্ট স্থাপনের সমগ্র খরচ হবে ২.৭৫ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে মাইক্রনের ভাগ থাকবে মাত্র ৮২৫ মিলিয়ন ডলার! অর্থাৎ, ওই সামান্য পুঁজি বিনিয়োগ করে মাইক্রন ওই প্ল্যান্টের ১০০ শতাংশ মালিকানার অধিকারী হবে। ইউরোপের শিল্পমহলের রিপোর্ট ইইনিউজ এ’নিয়ে মন্তব্য করেছে যে, “এটা হল ঢালাও ভর্তুকি প্রদানের এক চরমতম উদাহরণ”। আমেরিকার এক বিপুলাকার কর্পোরেট সংস্থার অ্যাসেম্বলিং, টেস্টিং’এর এত নিম্নতর প্রযুক্তির জন্য ভারত সরকার নিজের রাজকোষ থেকে ঢালাও ভর্তুকি দিচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনও বিরাট পরিমাণে ভর্তুকি দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সুলভে চিপ উৎপাদন ও তারই আনুসাঙ্গিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য ৫২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। চীনেরও রয়েছে ৭৩ বিলিয়ন ডলারের এক জাতীয় তহবিল যা চিপ তৈরির উৎপাদন শিল্পের জন্য বরাদ্দ।
কিন্তু তফাৎ হল, এই উভয় দেশই খুবই আধুনিক, অগ্রগামী, ও উচ্চপ্রযুক্তি সম্পম্ন চিপ, লিথোগ্রাফিক মেশিনের মতো উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের লক্ষ্যেই এই খরচ করে, অ্যাসেম্বলিং বা টেস্টিং মতো নিম্নতর ক্ষেত্রে নয়। যদি একেবারেই নিম্নতর (লোয়ার এন্ড) প্রযুক্তির জন্য টাকা খরচ করতে হয়, তবে তাও যৎসামান্য। মোট তহবিলের বড় জোর ৫ শতাংশ।
মোদীর মতো বাইডেনেরও কিছুদিন পর নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার রাজনৈতিক বাধ্যকতা রয়েছে। উভয়ের কাছেই রয়েছে মার্কিন-ভারতের সম্পর্ককে পুনর্বিন্যস্ত করার বাধ্যতা। গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টরের জন্য প্রযুক্তি আমদানির মাধ্যমে নিজের ভাবমূর্তিকে ঘষা মাজা করতে মোদীর যেমন রয়েছে রাজনৈতিক প্রয়োজন, অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকাকে টক্কর দিয়ে শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া চীনকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলতে মার্কিন শিল্প সংস্থাগুলোকে ভারতে স্থানান্তরিত করার পেছনে রয়েছে বাইডেনেরও রাজনৈতিক চাল। আর তা করতে গিয়ে মোদী মার্কিন বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাটির শিল্প স্থাপন ভারতে (নিজের রাজ্য গুজরাটে) করে দিতে দু’হাত উপুড় করে দিল। ১০০ শতাংশ মার্কিন মালিকানাধীন সংস্থাটির জন্য মোদী সরকার দিচ্ছে ৭০ শতাংশ তহবিল, সস্তা শ্রম, জলের দরে জমি। আর, গুজরাটে এমনই এক পণ্যের কারখানা হতে চলেছে, যে ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া ইতিমধ্যেই অনেকটা বাজার দখল করে রেখেছে।
সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে জাতীয় তহবিলের বিপুল অপচয় করে মোদী এমনই এক শিল্পায়নের রাস্তা দেখাল, যা দেশবাসীর কল্যাণে নয়, ডেকে আনবে আরও অমঙ্গল।
- অতনু চক্রবর্তী