স্বাধীনতা! সমতা! সংহতি!
গণতন্ত্রের এই সোচ্চার ঘোষণায় প্রাণিত হয়ে ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের জনতা ঘৃণিত রাজতন্ত্রী নিপীড়নের কেন্দ্রস্থলে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিল। প্যারিসের বাস্তিল কারাগার তছনছ করে গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের আধুনিক যুগে ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রার রাস্তা খুলে দিয়েছিল। একশ ষাট বছর পর, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে ভারতীয় হাতে যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা ন্যস্ত হয়, তখন সেই মুক্তিকামী ভাবধারাই ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের মূল সুর হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের চরম পরিহাসে আজ, যখন অত্যাচারী মোদী শাসনে সেই সংবিধানকে পদদলিত করা হচ্ছে তখন, ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রধান সংহারককে এ’বছরের বাস্তিল দিবসের ফরাসি উদযাপনের সম্মানীয় অতিথি হিসেবে বরণ করা হচ্ছে। সুপরিচিত ফরাসি খবরের কাগজ ‘লা মন্দে’ তাদের সম্পাদকীয়তে এই পরিহাসকে বাস্তব রাজনীতির বিজয় হিসেবে অভিহিত করেছে।
এই বাস্তব রাজনীতি বর্তমান ফ্রান্স ও ভারতের ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের রণনৈতিক সমাপতনকে প্রতিফলিত করে। ২০১৭-তে এমানুয়েল মাক্রঁর ক্ষমতারোহনের পর এই চতুর্থবার এবং ২০১৪-তে নিজের জয়লাভের পর সপ্তম বার মোদীর এই ফ্রান্স সফর ভারত ও ফ্রান্সের রণনৈতিক অংশীদারিত্বের পঁচিশ বছরকে সূচিত করছে। এবং অংশিদারিত্ব গভীরতর হওয়ার মান দাঁড়িয়ছে ফ্রান্সের কাছ থেকে ভারতের আরো বেশি বেশি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়। ২০১৮ ও ২০২৩’র মধ্যে ফ্রান্স ছিল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র জোগানদার। ভারতের মোট অস্ত্র আমদানির ২৯ শতাংশ। বাস্তিল দিবসের কুচকাওয়াজ ফরাসি ও ভারতীয় ফৌজের যৌথ অংশিদারীত্ব দেখেছিল ফ্রান্সের কাছ থেকে ভারতের বিতর্কিত রাফাল জেট খরিদের সাথে সাথে। ফ্রান্সের সরকার চালিত টিভি নেটওয়ার্ক ‘ফ্রান্স ২৪’ সঠিক পর্যবেক্ষণ জানিয়ে বলে “মাক্রঁর মোদী বরণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নয় অস্ত্রের কুচকাওয়াজ”।
২০১৫ সালের রাফাল ক্রয়চুক্তি নিয়ে বিতর্ক এখনও মোদীকে তাড়া করে ফিরলেও — ভারতে মোদী সরকার ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে ‘বন্ধ খামে’ বার্তাযোগের পর তদন্ত থেমে আছে, কিন্তু এই চুক্তির বেনিয়ম নিয়ে ফ্রান্সে এখনও তদন্ত চলছে এবং সত্য সামনে আসছে — মোদীর বর্তমান সফরে ভারত নতুন করে আরো কেনার ঘোষণা দিয়েছে। খবর অনুযায়ী মূল দুটি চুক্তির মাধ্যমে মোট প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে ভারত আরো ২টি রাফাল জেট এবং ৩টি স্করপিন শ্রেণীর ডুবোজাহাজ কিনবে ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য। এই বৃহৎ প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলিই ভারতের অনেক ঢাকঢোল পেটানো রণনৈতিক অংশিদারীত্বের আসল বিষয়, তা সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইজরায়েলের সাথেই হোক বা বর্তমানে ক্রমবর্ধমান হারে ফ্রান্সের সাথে। এই তো কদিন আগে জুন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোদীর সরকারি সফরের সময় আমরা মোদীকে ইউএস’এর সাথে অতিরিক্ত চড়া মূল্যের শিকারি ড্রোন ক্রয়চুক্তিতে সীলমোহর দিতে দেখলাম।
এই ইউএস সফরের মতোই পিএম মোদীর ফ্রান্স সফরও ভারতে গণতন্ত্রের ওপর মোদী সরকারের সুসংগঠিত হামলার বিরুদ্ধে জোরালো আন্তর্জাতিক ধিক্কারে নিন্দিত হয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তহীনতা, প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দমন পীড়ন, ঘৃণা ও আতঙ্কের রাজত্ব এবং সন্ত্রাস ও হিংসা ছড়ানো সশস্ত্র ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে সবরকম ছাড় দেওয়া আর সবরকম অপরাধ সংগঠিত করে বিজেপি নেতাদের পার পেয়ে যাওয়া — এই সমস্ত দিকগুলি সঠিকভাবেই আন্তর্জাতিক জনমত তথা ভারতীয় গণতন্ত্রের শুভাকাঙ্খীদের দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফ্রান্সের অনেক জনমুখী বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত কণ্ঠস্বর “নাগরিক সমাজের ওপর দমন বন্ধ করতে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ও ধর্মীয় স্বাধীকার সুরক্ষিত রাখতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে উৎসাহ প্রদান করার” কথা মাক্রঁকে বলেছেন। স্পষ্টতই সিএনএন’এ ওবামার মন্তব্য এবং ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট জার্নালের সাংবাদিক সাবিনা সিদ্দিকির মোদীকে করা প্রশ্ন ফ্রান্সের বুকেও অনুরণন তুলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন সেনেটর তাঁদের প্রতিবাদ নথিভূক্ত করেছেন সম্মিলিথ ইউএস কংগ্রেসে মোদীর ভাষণ বয়কট করে। মোদীর ফ্রান্স সফর চলাকালীনই ৭০৫ সদস্যের ইউরোপীয় সংসদ একটি রেজল্যুশন আলোচনা করে পাস করেছে। সংসদের পাঁচটি অংশের আইন প্রণেতা সদস্যদের ৮০ শতাংশ এই রেজল্যুশনটি উত্থাপন করে। এই রেজল্যুশন মণিপুরে চলমান হিংসায় বিপজ্জনক মাত্রার গণউচ্ছেদ এবং ঘরবাড়ি ও উপাসনাস্থল, বিশেষত চার্চগুলি ধ্বংসের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এই নিন্দার জবাবে মোদী সরকার “ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হস্তক্ষেপ”এর সেই ফাটা কাঁসরটাই আবার বাজিয়েছে যা আমরা বিবিসি ভিডিও বা ওবামার মন্তব্য ও ইউএস মিডিয়ার প্রশ্নের সময়ও শুনেছিলাম। পরিহাসের বিষয় হল, জম্মু কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকারের ওপর হামলা চালানোর পর এই মোদী সরকারই নিজেদের পছন্দসই ইউরোপীয় সাংসদদের একটা ছোট্ট দলকে এক সন্দেহজনক সফরে এনেছিল, কিন্তু ভারতের নিজস্ব বিরোধী দলের সাংসদ ও রাজনৈতিক নেতাদের এই আর্ত রাজ্যের মানুষের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে দেয়নি।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে, মোদী সরকারের সর্বাত্মক ব্যর্থতা ও প্রতারণার ট্র্যাক রেকর্ডে, জনতার যে ক্রমবর্ধমান মোহভঙ্গ ও ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে তাকে প্রতিহত করার মরিয়া প্রচেষ্টায় বিজেপি এখন মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে বিশ্বস্তরে ভারতের বিশাল ভাবমূর্তী বাড়ার এক মিথ্যা ধারণা ছড়িয়ে দিতে চাইছে। মোদীর অস্ট্রেলিয়া, ইউএস ও ফ্রান্স ভ্রমণ ও জি-২০ সভাপতিত্ব নিয়ে এইসব হইচইয়ের সবটাকেই ব্যবহার করা হবে এই মিথ্যা বয়ান নির্মাণের কাজে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, বিপুল জনশক্তি ও ব্যাপক বিস্তৃত বাজার সম্পন্ন ও বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে ভারত নিশ্চিতরূপেই অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে এবং বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে তার বড় ভূমিকাও রাখার আছে। কিন্তু এই সুবিধাজনক দিকগুলিকে উত্তোলিত করে ভারতকে বিশ্বজুড়ে ন্যায়, শান্তি ও গ্রহের অস্তিত্বের সপক্ষে এক প্রভাবশালী কণ্ঠস্বরের শক্তিশালী গণতন্ত্র ও জনতা-কেন্দ্রীক অর্থনীতিরূপে বিকশিত করা তো দূর অস্ত, মোদী সরকার আদতে ভারতকে ঠেলে দিচ্ছে ইউএস ও তার পশ্চিমা দোসরদের ওপর রণনৈতিক নির্ভরশীলতার দুর্দশায় এবং নিজের ঘরের পাশের প্রতিবেশীদের সাথে ক্রমপ্রসারমান বিচ্ছিন্নতা ও বৈরিতায়। তদুপরি, আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের মর্যাদা দেশের অভ্যন্তরের গণতন্ত্রের অবস্থা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক বুনটচিত্রের সাথে সম্পর্কে বাঁধা। যে সরকার গৃহাভ্যন্তরে সর্বদিকে ক্রমাগত বিপর্যয় ডেকে আনছে তা আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চেও এক আপদরূপে প্রতিভাত হতে বাধ্য।
এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৮ জুলাই ২০২৩