আনন্দ তেলতুম্বড়ের ভূমিকাসমৃদ্ধ গ্রন্থটির আলোচনায় প্রফেসর চমনলাল
২০ আগস্ট ২০১৮
ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকর তাঁর সমগ্র লেখাপত্রে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার সাথে নিরন্তর কথোপকথনে ছিলেন, অন্তত মতাদর্শগত স্তরে। মার্ক্সবাদী ও আম্বেদকরবাদী — এই উভয় পক্ষের কিছু স্বার্থান্বেষী অংশ অনেক সামাজিক প্রশ্নে সমঝোতার চেয়ে বিরোধকেই বড় করে দেখাতে চায়। দুই চিন্তাধারার মধ্যে সংলাপকে আরও সাধারণ ভিত্তির ওপর স্থাপন করার কাজ খুব কম পণ্ডিত ও কর্মীরাই করছেন, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের উত্থান এবং ২০১৪ সালে হিদুত্ববাদীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে। জেএনইউ বা হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে বা চেন্নাই এবং খড়গপুর আইআইটি’র কিছু কিছু শিক্ষার্থি সংগঠন মার্ক্সবাদী বিপ্লবী ভগৎ সিং এবং ডঃ আম্বেদকর, পেরিয়ার ও মহাত্মা ফুলের মত দলিত মুক্তি চিন্তাবিদদের অভিন্ন ভিত্তির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।
আনন্দ তেলতুম্বড়ে নিজস্ব পরিচিতিতেই পণ্ডিত হিসেবে স্বীকৃত। আম্বেদকর পরিবারের সাথেও যিনি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তিনি ডক্টর আম্বেদকরের কিছু অসম্পূর্ণ লেখা সম্পাদনা করেছেন, ‘ভারত এবং কমিউনিজম’ শিরোনামে নিজের সুলিখিত ভূমিকা সহ। এই সংকলনে ‘প্রকাশকের কথা’ উল্লেখ করেছে যে, ডক্টর আম্বেদকর তাঁর কাগজপত্রে একটি নোট রেখে গেছেন যে তিনি ‘ভারত এবং কমিউনিজম’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি সেই গ্রন্থের সূচিপত্রের খসড়াও তৈরি করেছিলেন।
এরকম,
অংশ ১) সাম্যবাদের পূর্বশর্ত
• অধ্যায় ১) সাম্যবাদের জন্মস্থান
• অধ্যায় ২) সাম্যবাদ ও গণতন্ত্র
• অধ্যায় ৩) সাম্যবাদ ও সামাজিক ব্যবস্থা
অংশ ২) ভারত এবং কমিউনিজমের পূর্বশর্ত
• অধ্যায় ৪) হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থা
• অধ্যায় ৫) হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি
• অধ্যায় ৬) সামাজিক ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত কমিউনিজমের প্রতিবন্ধকতা
অংশ ৩) তাহলে আমরা কী করব?
• অধ্যায় ১) মার্ক্স এবং ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থা
• অধ্যায় ২) মনু এবং হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা
ডঃ আম্বেদকর তাঁর এই পরিকল্পিত গ্রন্থের সামান্য অংশই সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন, ৪ ও ৫ অধ্যায় দুটি টাইপ করা ৩৩ পৃষ্ঠা সহ। কাগজপত্রের একই ভাঁজে আরেকটি বইয়ের রূপরেখা ছিল — ‘আমি কি হিন্দু হতে পারি?’ এবং এর অংশ হিসেবে ‘হিন্দু ধর্মের প্রতীকসমূহ’। এই কাগজগুলো সম্ভবত ১৯৫০ সালের প্রথম দিকে টাইপ করা হয়েছিল।
এইভাবে আনন্দ তেলতুম্বড়ের ভূমিকা ও ডক্টর আম্বেদকরের অজানা কাগজপত্র আম্বেদকর-চিন্তার নতুন ও অধিকতর যুক্তিবদ্ধ উপলব্ধি সামনে নিয়ে আসে।
বইটির প্রথম পাতায় ডক্টর আম্বেদকরের ১৯৩৬ সালের মূল লেখা ‘জাতের বিলুপ্তি’ থেকে একটি উদ্ধৃতি রয়েছে।
“সমাজতন্ত্রীরা যদি সমাজতন্ত্রকে একটি সুনির্দিষ্ট বাস্তবে পরিণত করতে চান, তবে তাঁদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে সমাজ সংস্কারের সমস্যাটি মৌলিক এবং তাঁরা একে এড়িয়ে পরিত্রাণ পাবেন না।”
প্রথম যখন এই কথাগুলি লেখা হয়েছিল তার ৮১ বছর পর দাঁড়িয়ে এখন এই বিবৃতিটি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারেন যে ভারতীয় সমাজ কতটা জটিল এবং সামাজিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আরও কত তীব্র হয়ে উঠেছে। আর, এমনকি ১৯৩৬ সাল থেকে শুরু করে এই মধ্যবর্তী সময়টিতে সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্টরা এই কাজে কতটা ব্যর্থ হয়েছে, এবং যে সমাজকে একসময় তাঁরা নেতৃত্ব দিতেন সেই সমাজেই এখন তাঁরা প্রায় প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন।
আনন্দ তেলতুম্বড়েও তাঁর ভূমিকা শুরু করেছেন র্যাডিকাল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান চিন্তাবিদ ম্যালকম এক্স’এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে, “আমাদের নিজেদের জন্য স্বাধীনতা অর্জন করার একমাত্র উপায় হল বিশ্বের প্রতিটি নিপীড়িত মানুষের সাথে নিজেদেরকে একাত্ম করা”। (পৃষ্ঠা ৯)। আনন্দ তেলতুম্বড়ের প্রথম কথা হল, যারা আম্বেদকরকে কমিউনিস্ট বিরোধী বা মার্ক্সবাদ বিরোধী হিসাবে প্রজেক্ট করেন তাঁরা চরমভাবে পক্ষপাতদুষ্ট, যদিও তিনি সহমত যে মার্ক্সবাদের কিছু তাত্ত্বিক নীতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আম্বেদকরের গুরুতর ভিন্নমত ছিল।
আনন্দ তেলতুম্বড়ে অত্যন্ত কঠোরভাবে এই সত্যটিতে নজরটান দিয়েছেন যে, আম্বেদকর-পরবর্তী সমগ্র দলিত আন্দোলন মার্ক্সবাদীদের শত্রু হিসাবে বিবেচনা করার এক আচ্ছন্নতায় ভোগে। এটা দলিত ‘নেতাদের’ শাসকের সাথে গা ঘেঁসাঘেঁসিতে মগ্ন থাকার আত্ম-অনুমোদন ও সুযোগ-সন্ধান দিয়েছে, যদিও তাঁরা এখনও নিজেদেরকে ‘আম্বেদকরবাদী’ বলে অভিহিত করছেন। (পৃষ্ঠা ১১)। তিনি এমনকি রিপাবলিকান পার্টি অফ ইন্ডিয়া (আরপিআই)’র কিছু গ্রুপের নামও দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে, আনন্দ দুঃখের সাথে উল্লেখ করেছেন যে এমনকি দলিত প্যান্থাররা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক প্যান্থারদের আদলে গঠিত র্যাডিকালরাও, আরপিআই’এর মতো একই প্যাটার্নে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে রামবিলাস পাসওয়ান, উদিত রাজ এবং রামদাস আঠাভেলের মতো উল্লেখযোগ্য দলিত নেতারা কীভাবে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মণ্যবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি ‘বিজেপি’তে চলে গেছেন কিন্তু ভুলেও কমিউনিস্টদের কাছে ঘেঁষেননি! এই সুবিধাবাদী নেতারা বিজেপির সম্পূর্ণ আম্বেদকর-বিরোধী চিন্তাধারা সাথে নিয়ে চলতেও প্রস্তুত, কিন্তু ডক্টর আম্বেদকরের নিজের নাতি প্রকাশ আম্বেদকরকে, যিনি সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টদের সাথে অভিন্ন ফ্রন্টের পক্ষে, ‘আম্বেদকর-বিরোধী’ এমনকি ‘মাওবাদী সহানুভূতিশীল’ হিসাবে আক্রমণ করতে ছাড়েন না!
আনন্দ তেলতুম্বড়ে মার্ক্সবাদের সাথে ডক্টর আম্বেদকরের সম্পর্ককে ‘ধাঁধাপূর্ণ (এনিগ্ম্যাটিক)’ বলে বর্ণনা করেছেন। আম্বেদকর মার্ক্সবাদী ছিলেন না, কিন্তু তিনি নিজেকে ‘সমাজতন্ত্রী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন!
আনন্দ তেলতুম্বড়ে নিশ্চিত নন যে ডক্টর আম্বেদকর কার্ল মার্ক্সের ২৫ জুন ১৮৫৩’র ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ প্রবন্ধটি পড়েছেন কিনা। নিউইয়র্ক ডেইলিতে যা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে মার্ক্স ভারতীয় জাতব্যবস্থাকে “ভারতের অগ্রগতি এবং ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে নির্ধারক বাধা” হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু আম্বেদকর কখনই এই ধারণাকে খারিজ করেননি যে “জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শ্রেণী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ”। (পৃষ্ঠা ১৯)। সামাজিক-ধর্মীয় দিকগুলি বাদ দিয়ে কমিউনিস্টরা যে শ্রেণীকে নিছক ‘অর্থনৈতিক’ ক্যাটেগরি হিসাবে দেখছে তা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন আম্বেদকর। আনন্দ তেলতুম্বড়ে আরও উল্লেখ করেছেন যে যদিও আম্বেদকর মার্ক্সীয় শ্রেণির ধারণাকে গ্রহণ করেননি, তবুও তিনি নিজে জাতবর্ণকে শ্রেণী হিসাবে বিবেচনা করতেন, “জাত হল এক আবদ্ধ শ্রেণী”। আনন্দের মতে, আম্বেদকরের শ্রেণী সম্পর্কিত ধারণাটি কার্ল মার্ক্সের চেয়ে বেশি ম্যাক্স ওয়েবারের মতো ছিল। আম্বেদকর ১৯৩৬ সালের আগস্টে ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি (আইএলপি) হিসাবে তাঁর প্রথম রাজনৈতিক দলটি গঠন করেন, যাকে ক্রিস্টোফার জেফ্রেলট ‘ভারতের প্রথম বামপন্থী দল’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন, কারণ কমিউনিস্ট পার্টি তখনও হয় আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল বা কংগ্রেস পার্টির ছত্রছায়াতেই কাজ করছিল। আইএলপি দলটি সিএসপি ‘কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি’র সাথে ১৯৩৮ সালে ২০,০০০ কৃষকের বিশাল মিছিলের আয়োজন করেছিল এবং নিজেদের অনুশীলনে ‘জাত ও শ্রেণী’কে একীভূত করার পথ দেখিয়েছিল। ১৯৩৮ সালেই আইএলপি এবং এআইটিইউসি (সিপিআই অনুমোদিত অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস) মিলে এক বিরাট ধর্মঘট সংগঠিত করেছিল ১৯২৯ সালের ‘ট্রেড ডিসপিউটস্ অ্যাক্ট’এর বিরুদ্ধে, যে ধর্মঘটে এক লক্ষ শ্রমিক যোগ দেয়। এই অ্যাক্টের বিরুদ্ধে ভগত সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসে সেন্ট্রাল এসেম্বলিতে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। আনন্দের মতে, আম্বেদকর ১৯৩০’র দশকে তাঁর জীবনের সেরা র্যাডিকাল ফর্মে ছিলেন। আম্বেদকর ১৯৪৩ সালে আইএলপি তুলে দেন এবং অল ইন্ডিয়া শিডিউলড্ কাস্ট ফেডারেশন (এআইএসসিএফ) গঠন করে এই পর্বটি সমাপ্ত করেছিলেন।
আনন্দ তেলতুম্বড়ে বইটির ভূমিকায় লক্ষ্য করেছেন যে ১৯৩০’র দশক পর্যন্ত কমিউনিজমের প্রতি আম্বেদকর মোটেই বিরূপ ছিলেন না। শুধুমাত্র বোম্বাইয়ের কমিউনিস্টদের সাথে তাঁর সম্পর্কের অভিজ্ঞতাই কমিউনিস্টদের বিষয়ে তাঁর মনকে তিক্ত করে তুলেছিল। আম্বেদকর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা স্তালিনের প্রতি নরম মনোভাবাপন্ন ছিলেন, স্তালিন মুচির ছেলে ছিলেন বলে। এমনকি স্তালিনের মৃত্যুতে উপবাস পর্যন্ত করেছিলেন আম্বেদকর।
আনন্দ তেলতুম্বড়ের মতে ডঃ আম্বেদকর এবং তাঁর সময়ের কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে মূল মতপার্থক্য ছিল ‘ভিত্তি ও উপরকাঠামো’ সম্পর্ক বিষয়ে কমিউনিস্ট ধারণার কারণে, যে ধারণায় শ্রেণী হিসাবে দলিতদের অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্তির প্রশ্নটি শোষণের অর্থনৈতিক জোয়াল থেকে মুক্ত হওয়ার সাথে যুক্ত, আর তাদের ‘জাতগত বৈষম্যের প্রশ্নটি’ ‘উপরিকাঠামোর’ অংশ যা সমাজের ‘ভিত্তি’ পরিবর্তনের সাথে সাথে খতম হয়ে যাবে। সুবিধাবাদী অবস্থান থেকে কমিউনিস্ট পার্টি দলিত ব্যাকগ্রাউন্ডের অনেক কমরেডকে দলিতদের জন্য নিজেদের উদ্বেগের ‘শো-পিস’ হিসাবে ব্যবহার করেছিল। অনুশীলন বিপ্লবী গোষ্ঠির পটভূমি থেকে আসা জীবন ধুপিকে ১৯৪৬ সালে এগারো বছর জেল খেটে মুক্তি পাওয়ার পরই একমাত্র, সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে তপশিলি জাতির যোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করে, সিপিআইয়ের কেন্দ্রীয় কমটিতে নেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে, একজন সিনিয়র সিপিআই নেতা কে এন জোগেলকারের বহু বছর ধরে ‘ব্রাহ্মণ সভার’ সদস্য থাকাকেও পার্টির পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হয়নি।
যদিও আম্বেদকর বহু বছর ধরে সিপিআই’এর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন, তবু ব্যক্তিগত স্তরে তিনি সিপিআই’এ যোগদানকারী আর বি মোরের সাথে তাঁর উষ্ণ বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন।
আনন্দের মতে, জাতীয়তাবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের ইস্যুতে, আম্বেদকর এবং সিপিআই ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধিতে ছিল। সিপিআই কংগ্রেস পার্টিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং জাতীয়তাবাদী বলে মনে করেছিল এবং তার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়েছিল, আর আম্বেদকরের সমালোচনা করেছিল। আম্বেদকরের কাছে দলিতদের স্বার্থ ছিল প্রাথমিক, যারা শিক্ষা এবং কিছু চাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল। আম্বেদকর ব্রিটিশ-পরবর্তী ভারতে দলিতদের স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং তারজন্য গান্ধী বা কংগ্রেস দলের ওপর ভরসা রাখেননি।
যদিও আজ আরএএসএস অনুপ্রাণিত বিজেপি ক্ষমতায় আসার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডঃ আম্বেদকর প্রণীত ভারতীয় সংবিধানকে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার আরএসএস-প্রকল্পের বিরুদ্ধে এক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে দেখা হচ্ছে, আনন্দ তেলতুম্বড়ে কিন্তু ডক্টর আম্বেদকরের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন যে ডঃ আম্বেদকর নিজেই এই সংবিধান সম্পর্কে কতটা হতাশ ছিলেন। আনন্দ আম্বেদকরকে উদ্ধৃত করেছেন, “আমি তো এক ভাড়াটে মাত্র ছিলাম, আমাকে যা করতে বলা হয়েছিল আমি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার অনেক কিছু করেছি… কিন্তু আমি এখন এ’কথা বলতে প্রস্তুত যে আমিই সবার আগে এটা পুড়িয়ে ফেলব। আমি এটা চাই না। এটা কারো সাথেই খাপ খায় না।” (পৃষ্ঠা ৬৮, রাজ্যসভা থেকে উদ্ধৃত, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩)। মজার বিষয় হল, আজ যে সংবিধানকে আদর্শায়িত করা হচ্ছে তা যে মূলত শাসক ধনকুবের গোষ্ঠির স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে রচিত শ্রেণী-সংবিধান, শ্রমিক ও দলিত শ্রেণীর জন্য নয়, সে বিষয়ে আম্বেদকর বেশ স্পষ্ট ছিলেন, কিন্তু আমাদের আজকের বামপন্থী এবং আম্বেদকরবাদী উভয়েই সেই সংবিধানের প্রশংসা করছেন যা আম্বেদকর, তার রচয়িতা হওয়া সত্ত্বেও, নিজেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন!
ডক্টর আম্বেদকরের অসম্পূর্ণ প্রকল্প উপস্থাপন করতে গিয়ে আনন্দ তেলতুম্বড়ে মত প্রকাশ করেন যে, যদিও আম্বেদকর মনে করেছিলেন কমিউনিজম একটি মুক্তির দর্শন এবং মেহনতি জনসাধারণের কাছে এর বিপুল আকর্ষণ রয়েছে, তবুও নিপীড়নমূলক সামাজিক কাঠামো থেকে পরিত্রাণ পেতে দলিতদের দেওয়ার মতো খুব বেশি কিছু এতে ছিল না। আনন্দ তেলতুম্বড়ের মতে সিপিআই’র প্রথম দিককার মতবাদ প্রকরণ আম্বেদকরের মতো চিন্তাবিদদের মার্ক্সবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। এই ধরনের মতবাদের প্রকরণ পদ্ধতি প্রসঙ্গে তিনি মার্ক্সকে উদ্ধৃত করে বলেন, “যদি এটা মার্ক্সবাদ হয় তাহলে তিনি নিজে মার্ক্সবাদী না!”
বর্তমান পরিস্থিতিতে আনন্দ তেলতুম্বড়ে মনে করেন যে শুধু জাত পরিচয়ের রাজনীতি দলিত মুক্তিকে কোনও গন্তব্যে পৌঁছে দেবে না, বরং তাদের আরও বিভক্ত করবে। তিনি বিপ্লবের পথে এগোনোর জন্য শ্রেণী ও জাতের সমাকলনের পক্ষপাতী এবং আশা করেন যে আম্বেদকরের অসম্পূর্ণ লেখার প্রকাশনা “দলিত এবং কমিউনিস্টদের ভারতের এবং বিশ্বের ভবিষ্যত নির্মাণের বিলম্বিত কাজটি সম্পূর্ণ করতে অনুপ্রাণিত করবে।” (পৃষ্ঠা ৭৮)।
দলিত-বাম ঐক্যের আনন্দের এই প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব কিনা সে বিষয়ে আম্বেদকরের এই অসম্পূর্ণ গ্রন্থের দুটি অধ্যায় এবং অন্য কিছু লেখার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে।
‘হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থাঃ তার অপরিহার্য নীতিসমূহ’ অধ্যায়ে আম্বেদকর মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার দুটি মৌলিক বিষয়ের উপর আলোকপাত দিয়ে শুরু করছেন।
১) ব্যক্তি নিজেই চূড়ান্ত অভীষ্ট, এবং
২) সামাজিক শৃঙ্খলা অবশ্যই স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে — ফরাসি বিপ্লবে উদ্ভাসিত ত্রিনীতি।
ডঃ আম্বেদকর এই নীতিগুলির অর্থ ও তাৎপর্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন এবং হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থা ‘মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার’ এই মৌলিক নীতিগুলি অনুসরণ করে কিনা তা পরখ করেন; এবং তিনি দেখতে পান হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা এই অপরিহার্য নীতিগুলি অনুসরণ করতে সার্বিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আলোচনায় ডঃ আম্বেদকর হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার সবচেয়ে বিভক্ত ও বৈষম্যমূলক দিকগুলোকে তুলে ধরেছেন। তিনি তখনকার সময়ের কেবল পাঞ্জাবের উদাহরণ টেনে বলেন যে সেখানকার প্রধান ব্রাহ্মণ জাতের দেড় কোটি মানুষের মধ্যেই আবার ১৮৮৬টি উপজাত আছে!
ডক্টর আম্বেদকর স্পষ্ট করে দেন যে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার প্রাথমিক এবং মৌলিক নীতি হল গ্রেডেড ইনইক্যুয়ালিটি বা ‘স্তরবিন্যস্ত অসমতা’। তিনি তাঁর বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য ‘মনুস্মৃতি’ থেকে দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, যা সাত ধরনের দাস চিহ্নিত করে দেখিয়ে দেয় এবং দেখায় যে হিন্দু বিধান দাসপ্রথাকে ‘বৈধ প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে! (পৃষ্ঠা ৯৮)। হিন্দু বিধিবদ্ধ আইন থেকে অসংখ্য উদাহরণ টেনে ডক্টর আম্বেদকর ‘ব্যাভিচার’ ইত্যাদির মতো বিভিন্ন আইনের নৃশংসতাকে দেখিয়ে দেন। ডঃ আম্বেদকর হিন্দুদের দ্বিতীয় নীতি হিসাবে “প্রতিটি শ্রেণীর জন্য পেশা নির্দিষ্ট করে দেওয়া এবং বংশগতির দ্বারা তার ধারাবাহিকতা”কে চিহ্নিত করেছেন। হিন্দু সামজিক শৃঙ্খলার তৃতীয় নীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে “নিজস্ব শ্রেণীর অভ্যন্তরেই মানুষকে আবদ্ধ করে দেওয়া”। ডক্টর আম্বেদকর আরও উল্লেখ করেছেন যে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা “হিন্দু সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে অবাধ আদান-প্রদান এবং মেলামেশার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আন্তঃভোজন এবং আন্তঃবিবাহের বিরুদ্ধে রয়েছে বাধার প্রাচীর”। (পৃষ্ঠা ১০৮)।
আরেকটি অধ্যায়ে — ‘হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থাঃ এর অনন্য বৈশিষ্ট্য’, ডঃ আম্বেদকর হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে — ‘সুপারম্যানের উপাসনা’! আম্বেদকরের নিজের কথায়, “হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থা আদতে নিটশে কথিত সমাচারকে বাস্তবায়িত করা ছাড়া আর কিছু নয়”! (পৃষ্ঠা ১১১)। আম্বেদকর মনে করেন যে ব্রাহ্মণ হল হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার সুপারম্যান, যিনি বিশেষ সুযোগের অধিকারী, হত্যার অপরাধে অপরাধী হলেও যাকে, মনুস্মৃতি অনুসারে, ফাঁসি দেওয়া যায়না। ডক্টর আম্বেদকর হিন্দু সমাজ ব্যবস্থাকে আরও ব্যাখ্যা করে বলছেন — “সাধারণ মানুষের উত্থান সুপারম্যানের আধিপত্যের বিরোধী… সাধারণ মানুষ এক চিরস্থায়ী অবমাননার অবস্থায় রয়েছে...”। (পৃষ্ঠা ১১৯)।
ডক্টর আম্বেদকরের অত্যন্ত দৃঢ় মত হল, “হিন্দুরাই পৃথিবীর একমাত্র জনতা যাদের সামাজিক ব্যবস্থায় — মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককে ধর্ম দ্বারা পূতপবিত্র, শাশ্বত এবং অলঙ্ঘনীয় করা হয়েছে।” তিনি এই অধ্যায়টির উপসংহার টানেন এই বলে যে, “কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা হিন্দুদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এবং তার ফলে তা জোরদার ভাবে চলছে”। (পৃষ্ঠা ১৩০)।
আরেকটি অধ্যায়ে, ‘হিন্দুধর্মের প্রতীকগুলি’, আম্বেদকর ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিরে যান গ্রীক রাজা সেলিউকোসের রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিসের দৃষ্টির উপর ভর করে। হিন্দুদের সামাজিক সংগঠনটি অদ্ভুত ধরণের ছিল। মেগাস্থিনিস ভারতীয় জনসাধারণকে সাত ভাগে বিভক্ত করতে দেখেছিলেন। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে আম্বেদকর চলে আসেন ১০৩০ খ্রীষ্টাব্দে। ভারতে আলবেরুনির ভ্রমণ বিবরণ উল্লেখ করেন, যিনি হিন্দুদের চারটি প্রধান জাত বা বর্ণ দেখেছিলেন, ব্রাহ্মণরা সবচেয়ে ওপরের থাকে। আম্বেদকর আরও উল্লেখ করেন যে পর্তুগিজ কর্মকর্তা ডুয়ার্তে বারবোসা ১৫০০-১৫৭১ সালে ভারতে ছিলেন, যিনি ভারতীয় জাতগুলির বিশদ বিশ্লেষণ দিয়েছেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালপর্বে পাঞ্জাবের জাতগুলি সম্পর্কে ডেনজিল ইবেটসন লিখেছিলেন বলে উল্লেখ করেন আম্বেদকর। সম্পাদক আনন্দ তেলতুম্বড়ে তাঁকে “ভারতের আদমশুমারির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী আমলা” হিসেবে বিবেচনা করেছেন। (পৃষ্ঠা ১৪৭)। প্রকৃতপক্ষে ডেনজিল ইবেটসনের বই ‘পাঞ্জাব কাস্টস’ এখনও পাঞ্জাব সরকার তার পুরো নাম এবং পদবি ‘স্যার ডেনজিল চার্লস জেল্ফ ইবেটসন কেসিএসআই’ সহ ছাপে পাঞ্জাবের জাতগুলির তথ্যের প্রধান আকর হিসেবে।
ডঃ আম্বেদকর ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় জাত ও শ্রেণীকে পরস্পর সংযুক্ত হিসেবে দেখেন। ডাঃ আম্বেদকর জাতকে ‘বর্ণ’এর পরিণতি হিসেবে দেখার ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। বরং তিনি বলেছেন যে ‘জাত হল বর্ণের বিকৃতি’। ডঃ আম্বেদকর ‘সবর্ণ’ হিন্দুদের প্রশ্নটিও ছুঁয়েছেন। সবর্ণ মানে যারা চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত, যার মধ্যে রয়েছে — ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এবং ‘অবর্ণ’ হিন্দু মানে যারা বর্ণ ব্যবস্থার বাইরে, যাদের ‘অন্ত্যজ’ও বলা হয়, মানে শূদ্রদের চেয়েও খারাপ! ডক্টর আম্বেদকরের পাণ্ডুলিপিটি এই শব্দগুলি দিয়ে শুরু হয় — ‘অবর্ণ হিন্দুরা গঠিত হয় তিনটি...।
সাধারণভাবে ভারতীয় সমাজ অধ্যয়ন এবং বিশেষ করে, দলিতদের জন্য যা সবচেয়ে নিপীড়ক ভূমিকা নেয় সেই হিন্দু ধর্মের জাত কাঠামোর উপর জোর দিয়ে হিন্দু সমাজকে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ডক্টর আম্বেদকরের পাণ্ডিত্য নিয়ে কেউই সন্দেহ প্রকাশ করতে পারবে না। মহাত্মা গান্ধী এবং অন্যদের মতো সংস্কারকরা হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার সংস্কারের চেষ্টা করেছিলেন হিন্দু ব্যবস্থার মধ্যেই কোনোভাবে দলিতদের জন্য কিছু মর্যাদার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়ে, কিন্তু সমতা স্থাপন করে নয়। সেখানে ডঃ আম্বেদকর হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার অভ্যন্তরে দলিতদের জন্য সমতার কোনো সুযোগ খুঁজে পান না, তাই তিনি হিন্দু সমাজ ব্যবস্থাকেই ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সহ-দলিতদেরও একই কাজ করার আহ্বান জানান। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পর জীবনে খুব অল্প সময়ই তিনি পেয়েছিলেন। দলিতদের হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা থেকে বের করে এক নতুন স্বাধীনতা, সাম্য ও সংহতি ভিত্তিক সামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করার তাঁর পরিকল্পনাকে তাঁর অনুসারীরাও আর এগিয়ে নিয়ে যায়নি। এমনকি মায়াবতীর নেতৃত্বাধীন বহুজন সমাজ পার্টিও তা করেনি। এর আগে রিপাবলিকান পার্টির বিভিন্ন গোষ্ঠীও এটা করেনি। এবং এখন তাদের সকলকেই আরএসএস-হিন্দুত্ব ভিত্তিক দল বিজেপির করুণার পাত্রে পর্যবসিত হতে দেখা যাচ্ছে।
ডক্টর আম্বেদকরের লেখা এইসব কাগজপত্রগুলির এরকম এক আলোকিত ভূমিকা রচনার মাধ্যমে আনন্দ তেলতুম্বড়ে বামপন্থী ও আম্বেদকরপন্থীদের জন্য বিতর্কের এক নতুন বাতায়ন উন্মুক্ত করে দিয়েছেন যেখানে প্রবেশ করে তাঁরা উভয়েই এক সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পেতে পারেন ভারতকে আরএসএস-হিন্দুত্ব হিন্দু সামাজিক শৃঙ্খলার গ্রাসে পতনের ভবিতব্য থেকে বাঁচাতে, ডক্টর আম্বেদকর যে সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এত আবেগঘন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। আম্বেদকর যেমন ব্যাখ্যা করেছিলেন সেরকম সুপারম্যান হয়ে উঠছে নরেন্দ্র মোদী এই হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায়, যার সাথে দলিতদের কোনওরকম মিলমিশ থাকতে পারে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে বামপন্থী শক্তিগুলিই বোধহয় আম্বেদকর কল্পিত স্বাধীনতা, সমতা ও সংহতি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ জোটসঙ্গী হতে পারে। কিন্তু এই উভয় পক্ষই কি এই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করবে? জার্মানির সর্বসেরা বাম/কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক রোজা লুক্সেমবার্গ ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার এক সোচ্চার আহ্বান রেখেছিলেন পরিস্থিতিকে এই বলে ব্যাখ্যা করে যে “সমাজতন্ত্র, অথবা বর্বরতা”! ভারত বোধহয় এখন সেই অবস্থাতেই আছে যেখানে ‘সমাজতন্ত্র অথবা বর্বরতা’ বেছে নিতে হবে! সমাজতন্ত্র, তা সে হতে পারে আম্বেদকর ধরণের বা ভগৎ সিং/চে গেভারা ধরনের, অথবা অন্য আরো কোনও ধরনের যেমনটা আজ লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে হচ্ছে, কিন্তু হিন্দুত্ব সামাজিক শৃঙ্খলার বর্বরতা কখনই একটা চয়েস হতে পারে না!
আশা রাখি আনন্দ তেলতুম্বড়ে বা প্রকাশ আম্বেদকরের মত আম্বেদকরপন্থী চিন্তাবিদরা এবং বিভিন্ন বামপন্থী গোষ্ঠি ও দলগুলি এক সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পাবে; যেমন, আইআইটি চেন্নাই বা আরো বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা ‘ভগত সিং-আম্বেদকর-পেরিয়ার-ফুলে’ গ্রুপ গঠন করছে। হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্ট গাড্ডা থেকে দেশকে বের করে আনবে। কেন্দ্র ও বেশ কিছু রাজ্যে ক্ষমতায় এসে এবং ‘গো-রক্ষক’, শ্রীরামসেনা বা হিন্দু জাগরণ মঞ্চের মত অসংখ্য বাহিনী গড়ে, যারা দাবলকর-পানসারে-কালবুর্গি-গৌরি লঙ্কেশের মতো যুক্তিবাদীদের এবং আখলাক-জুনেইদদের হত্যা করছে, এই হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলি এই মুহূর্তে অত্যন্ত বলশালী হয়ে উঠেছে। ইতিহাস বিকৃত করে মিথ্যার জাল বুনে ধর্মোন্মত্ত জিগির তৈরি করছে ১৯৩০’র জার্মানির হিটলার ও ইটালির মুসোলিনিদের মতো, যার মূল্য তখন শুধু ওই দু’টি দেশকে নয় সারা পৃথিবীকেই চোকাতে হয়েছিল। আজও একইরকম বিশ্ব পরিস্থিতি, দু’টি বিপুল জনসংখ্যার দেশে ট্রাম্প ও মোদীর মতো শাসক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত!
আশা করি ভারতীয় ও মার্কিন জনতা ইতিহাস থেকে কিছু শিক্ষা নেবে এবং এর পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না, হলে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের থেকেও বহুগুণ ধ্বংসাত্মক হবে। ডক্টর আম্বেদকরের অসমাপ্ত গ্রন্থটি এই শিক্ষা লাভ করার পথ দেখাতে পারে।
(চমনলাল জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। অবসরপ্রাপ্ত। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভগৎ সিং’ এবং অন্যান্য বেশ কিছু দলিত সাহিত্যের রচয়িতা। বুক রিভিউ রূপে এই নিবন্ধটি কাউন্টার কারেন্টস ডট অর্গে প্রথম প্রকাশিত হয়।
ভাষান্তরঃ মলয় তেওয়ারি)