আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন ও প্রসঙ্গ তৃণমূল
context-trinamool

তৃণমূল নেত্রী তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীদের পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য চাঙ্গা করতে জরুরি তলব করে একপ্রস্থ আলোচনা সারলেন। বৈঠক থেকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে গ্রামগঞ্জে নেমে পড়তে হবে। ক্রমাগত বিক্ষোভ ও ধূমায়িত অসন্তোষের ঠ্যালায় দেওয়ালে এখনও পিঠ না ঠেকলেও দলের সামগ্রিক অবস্থা বেশ রক্ষণাত্মক। কারণ, এখন সবচেয়ে বেশি তাড়া করছে তৃণমূলের পঞ্চায়েত রাজত্বের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ-বিক্ষোভ। এর পিছনকার প্রধান প্রধান কারণ হল, ‘মনরেগা’ প্রকল্পে কাজ ও কাজের বিনিময়ে প্রাপ্য মজুরি না দেওয়ার প্রতারণা থেকে শুরু করে আবাস যোজনা প্রকল্পে স্বজনপোষণ ও কাটমানির দুর্নীতি। তার ওপর চাষাবাদে পুঁজি ও পরিকাঠামোগত সাহায্য-সহযোগিতা ব্যাপক অবহেলার শিকার হয়ে চলছে। কেন্দ্রের ‘পি এম কিষাণ’ এবং রাজ্যের ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পের মাত্র কয়েক হাজার টাকায় কী হয়! সামান্যই সংস্থান হয়। রাজ্য সরকার ওপর থেকে ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে’ ধান কেনার ঘোষণা করে খালাস। কিন্তু তা নিয়ে ব্লক প্রশাসন এবং ‘জোড়া ফুল’-এর পঞ্চায়েতবাবুদের সময়োচিত কোনও সক্রিয়তার দেখা মেলে না। চাষিকে তাই বাধ্য হয়ে ঋণ পরিশোধের জন্য এবং আরও পাঁচ রকমের অভাবের জ্বালা মেটাতে ফসল বেশিদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না, লোকসান হলেও বেচে দিতে হয়। বহু যোজন দূরের সরকারি মান্ডি পর্যন্ত যাওয়া হয়না। পরিবহণের খরচ বহনের ঝক্কি আছে, সময় অন্তর সেই খরচ বেড়ে চলার মাশুল গোনার ধকল আছে। মান্ডিতে কোনো উপায়ে ফসল নিয়ে গেলেই যে বেচে ফেরা যাবে, এমন নিশ্চয়তা থাকে না। কারণ, ফসল বিক্রির ‘স্লিপ’ নিয়ন্ত্রণ করে তৃণমূলের মদতপুষ্ট ফাটকা মধ্যস্বত্ব ভোগী দালালরা। এরাই মান্ডিতে গিয়ে সরাসরি ফসল বিক্রির ব্যাপারে চাষিকে নিরাশ করে, বিভিন্ন বাধাবিপত্তি সৃষ্টি করে। ফলে চাষি বাধ্য হয় সহায়ক মূল্য ছাড়াই গ্রামেই ফসল বিক্রি করে দিতে। সেই ফসল কেনা আর মান্ডিতে সরকারের সহায়ক মূল্যের বিনিময়ে বেচার সুযোগটা ভোগ করে শাসকদল করা দালালরা। এই পরিঘটনা ফি-বছরকার ব্যাপার। আর, একেই মমতা সরকার খাদ্যশস্য চাষির কাছ থেকে ‘দুয়ারে সংগ্রহ’ বা ‘মান্ডিতে সংগ্রহ’ হয় বলে প্রচার করে! এবছরও গ্রাম-গঞ্জে একই চিত্র প্রত্যক্ষ করা গেছে। এই অসাধু কারবারীদের সাথে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত, ব্লক প্রশাসন, থানা-পুলিশ মায় খোদ দলের নেতা, বিধায়ক সবপক্ষের সাটগাঁট রয়েছে; সবক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ চালায় তৃণমূলের দাদাগিরি ও তার ঘনিষ্ট স্যাঙাতচক্র।

আর, সম্প্রতি এর সাথে যোগ হয়েছে গত বছর থেকে ধরা পড়া শিক্ষাক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে নিয়োগ-নীতি সংক্রান্ত দুর্নীতি।

২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় চলে আসার পরের বছর থেকেই এপর্যন্ত রকমারি সংস্কার প্রকল্প প্রাপ্তির প্রশ্নে অবিরাম জমেছে অভিযোগের পাহাড়। শাসকদলের উপরিস্তরের নেতা-হোতা-মোড়ল-মাতব্বরদের সারদার চিটফান্ড প্রতারণা থেকে গোপনে আর্থিক সুবিধা লোটা, স্টিং অপারেশনে ধরা পড়া নারদ-এর পাতা ফাঁদে নগদে উৎকোচ গ্রহণ তৃণমূলকে প্রাথমিকভাবে বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দেয়। লাখ-লাখ টাকার গোপন লেনদেনের পর্দা ফাঁস হয়েছে! এইসব দুর্নীতির চূড়ামনিদের অনেকে পরে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন ও ২০২১-এর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। মুখ-পিঠ বাঁচানোর নাটক সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। ২০২১-এ তৃণমূলকে ক্ষমতায় ফিরতে দেখে ওই ঘাঘু-ঘুঘুদের একগুচ্ছ ফের তৃণমূলে ফিরে আসেন। অবশ্য সবচেয়ে ডাকাবুকো নেতাটি যে সপরিবারে বিজেপিতেই রয়ে যান, সে প্রসঙ্গ আলাদা। এইসব অভিযোগের আজও বিচার সারা না হওয়ায়, অপরাধীরা শাস্তি না পাওয়ায়, মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমেছে। তবু, তৃণমূলের সমানে দুর্নীতি-দলতন্ত্র চালিয়ে যাওয়ার দু’কান কাটা যোগসাজশ আর দুঃসাহস আরও বেড়েছে বৈ কমেনি।

তৃণমূল জমানায় শিক্ষাক্ষেত্রে সংগঠিত দুর্নীতিই এযাবৎ সম্ভবত সবচেয়ে বড় ঘোটালা। একদিকে টাকার অঙ্কে তো বটেই, এমনকি একদশক যাবত ব্যাপক জাল বিস্তার, দল ও মন্ত্রীসভার দু’নম্বর নেতা সহ বিভিন্ন স্তরের দাদা-নেতা ও তাদের জো-হুজুরে পরিণত হওয়া কর্তৃস্থানীয় শিক্ষা আধিকারিকদের জড়িত থাকার বহরের কারণে এহেন সুপরিকল্পিত দুর্নীতির মাত্রা নজিরবিহীন। এই দুর্নীতি অন্যদিকে গ্রামবাংলার যুব কর্মপ্রার্থী, গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সামাজিক সর্বজনীন সম্পদ ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থার যথেচ্ছ ক্ষতি করেছে। নিয়োগ বঞ্চনার শিকার হওয়া যোগ্য কর্মপ্রার্থীদের ও উৎকোচের বিনিময়ে নিয়োগ পেতে জমিজমা বেচে বা ঋণ করে টাকা দেওয়া বেকারদের বড় অংশই গ্রাম বাংলার। নিয়োগ দুর্নীতি থেকে কামিয়ে নেওয়া টাকায় জবরদস্তি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির নামমাত্র মূল্যে দখল নেওয়া, খাস জমি, ডোবা জমি, খেলার মাঠ, ক্লাবের জমি, পুকুর ভরাট করে বাগিয়ে নেওয়া জমির ব্যাপক অংশই গ্রামাঞ্চলে। এইসব কুকর্মে কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে পঞ্চায়েতী ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। বলাগড় ব্লকে তথ্যানুসন্ধানে তো সেই সত্যেরই উদঘাটন ক্রিয়া চলছে। এ হল দৃশ্যমান শিলাখন্ড মাত্র, কোথায় যে এর তল তা এখনও কারও জানা হয়নি। এসবের সামাজিক প্রতিক্রিয়ার জের আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে পড়বেই।

তৃণমূলনেত্রীর পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে মাথাব্যথার একটা বিশেষ কারণ হল, পঞ্চায়েতের কাজের পরিকল্পনা ও হিসাবপত্র নিয়ে গণতদারকির পদ্ধতি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে গ্রামাঞ্চলের মানুষজন ক্ষুব্ধ হয়েছেন প্রচন্ড। দুর্নীতি সর্বত্র ছেয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী এরকম তর্জন-গর্জনও শুনিয়েছিলেন, ‘অনেক হয়েছে পঞ্চায়েতের ওপর সব দায়-দায়িত্ব দিয়ে! সেই কাজ এরপর থেকে করানো হবে সরাসরি ব্লক প্রশাসনকে দিয়ে।’ এটা ময়দানে প্রমাণ হয়েছে হাস্যকর ছলচাতুরী। জনগণের মনে তা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন থেকে গেছে। এইসব বিষয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে কিভাবে সামাল দেবে তৃণমূল? ক্ষমতাসীন হয়ে অতিনিস্ক্রিয়তা অথচ ক্ষমতার দখল পেতে অতিসক্রিয়তা কেন! এই স্ববিরোধিতার সমস্যা ও সমাধান বোঝাতে হিমসিম খেতে হবে। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের কপাল ভাঁজের আরেকটি কারণ হল, দলের ক্ষমতার দাপট দেখানো কিভাবে কতটা সম্ভব করে তোলা যাবে! অর্থাৎ সন্ত্রাস চালিয়ে নির্বাচনের দখল নেওয়া কতটা পারা যাবে! গত ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে ত্রিস্তর মিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসনের দখল নিয়েছিল। পরে নির্বাচনের দিন সামগ্রিক গরিষ্ঠতা ছিনিয়ে নিতে সন্ত্রাসকেই চূড়ান্ত অস্ত্র করেছিল, যার কেন্দ্রে স্থান দেওয়া হয়েছিল ‘অনুব্রত মডেল’কে। এ নিয়ে বিগত পাঁচ বছরে যথেষ্ট ধিক্কার শুনতে হয়েছে। এবারের নির্বাচনে অনুব্রতর ‘চড়াম চড়াম’, ‘খেলা হবে’, ‘ভয়ঙ্কর খেলা হব’ হুমকি শোনানোর উপায় নেই। এবার বরং ঐধরণের হুমকির স্বর শোনা যাচ্ছে বিধানসভায় কাঁথি নিবাসী বিজেপি নেতার গলায়। যাই হোক, অনুব্রতর অনুপস্থিতিতে রাজ্যজুড়ে বিকল্প সংহারমূর্তির মডেল কিভাবে দাঁড় করানো সম্ভব তার উপায় খোঁজার চিন্তা তৃণমূলনেত্রীকে দুর্ভাবনায় রাখবে। ইতিমধ্যে ‘দিদির দূতরা’ গ্রাম-গ্রামান্তরে ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ বোঝাতে গিয়ে যথেষ্ট ক্ষোভের সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রতিশ্রুতির প্রতারণা, বৈষম্য, স্বজনপোষণ, আর্থিক নয়ছয়, তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘাতের ঘটনা ও প্রবণতার বিরুদ্ধে বাড়ছে গ্রামীণ জনতার বিক্ষোভ। এর প্রতিফলন আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে পড়বেই।

- অনিমেষ চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-7