গত ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ শ্রমিক কনভেনশনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ মার্চ ২০২৩ কলকাতায় শ্রমিক ভবনে রাজ্যস্তরের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহ, কর্মচারী সংগঠন সমূহ ও শিল্প ভিত্তিক ফেডারেশনগুলির আহ্বানে এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। কনভেনশনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, কেন্দ্রের মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের শাসনে সমগ্র দেশের শ্রমিক, কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ সহ সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা এক ভয়ংকর আক্রমণের মুখে। কর্পোরেটদের স্বার্থেদেশের শ্রম আইনসমূহ বাতিল করে শ্রমকোড তৈরি, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেলাগাম বেসরকারিকরণ, দেশের মানুষের সৃষ্টি করা জাতীয় সম্পদসমূহকে দেশী-বিদেশী কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি, দেশের অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিক লগ্নি পূঁজির কাছে বন্ধক রেখে দেশের সাধারণ মানুষের ও দেশের স্বনির্ভরতা, সার্বভৌমত্ব ও সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তুলেছে। এই সরকারের নীতি, যা দেশের অর্থনীতি এবং দেশের মানুষের ভয়ংকর বিপর্যয়ের কারণ, তা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য।
আরএসএস পরিচালিত কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও কর্পোরেটের অশুভ আঁতাতের প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত হল আদানি গোষ্ঠীর দুর্ণীতিকে ধামাচাপা দেবার কেন্দ্রীয় সরকারের নগ্ন প্রয়াস, হাজার হাজার কোটি টাকা স্টেট ব্যাঙ্ক ও এলআইসি’র লগ্নিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া স্বত্ত্বেও যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্তের বিরোধিতার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী মোদীর আশ্চর্যজনক নীরবতা।
বিগত ৯ বছরের বিজেপি শাসনে জীবন-জীবিকা ও মৌলিক অধিকারের উপর নামিয়ে আনা সরকারের নগ্ন আক্রমণে দেশের মানুষের দুর্দশা, যন্ত্রণা এবং দারিদ্র বেড়েছে অভাবনীয়ভাবে। কর্মচ্যুতি ও বেকারি আজ এক বিস্ফোরণের পর্যায়ে। পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস ও কেরোসিন সহ সমস্ত খাদ্যশস্য, ওষুধ এবং ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে চলেছে রকেট গতিতে, যা রোধ করার কোন উদ্যোগ সরকারের নেই। ফলে শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত মজুরি হ্রাস পাচ্ছে ব্যাপক হারে।
লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বন্ধ। কাজ হারিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। সরকারি চাকরিতে স্থায়ী পদ বিলোপ করা হয়েছে। নিয়োগ করা হচ্ছে ক্যাজুয়াল, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের যাদের ন্যূনতম বেতন, সামাজিক সুরক্ষা বা শ্রম আইনের কোনো অধিকার নেই।
সরকারের কর্পোরেটমুখী কৃষি-নীতির ফলে গত ৯ বছরে আত্মহত্যা করেছেন লক্ষাধিক ঋণগ্রস্ত কৃষক। ক্রাইম রেকর্ডব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালেই দৈনিক মজুরির শ্রমিকের আত্মহত্যার সংখ্যা প্রায় ৪১,০০০, যা কিনা দেশের ভয়ংকর সংকটের এক প্রতিফলন।
দেশের শ্রমজীবী মানুষ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে ৮ ঘণ্টা কাজের, ন্যূনতম বেতনের, সামাজিক নিরাপত্তার, ইউনিয়নে সংগঠিত হবার, যৌথ দর-কষাকষির অধিকারসমূহ আদায় করেছিল তা বাতিল করার লক্ষ্যে কর্পোরেট ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে নিয়ে আনা হয়েছে ৪টি শ্রমকোড। যেকোন সময়ে তা লাগু করার পরিকল্পনা চলছে।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরিখে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০১। তা স্বত্বেও আইসিডিএস, মিড-ডে-মিল ইত্যাদি প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ বিপুলভাবে হ্রাস করা হয়েছে সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় বাজেটে। ৩১ শতাংশ ভর্তুকি কমানো হয়েছে খাদ্যের উপর থেকে। মনরেগা প্রকল্প, যা গ্রামীণ কর্মসংস্থানে কিছুটা সহায়তা করতে পেরেছিল, তার বরাদ্দ কমানো হয়েছে ৩৩ শতাংশ। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দিতে এক নয়া শিক্ষা নীতি চালু করেছে এই কেন্দ্রীয় সরকার। শুধু শিক্ষার বেসরকারীকরণ নয়, এর মধ্য দিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছে পাঠ্য বই এবং সিলেবাসকে হিন্দুত্ববাদী/মনুবাদী মতাদর্শে পরিবর্তিত করার। দেশের সাধারণ গরিব মানুষ ও কৃষকদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে, কর্পোরেটদের স্বার্থে পরিবর্তন করা হচ্ছে বিদ্যুৎ আইন। এই লক্ষ্যে নতুন বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ২০২২ সংসদে পেশ করা হয়েছে।
লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সমাজকর্মী সহ বিরোধীদের সমালোচনার কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে মোদী সরকার ব্যবহার করছে ইডি, সিবিআই, এনআইএ’র মতো সংস্থা সহ দমনমূলক ইউএপিএ আইনকে। দেশজুড়ে ভয়-ভীতি এবং সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে।
শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যকে ভাঙতে সামপ্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই প্রেক্ষাপটে কনভেনশন থেকে শ্রমিক-বিরোধী, কৃষক-বিরোধী, দেশের মানুষের স্বার্থবিরোধী এবং দেশ বিরোধী কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সার্বিক ঐক্যবদ্ধ ও তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়।
পাশাপাশি এই রাজ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল সরকারের শ্রমিক-বিরোধী, কর্মচারী-বিরোধী ভূমিকা নগ্নভাবে আবার প্রকাশ পেয়েছে। তৃণমূল রাজত্বে ধর্মঘট বন্ধ করার মুখ্যমন্ত্রীর দম্ভোক্তি ও রাজ্য সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের ডিএ’র দাবিতে গত ১০ মার্চের ধর্মঘটের বিরোধিতা, বেতন কাট, চাকুরিচ্ছেদের হুমকি, শ্রমিক কর্মচারী স্বার্থবিরোধী স্বৈরাচারী মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাস ও ট্রাম সংস্থার সরকারি জমি বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া এবং সম্প্রতি সরকারি জমিকে বেসরকারি জমি মাফিয়া ও প্রমোটরদের হাতে তুলে দিতে লিজ হোল্ডকে ফ্রি হোল্ড করে বিধান সভায় বিল পাশ করানো হয়েছে। এইভাবে সরকারের হাতে থাকা লক্ষ লক্ষ একর শিল্প, কৃষি, অকৃষি জমি, জলাশয়, জঙ্গল, বনাঞ্চলের জমিও বিক্রি করার ক্ষমতা হাতে নিতে চাইছে। এরফলে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ উচ্ছেদ হবে। এরসাথে রয়েছে সমস্ত বিভাগের সরকারি চাকরি বিক্রি, আবাস যোজনা সহ সমস্ত স্তরের ব্যাপক দুর্নীতি। যারমধ্যে যুক্ত রয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী, আমলাদের একাংশ, শাসকদলের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সহ শাসক দলের লোকেরা। প্রতিবাদ আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পুলিশ প্রশাসনকে নগ্নভাবে ব্যবহার করে দমন পীড়ন চলছে ও মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে প্রতিবাদীদের। এর বিরুদ্ধেও রাজ্যের শ্রমিক কর্মচারী আন্দোলনকে সোচ্চার হবার আহ্বান জানানো হয়েছে।
কনভেনশন থেকে সিদ্ধান্ত হয়,
১) বিভিন্ন শিল্পের শ্রমিক, সংগঠিত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মধ্যে দাবিগুলো নিয়ে নিবিড় ভাবে প্রচার করতে হবে। এরসাথে শিল্পভিত্তিক যুক্ত কর্মসূচি ও কনভেনশন অনুষ্ঠিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে, শ্রমকোড, বিদ্যুৎ বিল, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার সংগঠিত করতে হবে। সাথে সাথে রাজ্যের শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী ও জনস্বার্থ বিরোধী নীতির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে।
২) এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জেলাভিত্তিক যৌথ কনভেনশন অনুষ্ঠিত করতে হবে। (পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণা হলে কর্মসূচির পরিবর্তন হবে)।
৩) ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা রাজ্য জুড়ে পদযাত্রা/জাঠা/ সাইকেল র্যালী ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করতে হবে।
৪) ৯-১০ আগস্ট ২০২৩ কলকাতায় রাণী রাসমনি রোডে শ্রমিকদের ‘মহাপড়াও’ ( মহাসমাবেশ) ও ধর্ণা অনুষ্ঠিত হবে।
৫) একই সাথে রাজ্যে শ্রমিক কৃষক ঐক্যকে শক্তিশালী করতে যৌথ প্রচার/অবস্থান কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
এই কনভেনশনে সভাপতিমন্ডলীতে ছিলেন এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী, সিটুর রাজ্য সভাপতি সুভাষ মুখার্জী সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের রাজ্য নেতৃবৃন্দ প্রমুখ। কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু, সিটুর রাজ্য সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু সহ অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়নের রাজ্য নেতৃত্ব প্রমুখ।