সমস্ত শূন্যপদে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ ও কেন্দ্রীয় হারে ডিএ প্রদান রাজ্য সরকারের দায়িত্ব

responsibility-of-the-state-government
মাস পাঁচ-ছয় আগে এই পত্রিকাতেই পশ্চিমবঙ্গে পিএসসি কর্তৃক নিয়োগের ক্ষেত্রে গড়িমসি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতি বছর পিএসসির মাধ্যমে রাজ্য সরকারের করণিক নিয়োগ করার কথা। সেই প্রক্রিয়াকে এই সরকার ক্ষমতায় আসা ইস্তক অবহেলা করছে। ওই নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএসসি-র ভূমিকাকে নাকচ করার উদ্দেশ্যে স্টাফ সিলেকশন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশন ২০১৬ সালে ক্লার্কশিপ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেয়। পরে তাদের অপারগতা বা সরকারের শুভবুদ্ধি উদয় হওয়ার দরুণ, যেটিই হোক, সেই নিয়োগ পিএসসি দ্বারাই করা হয়। তার পরে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলে দ্বিতীয়বার করণিক নিয়োগের জন্য। ৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সেই নিয়োগ সম্পূর্ণ হয়নি। বিদ্যালয় স্তরের নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অব্যবস্থা যে দুরবস্থার সৃষ্টি করেছে সে ব্যাপারে এরাজ্যের সকলেই ওয়াকিবহাল।

সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের জায়গাগুলি মূলত: হল সরাসরি সরকারি কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ- বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী, পুলিশে, পুরসভা ও পঞ্চায়েতে নিযুক্ত কর্মী। এই সমস্ত নিয়োগকেই নিয়ম মেনে করার দায়িত্ব সরকারের। তার জন্য বিভিন্ন নিয়োগ কাঠামো বা কমিশন তৈরি করার কথা। তবে, ওইসব নিয়ম মেনে বিধিসম্মত নিয়োগ করা হয় নিয়মিত কর্মীদের। কিন্তু বর্তমান সরকার নিয়মিত কর্মী নিয়োগকে প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। সমস্ত রাজ্য সরকারি দফতরেই (তাই বা কেন, কেন্দ্রীয় সরকারি দফতরেও) অস্থায়ী ক্যাজুয়াল ও কন্ট্রাকচুয়াল কর্মী দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে। যারা সরকারি অফিসে গিয়েছেন তাঁরা বেসরকারি সিকিউরিটি গার্ড অবশ্যই দেখেছেন, জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারতেন দফতরের বহু কর্মীই অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত; আর অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত সিভিক পুলিশ তো প্রতিদিন রাস্তায় দেখা যায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-বিদ্যালয়গুলিতেও সমস্ত স্তরে অনুরূপ অস্থায়ী কর্মী দিয়ে কাজ চালানো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে সরকার বেতন খাতে অর্থ বাঁচাচ্ছে, পরবর্তীতে পেনশন খাতেও অর্থ বাঁচানোর বন্দোবস্ত হচ্ছে।

নিয়োগের ক্ষেত্রে গড়িমসি, দুর্নীতি অব্যবস্থা তজ্জনিত আইন-আদালত, এবং শূন্যস্থান পূরণে অনীহার ফলে বিপুল সংখ্যক সরকারি পদ খালি রয়েছে। সংখ্যাটি ঠিক কত তা বলা দুষ্কর। সরকারও সে ব্যাপারের কোনো শ্বেতপত্র প্রকাশ করে হিসেব দিতে নারাজ, তবে সব মিলিয়ে তার সংখ্যা যতজন স্থায়ীভাবে নিযুক্ত আছেন তার থেকে বেশি হবে বলে আন্দাজ করা যায়। রাজ্য জুড়ে যখন কর্মপ্রার্থী যুবকেরা সুষ্ঠু ও দুর্নীতিমুক্তভাবে নিয়োগের জন্য রাস্তায় রয়েছেন দিনের পর দিন, অনশন করছেন তখন ওইসব শূন্যপদ পূরণ করার দাবিকে সমর্থন করতেই হবে।

ওই নিয়োগের ক্ষেত্রেই আনুষঙ্গিক যে বিষয়টি জরুরি হয়ে উঠেছে সেটি হল নিয়োগ দুর্নীতি। গত কয়েক মাসে এটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে শাসক দলের সর্বস্তরেই নিয়োগ দুর্নীতি শিকড় গেড়েছে, শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। শত শত কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, নেতা-মন্ত্রীরা জড়িত রয়েছে। স্থায়ী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের পরীক্ষা ইন্টারভিউ এসব হয়েছে, সেগুলির রেকর্ড থাকার কথা। ফলে সেক্ষেত্রে দুর্নীতি তদন্তের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে। সেই দুর্নীতির পরিমাণ পাহাড় প্রমাণ। কিন্তু যে বিপুল সংখ্যক অস্থায়ী কর্মী নিয়োজিত হয়েছে সেই নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়নি একথা বিশ্বাস করা কেবল কঠিন নয়, অসম্ভব। দেশ ও রাজ্য জোড়া বিপুল কর্মহীনতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলি একটুও ভাবিত নয়, চাটনি খবর হিসেবে অনুব্রতর মেয়ে সুকন্যার মনমড়া থাকা, বা কুন্তলের বান্ধবী সোমাকে সিবিআইএর পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদে ডাকা বা পার্থের কতটা ওজন কমল তা নিয়েই পাতা ভরানো হয়।

ওই দুর্নীতির বিচারের পথ দিয়েই তৈরি করা হয় কর্ম সঙ্কোচনের বন্দোবস্ত। মহামান্য বিচারক অবলীলাক্রমে ছাত্র না থাকলে বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার নিদান দেন। শিক্ষা দফতরও অতিসক্রিয় হয়ে অনতিবিলম্বে ৮ হাজারের বেশি বিদ্যালয়ের তালিকা তৈরি করেন যেখানে ছাত্র সংখ্যা ৩০এর কম। অন্যদিকে আরেকজন মহামান্য বিচারপতি অন্য মামলার সূত্রে ৭ জন ছাত্র থাকা বিদ্যালয়কে বন্ধ করার নির্দেশ দেন। যারা শিক্ষকতার দাবিতে রাস্তায় রয়েছেন তাঁরা বুঝতেও পারেন না ওই সমস্ত বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলেই অন্তত ৪০ হাজার পদ অবলুপ্ত হবে। তাছাড়া, রাজ্যের ছাত্র সংখ্যা বাড়লেও কেন বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র নেই, কেন বেসরকারি বিদ্যালয়গুলি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে সেই কারণ খোঁজার দায় মেসিয়া বিচারপতিরা নেন না। কারণ তাঁরাও উচ্চবিত্ত অভিজাত চিন্তার বাহক। ওই বিচারপতি সরকারি বিদ্যালয়গুলিকে বাঁচানোর জন্য, যা গরিব ঘরের শিশুদের পড়াশোনার জাযগা, নির্দেশ দিন না বিচারপতি সমেত সকল সরকারি বেতনভূক কর্মীদের সন্তানদের সরকারি বা সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে পড়ানোর। না, সেটি করা যাবে না, কোনো না কোনো আইনে আটকাবে নিশ্চিত; এমনকি সেই ধরনের আইন প্রণয়নের নিদানও মানীয় বিচারপতিরা দেবেন বলে মনে হয় না, কারণ তাঁদের প্রিভিলেজড সন্তানের প্রিভিলেজ নষ্ট যাবে যে। তাই দুর্নীতি দমনের বিচার পরিণত হয় কর্মী সঙ্কোচনের নিদানে। একেও তো রুখতে হবে।

এরাজ্যে এই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে রাজ্য সরকারি বেতন ও পেনশন প্রাপকদের  কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা (ডিএ) ও গত ২০০৯ সাল থেকে বকেয়া ডিএ প্রদান। বকেয়া ডিএ-র শুরুর সময় জুলাই, ২০০৯ সাল বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, কর্মচারীদের সারা ভারত ভোগ্যপণ্য মূল্য সূচক অনুযায়ী ডিএ দেওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারেরও গাফিলতি ছিল। এতদসত্বেও বামফ্রন্ট সরকার কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়ার বিষয়টি কখনো অস্বীকার করেনি। কিন্তু মমতা ব্যানার্জীর সরকার ক্ষমতায় আসার আগে তৃণমূলের অবস্থান ছিল, “যে সরকার কর্মীদের ন্যায্য ডিএ দিতে পারে না তাদের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই”; আর ক্ষমতায় আসার পরে, ডিএ নিয়ে কর্মচারীদের আন্দোলন হল ‘ঘেউ ঘেউ’ করা, বা ‘ কী পেলে খুশি হবেন নন্দলালেরা’? বারম্বার টালবাহানা চলছে ডিএ ও বকেয়া ডিএ নিয়ে আদালতের রায় কার্যকর করা নিয়ে। কর্মচারীদের প্রাপ্য ডিএ থেকে বঞ্চিত রেখে রাজ্য সরকার সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনুদানের জন্য ব্যয়ের দোহাই যে দিতে পারে না তা হাইকোর্টের বিভিন্ন রায়ে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। রাজ্য সরকার কর্মচারীদের নিয়োগকারী। নিয়োগকারী নিয়োগের শর্ত মেনে নিয়োজিতকে বেতন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা দিতে দায়বদ্ধ, আর্থিক সীমাবদ্ধতা সেই দায় থেকে তাকে মুক্তি দেয় না।

ডিএ দেওয়া হয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে বলে। যে সরকারের আমলে সরকারি ভাড়ার হারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাস মালিকেরা বাসের ভাড়া ৪০-৬০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়ে কর্মীদের যাতায়াত দূর্মূল্য করে তোলে, জ্বালানি সমেত সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়তেই থাকে সেই সরকারের অপদার্থ মুখ্যমন্ত্রী তখন ডিএর দাবিতে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে ‘কী পেলে খুশি হবে নন্দলালেরা’ বলে হুঙ্কার ছাড়েন। হুমকি দেন পেনশন প্রাপকদের পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার, অসত্য কথা বলে। প্রকৃত তথ্য হল যে, বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যে  ২০০৪ সালের ৩১ মার্চের পরে নিযুক্তদের সরকারি পেনশন প্রকল্প থেকে বিযুক্ত করে নতুন পেনশন প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে কর্মী ও নিয়োগকর্তা উভয়েই অর্থ প্রদান করে তহবিল তৈরি করবে ও অবসরের সময় সেই তহবিল ব্যবহার করে এ্যানুইটি পাবে পেনশন হিসেবে। কিন্তু ২০০৪ এর ৩১ মার্চে পর্যন্ত নিয়োজিত স্থায়ী কর্মচারীরা যথাবিহিত পেনশন পাচ্ছেন। ওদিকে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, অন্য রাজ্য পেনশন বন্ধ করে দিয়েছে, উনিও কি পেনশন বন্ধ করে দিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা বাঁচাবেন? এক অদ্ভুত অকর্মণ্য যুক্তিজালে নিজেকেই জড়াচ্ছে এই সরকার। কেউ যদি ট্রেনে উঠে, বাসে উঠে বলেন যে তাঁর পয়সা নেই তাই তিনি বিনা টিকিটে বা কম ভাড়ায় ট্রেনে বাসে চড়বেন তাহলে কি সেই যুক্তি মানা হবে? তাহলে দেওয়ার সঙ্গতি নেই এই বাহানা কীভাবে ন্যায্য প্রাপ্য ডিএ বা বকেয়া ডিএ দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? পরিসংখ্যানগত ভাবেও রাজ্য সরকারের পেনশন খাতে ব্যয় ২০২১-২২ থেকে কমতে শুরু করেছে। ২০২১-২২ সালে যা ছিল ২৬,৬৭৬ কোটি টাকা তা ২০২৩-২৪ সালের বাজেটে কমে দাঁড়িয়েছে ২৩, ৮৯৬ কোটি টাকা (১০.৪ শতাংশ হ্রাস)। বেতন খাতে বৃদ্ধির পরিমাণ দুবছরে সাকুল্যে ৮.৭ শতাংশ। যেকোনো নিয়োগকারী রাজ্য সরকারকেই কর্মীদের বেতনকে মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে বাড়াতে হবে। নতুবা সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার অধিকার থাকে না, যেমনটা মমতা ব্যানার্জী বিগত বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে বলেছিলেন।

ডিএ বৃদ্ধির দাবিতে বৃহত্তর জনতার ঐক্য গড়ে তোলা আবশ্যিক হলেও একটি বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার, ঘোলা জলে মাছ ধরতে হাজির হয়েছেন যে বিরোধী দলনেতা তিনিও ডিএ না দেওয়ার জন্য দায় এড়াতে পারেন না। ২০১৬ সালে যখন ডিএ মামলা রুজু করেছিলেন কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ-এর নেতারা তখন মন্ত্রীসভায় ছিলেন আজকের বিরোধী দলনেতা। তিনি সেই সরকারের সঙ্গে ২০২১ সাল পর্যন্ত অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিলেন। আজ ডিএর দাবিতে আন্দোলন ও অনশনরত কর্মৱারীদের পাশে গিয়ে তিনি সেদিনের মমতা ব্যানার্জীর মতো মিথ্যে কথা বলছেন। এভাবেই ত্রিপুরায় ক্ষমতায় এসেও কেন্দ্রীয় সরকারী হারে বেতন বা ডিএ সেখানকার বিজেপি সরকার দেয় না। ওই নারদা মামলায় কাগজে মুড়ে টাকা নেওয়া বিজেপি নেতার মুখের উপর একথা বলার প্রয়োজন রয়েছে। একই রকমভাবে দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগের দাবিতে যে সমস্ত কর্মপ্রার্থীরা রাস্তায় রয়েছেন তাদের ওই নেতার মুখের উপর বলা উচিৎ ২০১১ সাল থেকে যখন নিয়োগ দুর্নীতিগুলি ঘটেছে, তখন তিনি কী করছিলেন, দুর্নীতির কতটা তাঁর কাছে পৌঁছেছে। তিনি যে টাকা নিতে দড় তা ওই নারদ ঘটনায় পরিষ্কার।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-30
সংখ্যা-5