এক বছর পেরিয়ে যাওয়া দীর্ঘায়িত যুদ্ধ আর নয়
passed-a-year

রাশিয়া ২০২২-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের ওপর সামরিক আক্রমণ শুরু করার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধ এখনও থামেনি। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে রণনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাখমুট শহরে দু-পক্ষই মরণপণ লড়াই চালাচ্ছে। রুশ বাহিনীর পাশাপাশি তাদের ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গোষ্ঠীও সেখানে যথেষ্ট সক্রিয়। শহরটা দখলের জন্য রাশিয়ার ছোঁড়া একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র শহরটাকে বলতে গেলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, অল্প কিছু মানুষ বাদে সেখানকার সব জনগণই শহর ছেড়ে চলে গেছেন, শহর তিন দিক থেকে এখন রাশিয়ার ঘেরাওয়ের মুখে। ইউক্রেন বাখমুটে রাশিয়ার আক্রমণকে প্রতিহত করা এবং শত্রু পক্ষের প্রচুর সেনাকে নিহত করার দাবি জানালেও ভাষ্যকারদের মতে পরিস্থিতির বিকাশে বাখমুট হয়ত কিছু সময়ের মধ্যে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে এবং ইউক্রেন সেনাদের সেখান থেকে পশ্চাদপসরণ করতে হবে। তবে, শুধু পূবের ডনবাস অঞ্চলের বাখমুটই নয়, ইউক্রেনের রাজধানী কিভ, পূবের আর এক শহর নিপ্রো, দক্ষিণের বন্দর শহর ওডেসার ওপরও রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের সাক্ষর রেখে চলেছে। সারা দুনিয়ার সাধারণ, শান্তিকামী জনগণই আজ প্রশ্ন তুলছেন– এই যুদ্ধ আর কতদিন চলবে? যুদ্ধের পরিণামে জ্বালানি, খাদ্য, সারের দাম বাড়ায় তাঁদের জীবন যে যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে, তার আশু অবসান কি হবে না? তবে, কিছুদিন আগেও যুদ্ধ শেষের কোনো লক্ষণ যেখানে দেখা যাচ্ছিল না, এখন পরিস্থিতিতে একটু বদল এসেছে বলে মনে হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই যেমন যুদ্ধ বন্ধের আকাঙ্খা তীব্র হচ্ছে, তার পাশাপাশি কিছু শান্তি প্রস্তাবও উঠে আসছে। শান্তি প্রস্তাব এসেছে রাশিয়ার মিত্র দেশ চীনের কাছ থেকে। এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি শিন ফিং এখন তিন দিনের সফরে ২০ মার্চ মস্কো গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করছেন।

যুদ্ধের এই এক বছরে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের বহু সেনা-সহ হাজার-হাজার অসামরিক জনগণ নিহত হয়েছেন, পরিকাঠামোর একটা বড় অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর ওপর রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ বিদ্যুৎ সংকটকে তীব্রতর করেছে। যুদ্ধ জনগণের জীবন-জীবিকায় বিপর্যয় ঘটানোয় যুদ্ধ শুরুর আগে ইউক্রেনে দারিদ্র সীমার নীচে থাকা জনগণের অংশ যেখানে ছিল মাত্র ২ শতাংশ, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ শতাংশে। ঘর-বাড়ি আবাসনের ওপর আক্রমণের পরিণামে দেশের এক-তৃতিয়াংশ জনগণ বাড়িঘর ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। একটা হিসাব অনুসারে, ইউক্রেনের পরিকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৫০০ বিলিয়ন ডলার এবং অন্তত ১০০০০০ অসামরিক জনগণ নিহত হয়েছেন।

যুদ্ধ এত দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণ রুশ আক্রমণের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের শক্তিশালী প্রতিরোধ। রাশিয়া ভেবেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত ক্রাইমিয়া দখল তার পক্ষে যতটা অনায়াস হয়েছিল, এবারও দানেস্ক ও লুহানস্ক-সহ ডনবাস অঞ্চল দখল করে ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাশিয়ার শর্ত গেলাতে বাধ্য করতে পারবে। যে শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে--ইউক্রেনকে সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে; সংবিধান সংশোধন করে কোনো জোটে যোগদানের লক্ষ্য থেকে সরে আসতে হবে, অর্থাৎ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য হওয়া যাবে না; ২০১৪ সালে দখল হওয়া ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার এলাকা বলে স্বীকার করতে হবে; ডনবাস অঞ্চলের দানেস্ক ও লুহানস্কককে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকার করতে হবে। আর এটাও সবাই জানে যে, মূলত আমেরিকা ও ন্যাটো সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র নিয়েই ইউক্রেন তাদের প্রতিরোধ গড়েছে, রাশিয়ার যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে। রাশিয়ারও বহু, হয়ত বা লক্ষাধিক সেনা নিহত হয়েছে, প্রথম দিকে দখল করা কিছু স্থান থেকে রুশ বাহিনীকে হঠিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে ইউক্রেন বাহিনী।

ন্যাটোর পূবমুখী সম্প্রসারণ এবং রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ন্যাটোর সদস্য করাটা তাদের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হচ্ছে, এই উদ্বেগই রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে এসেছে এবং রাশিয়ার এই বিপদাভাসকে একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যে পনেরটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে তার তিনটি, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়াকে ন্যাটো সদস্য করা হয়েছে এবং জর্জিয়া-ইউক্রেন-সহ রুশ প্রতিবেশী আরও কিছু দেশকে সদস্য করার পরিকল্পনাও ন্যাটোর রয়েছে। অতএব, ঠাণ্ডা যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়েও আমেরিকা ও ন্যাটোর রুশ-বিরোধী বৈরিতায় কোনো যতি নেই। ন্যাটো সদস্যরা সেনা বাহিনী নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে না নামলেও তারা একভাবে এই যুদ্ধে শামিল হয়েছে এবং ন্যাটোর রুশ-বিরোধী সক্রিয়তাকেও গতি দেওয়া হয়েছে। ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল স্টলটেনবারগ সম্প্রতি তুরস্ক সফরে গেলেন যে দেশটি কিছুদিন আগেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছে। সেখানে গিয়ে তুরস্কের বিপর্যয়, সেখানকার জনগণের দুরবস্থা তাঁর কাছে বিবেচনার তেমন বিষয় হলো না। তিনি গিয়ে তুরস্কের কাছে আবেদন জানালেন – তুরস্ক যেন সুইডেন ও নরওয়ের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার প্রস্তাবে তাদের আপত্তিকে প্রত্যাহার করে নেয়! ন্যাটোর সংবিধান অনুযায়ী নতুন কোনো দেশকে ন্যাটোর সদস্য হতে হলে সমস্ত সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন। তুরস্কের আপত্তিতে সুইডেন ও নরওয়ের সদস্যপদ আটকে যাচ্ছে, আর ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও স্টলটেনবারগের কাছে দুই দেশের ন্যাটো সদস্য হওয়ার লক্ষ্যে তুরস্কের সম্মতি আদায়ই সবচেয়ে গুরুত্ব পেল!

তবে, পশ্চিমের এই বৈরী মনোভাবকে ইউক্রেন আক্রমণের ন্যায়সঙ্গত কারণ হিসাবে পুতিন দেখাতে চাইলেও তাকে কখনই মেনে নেওয়া যায় না। আর পুতিন ইউক্রেন আক্রমণকে “বিশেষ সামরিক অভিযান” এবং ইউক্রেনের “সামরিকীকরণকে প্রতিহত করা” এবং ইউক্রেনকে “নাজি-মুক্ত” করা বলে চালাতে চাইলেও তা বিশ্বের জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এক পুরোদস্তুর যুদ্ধ এবং রুশ উগ্ৰজাতীয়তাবাদ দ্বারাই চালিত। ইউক্রেন রাশিয়ার নিরাপত্তার কাছে যত চ্যালেঞ্জেরই হোক, আলাপআলোচনার মাধ্যমে তার মোকাবিলাই হতো সংগত।

চীনের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও প্রাক্তন বিদেশ মন্ত্রী ওয়াং ই রাশিয়া সফরে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে এক ১২ দফা শান্তি প্রস্তাব দেন। চীনের প্রস্তাবে যুদ্ধ স্থগিত করা এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনা শুরুর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “সমস্ত দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে সম্মান জানাতে হবে।” রাশিয়ার ওপর চাপানো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে তুলে নেওয়া এবং ঠাণ্ডা যুদ্ধের মানসিকতা প্রত্যাহারের কথাও প্রস্তাবে রয়েছে। পশ্চিমের দেশগুলোর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে, তারা যেন “ইউক্রেনের সংকটকে আর বাড়িয়ে না তোলে।” পশ্চিম দুনিয়া প্রত্যাশিতভাবেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেন বলেছেন, “রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন এই প্রস্তাবের প্রশংসা করেছেন, সে ক্ষেত্রে এর মধ্যে ভালো কি থাকতে পারে? এই পরিকল্পনার মধ্যে এমন কিছু আছে বলে আমি দেখতে পাইনি যা থেকে রাশিয়া ছাড়া অন্য কারো লাভ হতে পারে। “ অতএব, যুদ্ধ থামার ফলে রাশিয়ার লাভ হলে সেটা বাইডেনদের কাছে বাঞ্ছিত নয়। তবে, প্রস্তাব নিয়ে পশ্চিম দুনিয়ার বিরোধিতা থাকলেও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি প্রস্তাবে কিছুটা আগ্ৰহ দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “শি শিন ফিং-এর সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা আমার রয়েছে এবং আমি বিশ্বাস করি এটা (চীনের শান্তি প্রস্তাব) আমাদের দেশ এবং বিশ্বের নিরাপত্তার পক্ষে সুফলদায়ক হবে।” তবে, জেলেনেস্কি চীনের প্রস্তাবে এবং শি শিন ফিং-এর সঙ্গে আলোচনায় আগ্ৰহ দেখালেও আমেরিকা এবং ন্যাটোর যে প্রবল নিয়ন্ত্রণ তাঁর ওপর রয়েছে তার থেকে তিনি কতটা বেরিয়ে আসতে পারবেন তা অবশ্যই একেবারে ভিত্তিহীন আশঙ্কা নয়।

ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ইতিবাচক একটা বিষয় হল – আমেরিকা তার সার্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার বহু দেশকেই রুশ-বিরোধী অবস্থানে নিয়ে আসতে পারেনি। ঐ দেশগুলোর কেউই ইরাক-আফগানিস্তান-সিরিয়া-ইয়েমেন নিয়ে আমেরিকার আগ্রাসি ভূমিকাকে বিস্মৃত হয়নি। আর ইউক্রেনে পশ্চিম দুনিয়ার প্রবল হস্তক্ষেপকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই বলে অভিহিত করার মধ্যে নিহিত কপটতাকে ধরে ফেলতেও তাদের অসুবিধা হচ্ছে না। বিপরীতে, দিনদিনই যুদ্ধ বন্ধের আকাঙ্খা বিভিন্ন দেশেই তীব্রতর হচ্ছে। যুদ্ধ থামানোর প্রবল আর্জি জার্মানির জনগণ জানালেন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের জার্মানির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অন্তত দশ হাজার মানুষ পথে নামলেন। বিক্ষোভকারীরা বললেন, জার্মান চ্যান্সেলরকে ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করতে হবে। কারণ, “প্রতিদিন হাজার খানেক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। ক্রমশ তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।” জার্মানির জনগণ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তা আমাদের, বিশ্বের শান্তিকামী জনগণের কাছে অনুসরণীয় নজির হয়ে উঠুক। যুদ্ধ এক বছর পেরিয়েছে, আর নয় – এই আওয়াজ সোচ্চারে উঠুক দেশে-দেশে।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ শুরুর সময়ই শি শিন ফিং বলেছিলেন, যুদ্ধ সমস্যা সমাধানের কোনো পথ হতে পারে না। মস্কো গিয়েও শি বলেছেন – তাঁর মস্কো সফরের উদ্দেশ্য যুদ্ধ বন্ধ তথা শান্তি প্রক্রিয়ায় গতি দেওয়া। একই সময় ইউক্রেন সফররত জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদার উদ্দেশ্যেও তিনি বলেছেন, যুদ্ধ পরিস্থিতিকে তীব্রতর করে না তুলে জাপানের উচিত পরিস্থিতিকে প্রশমিত করা। শি শিন ফিং-এর সফর থেকে যুদ্ধ বন্ধের কোনো সূত্র বেরিয়ে আসুক – এটাই পৃথিবীর শান্তিকামী জনগণের একান্ত কাম্য। যুদ্ধর বিপরীতে শান্তির পরিস্থিতিতেই যে দরিদ্র জনগণ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন, অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের দাম কমার প্রত্যাশা করতে পারেন।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-7